Featured Post
ভ্রমণকাহিনি ।। চিল্কিগড় ।। শংকর লাল সরকার
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
চিল্কিগড়
(কনকদুর্গা মন্দির, চিল্কিগড় রাজবাড়ি, কালাচাঁদ মন্দির, ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি ... )
গাড়ি থেকে নেমে তোরণদ্বার দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে আক্ষরিক অর্থেই একেবারে অবাক হয়ে গেলাম। যেকোন তীর্থস্থানে দেবতার মন্দিরের প্রবেশ পথের যে সাধারন দৃশ্য, সারি সারি দোকানে বিক্রি হচ্ছে নানারকমের পূজার উপকরণ। খাবারের দোকান, পর্যটকদের মনপসন্দ সুভেনীর, দেবতার ফটোর দোকান সেসব কোথায়? কোথায় চলেছি? এ তো ঘন জঙ্গল! কেঁন্দু, শাল, মহুয়া, মাধবীলতা আরও চেনা অচেনা হাজারো গাছের ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলা সরু রাস্তা ধরে পাখিদের কলতান শুনতে শুনতে এগিয়ে চললাম। জঙ্গলের ঘ্রাণ নিতে নিতে বেশ খানিকটা হাঁটবার পর মন্দির। চিল্কিগড়ের প্রধান আকর্ষণ কনকদূর্গা মন্দির। একরত্ন দেউলের আদলে তৈরি সুউচ্চ মন্দিরের সামনে বিরাট যজ্ঞস্থল। সভামণ্ডপের প্রশস্ত হলঘরে ভক্তদের বসার জায়গা। দুইদিকে দরজা আর একদিকে জানলা বিশিষ্ট মূল গর্ভগৃহের চারপাশে ঢাকা প্রদক্ষিণ পথ। তিনপাপড়ি বিশিষ্ট খিলান আর গর্ভগৃহের গম্বুজাকৃতি সিলিং হিন্দু আর ইসলামিক স্থাপত্যের মেলবন্ধনের নিদর্শন।
পুরোহিতের মুখেই শুনলাম মন্দিরের ইতিহাস। ১৭৪৯ খৃষ্টাব্দে জামবনির রাজা গোপীনাথ সিংহ মন্দির তৈরি করেন। স্থানীয়দের বিশ্বাস জামবনির সামন্তরাজাদের প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরে আজও অষ্টমীর রাতে ভোগ রান্না করেন দেবী স্বয়ং। প্র্রাচীন পঞ্চরত্ন মন্দিরটি পরিত্যক্ত হলে, সেই ধ্বংসাবশেষের পাশেই নতুন মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। কিংবদন্তি, স্বপ্নাদেশ পেয়েই স্ত্রীর হাতের সোনার কাঁকন দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল দেবীমূর্তি। তাই দেবীর নাম কনকদুর্গা। মন্দিরের স্থপতি ছিলেন শিল্পী যোগেন্দ্রনাথ কামিল্যা। মন্দির প্রতিষ্ঠার পর পুরোহিত ছিলেন রামচন্দ্র ষড়ঙ্গী। এখনও মন্দিরের পুজোর ভার রামচন্দ্র ষড়ঙ্গীর উত্তরাধিকারীদের কাঁধে। শুধু দুর্গাপুজোর সময় নয় সারা বছরই মন্দিরের পুজোর দায়িত্ব সামলান ষড়ঙ্গী পরিবারের বর্তমান সদস্যরা।
অষ্টধাতুর চতুর্ভূজ দেবী ঘোড়ার পিঠে আসীন। উপরের দুই হাতে খোলা তলোয়ার আর সুরা পানের পাত্র। তৃতীয় হাতে বরাভয় মুদ্রা। অন্যহাতে দেবী ঘোড়ার লাগাম ধরে রেখেছেন। পুরোহিত বললেন বছরে দুবার দেবীর পোশাক পরিবর্তন করা হয়। দুর্গাষষ্টীর সময়ে দেবী একবার নতুন বেশ পরিধান করেন। সেই সময়ে দেবীকে বিভিন্ন অলংকারে সাজানো হয়। দূর্গাপুজোর চারদিন দেবী সেই পোশাকে থাকেন। দশমীর দিন আবার নতুন পোশাকে দেবী সজ্জিত হন। সেই পোশাকেই দেবী বাকি বছর থাকেন। দুহাজার সাত আর আট, পরপর দুবার মন্দিরের দেবী মূর্তি চুরি হয়ে গেলে নতুন মূর্তিটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
মন্দিরের পাশটিতেই একটা বিরাট হাঁড়িকাঠ। আমার কৌতুহলী দৃষ্টি দেখে পুরোহিত বললেন এককালে এখানে নরবলির প্রথা ছিল। এক সময় গভীর রাতে মন্দির সংলগ্ন জঙ্গলে নরবলি হত। কিন্তু রাজার নির্দেশ ছিল তাঁর প্রজাদের মধ্যে কেউ কিংবা কোনও ব্রাহ্মণ সন্তানকে বলি দেওয়া যাবে না। বলির জন্য অষ্টমীর রাতে নর নাকি নিজেই চিল্কিগড়ের জঙ্গলে উপস্থিত হতেন। একবছর কোনও কারণে এক ব্রাহ্মণ সন্তান উপস্থিত হয়েছিলেন বলির দিনে। সেই থেকে দেবীর নির্দেশেই বন্ধ হয়ে যায় নরবলি। তবে আজও এখানে ছাগ আর মহিষ বলির প্রথা প্রচলিত আছে।
কনকদূর্গা মন্দিরের জঙ্গলের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ডুলুংনদী। ফেন্সিং দেওয়া বনবিথির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চমকে উঠি, হাতি নাকি? বেশ কয়েকটা হাতি আর হরিণের মূর্তি তৈরী করে জঙ্গলের ভিতরে রাখা হয়েছে পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য। রয়েছে শিশুদের জন্য বিনোদন পার্ক আর বোটিংএর আয়োজন।
ঝাড়গ্রাম প্রাসাদ দেখবার পরে গাড়ির ড্রাইভার বলেছিলেন, “জঙ্গলমহল মেলা জমতে কিছুটা দেরী আছে চলুন ততক্ষনে চিল্কিগড় থেকে ঘুরে আসি।” ঝাড়গ্রাম থেকে মাত্র পনের কিলোমিটার দূরে চিল্কিগড়। এককথায় রাজী হয়ে গিয়েছিলাম। চিল্কিগড় নামটাই রোমাঞ্চকর। ভাবলাম চিল্কিগড় রাজবাড়ি গিয়ে কোন কেল্লার ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাব। তাছাড়া দেবী মাহাত্ম্যের গল্প এবং লোকগাথা ছাড়াও চিল্কিগড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জঙ্গলের গা ছমছমে পরিবেশ যে কোনও ভ্রমণপিপাসু মানুষকে আকৃষ্ট করবে।
প্রধান রাস্তার উপরের এক বিরাট তোরণদ্বার পার হয়ে পাঁচিলঘেরা এক প্রশস্ত চত্ত্বরে প্রবেশ করলাম। প্রায় তিনশো বছর আগে জামবনীর সামন্তরাজা ছিলেন ভূমিপুত্র গোপীনাথ সিংহ, চিল্কিগড় ছিল তার রাজধানী। চিল্কিগড়ের প্রাচীন কনকদূর্গা মন্দির এবং এই রাজবাড়িটি রাজা গোপীনাথ সিংহের আমলেই তৈরি। পুত্রহীন রাজার একমাত্র কন্যা সুবর্ণমণির সঙ্গে পরবর্তীকালে বিবাহ হয় পার্শ্ববর্তী ধলভূমগড়ের রাজা জগন্নাথ সিংহের। ১৭৬৫ সালে রাজা গোপীনাথ সিংহের মৃত্যুর পর চিল্কিগড়ের রাজা হন জগন্নাথ সিংহ। ওনাদের পুত্র কমলাকান্ত দেও ধবলদেবের সময়কে চিল্কিগড়ের স্বর্নযুগ বলে মনে করা হয়। চিল্কিগড় রাজবাড়ির রয়েছে এক গৌরবময় ইতিহাস। ঐতিহাসিক চুয়াড় বিদ্রোহ চলাকালীন রাজা জগন্নাথ সিংহ এই চিল্কিগড় রাজবাড়ি থেকেই ১৭৬৯ সালে বিদ্রোহের ঘোষণা করেন।
বর্তমানে সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত না হলেও সর্বত্র অবহেলার ছাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজবাড়িটি। মূল প্রাসাদে রাজার বংশধরেরা বসবাস করেন, সেখানে প্রবেশ নিষেধ। মুঘল ও ব্রিটিশদের মিলিত স্থাপত্যশৈলীতে তৈরী দ্বিতল রাজবাড়ির দেওয়ালে অন্যান্য কারুকার্যের সঙ্গে বাংলারীতির কল্কার কাজও চোখে পড়ে। বাইরে থেকে একনজর দেখলেই বোঝা যায় এককালে প্রাসাদের কি রকম জৌলুশ ছিল।
প্রাসদসংলগ্ন আউটহাউস, পাশাপাশি বাংলার নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহনকারী রাধাকৃষ্ণের কালাচাঁদ মন্দির। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা নবরত্ন মন্দিরটি কেবলমাত্র পূজার সময়েই খোলা হয়। একপাশে শিবমন্দির। উঁচু ভিত্তিভূমির উপর নির্মিত সমতল ছাদের বর্গাকার মন্দিরটির উপরে যেন একটি দ্বিতল শিখরচূড়াকে পৃথকভাবে স্থাপন করা হয়েছে। এই শিখরচূড়া আর বর্গাকার গর্ভগৃহ স্থপতির কেরামতিতে বেদাগ মিলে গেছে। দ্বিতল শিখর সোজা উপর দিকে উঠে যাবার পর চারদিক থেকে বেশ খানিকটা বেঁকে শিখরশীর্ষে একটি মাত্র বিন্দুতে মিলেছে। কোথাও এতটুকু আড়ষ্টতা নেই। কয়েকধাপ সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলেই একটা প্রদক্ষিণপথ। গর্ভগৃহের ভিতরে শিবলিঙ্গ।
এবার আসি ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ির কথা প্রসঙ্গে। ১৫৭৪ খৃষ্টাব্দে মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহ তার রাজপুত সেনাবাহিনী নিয়ে বাংলা অধিকারে আসেন। জঙ্গলখণ্ড নামে পরিচিত এই অঞ্চলের উপজাতি শাসকদের পরাজিত করে দেশে ফিরে যাবার সময়ে মানসিংহ তার অনুগত সেনানায়ক সর্বেশ্বর সিংচৌহান ও তার দাদাকে এই অঞ্চলের অধিকার দান করেন। সর্বেশ্বর সিংচৌহান মল্লদেব উপাধি ধারন করে ঝাড়গ্রামে রাজধানী স্থাপন করেন। সর্বেশ্বর প্রতিষ্ঠিত রাজবংশের আঠারোজন রাজা পরবর্তী চারশো বছর ধরে এখানে রাজত্ব করেছেন। ১৯৩১ সালে সর্বশেষ মল্লরাজা নরসিংহ মল্লদেব মুসলিম ও ইউরোপীয় স্থাপত্য শৈলীর সংমিশ্রনে ঝাড়গ্রাম রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করান। বিরাট সিংদরজা পার হয়ে প্রাসাদে ঢুকলে প্রথমেই ফুলের বাগান। প্রাসাদের সামনে এসে দাঁড়ালে কেমন চেনা চেনা মনে হয়। মনে পড়ে “বাঘবন্দী খেলা’ সিনেমার ভবেশ বাঁড়ুজ্জের বাড়ি। সন্ন্যাসীরাজা চলচিত্রে দেখেছি এই প্রাসাদকে সূর্য কিশোর নাগচৌধুরীর প্রাসাদ হিসাবে। রাজপ্রাসাদ, উপরে উঠবার শ্বেত পাথরের সিঁড়ি সবই যেন বড্ড চেনাচেনা। ভিতরে প্রবেশ করলে দেখা যায় প্রাসাদের পুরানো অংশ। রাজপরিবারের লোকেরা এখনও এখানে বসবাস করেন।
বেলপাহাড়ি না গিয়ে কখনও ঝাড়গ্রাম বেড়ানো সম্পূর্ণ হতে পারেনা। কিন্তু এবারে আর আমাদের হাতে সময় নেই। করোনা পরবর্তী সময়ে সমস্ত ভ্রমণকেই কাটছাট করতে হয়েছে বাধ্য হয়ে। জঙ্গলমহল উৎসবের অজুহাতে ঝাড়গ্রাম ঘুরতে আসা গেছে। যখন ফিরছি তখন মেলাপ্রাঙ্গণে বেশ ভিড়, মাদলের বোলে উৎসবের পরিবেশ। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে জমে উঠছে জঙ্গলমহল উৎসব।
***********
শংকর লাল সরকার
Chinsurah, Hooghly
Pin 712101
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন