google-site-verification=aFCzFTmuVjPqPlrdWXeJSj2r_EMig_cypLnlmiUQpw0 re গল্প ।। অমৃতসুখ আখ্যান ।। পারিজাত ব্যানার্জী - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

রবিবার, ১৮ জুলাই, ২০২১

গল্প ।। অমৃতসুখ আখ্যান ।। পারিজাত ব্যানার্জী

 


 

এই এক মুশকিলে পড়েছি আমি আজকাল। দিন নেই রাত নেই, বৃষ্টি পড়লেই খাতা কলম নিয়ে বসে পড়ি হাবিজাবি কবিতা লেখার নেশায়। কি লিখলাম, তার কতখানি মানে দাঁড়ালো, কেউ তা আদৌ পড়বে, নাকি তা তাদের অন্তত মনে ধরবে - এতকিছু যদিও ভাবতে পারিনা। বেশি ভাবতে গেলেই মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে তো, সেই চেষ্টাতেও তাই আর যাই না। শুধু লিখি...কখনও ছেলের স্কুলের খাতা থেকে পাতা ছিঁড়ে; কখনও ওনার পড়ার ঘরের ফেলে দেওয়া এক পিঠ ব্যবহৃত প্রিন্টারের পাতা জোগাড় করে বা রান্নাঘরে মহিমাকে প্রতিদিনকার কাজ বোঝাতে বোঝাতে তাকে থাকা ফর্দের খাতা নামিয়ে, সেইখানে। লিখতে থাকি; লিখতেই থাকি যতক্ষণ না বৃষ্টিস্নাত হয়ে যাই নিজেই বাইরে নামা ওই প্রবল বর্ষণের ঝাপটায়।

 

এই যেমন কাল বিকেলেই তো! ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে এসে বাড়িতে ঢুকতেই ঝমঝম করে আকাশ একেবারে কালো করে এসে আমাদের উত্তর কলকাতার সাবেকি দোতলা এই বাড়ির ছাদে আছড়ে পড়ল। কোনোরকমে সদর দরজায় খিলটা তুলেই আমি ছেলের থেকেও জোরে দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা দিয়ে বিছানায় আধভিজে শাড়িটা পড়েই বসে পড়লাম বালিশের তলায় রাখা চটি খাতা আর পেনটা বার করে।

 

"ভেজা রচনা;

ভেজা আঁচল;

ভেজা শরীর -

চোখের কাজল ...

ঝরা বৃষ্টি

তালে সৃষ্টি

ধরা দৃষ্টি

দামাল অনল!"

 




বোধহয় অন্য কোনো জগতেই বিচরণ করছিলাম আমি যখন বহু দূর থেকে মনে হল শুনতে পাচ্ছি দরজায় প্রবল কড়াঘাতের নৃশংসতা। হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে যখন শেষমেশ পারলাম দরজাটা খুলতে, তখনও যেন কেমন ঘোরের মধ্যেই বাস করছিলাম তবু আমি। ওনার মুখ ঝামটায় চমক ভাঙল। বুঝলাম, এতসবের মধ্যে রাতের খাবারটাই বানাতে ভুলে গেছি এক্কেবারে!

 

ওনার মুখঝামটা খাওয়া আজকাল অবশ্য আর নতুন কিছু তো নয়! একরকম বলা যেতে পারে প্রায় রোজকারই ঘটনা। অবশ্য তাতে দোষই বা দিই কিভাবে আমি ওঁকে? আপনিই বলুন, কখনও শুনেছেন, কারও গৃহস্থ স্ত্রী কবিতা লেখার চক্করে রান্না চাপাতেই ভুলে গেছে একবেলা? বা ছেলের যত্ন নিতে? সকালে ওঁর মুখের সামনে চা-টা ধরতে? এই তো গত সপ্তাহেই... পরপর দুদিন বৃষ্টি হল না, ব্যস আমি ওমনি বেমালুম ভুলেই গেলাম ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে হবে। নেহনৎ ছেলের এক শিক্ষিকা আমাদের পাড়াতেই থাকেন... তিনি পৌঁছে দিয়ে গেলেন ওকে বাড়িতে। দ্বিতীয় দিন বেশ বিরক্তই হয়েছিলেন বুঝতে পারছিলাম। ভিতরে এসে একটু বসলেনও না। 'bloody irresponsible' বিড়বিড় করে বলে বৃষ্টি মাথায় করেই গাড়ি বারান্দা ধরে হনহন করে হাঁটা লাগালেন সদর রাস্তার দিকে।

 

"মনকেমনের বৃষ্টি ধোয়া জলের চলন আজ

তোমার চুলের স্পর্শ মেখেই বিলম্বিত মন্তাজ -

অভিমানিনী, সুর ভুলে তুমি কালচক্রের সাক্ষী,

রূপোলী ওড়নায় গাঁথা তোমারই

আমার বেহিসাবি অকাজ!"

 



আমি যদিও জানি, যতই বলিনা কেন মুখে, "এমনি করেই যায় যদি দিন, যাকনা" - তবু এত সহজ সরলভাবে সব যাবে না কিছুতেই। সাধারণ বাঙালি সেকেলে মধ্যবিত্ত সংসার আমাদের। এখানে সবার সব কাজ, দায়িত্ব ভাগ করা থাকে। বাড়ির পুরুষেরা রোজগার করেন। স্ত্রীয়েরা সংসার সামলান। বয়স্করা নতুন যুগের কর্তা কর্ত্রীর হাতে সব দায়িত্ব তুলে দিয়ে তীর্থ ও ধর্মকর্ম ও ওষুধবিষুধে মন দেন। আর ছোটরা; সকাল হলেই স্কুল ও বিকেল হলেই ছুট লাগায় হয় কোচিংয়ে নাহলে ক্রিকেট বা ক্যারাটে, সাঁতার, আঁকা বা নিদেনপক্ষে নাচ গানের প্রশিক্ষণের আখড়ায়। এদের মধ্যে শুধু যে ক'টা বখাটে ছেলে বেকার হয়ে বসে থাকে রকের আড্ডায় বিকেলবেলায়, বা যেই মধ্য যৌবন পেরনো পুরুষেরা মহিলাদের মন পেতে ক' কলি কবিতা লেখেন, সুর তাল মিলিয়ে গান বাঁধেন,  নাঃ, ভাগ্য দোষে আমি সে দলেও পড়িনা। তাই ঠিক বলতে পারবনা জানেন, আমার এই কাব্যি করার চর্চা হঠাৎ করে কিভাবে শুরু হয়ে গেল সকলের অগোচরে আমার মনন আখ্যানে। জানিওনা এর শেষ কিভাবে হবে। আদৌ এ রোগ কখনও এমন বয়সে গিয়ে একবার ধরলে আর সারেও কিনা! শুধু মনে আছে, সেই প্রথমদিনের আমার অস্তিত্বের বেঁচে ওঠার গল্পখানি আজও খুব স্পষ্টভাবে। শ্বশুর শ্বাশুড়িকে রাতের খাবার খাইয়ে ওষুধ, ইনসুলিন দিয়ে নিজের ঘরে এসেছিলাম সারাদিনের কাজের পর বাসি শাড়িটা ছেড়ে পরিষ্কার পাট করে রাখা নীল রঙের তাঁতের শাড়িটা পরে একটু ও পাড়ার বর্ণালীর সাথে দেখা করতে যাবো বলে। অনেকদিন ধরেই ও আমায় খুব করে ধরেছিল ওর বাড়ি যাওয়ার জন্য। ওর মেয়েটা আমার ছেলের থেকে দু বছরের বড়। দেখা হলেই খুব খেলে দুটিতে। আমিই তালেগোলে সময় বার করে উঠতে পারিনি। যাকগে, সেসব কথা থাক বরং। তা, আমি শাড়ি টাড়ি পরে তৈরী হয়ে একটা বড় নীল টিপ বার করে কপালে পরতে যাবো, এমন সময় খুব জোরে বাজ পড়ল। বোধহয় খুব কাছেই। আলোর ঝলকানিতে একেবারে আমার ভিতরটা এক ঝটকায় বেড়িয়ে এসে আমার সাধের মেহগনি কাঠের ড্রেসিং টেবিলটার উপরে ছিটকে গিয়ে পড়ল। আমি চমকে গিয়ে হাত থেকে টিপের পাতাটা কেজানে কোথায় ফেলে দিলাম মাটিতে। আর সাথেসাথেই ঝুপ করে নেমে এলো লোডশেডিং। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে খাটের একধারে বসে পড়লাম সব ফেলে। সেই প্রথম। বারান্দার পর্দার ফাঁক দিয়ে চোখ চলে গেল গ্রিলের মোটা মোটা গরাদগুলো পেরিয়ে আরও বাইরে। আমাদের বাড়ির লাগোয়া যে নতুন ফ্ল্যাটগুলো উঠেছে, ওদের কম্পাউন্ডের জেনারেটরের কড়া আওয়াজ উপেক্ষা করে যে আলো ভেসে আসছিল, তাতেই টের পেলাম, বর্ষার প্রথম বৃষ্টির উচ্ছ্বাস কেমন সব ভুলে আছড়ে পড়ছে  বারান্দায় আমার নিজের হাতে লাগানো বোগেনভিলিয়ার অগোছালো বনে।

 

"প্রাণ বলে, 'বৃষ্টি ওরে,

আমায় মুক্ত করিস!'

আমি শুধাই,

'কেমন কবলে জড়িয়ে তুমি

এ হরষে দাও বিষ!'

 

প্রাণ হাসে।

মেঘের ঘরে সেই যে আজ

জলের ফোঁটার বাজপাখি...

অমৃতসুখ তারই গহনে

বনফুলে মেখে থাকা

অযাচিত অমিত্রাক্ষর হয়রানি!"



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন