প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। নবপ্রভাত ৮৫ ।। চৈত্র ১৪৩১ মার্চ ২০২৫

বর্ষীয়ান লেখক উত্থানপদ বিজলী এক পরিচিত নাম বাংলা সাহিত্যে। একাধারে তিনি কবি, ছড়াকার, সম্পাদক এবং বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক। নামীদামি থেকে অনামী ছোটখাটো কত যে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর লেখাজোখা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। নিজের বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে অজস্র তাঁর সম্পাদিত বইয়ের জগৎ। আজকের মুখ-বইয়ের মতো সামাজিক মাধ্যমে বা ব্লগজিনেও তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। অশীতিপর-তিনি আজও সমান সক্রিয় তাঁর সৃজনকর্মে।
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর শিশু-কিশোরদের উপন্যাস 'পলাশডাঙার পলাশ'। বর্তমান আলোচকের মতে, এখনও পর্যন্ত তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি এটি। শিশু-কিশোরদের উপন্যাস বলা হলেও, এটিকে কেবল শিশু-কিশোরদেরই ভেবে এড়িয়ে গেলে এক বিশেষ কালের বিশেষ এক অঞ্চলের সামাজিক-সাংস্কৃতিক – হ্যাঁ, এমনকি ঐতিহাসিক – নিবিড় চিত্রসমন্বিত এ গ্রন্থটির প্রতি অবিচার করা হবে।
কাহিনির স্থান মজে যাওয়া আদিগঙ্গার তীরের নারকেলডাঙা-পলাশডাঙা ও তৎসন্নিহিত হংসগড়িয়া, দহকাঁদা, মাখালিয়া, তমালপুর-দুলালপুর, শিবপুর, সরবেড়িয়া প্রভৃতি গ্রাম এবং তাদেরও সীমা ছাড়িয়ে বহুদূর ব্যাপ্ত। এর মধ্যে কাহিনির নায়কের গ্রামটি হল চব্বিশটি পরগনার অন্তর্গত বরিদহাটি পরগনার উক্ত পলাশডাঙা। কাল হিসাবে এসেছে দেশের স্বাধীনতার বছরটিকে মাঝে রেখে তার পূর্ব ও পরের পনেরো-ষোলো বৎসর। পাত্র তথা কুশীলব শৈশব থেকে কৈশোর-যাত্রাপথের পলাশ ও তার পরিবার এবং প্রতিবেশ। বলা বাহুল্য, কোনও একক পাত্র ও তার পরিবারকেন্দ্রিক কাহিনি গণ্ডিবদ্ধ হয়ে পড়ার দিকেই পা বাড়িয়ে থাকে যতক্ষণ তা প্রতিবেশের মধ্যে প্রতিস্থাপিত না হচ্ছে। বিবিধ বিচিত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সেই প্রতিবেশই এ উপন্যাসের প্রাণসম্পদ এবং যে বৈশিষ্ট্যের অন্যতম প্রতিভূ পলাশ ও তার পরিবারটি। বদলে-যাওয়া আজকের গ্রামের বেশ খানিক বিপরীতে মানুষ-গাছপালা-পশুপাখি-মাঠ-জলার পরস্পরলগ্নতার মধ্যে প্রতিস্থাপিত এ উপন্যাসের কাহিনি। স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও শিশু-থেকে-কিশোর পলাশ ও তার পরিবার নিবিড়ভাবে সেই বৃহত্তর বৃত্তেরই অঙ্গীভূত। এ কাহিনি – বলা বাহুল্য, নিছক কেবল মানুষকে নিয়েই নয় – সেই বৃহত্তর বৃত্তকেই আমাদের গোচরীভূত করে পলাশকে কেন্দ্রে রেখে; বলা যায়, পলাশের চোখ দিয়ে। বস্তুত উপন্যাসটি কাহিনির বয়ানে একটি সময়ের দলিল, জনপদ-দর্পণ। সে দলিল, সেই দর্পণ কেবল উপন্যাসধৃত সময়য়খণ্ড বা স্থানিকতাতেই সীমায়িত থাকেনি, অঞ্চলগত বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যকে বক্ষে ধারণ করেও বৃহত্তর অখণ্ড বাংলা তথা গ্রামীণ ভারতবর্ষের অন্যান্য অনেক প্রদেশের সঙ্গেও নিশ্চয়ই তার সাযুজ্য দুর্লক্ষ্য ছিল না। পরিবর্তিত সময়কালে সেসব বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ বিলুপ্ত এ কথাও বলা যাবে না।
'পলাশ এ সব কথার সবটুকু বুঝে উঠতে পারে না।সে কিছু বিস্ময় নিয়ে বাবার মুখের দিকে চেয়ে বসে থাকে। অনেকক্ষণ। আর ভাবে, সত্যের আবার রকমফের হয়?' একটা যুক্তিগ্রাহ্য সচেতন মন বরাবর উন্মেষিত হতে দেখি আমরা পলাশের মধ্যে।
'বন্ধুত্ব শেষ হয়ে যায়। সত্য – মিথ্যা হয়ে যায়। কোনটা সত্যি? তাদের থাকাটা, না তাদের না-থাকাটা? ক্লাসের কোনও বন্ধু বা পরিচিত কোনও জন যদি হঠাৎ করে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, তবে সে কী করতে পারে? তাই পলাশ স্তব্ধ হয়ে যায়। নির্বাক হয়ে বসে থাকতে হয়। তাদের স্মৃতিটুকু শুধু থাকে। থাকতে থাকতে ক্রমে সুতোটুকু ক্ষীণ হয়ে আসে, তার পর একদিন বুঝি-বা সুতো ছিঁড়ে আকাশে ভো-কাট্টা হয়ে যায় ঘুড়ি! পলাশ কেমন করে মেলাবে কল্পজগতের গান সুর ও ছন্দের জলছবির সঙ্গে এমন নির্মম রূঢ়তা?' – জাগতিক চিরন্তন এই প্রশ্নের সামনে আমাদেরও নির্বাক হয়ে পড়া ছাড়া উপায় থাকে না।
পলাশও সঙ্গী উঁচু শ্রেণির ছাত্রের প্ররোচনায় বিদ্যালয় ফাঁকি দিয়ে বনবাদাড়ে এটা-সেটা খেয়ে সময় কাটিয়ে হাতে-কালি, মুখে-কালি হয়ে ফেরে, একদিন ধরা পড়ে মায়ের শাস্তির মুখে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় অমনটি আর না করার। পলাশেরাও যে হোগলাবনে ফাঁদ পেতে ডাকপাখি-পানপায়রা ধরে ঝোল করে খায়নি এমন নয়। অর্থাৎ নায়কের প্রতি দুর্বলতাবশত সময়ের ভাষ্যকে আপন ইচ্ছামতো আড়াল করতে চাননি লেখক।
এমন নয় যে উপন্যাসধৃত সমস্ত বিষয়ই অভিনব কিছু – তা পুরোপুরি হওয়া সম্ভবও নয়, বিশেষত কাটিয়ে-আসা সময়ের কথায়। এমনকি গত শতাব্দীর সাত-আটের দশকে শৈশব-কৈশোর-কাটানো বর্তমান আলোচকও এসবের কিছু কিছুর একাধারে সাক্ষী ও শ্রোতা। বিচ্ছিন্নভাবে অনেকের লেখায় উঠেও এসেছে এসব কিছু কিছু। কিন্তু তার পরেও আত্মজীবনীমূলক এ উপন্যাসের গুরুত্ব কমে না এতটুকুও। একই আধারে সংহত শৃঙ্খলায় এমন বিশদ-দর্শন বিরল। সর্বোপরি স্রষ্টার স্বতন্ত্র অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি ও উপস্থাপনদক্ষতাকে তো স্বীকার করতেই হয়।
লোক-পরিভাষার উল্লেখের সঙ্গে সঙ্গে বর্ষীয়ান সাহিত্যিকের কলমে 'সামন', 'সকলার', 'ধন্নে' (ধরনা), 'তিনো' (তৃণ), 'আয়ের' (আহার, খাদ্য), প্রভৃতি স্থানীয় উচ্চারণ উঠে এসেছে দেখে ভালো লাগল।
উপন্যাসটিতে কোথাও কোথাও কোনও ঘটনা ইত্যাদি কথকের মাধ্যমে উল্লেখের পরিবর্তে, পলাশকে সরাসরি সেইসব ঘটনাবৃত্তের মধ্যে দিয়ে যেতে দিলে তার আরও সব জীবন্ত ও চলমান অনুভূতিগুলোর সঙ্গে আরও বেশি করে একাত্ম হয়ে যেতে পারত পাঠক। ঘটনা অতীতের হলেও, সেই অতীতই যখন চলমান জীবন্ত বর্তমানে তুলে ধরে নিজেকে, 'সে সময় এখানকার গ্রাম সব এই রকম।...' বা 'তখনকার দিনে ছিল আর এক মারাত্মক রোগ কালাজ্বর। তবে তখন এর তেমন কোনও ওষুধ ছিল না।...' জাতীয় বাক্য এড়িয়ে যাওয়া যেত, ঘটনার বিন্যাস বা পারম্পর্যেই বুঝে যাবে পাঠক। এমনকি ঘটনার বর্ণনাতে কোনও কোনও স্থলে অতীত ক্রিয়াপদ এড়ানো গেলে সেইসব জায়গায় কাহিনি আরও জীবন্ত, আরও অনুভূতিময় হয়ে উঠতে পারত।
ছাপার ভুল আছে কিছু।
লেখক কর্তৃক গৃহীত আলোকচিত্রে শোভন ও বিষয়ানুগ হয়েছে উভয় প্রচ্ছদ।
দ্বিতীয় শৈশবে এসে নির্ভার কাহিনির বয়ানে প্রথম শৈশব-কৈশোরকে ফিরে দেখার মান্য সাহিত্যিক উত্থানপদ বিজলীর এই সাহিত্য-কীর্তিটি আদতে একান্তভাবেই প্রকৃতি ও জীবনসম্পৃক্ত। গ্রামীণ যে নিবিড় চিত্র তথা যাপনচিত্র ফুটে উঠেছে, ভাবতে ভালো লাগে, প্রায়-প্রতিবেশী গ্রামের বাসিন্দা হিসাবে তথা বৃহত্তরভাবে একই জেলার জাতক হিসাবে আমরা তার একান্ত অংশী। কাহিনির সচল বয়নে – এমনকি কখনও কাহিনির বয়নকে কিঞ্চিৎ বিঘ্নিত করেও – কথা বলে উঠেছে লোকসংস্কৃতি, ইতিহাস। এখানে সজীব হয়ে উঠেছে একটা সময়; জীবন্ত হয়ে উঠেছে একটা জনপদ ভালো-মন্দমেশা তার সমগ্র সত্তা নিয়ে। আর শেষ পর্যন্ত সেই কিঞ্চিৎ বিঘ্নও তাই পাঠকের সামনে বড় কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না দ্বিতীয়-শৈশবে-আসা অভিজ্ঞ এক কথকের লিখন-প্রসাদগুণের সুবাদে। সর্বোপরি নিজেকে উজাড় করে দিয়ে এ তাঁর আপন জন্ম ও জন্মভূমির প্রতি ঋণশোধ-প্রচেষ্টাও। প্রসঙ্গত, এ উপন্যাসের স্রষ্টার নিবাস নারকেলডাঙা গ্রাম, কিন্তু উপন্যাসের নায়ক পলাশের নিবাস নারকেলডাঙার সঙ্গে একই লপ্তে উচ্চারিত পলাশডাঙায়। বোঝাই যায় উপন্যাসের নিজস্ব সত্তাকে মর্যাদা দিতেই এই সামান্য আড়ালটুকুর আশ্রয়গ্রহণ-অভিপ্রায় লেখকের। পলাশের পিতা চূড়ামণি, যা উত্থানবাবুর পিতার নাম (উপন্যাসে কোনো চরিত্রেরই প্রায় পদবি নেই, সুতরাং সেদিক দিয়েও তফাত করার নেই) ।
আমাদেরই জেলার জলহাওয়াজাত আপনার এই উজ্জ্বল সাহিত্যকর্মটির জন্য – যা অনেক লোকসংস্কৃতি-গবেষককে তো বটেই, স্থানিক ইতিহাসের চর্চাকারীকেও অকৃত্রিম উপাদান জোগাবে – আপনাকে অভিনন্দন, উত্থানবাবু। লেখক হিসাবে আজও আপনার সক্রিয়তা দরকারে খুচরো কিছু কাজ কমিয়ে ধারাবাহিক ত্রিগ্রন্থ উপহার দিক আমাদের।পরবর্তী কোনও সময়খণ্ডের আপনার হাতে এমনই সত্য হয়ে ওঠার আশায় থাকব আমরা।
পুস্তকের নাম : পলাশডাঙার পলাশ
লেখকের নাম : উত্থানপদ বিজলী
প্রকাশক : দোয়েল পত্রিকা
প্রকাশকাল : এপ্রিল ২০২০
মূল্য : দুশো টাকা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন