Featured Post
করোনাকাল ও ভারতে কৃষিসংস্কার ।। রণেশ রায়
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
ভূমিকা:
করনার আক্রমণের এক বছর সমাপ্তি। এই এক বছরে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। অর্থনীতি তলানিতে। বাজারে ইতিমধ্যে এই রোগ প্রতিষেধক টিকা এসেছে। তার কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় যায় নি। এমনকি ডাক্তার বা স্বাস্থ্য সেবায় যুক্ত মানুষজনও এই টিকা নিতে ভরসা পাচ্ছে না। সরকারি হিসেবে বরাদ্দের অন্তর্ভুক্ত মানুষজনের ৫০ শতাংশ মানুষও টিকা নিতে আসছে না বলে খবর। মানুষ বিভ্রান্ত।হয়তো টিকা গ্রহণকে বাধ্যতমূলক করা হবে বাজার ধরার স্বার্থে। সংক্রমণের হার ভারতের মত দেশে কমে চলেছে। মৃত্যুহার নেহাতই নগণ্য। তাও আতংক যায় নি। এরই মধ্যে টিকা উৎপাদনকারী দেশ ও উৎপাদন সংস্থাগুলোর মধ্যে অশুভ প্রতিযোগিতা কে কত বাজার পাবে তার। একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনের কুৎসা। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত। এরই মধ্যে বিশ্বায়ানের কর্মসূচির প্রকল্পে থাকা বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি অবলীলায় গৃহীত হয়ে চলেছে। ভারত তার বাইরে নয়। এই কর্মসূচির বিরোধিতা করলেই কাউকে দেশদ্রোহী সন্ত্রাসবাদী তখমায় ভূষিত করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক কৃষি সংস্কার এর অন্তর্ভুক্ত যার ওপর আমরা আজকের আর্থ সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে আলোচনা করব। এর জন্য কৃষি সংস্কারের পশ্চাদপটটা জেনে নেওয়া দরকার।
কৃষির উন্নতির জন্য ঔপনিবেশিকোত্তর ভারতে ভূমিসংস্কারকে সামনে রেখে আত্মনির্ভর ও সাম্যের প্রশ্নকে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনার অর্থনীতিকে হাতিয়ার করে উন্নয়নের পথে এগোবার কথা বলা হয়। প্রথম প্রায় চল্লিশ বছর নিয়ন্ত্রণের অর্থনীতি চালু রাখা হয়। তারপর ১৯৯১ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বায়নের নীতি অনুসরণ করার তাগিদ। কংগ্রেসের জমানাতেই নতুন আর্থিক নীতি চালু করা হয়। বাজার অর্থনীতিকে অর্থনীতির উন্নয়নের চালিকা শক্তি বলে গ্রহণ করা হয়। বিশ্বায়ন বেসরকারিকরণ ও উদারীকরণের তাগিদে সংস্কার নীতি গ্রহণ করা হতে থাকে একের পর এক। কংগ্রেস আমলে ধীর গতিতে আর গত সাত আট বছর ধরে মোদীর জমানায় দ্রুত তালে। তারই সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বর্তমানের কৃষি সংস্কার নীতি চালু হয়। সংস্কার সম্পর্কে ধারণাটাতেই বদল আসে। আগে রাষ্ট্রের ভূমিকা বজায় রেখে অন্তত মুখে অর্থনৈতিক সাম্য বজায় রেখে উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে সংস্কারের কথা বলা হত। পরিকল্পনার অর্থনীতি ছিল এ ধরণের উন্নতির হাতিয়ার। বাজার অর্থনীতি অবাধ ছিল না। শিল্প নীতি ফেরা আইন চালু ছিল। বিদেশি পুঁজির অবাধ প্রবেশ স্বীকৃত ছিল না। আজ এর ঠিক বিপরীতটাই সরকারি নীতি যার প্রতিভূ কর্পোরেট দুনিয়া। পরিকল্পনার অর্থিনীকে বিদায় করে বাজার অর্থনীতিকে অবাধ করে দেওয়া বিদেশি পুঁজির অবাধ অনুপ্রবেশ কৃষি শিল্প সেবা সব বেসরকারিকরণ কর্পোরেটের কর্তৃত্ব স্থাপনই হল সংস্কার কর্মসূচি।আমরা এই প্রেক্ষাপটে আজের করোনা কালে কৃষি সংস্কারের ওপর আলোচনা করব। তার আগে অর্থনীতিতে কাঠামোগত ভাবে কৃষির অবস্থানটা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করব। উল্লেখযোগ্য যে অর্থনীতির একটা নিদৃষ্ট কাঠামোর মধ্যে সংস্কারের কাজকে সাফল্য মণ্ডিত করতে হয়। তাই সংস্কার আলোচনায় অর্থনীতির কাঠামোর স্বরূপটা জেনে নেওয়া দরকার।
ভারতে কৃষি কাঠামোর প্রেক্ষাপটে কৃষি সংস্কার :
প্রায় ৩৩ হাজার বর্গ কিমি বিস্তৃত অঞ্চল নিয়ে ভারত রাষ্ট্র অর্থাৎ ভারতের প্রশাসনিক পরিধি। এর মধ্যে ১৬ লক্ষ বর্গ জমিতে চাষবাস হয় যাকে কৃষি এলাকা বলা হয়। অর্থাৎ ফসল ফলে এমন এলাকা দেশের অর্ধেক অঞ্চল। ডাল চাল বজরা ভুট্টা প্রভৃতি বিভিন্ন ধরণের দানা শস্য আখ পাট চা ও বিভিন্ন ধরণের ফল সবজি উৎপাদন হয় এই বিস্তৃত অঞ্চলে। সুতরা আমরা ওপরে জাতীয় আয়ে কৃষির যে অবদানের কথা বলেছি তার থেকেও বাস্তবে ভারতে কৃষির অবদান অনেক বেশি বলে দেখি যদি কৃষি অঞ্চলের বিস্তৃতি তাতে ফলা ফসল ধরে বিষয়টা বিবেচনা করি। এর সঙ্গে আছে ব্যাপক মানুষ তার জীবিকার প্রশ্ন যা সামগ্রিক অর্থনীতিকে বেষ্টন করে আছে, যার গুরুত্ব ভারতের আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় সর্বাধিক।জীবিকা হিসেবে কৃষির গুরুত্বের কথা আমরা বলেছি। সব দিক বিবেচনা করে বলা চলে কৃষি ভারতের অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একক বিভাগ। কৃষির অভ্যন্তরের বিভিন্ন বিষয় যা কৃষি কাজে সাহায্য করে যেমন জমির মালিকানা ধরণ উৎপাদনের ধরণ তার বাজারিকরণ বাজার সম্পর্ক কৃষিপ্রযুক্তি এ সব এবং এদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক কৃষিকাঠামোর ধরণ বুঝতে সাহায্য করে। কৃষি সংস্কার এই কৃষি কাঠামোর ধরণটা বদলাতে সাহায্য করে। তাই আজকের সংস্কার কর্মসূচিকে বুঝতে কৃষি কাঠামোটা বুঝে নিতে হয়।
বিভিন্ন স্তরের কৃষকরা কে কতটা চাষ জমির মালিক সেটা আমরা তুলে ধরতে পারি কৃষি কাঠামোয় জমির মালিকনা আর বৈষম্যের ধরণটা ধরে। পুঁজি বিকাশের বিষয়টা তুলে ধরে কৃষিতে পুঁজি গঠন কিভাবে কৃষি উন্নতিতে সাহায্য করে কৃষি কাঠামো বদলে সাহায্য করে সেটা জানা দরকার।। কৃষি সংস্কারে কোন সম্প্রদায় কিভাবে প্রভাবিত হতে পারে তা মালিকনার ধরণের ওপর নির্ভর করে। উৎপাদনের ধরণ তার বাজারিকরণের বিষয়টাও এর সঙ্গে জড়িত। এছাড়া আছে ঋণ ব্যবস্থা প্রযুক্তির দিকটা। কৃষি বিভাগে কৃষি কাঠামোর এই বিষয়গুলো পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থেকে ক্রিয়া করে, কৃষি উন্নতিতে সাহায্য করে। কৃষি কাঠামোতে বদল আনে। যদি সঠিক নির্দ্দেশে সঠিকভাবে বিষয়গুলোকে কাজে লাগানো না যায় তবে কৃষি উন্নতি সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে কৃষি সংস্কার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সঠিক কৃষি সংস্কার বলতে কি বুঝি সেটা নিয়ে পরিষ্কার থাকা দরকার। আমরা সংক্ষেপে বিষয়টা তুলে ধরে এই করোনা কালে দেশের অর্থনৈতিক সংকটকালে যে কৃষি সংস্কারের কাজ চলছে আর তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দানা বেঁধেছে সেটা তুলে ধরব।
২০১৮ সালে সরকার প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় যে ভারতে মত কৃষিজমির ২৯ শতাংশের মালিক ৪.৩৩ শতাংশ মাঝারি ও ধনী কৃষকের মালিকনায় যেখানে ৮৭ শতাংশ প্রান্তিক আর খুদে কৃষক ৪৭.৩৫ শতাংশ জমির মালিক। যদি মাঝের আর আধা মাঝারি কৃষককে একটা আলাদা গোষ্ঠী বলে বিবেচনা করলে দেখা যায় মত কৃষকুলের এই ১৩.২১ শতাংশ মানুষের হাতে আছে মত কৃষি জমির ৪৩.৬১ শতাংশ যারা ২ থেকে ১০ হেক্টর জমির মালিক। ভারতে কৃষি জনসংখ্যার ১৩.৭৮ শতাংশ ধোনি ও অতি ধোনিকদের হাতে আছে ৫২.৬৫ শতাংশ জমি।জমি মালিকনার এই বৈষম্যটা স্বাধীনতার ৭০ বছরে বিভিন্ন রাজ্যে ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে জমির উর্ধসীমা ঠিক করা সত্ত্বেও কারণ কিছু রাজ্যে ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে মালিকনা নিয়ন্ত্রণ নীতি কার্যকরী হয় নি। সেজন্য মালিকনার ধরণের দিক থেকে রাজ্যে রাজ্যে ফারাক অনেক। এই দিক থেকে বিষয়টি আজকের ভূমিসংস্কারের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ন বলে আমরা দেখব। বিভিন্ন রাজ্যের কৃষকদের স্বার্থের ধরণটাও ভিন্ন। তাই এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজ্যে আন্দোলনের তীব্রতা ভিন্ন। প্রসঙ্গটায় আমরা পরে আসব।
স্বাধীনতার পর কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকাকালীন কৃষিতে জমির মালিকনায় সমতা এনে গরিবকৃষককুলকে উন্নতির সামিল করে শিল্পায়নের মাধ্যমের আত্মনির্ভর উন্নতির কথা বলা হয়। রাজ্যসরকারগুলোকে কৃষি উন্নতিতে সামিল করার জন্য যে ভুমি সংস্কার নীতি গ্রহণ করা হয় তা কার্যকরী করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। জমির উর্ধসীমা স্থির করা তখন ভূমিসংস্কারের প্রধান দিক ছিল।সরকার প্রচারিত নীতি অনুযায়ী সেই দিক থেকে সংস্কারের উদ্দেশ্য তখন শুধু উৎপাদন বৃদ্ধি ছিল না, বৈষম্য স্থাপন করে উন্নতির কথা বলা হত। অর্থনীতিতে নিয়ন্ত্রণের নীতি চালু ছিল। অর্থনীতির সম্প্রসারণ আর উন্নয়নের ধারণার মধ্যে পার্থক্যটা বিচার করা হত। বাম রাজত্বকালে সামগ্রিক ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যে ভূমিহীন চাষীর হাতে জমি দেওয়ার নীতি গ্রহণ করা হয়। ন্যায্য দাম নীতি বাজার কাঠামোয় সংস্কার আনার জন্য সরকারের নেত্রীত্বে মন্ডি ব্যবস্থা চালু হয়। সমবায় চাষ নীতি গ্রহণ করা হয়। অর্থাৎ কৃষক সুরক্ষার দিকটা অন্তত কাগজে কলমে গুরুত্ব পায়। অবশ্য এসবে একটা বিরাট কিছু হয়েছে তা নয়। জমি বন্টনের সঙ্গে সমবায় সেচ ঋণ বাজারিকরণ এর কর্মসূচী তেমন কার্যকরী না হওয়ায় ভূমিসংস্কারের কাজ অসম্পূর্ণ থাকে কৃষিকে শিল্পের ভিত্তি হিসেবে গড়ে তোলা যায় না। তবে তখন উন্নতির কাজে সমবন্টন গরিব মানুষের অধিকার টা স্বীকৃতি পায়। আজ সংস্কারের সেই ধারণাটাকেই বদলে দেওয়া হয়েছে। বেসরকারিকরন ঘটিয়ে মালিকনা অধিকারকে অবাধ করে দিয়ে কর্পোরেট ধাঁচে কৃষিকে বাজার কাঠামোয় গড়ে তুলতে যে আইনি ব্যবস্থা চালু করা হয় তাকে সংস্কার বলা হচ্ছে। রাষ্ট্রের এই নীতিগত দিকতার প্রেক্ষাপটে বর্তমানের কৃষিসংস্কারকে বুঝতে হয়। বাজারিকরণ ঋণ ব্যবস্থায় বেসরকারি সংস্থাকে চুক্তিচাষের মাধ্যমে স্বীকৃতি দেওয়া কর্পোরেট সংস্থার কৃষিপণ্যের সুযোগ করে দেওয়া বিদেশি পুঁজির স্বীকৃতি এ সবই সংস্কার কাজের অঙ্গীভূত করা হয়। অর্থাৎ বেসরকারিকরণ উদারিকরণ বিশ্বায়ন নীতির সঙ্গে এই সংস্কার নীতি যুক্ত যা আজ আন্তর্জাতিকভাবে প্রধানয়কামী দেশের ইচ্ছাজাত কারণ তাদের দেশের কর্পোরেট জগৎকে ভারতের কৃষিব্যবস্থায় কর্তৃত্ব কায়েমের সুযোগ করে দেওয়াই ভারতের মত দেশগুলোতে রাষ্ট্রের কর্মসূচি। এই প্রেক্ষাপটে আমরা কৃষি সংস্কার ও তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বিষয়টায় আসব। আর সরকার আজের করোনা আক্রমণের মধ্যে এ কাজে বিশেষ তৎপর বলে করোনা কালকের অর্থনীতির তৎপর্যের দিক থেকে বুঝে নেবার চেষ্টা করব।
করোনাকাল নিয়ে কিছু কথা:
কৃষি সংস্কার ও সাম্প্রতিক কৃষি বিল :
আজ পৃথিবী শুদ্ধ কর্পোরেট দুনিয়া ব্যবসায় নেমেছে। আর শাকসবজি থেকে সব ধরণের কৃষি পণ্য ব্যবসায়ে এরা বেশি লাভের গন্ধ পেয়েছে। কিন্তু ভারতে কৃষি ব্যবসায় বড় বড় জমির মালিকরা এতদিন কর্তৃত্ব করেছে বিশেষ করে সেসব জায়গায় যেখানে ভূমিসংস্কার সেভাবে কার্যকরী হয় নি। এখন নতুন আইন শহরের শিল্পপতিদের প্রবেশের সুযোগ অবাধ করে দেওয়ার ফলে পণ্যের বাজারিকরণে কৃষি জমি কেনা বেঁচায় কর্পোরেট দুনিয়া সুবিধা পাওয়ায় আর এদের পেছনে কেন্দ্রীয় সরকার থাকায় এতদিনকার সুবিধে পাওয়া বড় জমির মালিকরা সিঁদুরে মেঘ দেখছে। তাই শহর আর গ্রামের মালিকসম্রদায়ের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত। শহরের কর্পোরেট মালিকদের সঙ্গে বিদেশি কর্পোরেট জগৎ যুক্ত যারা ই কমার্স ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। ই-কমার্স এর সাহায্যে পৃথিবীর বড় বড় কর্পোরেট সংস্থা আজ খুব বড় আকারে কৃষি পণ্য নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছে। বিমুদ্রাকরণ কাল থেকে আজ করোনা কালে তাই ডিজিটাইজেশনের শ্লোগান যার সুবিধে পায় কর্পোরেট সেক্টর। আর সব বন্ধ থাকার সুযোগ নিয়ে মানুষ জনকে সামাজিক দূরত্বের দাবাই দিয়ে সংস্কারের রম রমা সারা পৃথিবী সুদ্ধ। সেই জন্যই করোনা আতংক সৃষ্টিতে এদের আগ্রহ। করোনা সমস্যা নয় তা বলছি না। তবে এ নিয়ে আতংক তৈরি করা হয়েছে সেটা পৃথিবীতে অনেকেই মনে করছে। আজকের দুনিয়ার ব্যবসা প্রযুক্তির কারণে শিল্পের ধরণে যে বদল এসেছে যার সুযোগ পাচ্ছে কর্পোরেট দুনিয়া সেটার সঙ্গে ব্যাপারটা ওতপ্রোতভাবে যুক্ত বলে আমার ধারণা। এদিকে একসময় বামপন্থী ভাবনাকে সামনে রেখে কৃষিতে যে ভূমি সংস্কার হয়েছে তাতে ছোট মালিকের হাতে জমি গেলেও তাকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে গেলে সমবায় কৃষি সেচ বাজার ঋণ এ সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন আনা দরকার ছিল তা আনা হয় নি। মধ্যসত্বা ভোগীদের দৌরাত্ব কমে নি। ছোট ও প্রান্তিক কৃষকরা উৎপাদন করলেও তারা সুবিধে পায় নি। তাদের সমস্যা মেটে নি। শেষ বিচারে আজের ধনী কৃষকদের নেতৃত্বে থাকা আন্দোলনকারীরা তাদের দিকে কতটা তাকাবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আবার নতুন কৃষি নীতি কর্পোরেট দুনিয়াকে ঢুকিয়ে নতুন এক মধ্যসত্তা ভোগী সৃষ্টি করবে। আজের ই-কমার্স এ B2B ব্যবসায় সেটা পরিষ্কার হচ্ছে। প্রারম্ভিক (start up) কোম্পানিগুলো অনেক গুলোই মধ্যসত্বাভোগী B2B ব্যবসায়ী। এখানেও প্রান্তিক কৃষকদের বিপদ। কর্পোরেট দুনিয়া ব্যবসায় নেমেছে মানে উৎপাদন থেকে ব্যবসার দিকে নজর বেশি দিয়েছে বোঝাচ্ছি। আর উৎপাদনের ধরণ বদলেছে। চুক্তি ভিত্তিক ছোট উৎপাদনকারীদের দিয়ে উৎপাদন করিয়ে ব্র্যান্ড মেরে কর্পোরেট সংস্থা ব্যবসায় নজর দিয়েছে।
ভূমি সংস্কারের পর কৃষিকে ঢেলে সাজিয়ে তার ওপর দাঁড়িয়ে যে শিল্পায়ন সেটাই অস্বীকৃত হয়েছে কংগ্রেস বাম জমানায়। বর্তমান তারই ধারাবাহিকতা পশ্চিম বঙ্গে। আর কেন্দ্র কর্পোরেট স্বার্থের প্রতিভূ বিদেশি শক্তির ছাতার তলায়। ভূমি সংস্কারকে একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় আর যথেষ্ট শর্ত বলে বিবেচনা করা হয়েছে এতদিন। আর কেন্দ্র এখন ন্যূনতম ভূমিসংস্কার বা শ্রম আইনের বিরোধী এক উগ্র দক্ষিণপন্থী পথের পথিক। ফলে শিল্প উন্নতিও ব্যাহত হয়েছে কারণ এই কৃষি কাঠামোতে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। কৃষি আমাদের ভিত্তি কথার কথা থেকে যায়। আর বিদেশি অর্থনীতির স্বার্থে দেশীয় স্বার্থ বিকিয়ে দেওয়া হয়েছে। আত্মনির্ভর অর্থনীতি গড়ে উঠতে পারে নি। আজের এশিয়া আফ্রিকার দেশগুলোতে যেখানে বিদেশি আগ্রাসন অর্থনীতিতে সেখানে কোন দেশই 70 বছরেও স্বনির্ভর হতে পারে নি। উচ্চ বিত্তদের ওপর নির্ভর করে স্বনির্ভর অর্থনীতি বিদেশি ছাতার তলে থেকে সম্ভব বলে আমার মনে হয় না।
দু'হাজার কুড়ি সালে সেপ্টেম্বরে তিনটি বিলের মাধ্যমে সরকারের কৃষি সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় যা নিয়ে বিরোধীদের বিরোধিতায় পার্লামেন্ট উত্তাল হয়ে ওঠে। বিল তিনটের একত্রে নাম Farm Bills 2020, Provisions and Opposition। উদারিকরণ বেসরকারিকরণ ও বিশ্বায়নের নীতি অনুসরণ করেই এই কৃষি সংস্কার অনুসৃত হয়। তাই একে মোদির একার বিষয় বলে মনে করার কারণ নেই। ১৯৯১ সালের নতুন আর্থিক নীতি অনুসৃত হওয়ার সময় এটা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল কারন সেই নীতিটিতেই সরকার এ ব্যাপারে দায় বদ্ধ হয়ে পড়েছিল। বিষয়টা ছিল সময়ের অপেক্ষায়। তাই বিরোধীদের এই বিরোধিতায় কতটা আন্তরিকতা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। তবে আজ যারা বিরোধী তারা তাদের আমলে নীতি নির্ধারণে ততটা আগ্রাসী হতে পারে নি কারণ তারা জানত এরকম একটা বিল ভারতের আর্থিক কাঠামোয় কৃষি কুলের তরফ থেকে একটা বিরোধিতা আসবেই। আর আজ মোদি সরকার সেই তুলনায় অনেক আগ্রাসী।আন্তর্জাতিক স্তরে মোদি কর্পোরেট দুনিয়ার কাছে নীতির দিক থেকে অনেক বেশি দায়বদ্ধ তাই সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ অনেক বেশি আগ্রাসী। আজকে ভারতজুড়ে এই বিলের বিরুদ্ধে কৃষি আন্দোলন ও তার প্রতি সরকারের অনমনীয় মনোভাব সেই ইঙ্গিতই বহন করে। এই প্রেক্ষাপটে এই বিল কি বলে কেন এর বিরোধিতা সেটাই আমাদের আলোচনার মূল বিষয়। উল্লেখযোগ্য যে এই ধরণের বিল পাশ করা হয় বিলের অন্তর্বস্তু যা তা প্রয়োজনমত ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করে এর পক্ষে অনেক ভালো ভালো কথা বলে আপাতভাবে যা বিলটাকে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। আজ যারা বিদেশি পুঁজির অবাধ প্রবেশ ও বেসরকারিকরণের বিরোধিতা করছেন তারাও ১৯৯১ সালে নতুন আর্থিক নীতি চালু করার সময় একই কথা বলেছিল। তাই নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে গেলে আমাদের বিলের অন্তর্বস্তু বুঝে নিতে হয়। ওপরের তিনটি বিল কি বলে তা আমরা এক এক করে আলোচনা করতে পারি।
প্রথম বিলটি কৃষি পণ্যের বাজার সংক্রান্ত।. এই বিলটি উৎপাদন ব্যবসা ও বাণিজ্য (প্রচার ও সুবিধাদি) বিল, ২০২০ নামে গৃহীত হয়। বিলে বলা হয়েছে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজার কমিটির অধীনে নিবন্ধিত কৃষিমণ্ডির বাইরে নিজেদের ইচ্ছে মত বিক্রি করতে পারবেন।অর্থাৎ কৃষিবাজারিকরণের ওপর নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হবে। এতে আশা করা যায় কৃষিবাজার উন্মুক্ত হবে। বাজারে নিজের সুবিধামত ভালো দামে কৃষি পণ্য বিক্রি করতে পারবে কৃষকরা। তার উৎপাদনে উৎসাহ বাড়বে। কৃষক অঞ্চলের মধ্যে কেনাবেচায় আটকে থাকবে না। তার ব্যবসার পরিধি রাজ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। দেশ থেকে দেশান্তরে কৃষি বাণিজ্য বাধামুক্ত হবে। এতে কৃষকের ব্যবসার চিন্তা ভাবনা প্রসারিত হবে। তার আন্তর্জাতিকরণ ঘটবে বলে নীতি নির্ধারকদের দাবি। এই ফসল বিক্রির জন্য কৃষককে ই-কমার্সের মাধ্যমে কেনাবেচার সুযোগ করে দেওয়া হবে। অর্থাৎ কৃষি ব্যবসাকে ডিজিটাইজেশন করা হবে যেটা আজকের রাষ্ট্রীয় নীতি। কর্পোরেট দুনিয়ার স্বার্থ বজায় রাখা বাজার অর্থনীতিকে বিমুদ্রাকরণ করার মাধ্যমে। যেটা কালো বাজার অবসানের কথা বলে কিছুদিন আগে করার প্রথম পদক্ষেপ ছিল।হয়েছে। অর্থাৎ বেসরকারিকরণ বিমুদ্রাকরণ ই-কমার্সের মাধ্যমে ব্যবসা বাজারিকরণ বাণিজ্যিকরণের বৃহত্তর কর্মসূচির অংশ এটা। পরে এর ওপর বিশ্লেষণে আসব।
দ্বিতীয় বিলটি চুক্তিভিত্তিক চাষ সংক্রান্ত। এর নাম কৃষকদের (ক্ষমতায়ন এবং সুরক্ষা) মূল্য আশ্বাস এবং খামার পরিষেবার চুক্তির বিল, ২০২০।এই বিলে কৃষকদের অগ্রিম চুক্তিতে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বলা হয় যে কৃষকরা কৃষি বাণিজ্য সংস্থা প্রক্রিয়াকরণ সংস্থা হোল জেলার খুচরো ব্যবসায়ী রপ্তানি সংস্থা এমনকি বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থার সঙ্গে অগ্রিম চুক্তিতে চুক্তিবদ্ধ হতে পারবেন। যুক্তি দেখান হয় যে এর ফলে ছোট ও প্রান্তিক চাষিরা উপকৃত হবে কারণ এতে বাজারের ঝুঁকি থেকে কৃষকরা মুক্তি পাবে। ভারতে ৮৬ শতাংশ কৃষকই ছোট ও প্রান্তিক কৃষক। অগ্রিম চ্যুক্তি দামের নিশ্চয়তা দেবে। ঝুঁকি স্থানান্তরিত হবে ক্রেতার ঘরে অর্থাৎ ব্যবসায়ীর ঘরে। মধ্যসত্তাভোগীদের দৌরাত্ম দূর হবে বলে মনে করা হয়।আমরা এই যুক্তির সারবত্তা আলোচনা করব আমাদের বক্তব্যে।
তৃতীয় বিলটির নাম অত্যাবশ্যক পণ্য (সংশোধনী) বিল, ২০২০। এই বিলে খাদ্যশস্য ডাল শস্য তৈলবীজ পেঁয়াজ আলু জাতীয় ফসলকে আর অত্যাবশ্যকীয় ফসলের আওতায় রাখা হবে না বলে বিধান দেওয়া হয়। জরুরি ব্যবস্থা বজায় না থাকলে এই জাতীয় পণ্যের মজুত কোন উর্ধসীমা থাকবে না বলে বলা হয়। এর পক্ষে যুক্তি দেখানো হয় যে এই ব্যবস্থায় বিনিয়োগকারীদের কৃষিতে বিনিয়োগে উৎসাহ বাড়বে কারণ কৃষি পণ্য নিয়ে ব্যবসার ওপর অহেতুক নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তাদের ব্যবসার স্বার্থ রক্ষিত হবে। কৃষকরাও খোলা বাজারের সুযোগ পাবে। দেশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়বে। কৃষিতে পুঁজি স্বল্পতার সীমাবদ্ধতা দূর হবে। ব্যবসার স্বার্থে বেসরকারি উদ্যোগে বাজার পরিকাঠামো গড়ে উঠবে বলে যুক্তি দেখান হয়। পণ্য সংরক্ষণের জন্য মজুতঘর তৈরি করবে ব্যবসায়ী কর্পোরেট দুনিয়া। দামে স্থিতি আসবে যার সুযোগ পাবে কৃষকরা। তাদের অভাবী বিক্রির ফাঁদে পড়তে হবে না।
কৃষি সংস্কারকে সামনে রেখে যে তিনটি বিল আনা হয়েছে ভারতের অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে তা বিশেষ তাৎপর্য পূর্ণ। এটা নেহাত কৃষি সংস্করের প্রশ্ন নয় ভারতের অর্থনীতির সামগ্রিক পুনর্গঠনের প্রশ্ন যার সঙ্গে যুক্ত উদারিকরণ বেসরকারিকরণ আর বিশ্বায়ন। এক কথায় বাজার অর্থনীতি চালু করে কর্পোরেট রাজ প্রতিষ্ঠিত করা। আর এই কর্পোরেট রাজে থাকবে আন্তর্জাতিক স্তরের দেশি বিদেশি পুঁজিপতিদের কর্তৃত্ব। কৃষিতে তাদের অবাধ কর্তৃত্ব স্থাপন। এতদিন ভারতে জীবন জীবিকার উৎস হিসেবে কৃষি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে ছোট প্রান্তিক কৃষকদের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। কৃষিতে কর্পোরেট বিভাগের তেমন প্রাধান্য ছিল না যদিও অনেক অঞ্চলে বৃহৎ জমিমালিকের কর্তৃত্ব ছিল তাদের জমি মালিকনার দরুন। ভাগ চাষের প্রাধান্য ছিল। মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষণও কায়েম ছিল। কিন্তু পুঁজিবাদের বিকাশ সীমিত ছিল। সেক্ষেত্রে ভূমিসংস্কার ও তার সাথে বাজার সংস্কার সমবায় চাষ সেচ ব্যবস্থার বিকাশ ঘটিয়ে কৃষির ভিত্তি স্থাপন করার কথা বলা হলেও কার্যত পরিকল্পনার অর্থনীতি চালু হলেও এসব করা হয়নি। ফলে কৃষির উন্নতি হয় নি। সংগঠিত শিল্প জগতে একধরনের অলিগারকি কাজ করছিল। সরকারি বিভাগের প্রচলন হলেও বেসরকারি বৃহৎ পুঁজির প্রাধান্য ছিল। এরা রাষ্ট্রের ওপর প্রাধান্য বজায় রাখায় কৃষির উন্নতি তেমন হয় নি। ভারতের অর্থনীতি দেনার দায়ে জড়িয়ে পড়ে বিশ্ব ব্যাঙ্ক আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডারের কাছে। এরই ফলশ্রুতিতে তাদের নির্দেশ ও শর্তে নতুন আর্থিক নীতি চালু করে যার ফলশ্রুতি আজকের কৃষি সংস্কার তথা কৃষি বিল। মালিকনা সম্পর্ক যে আর্থিক কাঠামো গড়ে তোলে তাকে কর্পোরেটমুখী করে তোলার জন্যই এই সংস্কার। সরকারি বিলে এই সংস্কারের মুখবন্ধে যতই এর গুনগান করা হোক এর আসল চেহারাটা তিনটে বিলের বিষয়বস্তু ধরে তুলে ধরা যায়। তবে আমাদের বলতে দ্বিধা নেই যে আগের জমানার ব্যর্থতা তাদের নতুন আর্থিক নীতি আজকের এই সংস্কারের পশ্চাদপট সেটা না বললে সত্যকে অস্বীকার করা হবে।
প্রথম বিলে যে বাজার সংস্কারের কথা বলা হয় তা কার্যত ভারতের কৃষিকাঠামো শক্তপোক্ত করে তোলার থেকে কর্পোরেট দুনিয়াকে ভারতের কৃষিতে অবাধ করে দেওয়ার এ এক পরিকল্পনা। কৃষকের উৎপাদিত ফসল বিক্রি করার অধিকারের নামে দেশের প্রতিটি কোনে কর্পোরেট দুনিয়ার অবাধ প্রবেশের পথ প্রশস্ত করা হয়। ছোট ও প্রান্তিক কৃষকের আর্থিক ক্ষমতা খুবই সীমিত, বাজারে তাদের প্রতিষ্ঠা নেই। তাই ফসলের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা তাদের কেনা বেচার সুযোগ সবই থাকবে বড় বড় কর্পোরেটদের হাতেই। কৃষকরা তাদের শর্তে তাদের ঠিক করা দামেই ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হবে আবার ভোক্তা হিসেবে বেশি দামে টা বাজার থেকে কিনতে বাধ্য হবে। এটা হল বাজার ব্যবস্থায় কর্পোরেট দুনিয়ার দ্বিমুখী আক্রমণ যা নিশ্চিত হবে এই কৃষি সংস্কারের মাধ্যমে।সরকারি নিয়ন্ত্রণে যে ন্যূনতম সুযোগটা কৃষকরা পেত সেটা আর পাবে না। বলা হচ্ছে মধ্যস্বত্তা ভোগীদের দৌরাত্ম কমবে । সেটা হবে না। আগের মধ্যসত্মভোগীদের জায়গা নেবে আরও শক্তিশালী সংগঠিত মধ্যসত্তা যারা কর্পোরেট সংস্থা বলে পরিচিত। তার পরিচয় ইতিমধ্যেই আমরা পেয়েছি। লক্ষ্য করা যাচ্ছে আমাজন ফ্লিপকার্ড মত কর্পোরেট সংস্থাগুলো আজ কৃষিপণ্য নিয়ে ব্যবসায়ে বেশি উৎসাহী। কারণ এতে লাভ বেশি আর এই পণ্য বাজারে চক্রাকার গতির দ্রুতগতি সম্পন্ন (fast moving) ভোগ্য দ্রব্য হওয়ায় এর বাজার খুব বড় আর তা প্রবাহমান। দেখা যাচ্ছে B2B ব্যবসার সম্রোসারণ ঘটে চলেছে নীরবে। তার মানে নতুন ধরনের কর্পোরেট সংস্থার বিস্তার যারা কার্যত মধ্যসত্তা ভোগী ব্যবসায়ী। এরা বড় একটা কর্পোরেট সংস্থার কাছে আরেকটা কর্পোরেট সংস্থার মাল বেঁচে। এরাই কৃষি বিভাগে বড় মধ্যসংস্থা ভোগীর কাজ করবে। দরকারে আঞ্চলিক কিছু দালাল সংস্থা রাখবে কৃষকদের কাছে মাল কেনার জন্য কৃষকদের অগ্রিম চুক্তিতে আবদ্ধ করার জন্য। আঞ্চলিক স্তরে কৃষকদের ওপর আধিপত্য বজায় রাখার জন্য। ফলে মধ্যসংস্থাভোগীর অবসান হবে না সেখানেই এক ধরণের শিল্প অলিগারকি তৈরি হবে। এরফলে একটা ঘটনা ঘটবে। গ্রামীন স্বার্থগোষ্ঠীর সঙ্গে শহরের স্বার্থগোষ্ঠীর স্বার্থের বিরোধ দেখা দেবে যেটা সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনে দেখা যাচ্ছে। তার মানে এই নয় যে এই কৃষক আন্দোলন অন্যায্য।কার্যত এই আন্দোলনে কর্পোরেট মালিকনা বিরোধী বিদ্রোহ দেখা যাচ্ছে যাতে ছোট ও মাঝারি মালিকরাও যুক্ত হয়েছে।আর কর্পোরেট বিভাগগুলো বিদেশি বহুজাজিক সংস্থার সঙ্গে গাটছড়া বাধা বলে এই আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী উপাদান থাকতে বাধ্য।
দ্বিতীয় বিলে চুক্তি চাষের কথা বলা হয়। বলা হয় কৃষকরা অগ্রিম পেতে পারে চ্যুক্তি চাষের সুযোগ নিলে। সেজন্য চুক্তিচাষের সুযোগ অবাধ করার বিধান দেওয়া হয়। কোন সরকারী নিয়ন্ত্রণ থাকবে না । এ এক ভয়ঙ্কর সংস্কার যা কৃষক পরিবারকে দাস চাষীতে পরিণত করবে।ব্যাংকের ভূমিকাকে নস্যাৎ করা হবে। অত্যাচারের মুখেও সরকার হয়ে পরবে নীরব দর্শক। এর ফলে মধ্যসত্ত্বভোগীর অবদান তো কমবেই না বাড়বে। দালাল তৈরি হবে যারা কৃষকের অভাবের সুযোগ নিয়ে তাদের বড় ব্যবসায়ীর শর্তে চ্যুক্তি বদ্ধ হতে বাধ্য করবে। অগ্রিম দেওয়ার নামে বকলমে একধরনের কর্পোরেট মহাজনী কারবার শুরু হবে। চুক্তিতে চাষের জন্য আগাম দিচ্ছে এই অজুহাতে আর টাকার জন্য নির্ভরশীলতার জন্য কম দামে চুক্তি করতে বাধ্য হবে চাষী। ন্যায্য দাম এর যে গল্প তা গল্পই থেকে যাবে। বর্তমানে মধ্যসত্ত ভোগী আছে কৃষকরা ন্যায্য দাম পায় না সেটা ঠিক কিন্তু নতুন ব্যবস্থায় সেটার অবসান হবে না বরং আঁটুনি আরও শক্ত হবে। এই কম দামে চুক্তির মধ্যেই নিহিত আছে বকলমে একধরনের মহাজনী কারবার।
তৃতীয় বিল ওপরের প্রথম দুটো বিলের যে কর্পোরেট মুখিতা তাকে আরও সাহায্য করবে। গরীব মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগের ফসল তাকে তাদের জন্য আর অবশিষ্ট রাখবে না। এই অগ্রিম চুক্তির চাপে উৎপাদকরা আলু পেয়াজ তেলের মত ভোগ্য দ্রব্যকে আর প্রয়োজনীয় ভোগ্য দ্রব্য বলে বিবেচনা করতে পারবে না । সবটাকে খোলা বাজারে পাঠাবার ব্যবস্থা করবে। এখনো প্রান্তিক ও ছোট কৃষকরা নিজেদের জন্য কিছুটা হলেও রেখে বাকিটা বিক্রি করে। সেই সুযোগটা থাকবে না কারণ বাজার ব্যবস্থায় উৎপাদকের প্রয়োজন নয় বাজারই কথা বলে। আর সরকারি মান্ডি ব্যবস্থাকে আর কার্যকরী রাখবে না মুখে যাই বলুক। এই প্রসঙ্গে মনে করে দেখতে পারি বিশ্বায়ন চালুর প্রথম পর্যায় পরিকল্পনা ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার কথা বলা হয় নি কিন্তু পরে নীতি আয়োগ চালু করে কার্যত পরিকল্পনার অর্থনীতিকে নাকচ করে দেওয়া হয়।
ভারতের সংবিধানের ফেডারেল চরিত্র মেনে কৃষি বিভাগ রাজ্য সরকারের অধিকার মেনে নেওয়া হয়েছিল। কৃষি সংবিধানের যৌথ তালিকার অন্তর্ভুক্ত। অনেকে মনে করেন রাজ্য সরকারের কৃষি প্রশাসনের ওপর অধিকার এই সংস্কারের ফলে লোপ পেতে চলেছে। কৃষ বাজারের ওপর রাজ্যের অধিকার আর স্বীকৃতি পাবে না। সরকারের মাণ্ডির ওপর কর্তৃত্ব থাকবে না। তৈরি হবে কর্পোরেট নেতৃত্বে নতুন বাজার কাঠামো যেখানে মধ্যসত্মভোগী উবে যাবে না বরং একধরনের নতুন মধ্যসত্মভোগী কর্পোরেট নেতৃত্ব কর্তৃত্ব করবে যার কথা আমরা বলেছি। বাজার ব্যবস্থার মধ্যে নির্ধারিত হবে কৃষি সংক্রান্ত বিষয়গুলি। ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের ভূমিকা থাকবে না। এই অবস্থায় কর্পোরেট স্বার্থে দাম নির্ধারিত হবে। চুক্তিচাষ ছোট ও প্রান্তিক কৃষককে এক ধরণের দাসত্বের বাঁধনে বাঁধবে।
ন্যুনতম সহায়ক দামনীতি শিথিল করার নামে তার কার্যকারিতার পথে নানা বাধার সৃষ্টি করে তাকে অকার্যকর করে দেওয়া হচ্ছে। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হবে কর্পোরেট দুনিয়ার হাতে কারণ বাজারটা একটা মুখ্যতান্ত্রিক তথা অলিগারকিক বাজার হয়ে দাঁড়াবে, কয়েকটি বহুজাতিক সংস্থার একাধিপত্য স্থাপিত হবে যেটা আজ শিল্পে ভারতের বাজার ব্যবস্থা র বৈশিষ্ট্য। দামনিয়ন্ত্রণ ও তাকে ধরে রাখার ব্যাপারে রাজ্য সরকারের কোন ভূমিকা থাকবে না। আর আলু পেয়াজের মত ভোগ্য পচনশীল দ্রব্যকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে গণ্য করা হবে না যুদ্ধের মত অস্বাভাবিক অবস্থা ছাড়া কখনো। মান্ডি ব্যবস্থায় কর্পোরেট দুনিয়া ছড়ি ঘোরাবে। চুক্তি চাষ বড় ব্যবসায়ীর ও বিনিয়োগকারীর হাত শক্ত করবে।বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিদেশি প্রভাব তীব্র হবে কারণ কোন পণ্য উৎপাদন হবে তার গুদামজাত করার ক্ষমতা বাজারিকরণের ক্ষমতা তাদের হাতে ন্যস্ত হবে। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে পার্টিতে করা বড় মালিকের ক্ষমতা খর্ব হয় প্রান্তিক ও গরীব চাষী অনিশ্চয়তার সন্মুখীন হয়। অনেক দিন ধরেই উননয়নের নামে বিকৃষিকরণ নীতি চালু হয়েছে সবুজ বিপ্লবের নামে। অল্প জমতে শরীর স্বাস্থ্য এর প্রশ্ন অস্বীকার করে অল্প জমিতে বেশি ফসল ফলিয়ে জমিকে উদ্বৃত্ত রেখে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা অবাধে চলছে। নগরায়নের দৌলতে কৃষিকাজ ব্যাপকভাবে লোপ পাচ্ছে ফসল উৎপাদন বাড়লেও তার গুণগত ম্গলবার কমছে মানুষের শরীর স্বাস্থ্য এমন অবস্থায় পৌঁছচ্ছে যে তার ন্যুনতম প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকছে না। করোনা সংকট সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে। আর সেজন্যই দেখছি গ্রামে গঞ্জে রাস্তায় কাজ করা গরীব মানুষের ওপর করুণার আক্রমণ তত তীব্র নয় কারণ পরিবেশ ধ্বংসের কুপ্রভাব তাদের ওপর কম। এই অবস্থাতেও রাষ্ট্র কৃষি সংস্কারের ওপরের নীতিগুলো কার্যকরী করতে দায়বদ্ধ অর্থাৎ তারা কর্পোরেট স্বার্থকেই বড় করে দেখছে। এরই ফলে আজের এই আন্দোলন যার ওপর দু একটা কথা বলে আমরা শেষ করব।
কৃষি সংস্কারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান :
আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ন হলো শিল্পে ও কৃষিতে স্বার্থগোষ্ঠীর মধ্যে স্বার্থ নিয়ে বিরোধের বিষয়টা যেটা আমরা তুলে ধরতে চাই। এর প্রতিফলনও আমরা দেখি সংস্কারের বিরুদ্ধে বর্তমানে সংগঠিত আন্দোলনে। আমরা জানি ভারতে ভূমি সংস্কার সব জায়গায় একই মাত্রায় গুরুত্ব পায় নি। পাঞ্জাব হরিয়ানা উত্তরপ্রদেশ মহারাষ্ট্র কর্ণাটকের মত রাষ্ট্রে আজ জমির বড় মালিকরা যাদের রাশিয়ায় কুলাক বলত কৃষি উৎপাদন সিদ্ধান্ত ও বাজারে কর্তৃত্ব করে। আজকের এই সংস্কার এদের একাধিপত্য কেড়ে নিয়ে তা শহরের দেশি বিদেশি কর্পোরেট সংস্থার হাতে স্থানান্তরিত করার পথ প্রশস্ত করছে। এর ফলেই দুই স্বার্থগোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ। আর এই সংস্কার ছোট ও প্রান্তিক কৃষককেও ক্ষুব্ধ করছে। তাই এই আন্দোলনে ধোনি ও গর্বকৃষককুলের মধ্যে এক যৌথ মঞ্চ তৈরির সুযোগ করে দিয়েছে যা এই আন্দোলনকে গতি দিয়েছে ব্যাপক কৃষককুলকে আন্দোলনে সামিল করেছে। এটা আমাদের ব্রিটিশ আমলে সিপাহী বিদ্রোহের কথা মনে করিয়ে দেয়। জমিতে জমিদারদের স্বার্থ বিরোধী নীতি আর শহরের ব্যবসায়ী আর শিক্ষিত সমাজকে ব্রিটিশ নীতি বেশি তোয়াজ করে। ফলে দেশপ্রেমিক একটা শক্তির উদ্ভব ঘটে। কৃষক বিদ্রোহে ভারতের আঞ্চলিক রাজতন্ত্র জমিদার যন্ত্র নেতৃত্ব দেয়। আজ আন্দোলনে কৃষি ও অকৃষি শহুরে স্বার্থগোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ এই সংস্কার কর্মসূচি তীব্র করে তোলে। এখানে বামপন্থীরা কোথাও কোথাও উপস্থিত থাকলেও সর্বাত্বক ভাবে নেতৃত্বে নেই। শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলনের গতি কোন দিকে কে তার ফায়দা তোলে সেটা দেখার। এই আন্দোলনের মধ্যে বিদ্রোহের উপাদান যেমন আছে তেমনি তার সমঝোতায় মিলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আজ লোকসভা ও রাজ্যসভার ভেতরে কৃষি সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর সীমাবদ্ধ নেই। ব্যাপক কৃষিজীবী মানুষ ছাত্র শিকসক যুবকের সমাবেশ মিটিং মিছিলে রাজপথ উত্তাল হয়ে উঠেছে প্রতিবাদে।পাঞ্জাব হরিয়ানা দিল্লী উত্তরপ্রদেশ কর্ণাটক তেলেঙ্গানা সহ সব রাজ্যেই কৃষিকুল এই আন্দোলনের সমর্থনে পথে নেমেছে। এটি বড় আন্দোলন এত অল্প সময়ে সংগঠিত হল পার্লামেন্টে বিরোধীপক্ষ খুব দূর্বল হওয়া সত্ত্বেও। পার্লামেন্ট বহির্ভূত রূপ পেয়েছে এই আন্দোলন । এখনও পর্যন্ত আন্দোলনকারীরা তাদের দিক থেকে শান্তি বজায় রেখে আন্দোলন চালাচ্ছে। প্রতিবাদ প্রতিরোধের রূপ নিয়েছে রাষ্ট্রের দমন নীতির বিরুদ্ধে। ব্যাপক হারে মহিলা অংশ গ্রহণ এই বিদ্রোহকে এক ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে সন্দেহ নেই। রাষ্ট্রের আক্রমণকে ভয় না পেয়ে দিনে দিনে আন্দোলন উচ্চতর পর্যায়ে পড়েছে। সরকার বিপদে পড়ে বিলের মৌলিক বিষয়টাকে রেখে তার মধ্যে কিছু সুবিধে দেওয়ার কথা বললেও আন্দোলনকারীরা মনে নি। তারা বিল তুলে নেওয়ার দাবিতে অনর থাকে। আন্দোলন চার পাঁচ মাস হতে চলেছে এখনও কোন সমাধানসূত্র পাওয়া যায় নি সামাদের ধারণা পাওয়া যাবে না। সরকার সেটা জানে। তারা আন্দোলনকারীদের ভয় দেখাচ্ছে খুন করছে। কয়েক শ আন্দোলনকারী মারা গেছে। একদিকে সরকার দমননীতি চালাচ্ছে অন্যদিকে পেছনের দরজা দিয়ে আন্দোলনের নেতাদের টোপ দিয়ে চলেছে ভেতর থেকে আন্দোলনকে ভেঙে দিতে। সরকাকার নিজের কৃষি সংগঠনকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করছে।
ওপরের আলোচিত তিনটি বিলের মাধ্যমে প্রবর্তিত কৃষি সংস্কারের মাধ্যমে প্রবর্তিত কৃষি সংস্কারের বিরুদ্ধে ব্যাপক কৃষক সম্প্রদায়ের আন্দোলন যেন বিদ্রোহের আকার নিয়েছে।অনেকে মনে করছেন এই আন্দোলন রাষ্ট্রের দমন পীড়নের তোয়াক্কা না করে এক সর্বাত্মক বিদ্রোহের রূপ নিয়েছে।সারা পৃথিবীতে এই আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে বলে কাগজ পত্র থেকে জানা যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে এর পক্ষে মিছিলের ছবি বেরোচ্ছে। রাষ্ট্র এর মুখে অস্বস্তিতে পড়েছে সন্দেহ নেই। করোনাকালে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই এর দায় কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়ে কৃষিতে রাজ্যের দায়িত্ব খর্ব করে কর্পোরেট দুনিয়াকে কৃষিপণ্য নিয়ে ব্যবসার সুযোগ করে দিচ্ছে দেখে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এমনকি কৃষিতে যে বড় মালিকগোষ্ঠী এই সরকারের পক্ষে ছিল আজ তারা এই আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যোগ দিয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে ধনিকৃষক জোতদারদের সঙ্গে মাঝারি আর ছোট কৃষকদের বিরোধ থাকলেও সবাই একজোট হয়ে রাস্তায় নেমেছে।লকডাউন বজায় রেখে ও রাষ্ট্র ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে করোনা আতঙ্ককে পুঁজি করে যেভাবে একের পর এক জনবিরোধী কর্মসূচিকে আগ্রাসী ভাবে লাগু করেছে মোদি সরকার তার বিরুদ্ধে এটা একটা প্রতিরোধ আন্দোলন তাতে সন্দেহ নেই।গত তিনমাস ধরে প্রচন্ড ঠান্ডার রাষ্ট্রের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে মানুষ রাতের পর রাত অবস্থান বিক্ষোভ করেছে এমনকি মৃত্যু বরণ করেছে। কোন আংশিক সুবিধে নয় পুরো আইন বাতিলের দাবিতে অনড় থেকেছে।কৃষিকে কেন্দ্র করে এত বড় গণ অভ্যুত্থান আগে দেখা যায় নি।
উল্লেখযোগ্য যে আলোচিত তিনটে বিল পাশ করার বিষয়টা কার্যত ১৯৯১ কার্যকরী করা নতুন আর্থিক নীতিকে কার্যকরী করার এ এক ধারাবাহিকতা। উদারীকরণ বেসরকারিকরণ- বিশ্বায়ন নীতিরই এটা ধারাবাহিকতা।এই নীতি ভারতবর্ষের রাজনৈতিক দল, নীতিপ্রণেতা, মিডিয়া সবাই প্রায় ঐক্যমতের ভিত্তিতে গ্রহণ করে। বলে এর কোন বিকল্প নেই। বিষয়টা বিভিন্ন নীতি অনুসরণে আগে থেকেই প্রতিভাত হয়।নতুন আর্থিক নীতি চালু হওয়ার পর থেকেই থেকেই ভারতের কৃষি ক্ষেত্রে এর সূত্রপাত। যদিও মোদী আসার আগ পর্যন্ত এমনকি বিজেপির প্রধান মন্ত্রী যেতে এত দ্রুতহারে চালু করতে ভরসা পায় নি সেটা করোনা কে সামনে রেখে সামাজিক দূরত্বের শ্লোগান সামনে রেখে এই সরকার অল্প কোয়েল দিনের মধ্যে করেছে। এত গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কিত বিল নিয়ে সংসদে বিতর্কের সুযোগও দেওয়া হয় নি।
উল্লেখযোগ্য যে ভারত ১৯৯৪ সালে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সদস্য হয়। ২০০০ সালে প্রথম বার ঘোষিত হয় ' ন্যাশানাল এগ্রিকালচার পলিসি ', ২০০২ সালে ঘোষণা করা হয় ' লং টার্ম গ্রেইন পলিসি', ২০০৬ সালে 'ন্যাশানাল কমিশন অন ফার্মার্স'l এর পর আনা হয় কুখ্যাত BRAI( biotech regulatory authority of india)মত কুখ্যাত নীতি।। তার ই ধারাবাহিকতা আজের এই নতুন তিনটি বিল। মনে রাখা দরকার যে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি তার নির্বাচনী প্রচারে কর্পোরেটদের বার্তা দিয়েছিলেন যে কর্পোরেট নির্ধারিত সংস্কার কর্মসূচি (যার প্রাথমিক রূপকার অবশ্যই নরসিমা রাও- মনমোহন সিং ) রূপায়ণে তিনি অনেক বেশি দায়বদ্ধ ও আগ্রাসী হবেন। কর্পোরেট বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন যে নব্বই-এর দশকে অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রে যে সব সংস্কার হয়েছে, কৃষি তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না । এই আইন তিনটির মধ্যে সেই অভাব পূরণের চেষ্টা চেষ্টা করে মোদী সরকার।
আমরা বলেছি এ আজের এই সংস্কার নীতি কার্যত সরকারগৃহিত ১৯৯১ সালের আর্থিক নীতি তথা বিশ্বায়নের আওতাভুক্ত বেসরকারিকরন আর উদার্নীতিকরণ। কৃষিতে ভারতে বৃহৎ মোমির মালিক তথা বৃহৎ কৃষকরা কর্তৃত্ব করত। কিন্তু আজের কর্পোরেট দুনিয়া ভারতের মত দেশে কৃষি পঁয় নিয়ে ব্যবসায়ে ব্যাপক লাভের সুজুগ দেখে। আজ মানুষের খাদ্য অভ্যাস বদলেছে। নানা ধরণের আধুনিক খাবারে আজের প্রজন্ম অভ্যস্ত হচ্ছে যা উৎপাদিত হয় বড় বড় হোটেল রেস্টওড়ায়। কৃষিতে উৎপাদিত ফসল কাঁচামাল হিসাবে দরকার হয়। এদের নগদ শস্যে রূপান্তরিত করে বাজারিকরন করতে হয়। এই কৃষিপন্যকে শিল্প শহরে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করলে তার থেকে লাভের পরিমান বাড়ে। আর এই দিকে লক্ষ্য রেখে কৃষি উৎপাদনের অভিমুখ বদলাতে হয়। আগে প্রত্যক্ষ ভোগ ভিত্তিক দ্রব্যের জায়গায় নতুন ধরনের ফসল ফলাতে হয়। তাকে প্যাকেজিং করে শহরে আনতে হয় তা চাল ডাল হোক সয়াবিন হোক আপেল মসলা হোক। র এই ব্যবসায় আজ আমাজন ফ্লিপ কার্ড ওয়াল মার্টের হাতে ব্যবসা তুলে দিতে হয়। B2B কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের পথ করে দিতে হয়। এরাই নতুন ধরনের মধ্যসত্ত্বা ভোগী ব্যবসায়ী যাদের হাতে কৃষি ব্যবসা স্থানান্তরিত হবে। আর এর জন্য চ্যুক্তি চাষকে বৈধতা দিয়ে কর্পোরেট জগৎকে সুযোগ করে দেওয়া যেতে কি উৎপাদন হবে কি দামে বিক্রি হবে তা এই নয় ব্যবসায়িকুল স্থির করবে। এর সঙ্গে যুক্ত কৃষিতে যে বিনিয়োগ হবে তার একচেটিয়া অধিকার বর্তাবে কর্পোরেট হাতে। তারা কৃষকদের অগ্রিম দেবে মহাজন হিসেবে অগ্রিম চ্যুক্তিতে কৃষককে তাদের সুবিধার দামে বিক্রি করতে। ন্যূনতম দাম নীতি অকার্যকর করে খোলা বাজারের চাহিদা যোগানের খেলার নামে কম দামে কৃষককে বিক্রি করতে বাধ্য হবে কারণ কৃষি বাজার এক ধরণের মনপিসোনি বাজার হয়ে উঠবে যেখানে ক্রেতা কয়েকজন কিন্ত বিক্রেতা অনেক। উল্লেখযোগ্য যে চুক্তি চাষ ও অত্যাবশক পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন একে অপরের পরিপূরক। কৃষকের ফসলের দাম এদেশে অনিশ্চিত। প্রান্তিক আর গরীব কৃষকরা অভাবী বিক্রিতে বাধ্য হবে। সরকারের মান্দি ব্যবস্থা যথেষ্ঠ নয়। বাজারে ছোট কৃষকের কোন অধিকার নেই। ফসল না ফল লে যেমন দুর্গতি অতিফলন হলে তেমনি দুর্দশা কারণ কৃষকরা দাম পায় না ফসল মাঠেই পচে। তাই গুদাম তৈরি করে দিয়ে বাজারে নিজের পছন্দ অনুযায়ী বিক্রি করার অধিকার পেতে কৃষকরা লাভবান হবে সরকারের এই প্রচারে বিশ্বাস করে একটা সাময়িক আশার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কিন্তু শেষ বিচারে কর্পোরেট হাতে ক্ষমতা স্থানান্তরিত হবে। কগুদাম তৈরী আর গুদাম জাত করার একচেটিয়া অধিকার কার্যত বর্তাবে কর্পোরেট সংস্থার হাতে কারণ সরকার এই ভূমিকা থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে নতুন কৃষি বিলে আর অর্থনীতির কাজ থেকে সরকারের হাত গুটিয়ে নেওয়ার কর্মসূচিতে। ব্যাংকের ঋণ নিতে ছোট কৃষকদের প্রতি দায়বদ্ধতা দেখা যায় না। বড় কৃষকরা ও সুবিধা পাবে না। সরকারি ব্যাংকের ভূমিকা আরও সংকোচিত হচ্ছে। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলো করপোরেট হাতে। তারা ব্যাংকের টাকায় অগ্রিম চুক্তি করবে কৃষকদের সাথে সেখানেই কম দামে কেনার সুযোগের মধ্যে ব্যাংকের সুদটা ধরা থাকবে। তাই মহাজনের টাকা খাটানোর কাজটা বকলমে বিনা ঝুঁকিতে কর্পোরেট দুনিয়া করবে। কৃষকদের মধ্যে উৎসাহের সৃষ্টি হবে। কিন্তু ইতিমধ্যে এদেশে ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে চুক্তি চাষের অভিজ্ঞতা বলে যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষককে দেউলিয়া করে চুক্তির ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা কর্পোরেট সংস্থাই নির্ধারক শক্তি হয়ে ওঠে । তাদের সিদ্ধান্তেই ঠিক হয় কৃষক কী ফসল ফলাবে। বহুজাতিক কৃষি কোম্পানিগুলি র বহুদি নের দাবি ভারতে যেন খাদ্যশস্যের উৎপাদন হ্রাস পায় ও আর অর্থকরী ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। আজকের নতুন ধরনের ফসলের চাষ অনেক বেশি ব্যয়বহুল ও প্রযুক্তি নির্ভর। এর ফলে কৃষককে কর্পোরেটের ওপর দাদন নির্ভর হয়ে উঠতে হবে যা নীল চাষের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে। একই সঙ্গে অত্যাবশক পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন থেকে আলু পিয়াজের মত প্রয়োজনীয় ভোগী ফসলকে বিযুক্ত করার ফলে যথেচ্ছ মজুতদারি বাড়বে, কৃষি ফসলের দাম বাড়বে- যার একমাত্র লাভ পাবে কর্পোরেটরা। আর এসব দ্রব্য হোটেল রেস্তোরা প্যাকিং শিল্পে কাঁচামাল হলে দুঃখে।সেই অনুযায়ী ভোগের ধরনও বদলাচ্ছে বিশেষ করে শিল্প ও আধাশিল্প নগরে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা যেখানে জমি যাচ্ছে প্রমোটারদের পেটে। অথচ উৎপাদন শিল্প গড়ে উঠছে না। অর্থনীতি টাই ব্যবসা ভিত্তিক হয়ে উঠছে।অন্যদিকে এটাও ঘটনা যে কৃষি ক্ষেত্র সরকারি নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হচ্ছে। যথেচ্ছ আমদানি বাড়ছে। কৃষি পণ্যের আন্তর্জাতিক কারবারিদের কাছে ১৩০ কোটি জনসংখ্যার এই দেশ ভারত এক লোভনীয় সম্ভাবনাময় বাজার। দেখা যাবে চুক্তি চাষের সুযোগে একদিকে খাদ্য শস্যর উৎপাদনকমবে, অন্যদিকে আমদানি করা খাদ্য শস্যে বাজার ভরাট হবে । এইভাবে আমাদের খাদ্য স্বনির্ভরতা যেটা অর্জন করেছি তার শেষ হয়ে যাবে । দেশ খাদ্যের ব্যাপারে কর্পোরেট নির্ভর হয়ে উঠবে।
সুতরাং মধ্যসত্ত্বভোগী উঠে যাবে কৃষক ন্যায্য দাম পাবে এসব কল্প স্বর্গ থেকে যাবে। আজ এই কর্পোরেট জগতের অশুভ ছায়া দেখতে পাচ্ছে গোটা কৃষককুল। ধনি কৃষকরা যেমন প্রমাদ গুনছে তেমনি মাঝারি কৃষক এতোদিনকার মধ্যস্বত্বভোগী ছোট ব্যবসায়ী সবাই। আমাজনের মত বিদেশি কর্পোরেট দুনিয়ার দখলদারি মনে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ রক্ষা। আজকের যে কৃষি অভ্যুত্থান তারমধ্যে সেজন্য জাতীয় স্বার্থ যুক্ত ব্রিটিশ আমলে নীল বিদ্রোহে যেটা দেখা গিয়েছিল। তবে এতে আপনা থেকে গরিব ছোট কৃষকদের স্বার্থ সিদ্ধ হবে না।কার্যত ধোনি কৃষকরাও এদের শোষণ করে। গ্রামীন কৃষি স্বার্থ গোষ্ঠীর সঙ্গে শহুরে দেশীয় বিদেশী কর্পোরেট স্বার্থের এই যে বিরোধ তার সুযোগ নিয়ে গরিব মাঝারি কৃষকরা নিজেদের দাবি তুলে ধরতে পারে কি না সেটা দেখার। আর সেখানে সত্যিকারের বামপন্থীদের ভূমিকা। তারা ব্যর্থ হলে এই আন্দোলন বিপথগামী হবে বলে আমাদের ধারণা।
আজের এই কৃষি আন্দোনের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ভারতে বহুফসলি সবুজবিপ্লবের প্রবর্তনের বিষয়টি ধরব। সেখানে কর্পোরেট দুনিয়ার শিল্প উৎপাদনকারী স্বার্থগোষ্ঠীর দিকটা পেছনে থেকে কাজ করেছে সরারাসরী বৃহৎ জমি মালিকের স্বার্থের সঙ্গে বিরোধে হওয়ার দরকার ছিল না কারণ কৃষিতে সরাসরি ব্যবসায় তাদের ঢুকিয়ে ভারতে কৃষি জীবনকে কর্পোরেট হাতে তুলে দেওয়া হয়নি। সবুজ বিপ্লবে উচ্চফলনশীল বীজ বা পকমারার ওষুধ উৎপাদন করতে রসায়ন শিল্পের কর্পোরেট দুনিয়া। বিশ্বের তাবড় তাবড় একচেটিয়া স্বার্থ একে কেন্দ্র করে ভারতের অর্তবনীতিতে ঢুকেছিল বটে কিন্তু প্রধানত শিল্প ক্ষেত্রে। গ্রামীন অর্থনীতিকে কব্জা করার দরকার ছিল না। তবে তাদের বাজার দরকার ছিল। এর জন্য তারা ভারতের রিলায়েন্স এর মত শিল্প গোষ্ঠীর সাথে হাত মিলিয়েছিল। তবে সেই শিল্প বিপ্লব ভারতের অর্থনীতির যে দুর্দশা ঘটিয়েছে শেষ বিচারে জমির উৎপাদনশীলতা কিভাবে নষ্ট করেছে পরিবেশ কিভাবে নষ্ট করেছে তা আজ পাঞ্জাব হরিয়ানার ধোনি কৃষকরা হারে হারে বুঝছে। সেটা অন্য গল্প। আজ ভারতের গোটা কৃষি জীবনটাই কর্পোরেট হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। উপনিবশবাদের এটা একটা নয়া দিক যার সাথে ভারতের স্বাধীনতা আত্মসম্ভ্রমের প্রশ্ন জড়িত। সুতরাং আজকের এই সংস্কার নীতি কৃষি উন্নতির জন্য সংস্কার নীতি নয় কর্পোরেট স্বার্থ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য 'সংস্কার'। একে কি আমরা সত্যি সংস্কার বলতে পারি? এই প্রশ্ন রেখে আমি ইতি টানছি। বিজেপিকে সাবধান করে দিতে চাই যে এতে তাদের হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডাও সাফল্য পাবে না যেমন আফগানিস্তানে তালিবানদের মোল্লাকরণের নীতি সাফল্য পায় নি। তালিবানদের মত এরাও সম্রাজ্যবাদিদের চালের ঘুটি হবে মাত্র। আর আজকের রাষ্ট্রপ্রধানরা অমর হয়ে থাকবে ভারতের নয়া মীরজাফর।
নতুন বিলের এই বিনীয়ন্ত্রণ আর বেসরকারিকরণ নীতি নতুন নয় তার অনেকটাই আগেই চালু হয়ে গেছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন দল ক্ষমতাসীন থাকার সময়ে নানা সংশোধনি এনেছে। ২০০৩ সালের ' মডেল এপিএমসি' আইনের অনুকরণে ১৭ টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ফল ও সবজি বাজারের বিনিয়ন্ত্রণ বিধি চালু করেছে, ২২ti রাজ্যে ই- ট্রেডিং চালু হয়েছে, ডাইরেক্ট মার্কেটিং ২১ টিতে, গুদাম ও হিমঘরকে বাজার চিহ্নিত করা ৬ টি রাজ্যে ইত্যাদি ( তথ্য সূত্র – কবিতা কুরুগান্তি, দি ওয়ার,২১সেপ্টেম্বর,২০২০)। চুক্তি চাষও বিভিন্ন রাজ্যে অনেক দিন থেকে গোপনে বা খোলাখুলি প্রচলিত। অত্যাবশক পণ্য আইনেও স্বাধীনতার পর একাধিকবার সংশোধনী আনা হয়েছে।। তাহলে ও মোদী সরকারের এই তাড়াহুড়ো । তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিকে কাজে লাগানো। কভিদকে হাতিয়ার হিসেবে পেয়ে যাওয়া য় তার সতব্যবহার করে মোদী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে তুষ্ট করলেন বলে বোধহয় বাড়িয়ে বলা হবে না। মনে রাখা দরকার যে বর্তমান শাসক জোট মতাদর্শগত ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী এবং কেন্দ্রীয়করণের পক্ষে। এই আইনগুলো সেই মতাদর্শ কার্যকরী করতে সহায়ক সন্দেহ নেই। কৃষি রাজ্য তালিকায় থাকা সত্ত্বেও এই সংস্কার কাজগুলো সম্পন্ন হলে নীতি নির্ধারণে রাজ্য সরকারগুলোর আর তেমন কোন ভূমিকা থাকবে না। এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে। কৃষিতে কর্পোরেট দুনিয়াকে জায়গা করে দেওয়া হবে আবার কর্পোরেট দুনিয়ার চাহিদা অনুযায়ী সারা দেশে একটা এক কেন্দ্রীয় আইন (one country – one law- one market) ব্যবস্থা চালু হবে যা বিভাগ নির্বিশেষে দেশের অর্থনীতির সব বিভাগে কর্পোরেটের একা রাজত্ব করতে সুবিধা হবে। সমস্ত দেশকে একটা বাজার বলে শাসন করার সুবিধা হবে।
উপসহার :
আমরা আমাদের আলোচনায় বর্তমান সরকারের কৃষি সংস্কারের স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করলাম। দেখলাম যে কর্পোরেট জগতের প্রতি প্রতিশ্রুত বদ্ধ একটা রাষ্ট্র কিভাবে একটা মারণ রোগকে সামনে রেখে সংস্কারের নামে কর্পোরেট দুনিয়ার নির্দেশ মেনে চলে। এর ফলে দেশের মধ্যে বিভিন্ন স্বার্থ গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ বাধে । এই বিরোধ থেকে একটা আন্দোলনের সূচনা হয় যা বিদ্রোহের দিকে যায়। এবার আমরা একটা বিষয়ের উল্লেখ করে লেখার যবনিকা টানব।
এটা বাস্তব সত্যি যে কৃষি বিল বিরোধী আন্দোলন আজ কয়েকটি নির্দিষ্ট রাজ্যে সীমাবদ্ধ যেমন ডানা বেঁধেছে অনেক রাজ্যে আনুষ্ঠানিক সমর্থন পাওয়া গেলেও টা তেমন ডানা বাঁধ তে পারে নি। এর কারণ ভারতের কৃষি কাঠামোয় অসম বিকাশ।কৃষিতে বিভিন্ন স্বার্থ গোষ্ঠীর মধ্যে স্বার্থের সংঘাত। এটা অস্বীকার করা যায় না।এ বিষয়টি অনেকে উল্লেখ করেছেন যা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। দেখা যাচ্ছে যে কৃষকদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ মূলত কেন্দ্রীভূত হয়েছে পাঞ্জাব,হরিয়ানা,পশ্চিম উত্তর প্রদেশ,কর্নাটক এবং তেলেঙ্গানায়। অন্যত্র সমর্থন অনেকটাই কৃষক সংগঠনগুলির আহ্বানে সংগঠিত ও আনুষ্ঠানিক। লক্ষণীয় যে আন্দোলন প্রথমে সবুজ বিপ্লবের এলাকাগুলিতে কেঁপে উঠেছে। ওখানকার কৃষকরা দীর্ঘ দিন ধরে ন্যুনতম নিয়ন্ত্রণ আইনের সুবিধা পেয়েছেন এবং মূলত ভারতের শস্য গোলা বলে পরিচিত। সেখানে ধনী কৃষকের কর্তৃত্ব সারা গ্রামীণ সমাজে। পুঁজিবাদের পুরো বিকাশ না ঘটলেও কৃষি পণ্যের বাজারিকরনের মাত্রা বেশি। এমএসপির ক্রমিক হ্রাস ও মান্ডি ব্যবস্থার ধ্বংস তাদের অনেক বেশি আশঙ্কিত করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের এমন অনেক রাজ্য আছে যেখানে সেই অর্থে কোন মান্ডি ব্যবস্থা নেই ও কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এমএসপিতে ফসল কেনাবেচা তেমন হয় না। তাই সেখানে কৃষকেরা এখনও বিপদের মাত্রাটা আঁচ করতে পারছেন না। এসব জায়গায় ভূমিসস্কারের কাজ কিছুটা হওয়ায় জমির মালিকানা ছোট কৃষকের হতে বেশি যারা দাম ও বাজারিকরণে মধ্যস্বত্বভোগীদের শিকার।তাই নতুন কৃষি নীতি তাদের আর কি ক্ষতি করবে এরকম একটা ভাবনা আছে।আবার যেহেতু কৃষকেরা এক সমাজ সেখানে বৃহৎ, মধ্য, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক এবং ব্যাপক সংখ্যায় কৃষি মজুর রয়েছে তাই সবার প্রতিক্রিয়াটা এক রকম হয় না। তবে আশঙ্কা থেকেই যায় যে এই আইনগুলি কার্যক্ষেত্রে দেশজুড়ে প্রয়োগ হলে আক্রান্ত হতে কেউ বাদ পড়বে না। আক্রান্ত কৃষকের সংখ্যাটা বাড়বে।কৃষিতে কর্পোরেট অনুপ্রবেশ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই যান্ত্রিকীকরণ আরও বাড়বে। কৃষিকে ডিজিটাইজ করার শ্লোগান প্রধানমন্ত্রী আগেই দিয়েছেন। এর মধ্যে কৃষিপণ্য নিয়ে ব্যবসায় কর্পোরেট দুনিয়া সুযোগ পেতে গেছে। ফলে কৃষি মজুররা কাজ হারাতে শুরু করেছে। কৃষিতে রাষ্ট্রের দায় ও নিয়ন্ত্রণ না থাকলে কর্পোরেট মুনাফাই হবে একমাত্র বিবেচ্য। এর ফলে বৃহৎ ও মধ্য কৃষকদের আয়ের সুযোগ কমবে। প্রান্তিক কৃষকরা তো ইতিমধ্যেই খাদে পড়ে গেছেন। সেই জন্য আগামি দিনে কৃষক বিক্ষোভ সর্বভারতীয় চরিত্র নিতে পারে।
কৃষি ক্ষেত্রে অর্ডিন্যান্স এর মাধ্যমে আলোচিত বিলগুলি তিন মাস আগে প্রবর্তিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন আলোচনায় এই প্রশ্নটা উঠতে শুরু করেছে যে ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থায় পুঁজিবাদ কায়েম হতে যাচ্ছে কি না । ভারতে কৃষকের হাতে গড়পড়তা জমির পরিমাণ, উৎপাদন সম্পর্ক, জমির খণ্ডীকরণ, বিপণন ব্যবস্থা এবং গ্রামীণ কৃষি সংস্কৃতি সমস্ত কিছুর মাপকাঠিতে বিচার করে বলা হয় যে এখনও পর্যন্ত ভারতীয় কৃষি চরিত্রগত ভাবে আধাসামন্ততান্ত্রিক ও আধাঔপনিবেশিক। আর লক্ষণীয় যে গত তিরিশ বছরে নতুন আর্থিক নীতি গৃহীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষিক্ষেত্রেফিনান্স পুঁজির অনুপ্রবেশ এর পথ সুগম হয়েছে । কিন্তু আমূল ভূমি সংস্কার ঘটিয়ে কৃষির পুঁজিবাদী বিকাশ সম্ভব হয় নি। সেটা ঘটাবার সাধ্য ভারতের আমলা পুঁজির নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক অর্থ লগ্নি সংস্থাগুলি চাপ আসে কৃষিতে কর্পোরেট প্রবেশের পথ যে কোনো মূল্যে সুগম করার।আর শাসক সম্প্রদায় এটা করতে দায়বদ্ধ ছিল । তাই উপর থেকে পুঁজিবাদ চাপানোর এক বকচ্ছপ প্রচেষ্টা। এর ফলে উপরিকাঠামোয় পুঁজির চলাচল পরিমাণগত ভাবে বাড়লেও কৃষি ক্ষেত্রে বুনিয়াদি উৎপাদন সম্পর্কের কোন গুণগত পরিবর্তন ঘটবে না।
অনেকে মনে করেন এই আন্দোলন সম্ভাবনা পূর্ণ। আমরা জানি যে জিডিপিতে কৃষির অংশ কমে ১৬- ১৭ শতাংশে নামলেও, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশের ৫৫% মানুষ যুক্ত কৃষ্র ওপর নির্ভরশীল।। তাই কৃষক দের ব্যাপক হারে মাঠে নামাটা রাজ্য হোক বা কেন্দ্রীয় সরকার সবার কাছেই মাথা ব্যথা। সাম্প্রতিক অতীতে সময়ে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক কৃষক আন্দোলন মাথা চাড়া দিয়েছে (বিগত বছরে লংমার্চ বা দেশের রাজধানীতে কৃষক সংসদ), এর ফলে শুধু কেন্দ্রীয় সরকার এমন কি রাজ্য সরকারও কৃষকদের জন্য বিভিন্ন আর্থিক সহায়তা প্রকল্প ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে। যদিও সেগুলো যৎসামান্য। এবারও এমএসপি ঘোষণা এরই ফলশ্রুতি। আজ আশা করা যায় যে আন্দোলনকারীরা শুধু এই তিনটি আইন প্রত্যাহারই নয়, একই সঙ্গে তারা আন্দোলনের দাবি সনদে যুক্ত করতে চাইবে আমূল ভূমি সংস্কার, খাস জমি বন্টন, জমির ঊর্ধ্বসীমা আইনের সংশোধন প্রত্যাহার, কৃষি উপকরণের মূল্য হ্রাস, এমএসপিকে আইনি অধিকার দান, সার্বজনীন গণবন্টন ব্যবস্থা, কৃষি বিপণন ব্যবস্থায় সরকারের ভূমিকা বৃদ্ধি, কৃষি মজুরি বৃদ্ধির মতো মূলগত বিষয়গুলি নিয়ে ভাববে।এই সব গুলো বাস্তবায়নের লড়াই সফল হলে কর্পোরেট দুনিয়ার হানাদারি পরাস্ত হবে। কৃষক কূলের স্বার্থ কিছুটা হলেও রক্ষিত হবে। আর এখানেই এই লড়াই এর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার সারবস্তু নিহিত আছে।
=====০০=====
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন