google-site-verification=aFCzFTmuVjPqPlrdWXeJSj2r_EMig_cypLnlmiUQpw0 re স্মৃতিকথা ।। অবিশ্রান্ত বর্ষা আর ব্যাঙধরা দল ।। সোমা চক্রবর্তী - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

রবিবার, ১৮ জুলাই, ২০২১

স্মৃতিকথা ।। অবিশ্রান্ত বর্ষা আর ব্যাঙধরা দল ।। সোমা চক্রবর্তী


স্মৃতিকথা



বর্ষা এখনও সারাদিন ধরে হয়, অবিশ্রান্ত ধারায় হয়। ঘরে ঘরে গান বাজে- "মন খারাপ করা বিকেল মানেই...."। টিভিতে ঘন্টায় ঘন্টায় নিউজ আপডেট, হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুকে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, অন লাইনে পছন্দের খাবার অর্ডার- ইত্যাদি। আমাদের ছোটবেলায় 'সারাদিন ধরে বর্ষার রূপটা ছিল একেবারেই আলাদা। সে যেন এক অন্য পৃথিবীর অন্য গল্প। শহরের কথা অল্প জানি। সেখানে ছিল আমার মামার বাড়ি। যখন সেখানে থাকতাম, দেখেছি কিছুক্ষণ বৃষ্টি হলেই পথঘাট জলে থই থই। দিনে দুপুরে গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে ধীরে ধীরে যাওয়া। সারা পৃথিবীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন, অন্তত যতক্ষন বৃষ্টি না থামে। খিচুড়ি আর ডিমভাজা রাতের মেনু। বিকেল থেকে সবাই মিলে আড্ডা। লোডশেডিং এ ভুতের গল্প। তারই মধ্যে পাঁপড়, পেঁয়াজি আর চায়ের ঘন ঘন আবির্ভাব। মাঝে মাঝে রেডিওতে বিজ্ঞপ্তি, "চাষী ভাইদের উদ্দেশ্যে বলছি....." কিম্বা "সমুদ্রে যারা মাছ ধরতে যাবেন, তাদের উদ্দেশ্যে সতর্কবার্তা......."।
আমার বড় মামা ভুতের গল্প বলার বিষয়ে ছিলেন এক নম্বর। ওনার গল্প যখন শেষ হতো, বাড়ির আনাচে কানাচে তখন ভুতের রাজত্ব। একা একা দোতলায় কিম্বা বাথরুমেও যেতে পারছি না। আবার কাউকে বলতেও পারছি না- পাছে সবাই ভিতু বলে!


আমাদের বাড়ি মফস্বলে, নিতান্ত পাড়াগাঁয়ে। আর আমার ছোটবেলায় তো এখানকার কথা বলা যেতো 'অজগ্রাম'। অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে সবারই বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ। সকাল বেলাতেই মনে হতো, "...বেলা বেশি আর নাহি রে"। এরকমই কোনো একটা দিনে রবি ঠাকুরের "আষাঢ়" কবিতাটা মা শিখিয়েছিল মুখে মুখে। মায়ের সাথে বলতে বলতে মনে হতো, কবিতার সব কথাই তো সত্যি! 
সারাদিন একনাগাড়ে ব্যাঙের ঘ্যানঘ্যানানি। মানে "দাদুরী ডাকিছে সঘনে" আর কি! তখন তো পাড়ার ভেতরের রাস্তা গুলো কাঁচা ছিল। বৃষ্টির সময় কাদা হয়ে আর জল জমে তার কি অবস্থা হতো, তা হয়তো এখনকার ছেলেমেয়েরা কল্পনাই করতে পারবে না। আমার মনে আছে, আমদের বাড়ির সীমানা তখন বেড়া দিয়ে ঘেরা হতো। বর্ষার সময় বাবা দুটো করে ইট পেতে একটা অস্থায়ী পথ বানিয়ে দিত। বর্ষা শেষ হতে হতে সেগুলোতে শ্যাওলা জমে যেতো। পরের বর্ষায় আবার নতুন করে ইট পেতে নতুন রাস্তা তৈরি হতো। সারা জমিতে বৃষ্টির জল ভরে আছে। আমরা সাবধানে ইটের উপর পা ফেলে ফেলে চলাচল করছি। বাড়ি, রাস্তা সব একরকম লাগছে- জলে থই থই। বারান্দা থেকে কাগজের নৌকা ভাসাচ্ছি আর একটুখানি হেলে দুলে যাবার পরই বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটায় সেগুলো ডুবে যাচ্ছে। বেশী বৃষ্টিতে কখনো কখনো পাড়ার পুকুরটার জল বেড়ে রাস্তাটাও ডুবে যেত। তখন পুকুরের মাছগুলো ভেসে রাস্তায় চলে আসত। পুকুরের যিনি মালিক তাকে পাড়ার বড়ো ছোটো সবাই ডাকত- নিতাই খুড়ো। তাই পুকুরটাকে 'খুড়োর পুকুর' বলার চল হয়ে গিয়েছিল। বাবার সঙ্গে দেখা হলেই খুড়ো দুঃখ করত মাছ চাষ করে তার 'এ বছর' কত ক্ষতি হলো - তাই নিয়ে।


সেবার প্রায় বেশ কয়েকদিন টানা বৃষ্টি। তারই মধ্যে একদিন সকালের দিকে বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। সেই সময় আমার বড়পিসি এসে হাজির। বড়পিসি বাবার বড়দিদি। তাদের বাড়ি কাছেই। মাত্র বড় রাস্তাটার উল্টো দিকে। পিসি আমাদের খোঁজ-খবর নিতে এসেছে। আসার পথে নাকি রাস্তায় একটা বেশ বড় 'কই মাছ' দেখে আমাদের দেখাবে বলে সেটা ধরে নিয়ে এসেছে। আসলে রাস্তা আর পুকুর তো মিলে মিশে একাকার তখন। আমি তো শুনে হাঁ। রাস্তায় নাকি ওই জ্যান্ত মাছটা পাওয়া গেছে! সেদিনই প্রথম শুনলাম যে, অনেক মাছই-  বিশেষ করে কই, মাগুর, সিঙি এইসব মাছ নাকি ডাঙা দিয়েও অনেক দূর যেতে পারে। খরার সময় বাঁচার জন্য নাকি শুকনো পুকুর থেকে উঠে ওরা অনেক দূর যায় জলের আশায়। এদের জিওল মাছ বলে। একটু বড় হয়ে প্রকৃতি বিজ্ঞান বইতে পড়েছিলাম যে, অতিরিক্ত শ্বাসযন্ত্র থাকার ফলেই ওরা জলের বাইরে বেশ কিছুক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে। তবে ছোটবেলায় তো এতকিছু জানতাম না। তখন যাই শুনি তার সবকিছুই অবাক হবার মতো কথা। দু'দিনের একটানা একঘেয়েমি কাটতে না কাটতে সন্ধ্যা থেকেই আবার এলো তুমুল বৃষ্টি। রেডিওটাও সিগন্যাল না পেয়ে বোবা হয়ে রয়েছে। আমাদের পাড়ায় ইলেকট্রিক তখনও আসেনি। হ্যারিকেনের আলোয় ঘরময় সব ভুতুড়ে ছায়াছবি।

বাইরে কেবল জলের শব্দ 
ঝুপ্ ঝুপ্ ঝুপ্-
দস্যি ছেলে গল্প শোনে
একেবারে চুপ।


আমাদের অবস্থাও ওই রকম। সময় কাটছে না যেন। রাত বোধহয় দশটা হবে- সঠিক মনে নেই। হঠাৎ পিছনের বাঁশ বাগানের দিক থেকে একটা তীক্ষ্ম বাঁশি বা শিষের মতো আওয়াজ হলো। আমরা তো বটেই, মা সুদ্ধ ভয় পেয়েছে মনে হলো। বাবা আরও একটু শুনে বলল, ভয়ের কিছু নেই। ওটা ব্যাঙধরাদের দলের বাঁশি। এই প্রথম শুনলাম এরকম অদ্ভুত একটা নাম-  "ব্যাঙধরা দল"। সেটা কি মা ও জানেনা। বাবা বুঝিয়ে বলল, ওরা পাড়াগাঁ থেকে ব্যাঙ ধরে নিয়ে গিয়ে হোটেল, ল্যাবরেটরি-  এসব জায়গায় বিক্রি করে। পিছনের জানালাটা বাবা আস্তে আস্তে খুললো। বৃষ্টি তখনও একই ভাবে পড়ছে। তবু বাঁশ বাগানের কাছে ঘন অন্ধকারের মধ্যে একটুখানি জায়গা জুড়ে তীব্র আলো। দেখলাম, পাঁচ-ছ জন লোক। বর্ষাতি আর গাম্বুট পরা। হাতে হ্যারিকেনের থেকেও বড় একটা আলো। বাবা বলল ওটাকে নাকি 'হ্যাজাক' বলে। মাটিতে জল প্রায় হাঁটু পর্যন্ত। তার মধ্যেই আস্তে আস্তে ওরা চলাফেরা করছে। সঙ্গে থলে ধরনের কিছু আছে। ব্যাঙ ধরে তাতে রাখছে। কাছাকাছি হয়তো আরও লোক আছে। তাদের উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝে বাঁশি বাজাচ্ছে। চাপা অথচ তীব্র শব্দ। বৃষ্টির প্রবল ঝাপটায় জানলাটা বেশীক্ষণ খুলে রাখা গেল না। সেদিনের পর আর কোনোদিন ওদের দেখিনি। সেই বাঁশ বাগান এখন আর নেই। খেলার মাঠ হয়ে গেছে। যখন স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে গিয়ে ব্যাঙ কাটার চেষ্টা করেছি, তখন সেই বর্ষণমুখর রাত আমার বার বার মনে পড়ে গেছে। ভেবেছি এই ব্যাঙগুলো কারা দিয়ে যায়, কারা ধরে, কোথা থেকে ধরে! খবরের কাগজে যখন পড়েছি-  স্কুল-কলেজের ল্যাবরেটরি আর হোটেল-রেস্তোরাঁর চাহিদা মেটাতে ব্যাঙও নাকি বিলুপ্তির পথে, তখনও ভেবেছি ছোটবেলার সেই বৃষ্টির রাত আর ব্যাঙধরা দের সেই অদ্ভুত দলটার কথা!

কথা কি ফুরোয়.....

_______________________

সোমা চক্রবর্তী
Kalikapur, Taki Toad 
PO. Barasat, Dist: 24 Pgs (N), WB.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন