অচেনা সময়ের কাব্য : ভাবপ্রকাশের স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল
সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়
কবিতা মানুষের মনের কথা বলে। কবিতার অন্তরে প্রবেশ করা যে সব সময় খুব সহজ হয় তা নয়,কবিতার গভীর
অর্থ
অনেক সময় মনোজগতে এক স্থায়ী ছাপ ফেলে রাখে,যা কখনো সময়ের দৈন্যতার দুঃখও
কিছুটা হলেও হ্রাস করে ভুলিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। তাছাড়া কবিতার ভাষার
মিষ্টতা,শব্দের তুলিলেপন পাঠকদের মনে এক নিবিড়
আবেশের উদয় ঘটায়। 'অচেনা সময়ের কাব্য' কাব্যগ্রন্থটি পড়তে বসে মনের
মধ্যে যেন সেই ভাবনাই সঞ্চারিত হচ্ছে।বইয়ের সামনের ছবিটি অচেনা সময়কে
তুলে ধরেছে,প্রচ্ছদচিত্রে বাড়িগুলোকে চিত্রশিল্পী একটু দূরত্ব রেখেই
এঁকেছেন,প্রচ্ছদে কবির সঙ্গে প্রচ্ছদপটশিল্পীর নামও উল্লিখিত।বইয়ের
ভূমিকাও কবিতা দিয়ে শুরু যেখানে কবিদেরকে নীলকন্ঠ বলা হচ্ছে ,কাল তথা
সমাজের বিষপানে ওনারা জর্জরিত, নিজেরাও ক্রমাগত ক্ষত-বিক্ষত করছেন
নিজেদেরকে,কবিদের সংহার হচ্ছে, তারপরেও আবার তাঁরা জেগে উঠছেন মনের
সৃষ্টি-সুখে সমাজকল্যাণে তাঁদের লেখনীকেই হাতিয়ার করে। প্রথম কবিতা বইএর
কাব্যগ্রন্থের নামে,যেখানে অপরিচিত মুখগুলোর মধ্যেও ফুটে উঠছে মানুষের
এখনকার ক্লেশকর জীবনছবি,
'লাইনে লাইনে ভিড়।
তবু একা সম্বল,
চেষ্টার খোলা কাঁধে
অচেনা মুখের সারি।'
পৃথিবীর এই দু:সময়েও মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক কাজের কোনো শেষ নেই।
কাজ যেন চলতেই থাকে।
একই কবিতায়,
'আজও রাত আটটায়
আজানের চেনা সুর ভাসে।
মানুষ তো একই আছে।
তবু।
অচেনা সময়।
আর কতদিন?'
আমাদের জীবনের এই কঠিন সময়ের প্রতিটা মুহূর্তকে দুঃখের শব্দযাপনে কবিতার
দেহকাঠামো দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা,সমকালকে কবিতার পাতায় পড়তে বসানো এবং
সর্বোপরি মানুষের স্বাভাবিক চেতনার উন্মেষ ঘটানোর এক নিবিড় প্রচেষ্টা
রয়েছে আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি পাতায়। কবিতার নামগুলোও প্রশংসার
দাবি রাখে যেমন,
'তাপ', 'করোনা টেস্ট, 'করোনায়
আক্রান্ত', 'পৃথিবীর অপেক্ষা', 'রিক্ত কুলায়',
'রোজানা','ডাস্টবিন','অর্থনীতির সূত্র' ইত্যাদি। তাছাড়া 'পুঁজি','জরা
','পৃথিবী-গ্রহের ছবি' বর্তমান এই ক্ষয়িষ্ণু সময়েরই কালদর্পণ।
'পৃথিবী-গ্রহের ছবি' কবিতার কিছু লাইন,
'ঈশ্বর নানা বেশে, নানাভাবে
এঁটো-মাখা সমাজের এঁটো মুছে যায়।
ধরণীর ধূলিঝড় আমাদেরই দম্ভের স্ট্যাচু ভাঙে;
অহমিকা ঘরমোছা জলে ধুয়ে যায়।'
আবার,'পুঁজি' কবিতার শুরুতে বলা হয়েছে,
'ভয়।
সে আজ ভীষণ ব্যাধি।
অচেনা ধ্বংসস্তূপে
ভিড় থাকে মন।'
এ তো গেল সময়ের অবসাদ-ধ্বনি।
প্রকৃতি, প্রেম, রাগ, দুঃখ, দ্বন্দ্ব সবকিছুই এই চৌষট্টি পাতার কবিতার বইটিতে উপস্থিত। যেমন 'প্রেম' কবিতায়,
'হঠাৎ দেখা একটুখানি।
দুই একটা ছোট্ট কথা।
এটুকুতেই আমি তুমি,
মুখে নিলাম আলোর সোহাগ।
একলা মনে বৃষ্টি ঝরে।
পাতায় ছুঁয়ে জলের চুমু।
আসুন কথা মন কি বোঝে?
মনের আকাশ বুঝতে পারে
কোন মেঘেতে বৃষ্টি নামে?'
ঠিক
তার পরবর্তী কবিতা 'বিষ'-এ,ঠিক সম্পূর্ণ বিপরীত মনস্তত্ত্ব। আবার 'মাটির
টানে','চাঁদ নেমেছে','বৃষ্টি-ছোঁয়া','পর্বত- প্রান্তরের ডাক' প্রভৃতি
কবিতায় ফুটে উঠেছে নিসর্গের অনাবিল আনন্দ। প্রকৃতির টানে গৃহবন্দি জীবনের
বাইরের মুক্ত আকাশে মুক্তির স্বাদ নেওয়ার এক অমোঘ আহ্বান। তাই তো 'জলের
ছোঁয়া' কবিতায় স্পষ্টতঃই উল্লেখ্য,
'এখনো জল পড়ছে অবিরত।
ঘর ভিজছে বৃষ্টি জলের ছাঁটে।
মনটা ধরে বদ্ধ ঘরে রাখা;
ক্লান্ত জীবন সবার অন্তরীনে।
একটু যদি বাইরে যাওয়া যেতো,
পেতাম তবু জলের আলতো ছোঁয়া।
জলের তো নেই ছোঁয়াছুঁয়ির বেড়া।
বৃষ্টি সাথে হঠাৎ করে ঝাঁপায়।
তোমার মত বাইক চড়েই আসা;'
কবিতার
বিষয়বিন্যাসগুলো আমার কাছে যথেষ্ট মনোগ্রাহী লেগেছে। ঠিক যেন আকাশের কালো
মেঘে বৃষ্টি ফোঁটার পরে এক ফালি রোদের মিঠে হাসি।কবিতাগুলি পরস্পর একটির
সঙ্গে অন্যটি বিষয়বস্তুর দিক থেকে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত না হয়েও কবিতার
স্বরমালিকা গঠন করতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সামগ্রিক
চিন্তায় রবীন্দ্রমনস্কতা সবসময়ের সঙ্গী। রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে আমাদের
কিছু ভেবে ওঠা সম্ভব হয় না। অচেনা সময়ের কবিতার ভাবনায়ও তাই কবিযাপন উঠে
এসেছে 'আমার রবীন্দ্রনাথ' এবং 'গীতবিতান' কবিতায়।
'সারাদিনের অনেক কাজের পরে
বদ্ধ যখন ক্লান্ত শরীর মাথা,'
সেই সময় যেন রবীন্দ্রসঙ্গীত ফুলের মত মনোকাননে শোভা পায়,তাই
'সুরগুলো সব ছবির মতো ভাসে,
কথা বলে গানের বইয়ের পাতা।'
এরই
পাশাপাশি খেলার প্রেক্ষাপটে উইকেট-রক্ষক ক্রিকেটার অধিনায়ক ধোনির দৃপ্ততা
আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের 'ধোনি' কবিতায় উঠে আসে,এ হয়তো তাঁর অবসরকালীন সময়ের
কথা মাথায় রেখেই এই বইয়ে রাখা।
'কঠিন
প্রশ্নপত্র','ছবি-আঁকা' শব্দের রং তুলি দিয়ে সমাজ এবং প্রকৃতির ভুলে
যাওয়া চেহারাকে নতুন করে দেখবার এক উদ্যমী প্রচেষ্টা। 'ছবি আঁকা' কবিতার
শুরু হয়েছে এইভাবে,
'প্রমিতারা বেশ আঁকে ছবিটা।
মনেতেই রং-তুলি সাজানো।
প্রকৃতির জলছবি যেখানে,
সেই ঘরে হৃদয়টা বসানো।
ছোট ছোট কুড়ি-মন ফুটছে।
একদিন ফুল হয়ে উঠবে।
যেমনি সে ঘুমানো তো রোজ-রাত;
রাত শেষে রবি ভোরে উঠবেই।'
এ
তো নিরাশার নিকষ-কালো অন্ধকার থেকে আলোর দিশা খোঁজার এক কঠিন প্রচেষ্টা।
সত্যিই রাত শেষে রবি ভরে উঠবে কিনা জানা নেই। যেটা জানা আছে,যে
দীর্ঘকালীন পরিশ্রমের দ্বারা অর্জিত দক্ষতার ফসলে ভালোবাসার ধানক্ষেত
নিশ্চয়ই একদিন সবুজের প্লাবনে ভরে উঠবে। প্রকৃতি আবার ফুল্লকুসুমিত
সুজলা-সুফলা রূপ নিয়ে দু:খময় কঠিন কালকে অতিক্রান্ত করবে।'অচেনা সময়ের
কাব্য'ও চিরস্থায়ী আসনলাভ করবে পাঠককুলে।
পাঠ্য
প্রতিক্রিয়া লিখতে গিয়ে যেন আরো কিছু কথা বাকি থেকে যায়। ভাবনার
অন্তঃস্থলে ঢুকে সবটুকু সঠিকভাবে অনুধাবন করে ওঠা কোন পাঠকের পক্ষেই মনে হয়
না খুব একটা সহজতর। সেইটা হয়তো বিদগ্ধ ব্যক্তিরাই পারেন। তবু কোন কোন
কবিতার বেশ কিছু লাইন যেন মনের মধ্যে সত্যিই দাগ রেখে যায়। আসলে এখন
একাকীত্বের বিরক্তি যেন মানুষকে আরো উদ্ভ্রান্ত করে তুলেছে,
'কেউ কারো সাথে
নাই বলে কথা,
মনেতে চেপে
নিজ মনোব্যথা।'
তবুও এরই মাঝে যেন আশাবাদের দূরাগত সুবাস,
'শান্ত প্রকৃতি, পান্থ সুগীতি;
সুর ভেসে আসে কানে।'(পথ চলা)
বইএর
শুরুর ভূমিকাতেও যেভাবে বলা হয়েছে, কবি যেন বারবার আশাহত হয়েও আবার তিনি
নিজেই আশা নিয়ে সবাইকে বাঁচাতে চেষ্টা করেন এবং নিজেও বাঁচেন।আর তাই আমরা
পাঠকেরাও বেঁচে থাকি সমস্ত দুঃখ দুর্দশার মধ্যেও তা কাটিয়ে ওঠার এক
নিরন্তর প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে।
আসলে
বইয়ের আলোচনা করতে বসে কবিতার নান্দনিক দিকগুলো পাঠকের মনের খুব কাছাকাছি
চলে আসে। তাই তখন লিখেই যেতে ইচ্ছে করে,সময়ও যেন থেমে থাকে ক্ষণকালের
তরে।বইএর অন্যান্য কবিতাগুলোর নিজস্ব দীপ্তির পাশে কয়েকটি গদ্যকবিতা
আছে,সেইগুলো সত্যিই বেশ ভালো লাগবার মতো।আপনার মনকে নাড়া দেবেই।
বইয়ের শেষের দিকে 'গণেশ পুজো' কবিতাটি যেন ঈশ্বরেরই আবাহন। খুব ভালো লাগলো 'টান' বলে আরেকটা কবিতা সেখানে বলা রয়েছে,
'সময় কঠিন বলে,
চিন্তাটা বেশি বেশি হয়।
ভালোবাসাটাই ফেরে
অবচেতনের রঙে,
আকাশেতে ঘুরে দেখা
ড্রোন হয়ে খোঁজ নেয়
লকডাউনের ঘরে,
চেনা মানুষের ভিড়ে।'
আসলে
মানুষের সহমর্মিতা, মনের যোগাযোগ, সহযোগিতা আজকে যেন আরো বেশি করে দরকার।
তাই কবিতাতেও যেন সেই ভাবনাই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বারবার। অনন্যসাধারণ লেখা 'পথ চলা','এপার ওপার'।
সুন্দর লাইন,
'এ পারেতে আমার বাড়ি।
তাইতো জীবন ওপার চলা।
দায়িত্ব তার নেই কোন মাফ।
দায়ভার-ভর দু-পাল্লাতেই।'
এইভাবে জীবনের রোজকার পথ চলার আশা-আকাঙ্ক্ষা,অস্তিত্ব
সবটুকুই যেন উদীয়মান কবি,রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুসারী, পেশায় শিক্ষক অমিতাভের
সরকারের নিজস্ব ভাবনার সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে সমকালকে নতুনভাবে প্রতিভাত করে
তুলেছে। সামান্য কিছু বানান, যতিচিহ্নের ত্রুটি থাকলেও কবিতার উৎকর্ষতার
কাছে সেইটা তেমন কিছু অসুবিধের মনে হয় নি।
কবির
কলম চলতে থাকুক। আশা করি,আলোচ্য বইএর কবিতাগুলি সমস্ত ধরনের পাঠকদের
কমবেশি খুব ভালোই লাগবে। কবিতাগুলোর ভাষা খুব সহজ এবং সাবলীল। তবে কেউ যদি
দ্রুত পড়ে ফেলার চেষ্টা করবেন বলে মনে করে থাকেন,তবে তা হওয়ার নয়।বইটি
দেখতে আকারে ছোট হলেও বাহান্নটি কবিতার এই সংকলন আপনাকে কবিতার রস
আস্বাদনে মুগ্ধ করতে থাকবে,কবিতাগুলো, যতই আরও বারংবার পড়বেন।
কাব্যগ্রন্থঃ অচেনা সময়ের কাব্য,অমিতাভ সরকার
প্রকাশকঃ
ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, ৯ শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০৭৩।প্রচ্ছদশিল্পী শ্রী শঙ্খজিৎ জানা।মূল্য ৫০ টাকা
--------------------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন