গল্প ।। কাঁচের দেওয়াল ।। চিন্ময় গঙ্গোপাধ্যায় - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

Sunday, July 18, 2021

গল্প ।। কাঁচের দেওয়াল ।। চিন্ময় গঙ্গোপাধ্যায়

    

গল্প 

               


 

 "কোনো সমস্যা হচ্ছে ম্যাডাম?"

ঝকঝকে স্মার্ট তরুণী নার্স জিজ্ঞেস করলেন।

অন্যমনস্ক সুচরিতা প্লাস্টার সমেত ভাঙা পা-টা একটু সরিয়ে নিয়ে তাকালেন বাঁ হাতের ফোনটার দিকে। শব্দহীন উচ্চারণে বললেন-"কেন ফোন করলে সুনন্দ? এতবছর পর?"

"কিছু বললেন ম্যাডাম"?

বহুদূরে ভাসতে থাকা এলোমেলো চেতনার টুকরোগুলো বহুকষ্টে একত্রিত করে ঘোলাটে চোখে তাকালেন নার্সের দিকে। শুকনো ঠোঁটে সৌজন্যের হাসি টেনে বললেন -"না-কিছু না"!

"আপনি ঘুমোনোর চেষ্টা করুন ম্যাডাম। দেখবেন যন্ত্রণাটা কম বোধ হবে।আমি পাশেই আছি। প্রয়োজন হলেই ডাকবেন।"


ধবধবে চকচকে অভিজাত নার্সিংহোম।প্রফেশনাল কেবিনে সুবিন্যস্ত ব্যবস্থাপনা। সামনে কাঁচের দেয়ালের ওপর থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে পর্দা। বর্ষার মেঘে ঢেকে আছে আকাশ। সঙ্গে বৃষ্টি ঝরছে অবিরল। এলোমেলো গাছগুলোর মাথায় আছড়ে পড়ছে শ্রাবণের অঝোর ধারা।দুলে- দুলে এ- ওর গায়ে যেন আহ্লাদে ঢলে পড়ছে স্নানরতা বনানী। দৃষ্টি সরিয়ে নিতে গিয়েও পারল না সুচরিতা।বর্ষায় আকুল পৃথিবীটাকে যেন চোখ দিয়েই ছুঁতে চাইছে সে।




মনে পড়ছে সবকিছু। সুচরিতা চোখ বন্ধ করলেন।

একটু একটু করে সব মনে পড়ছে। চারপাশে ছেয়ে আছে বর্ষার মেঘ। ফাঁকা রাস্তা। নতুন সবুজে সেজে উঠেছে পৃথিবী। নিশ্চিন্তে স্কুটি চালিয়ে ফিরছিলেন।এরকম সময়ে গান পেয়ে বসে তাঁকে। গুনগুন করতে করতে মন যেন শ্রাবণমেঘের সঙ্গী হয়ে গেছে কখন। জীবন হালকা তুলোর মতো নির্ভার। কোনো দুঃখ- বেদনা নেই,ঝড়-ঝাপটা নেই,কেবল মনের সুখে পাখির মতো উড়ান দিকচিহ্নহীন নিরুদ্দেশে।


ঠিক তখনই পিছন থেকে একটা সজোরে একটা ধাক্কা। রাস্তায় ছিটকে পড়ে গেলেন সুচরিতা।ব্যাস।আর কিছু মনে ছিল না তাঁর।


জানলার কাঁচে ছিটকে আসছে বৃষ্টির ফোঁটা। বেশিদূর দেখাও যাচ্ছে না বৃষ্টির দাপটে। কিন্তু,কী অদ্ভুত ব্যাপার! সমস্ত শরীর- মনে তোলপাড় করা এক অনুভূতি টের পাচ্ছেন সুচরিতা। আবার তাকালেন হাতের মুঠোয় থাকা ফোনটার দিকে।


"কেন ফোন করলে সুনন্দ"?

আপন মনেই বলে উঠলেন তিনি।

"আমাদের সম্পর্কের ভাঙনটা আজ কতবছর হল সুনন্দ! আমার কথা তুমি ভাব? এতবছর পরও তোমার গলার স্বর একই রকম আছে!কী করে জানলে, আমার পা ভেঙেছে?কী করে জানলে, আমি খুব জোরে স্কুটি চালাই? কেন বললে-স্কুটি চালাতে চালাতে এত কথা বলি কার সাথে?"




দু-চোখের কোলবেয়ে তরতাজা কয়েকফোঁটা চোখের জল দুধ- সাদা বেডকভারটা ভিজিয়ে দিল।

বাইরের মেঘগর্জন ছাপিয়ে সুচরিতার মনে তখনো

অনুরণিত হচ্ছে সুনন্দের কন্ঠস্বর।

-"দ্রুত সেরে ওঠো। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি"

-"তুমি বলছিলে সুনন্দ।

-আমি জানি ।সেরে উঠব।ডাক্তারবাবু বলেছেন।

পায়ের ভাঙা হাড় জোড়া লাগবে। কিন্তু আমাদের ভাঙা সম্পর্ক আর কোনদিন জোড়া লাগবে না।"


কাঁচের ওপারে তখন শুরু হয়েছে বৃষ্টির মাতাল নাচন।পৃথিবী যেন ভেসে যাবে এবার। গাছগুলো আহ্লাদে, অস্থির সোহাগে এখন দিশেহারা। ছটফট করছেন সুচরিতা।ডাকলেন নার্সকে।বললেন-"পর্দাটা টেনে ঢেকে দাও কাঁচের দেয়াল।"


ভরা- বাদল ওপারেই থাক।

 

 

================= 




No comments:

Post a Comment