গল্পটা বলা শুরু করেছিলেন পঞ্চাদা ।
পঞ্চাদা মানে পঞ্চাননতলার পঞ্চবটী গল্পো চক্রের চেয়ারম্যান শ্রীযুক্তবাবু পঞ্চানন শুন্ড পাত্র ব্র্যাকেটে ফৌজি পুত্র মহশয় । ওঁর গল্প মানেই পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল । ওঁর গল্পের ভেতর থেকে মূল বিষয়টা বের করতে হলো যে , সবাইকে হংস হতে হবে সেটা পঞ্চবটির সব সদস্যরাই জানে । অল্প বিস্তর সবাই পুটকে , সন্তু , নিবারণ , নারদ এবং আমি নিজে এই পাঁচজন শুধু যে প্রতিদিন বিকেলে টিফিন খাওয়ার জন্যই ওনার আসরে যেতাম তাই নয় , ইস্কুলের মাস্টার মশাইদের মতে ওই চক্রের আসরে যাওয়া এবং গল্প শোনা মানে তার থেকে এক্সট্র্যাক্ট করে ভাবার্থ , সারমর্ম এবং ইংরেজির প্রেসি লেখার কায়দাটা দারুন ভাবে আয়ত্ববা করা শেখা যাবে । এবং সত্যি বলতে কি আমরাও সেই কায়দাটা দারুন ভাবে শিখেও উঠেছিলাম ।
ভদ্রলোক প্রত্যেকদিন একটা করে ও র নিজের দেশ বিদেশের জানাশোনা সব নতুন নতুন গল্প শোনাতেন । উনি একবার গল্প বলা শুরু করলে , কেউ মাঝখানে বাধা দিলে বা প্রশ্ন করলে ভীষন বিরক্ত বোধ করতেন । রাগের ফলস্বরূপ পঞ্চাদা তার সেই পুরাতন দিনের দাদু মার্কা ছাতার বাটটা গলায় লাগিয়ে কাছে টেনে এনে পিঠের উপরে একটা একমনী ওজনের কিল বসিয়ে দিতেন । আর , আমাদের বলতেন - বলেছি না , আমার কথার মাঝে একদম ফোঁড়ন কাটবি না ।
সে যাই হোক , সেদিনের গল্পটা ছিলো পঞ্চাদার জ্যাকেলের একটা বাচ্চা ধরে আনা !
- জ্যাকেলের বাচ্চা ! পূটকে খানিকটা অবাক হয়েই জানতে চায় - সে কি কথা ! শেয়ালের বাচ্চা পোষা ! এ আবার কি ধরনের শখ !
পঞ্চা দা গম্ভীর হয়ে বললেন - ডোন্ট কল জ্যকেল অ্যাজ শেয়াল । দুটো সম্পূর্ন আলাদা প্রাণী , বুঝেছিস ?
- জ্যাকেলটা তবে কি ? শেয়াল তো বটেই । গোরাচাঁদ স্যার সেদিন ক্লাসে পড়াবার সময় বলেছিলেন জ্যাকেল খ্যাঁকশিয়াল নয় , এক ধরনের পাতিশিয়াল । অনেকটা অ্যালসেশিয়ান কুকুরের মতো দেখতে ।
- থাম তুই । পঞ্চাদা রীতিমতো হুঙ্কার ছেড়ে বলে ওঠেন - বলেছি না আমার কথার মাঝে বাগড়া দিবি না । তাল কেটে যায় ।
- তাল ! নিবারণ প্রায় একপেট হাসি কোনমতে চেপে রেখে বলে দাদা ? শুনেছি গানের তাল , ছন্দ এবং লয় থাকে । গল্পের ওই ধরনের তাল , লয় এবং মাত্রা থাকে নাকি ?
- থাকেরে ইডিয়েট , থাকে । মূর্খ গবেট তোরা । এসবের কি বুঝবি ? এই তাল গাছের তাল বা ডুগি তবলার তাল নয় । গল্পের তাল । মানেটা হলো হৃদম ! অ্যাকসেন্ট ! বুঝেছিস ?
আমরা সবাই একদৃষ্টে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম । আসলে ওনার কথা আমাদের আদৌ বোধগম্য হচ্ছিল না । পঞ্চাদা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে টেনিদার মতো একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলে উঠলেন - ডিলা গ্রান্ডি ! মানেটা বুঝেছিস ? বুঝবি কি করে ? পড়াশুনা তো মোটেই করিসনি । এই ধরনের ঘটনা আমি ছাড়া এই পৃথিবীতে আর ক জনাই বা জানে ! পঞ্চাদা দাঁতের ফাঁকে একটা ছোট্ট হাসি খেলিয়ে বলেন - যদি তোরা শুনতে চাস তো , আমি গল্পটা বলতে পারি ।
- হ্যাঁ । আমরা রাজি ।
- বুঝলি দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় , পঞ্চাদা নাকের ভেতরে এক টিপ নস্যি পুরে নিয়ে বলতে লাগলেন - আই হ্যাড বিন দেয়ারস ফর ফাইভ ইয়ারস ।
- দেয়ারস মানে ? কোথায় ?
- আরে এ এ এ ..... । পঞ্চাদা আকাশের দিকে তাকিয়ে খানিক্ষণ ভেবে বলে ওঠেন - ওই তো এস্কিমোল্যান্ডে ।
- এস্কিমোল্যান্ড ! জগদীশ বলে ওঠে - বইয়ে তো এই রকম কোনো দেশের নাম শুনেছি বলে মনে পড়ছে না ।
- তোর বই নিশ্চয় দেশী লেখকের লেখা । বিদেশি লেখকের লেখা বই পড়লে নিশ্চয়ই ব্যাপারটা জানতে পারতিস । আসলে আমি তো সারা জীবনই বিদেশে থেকেছি , তাই ওইসব নামগুলো বেশী জানি । এনিওয়ে , এস্কিমোল্যান্ড হলো সেই জায়গা যেখানে এস্কিমোরা বসবাস করে ।
- ওটা এস্কিমোল্যান্ড নয় দাদা । ওটা হলো আইসল্যান্ড ।
- ওই হলো । তোদের বইয়ে নির্ঘাৎ ওটা ভুল করে লেখা হয়েছে । ওটা খুব সম্ভবত আইসল্যান্ড নয় , হবে আইস্ক্রিমল্যান্ড ।
জগদীশ কিছু বলতে যাবে বলে ভাবচ্ছিল । কিন্তু ,পঞ্চাদা ব্যাপারটাকে আর ভাবতে না দিয়ে বলে উঠলেন - যাকগে , এবারে আমার গল্পটা শুন । দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় আমি নিজের চোখে দেখেছি হল্যান্ড , গ্রীনল্যান্ড , পোল্যান্ড , এস্কিমো ল্যান্ড , ইত্যাদির দেশের ফৌজির লোকজনদের । তারা যেখানেই যাচ্ছে সঙ্গে ধরা থাকছে দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা লোমশ কুকুরের মত দেখতে চার পায়া বড়ো আকারের জন্তু ।
- ক্যান ? বাঙাল টোনা মিত্তির খানিকটা বিস্মিত হয়ে জিঞ্জেস করে - সৈন্যরা হাতে অস্ত্র না লইয়া , কুকুরের মতো জন্তু সঙ্গে নিয়া ঘুরে ক্যান ? ওই গুলানরে ফৌজিরা নিশ্চয় ল্যালাইয়া দ্যায় অন্যদের পেছনে !
প্রশ্নটা শুনে পঞ্চাদা না রেগে গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন যে , ব্যাপারটাতে তিনিও নাকি অবাক হয়েছিলেন । সঙ্গে থাকা দোভাষীকে জিঞ্জেস করে জেনেছিলেন ওগুলো আসলে স্নিফার্স ডগ ! গন্ধ শোঁকার কুকুর । সারা দেশে ওদের দিয়েই বরফের নিচে শত্রুপক্ষের লুকিয়ে রাখা গোলা বারুদের তল্লাসি চালায় । উদ্ধার করে । কিন্তু , দোভাষীর কথা ওঁর আদৌ বিশ্বাস হয়নি । পরে ভালো করে খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছিলেন যে , আসলে ওগুলো কুকুর নয় , উলফ বা জ্যাকেল ! গোদা বাংলায় ওরা হলো পাতি শেয়ালের মাসতুতো ভাই - জ্যাকেল । ওগুলো একমাত্র ফৌজিরাই ব্যবহার করতে পারে ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন