google-site-verification=aFCzFTmuVjPqPlrdWXeJSj2r_EMig_cypLnlmiUQpw0 re পুরীর রথযাত্রা : প্রায় ৮০০ বছর প্রাচীন ।। অনিন্দ্য পাল - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

মঙ্গলবার, ১৭ জুন, ২০২৫

পুরীর রথযাত্রা : প্রায় ৮০০ বছর প্রাচীন ।। অনিন্দ্য পাল

পুরীর রথযাত্রা : প্রায় ৮০০ বছর প্রাচীন

অনিন্দ্য পাল


আষাঢ় মাস আসলেই রথযাত্রার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। রথের মেলা অনুষ্ঠিত হয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক জায়গাতেই। কিন্তু রথযাত্রার প্রাচীন ইতিহাসের দিকে তাকালে পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রার কথাই সবচেয়ে পুরনো বলে মনে হয় না। বেদে রথের উল্লেখ থাকলেও রথে দেবমূর্তি স্থাপন করে রথ টেনে নিয়ে যাওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়নি। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ছয় ধরনের রথের কথা জানা যায়। ১) দেবরথ বা উৎসবে দেব প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হয় এমন রথ ২) পুষ্পরথ, এই ধরনের রথ বিয়ে বা বিভিন্ন ধরনের মঙ্গলকার্যে ব্যবহৃত হত ৩) সাংগ্রামিক রথ অর্থাৎ যুদ্ধে ব্যবহারের উপযোগী ৪) পারিযানিক রথ অর্থাৎ যাত্রী বহনের উপযোগী রথ ৫) পরপুরাভিযানিক যা কিনা শত্রুর দুর্গ ভাঙার জন্য ব্যবহৃত হত ৬) বৈগয়িক, অশ্ব বা ঘোড়ার চর্যাশিক্ষার উপযোগী রথ। এই বিবরণ থেকে এটুকু বলা যায় যে খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী বা সমসাময়িক সময়ে রথের প্রচলন ছিল, এবং আজকের রথযাত্রার মত না হলেও রথযাত্রার প্রচলন ছিল। 
 
      ইতিহাসের বক্তব্য অনুযায়ী, প্রাচীন সময়ে জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর এবং পার্শ্বনাথের রথ ছিল। কোথাও কোথাও সেই রথযাত্রা এখনো মহাবীর জয়ন্তীর সময় বেশ ধুমধামের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। জৈন ধর্মাবলম্বীদের শেষ তীর্থঙ্কর মহাবীরের জন্মবার্ষিকীতে এই রথযাত্রায় আজো মহাবীরের মূর্তিকে রথে বসিয়ে শোভাযাত্রা করা হয়। ভারত, চীন এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশে এই রথযাত্রার বিবরণ বহু পরিব্রাজকের লেখনীতে পাওয়া যায়। চীনা পরিব্রাজক ফা- হিয়ান ( ফা-জিয়ান বা ফাক্সিয়ান ও বলা যেতে পারে) খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে ভারতে আসার সময় মধ্য এশিয়ার খোটানে বুদ্ধ-রথযাত্রা দেখেছিলেন। সেই আষাঢ় মাসে অনুষ্ঠিত সেই রথযাত্রার যে বিবরণ তিনি দিয়েছেন, তাতে জানা যায়, সেই রথটি চারচাকার ছিল এবং উচ্চতা ছিল প্রায় ৩০ ফুট। মহামূল্যবান রত্ন, পাটের পোষাক এবং অন্যান্য আরো সাজ-সজ্জায় পরিপূর্ণ সেই রথের উপরে মাঝখানে থাকত বুদ্ধদেবের মূর্তি, তার দুপাশে বোধিসত্ত্ব এবং চারদিকে থাকত অন্যান্য দেবমূর্তি। রাজা নতুন পোশাক পরে মুকুট খুলে খালি পায় মাথা নীচু করে বুদ্ধমূর্তির পায়ে পুষ্পাঞ্জলী দিতেন। ফা-হিয়েন ভারতে ছিলেন (৩৯৯-৪১৪ খ্রীষ্টাব্দ) যতদিন, তার মধ্যে তিনি পাটলিপুত্রতে (বর্তমান পাটনা) বিশাল রথযাত্রা দেখেছিলেন। সেই রথযাত্রায় তিনি ২০টি রথের শোভাযাত্রা দেখেছিলেন। 
 
     তবে পুরীর বর্তমান এই রথযাত্রা, বিভিন্ন মত বিচার করে যতদূর ধারণা হয়, প্রায় ৮০০ বছর এই রথযাত্রার বয়স হতে পারে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ভারতে আসা ইউরোপীয় পর্যটকদের লেখায় এই রথযাত্রার কিছু বিবরণ পাওয়া যায়, আর সবচেয়ে ভালো বিবরণ পাওয়া যায় সপ্তদশ শতাব্দীর বিবরণে। তবে পুরীর এই রথযাত্রার প্রচলন সম্পর্কে একটা মত অনুযায়ী, বৌদ্ধদের প্রাধান্যের সময়, কলিঙ্গ, বিশেষত পুরী, কোনার্ক ছিল বৌদ্ধধর্মের অন্যতম পীঠস্থান। অনেক ঐতিহাসিক মতানুসারে, হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণের সময় হিন্দু ধর্মগুরুরা বৌদ্ধদের বেশ কিছু রীতি নীতি পদ্ধতি এমনভাবে গ্রহণ করার চেষ্টা করেন যাতে বৌদ্ধদের মনে আঘাত না লাগে অথচ তারা হিন্দু ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়। যার অন্যতম উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বুদ্ধকে ভগবান বিষ্ণুর নবম অবতার হিসেবে গ্রহণ করা। শ্রীমদ্ভগবতে তিনটি স্থানে বুদ্ধকে অবতার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পূর্বদিকের বাইরের দেওয়ালে যে দশ অবতারের মূর্তি খোদাই করা আছে তার মধ্যে নবম অবতার বুদ্ধদেব। কিন্তু মন্দিরের ভিতরে নাটমন্দিরের দেওয়ালে যে দশ অবতারের মূর্তি রয়েছে সেখানে বুদ্ধদেব নেই, সেই জায়গায় রয়েছেন জগন্নাথ স্বয়ং। হয়ত রথযাত্রার প্রবর্তনের উদ্দেশ্যও ছিল, বৌদ্ধ এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদেরকে হিন্দুধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করা, কারণ এই শ্রীক্ষেত্রে রথযাত্রায় কোন বিধিনিষেধ নেই। যে কোন ধর্মের, যে কোন জাতির মানুষ এই রথযাত্রায় উপস্থিত থাকতে পারেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ডঃ রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মতে পুরীর মন্দির নির্মিত হয়েছে প্রাচীন চৈত্যের ধ্বংসাবশেষের উপরে। বৌদ্ধ রথের সঙ্গে পুরীর রথের মিলও চোখে পড়ার মত। বৌদ্ধ রথ ছিল চারচাকার, কিন্তু সংখ্যা ছিল একটি। পুরীর রথে চারটির বেশি চাকা তবে এখানে রথের সংখ্যা তিনটি। আগে পুরীর রথে দুই প্রস্ত রথ টানা হত। এর কারণ ছিল, তখন জগন্নাথ মন্দির থেকে গুণ্ডিচা মন্দির পর্যন্ত রাস্তাটা দুটো ভাগে বিভক্ত ছিল। এই দুই রাস্তার মধ্য দিয়ে বয়ে যেত বলাগুণ্ডি নালা। এক প্রস্ত রথে চড়ে জগন্নাথদেব, বলরাম এবং সুভদ্রা আসতেন নালার পার পর্যন্ত। তারপর মূর্তিগুলোকে তুলে নিয়ে বসানো হত অপর পারে রাখা আর এক প্রস্ত রথে। এই ধরনের রথযাত্রা বন্ধ হল যখন রাজা কেশরী নরসিংহ (১২৮২-১৩০৭ খ্রীষ্টাব্দ) এই নালা বুজিয়ে দিলেন। 
 
       শ্রী কৃষ্ণের মথুরা যাত্রার উপলক্ষ্যে এই রথযাত্রার প্রচলন। সঙ্গে থাকেন দাদা বলরাম(বলভদ্র) এবং বোন সুভদ্রা। তিনটে রথ, কিন্তু মূর্তি চারটে- জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা এবং সৃষ্টি রহস্যের প্রতীক সুদর্শনচক্র। রথযাত্রার শুরুতেই তাই মন্দির থেকে বের হন সুদর্শনচক্র, তারপর অধিষ্ঠিত হন সুভদ্রার রথে। মন্দির থেকে সুদর্শনচক্র বের হবার পর বের হন বলভদ্র, তারপর বের হন সুভদ্রা এবং সবার শেষে বের হন জগন্নাথ। মন্দির থেকে দেবতাদের এই নিষ্ক্রমণ অনুষ্ঠানকে বলা হয় পহণ্ডি। নিমকাঠের তৈরি ভারী দেবমূর্তি পূজারীদের কাঁধে চেপেই মন্দিরের বাইরে আসেন এবং রথের উপর বসেন। এরপর "ছেরা পহরা" নামে একটা প্রথা অনুযায়ী পুরীর রাজা পালকিতে চড়ে এসে রথের সামনে নেমে খালি পায়ে রথে উঠে দেব সিংহাসনের নীচের ভূমি ঝাঁট দিয়ে এবং জল ছিটিয়ে পবিত্র করবেন। তিনি ভক্তিভরে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার পর শুরু হবে রথযাত্রা। সবার প্রথমে বলভদ্র তাঁর রথের নাম তালধ্বজ, তারপর শক্তিরূপিণী সুভদ্রার রথ তাঁর রথের নাম পদ্মধ্বজ বা দেবীরথ বা দর্পদলন আর সবার শেষে জগন্নাথদেবের রথ তাঁর রথের নাম নন্দীঘোষ। জগন্নাথদেবের রথের একেবারে শীর্ষে যে ধ্বজ থাকে তাতে গরুড়ের মূর্তি আঁকা থাকে, তাই এই রথকে গরুড়ধ্বজও বলা হয়। উদ্দেশ্য সন্ধ্যায় মাইল দেড়েক দূরে গুণ্ডিচা মন্দিরে পৌঁছানো। এই পুরো রাস্তাটা লক্ষ মানুষের সমাগমে একেবারে অন্য চেহারা নেয়। 
 
পৌরাণিক মতে বিশ্বকর্মা ছিলেন রথের নির্মাতা কিন্তু প্রচলিত বিশ্বাস অন্য। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী তিনটি রথের নির্মাতা তিনজন। বলভদ্রের রথ নির্মাণ করেছেন ময়দানব। সুভদ্রার রথ নির্মাণ করেন কালনেমী আর জগন্নাথদেবের রথ নির্মাণ করেন বিশ্বকর্মা। জগন্নাথদেবের রথের সারথি ছিলেন মাতলি, তবে মতভেদ আছে। বলভদ্রের রথের সারথি দারুক, সুভদ্রার রথের সারথি দেবদত্ত। রথগুলি তৈরি শুরু হয় শুভ অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে, চলে রথযাত্রার দিন পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় দু-মাস। 
 
     রথগুলির রং ও দেবতাদের অনুযায়ী, জগন্নাথদেবের রথের রং হলুদ, বলদেবের রথের রং নীল এবং সুভদ্রার রথের রং গাঢ় লাল। সারথি মাতলির বস্ত্রের রং হলুদ, দারুকের সবুজ আর দেবদত্তের কালো। রথগুলি পুরীর কাষ্ঠশিল্পীরাই বংশপরম্পরায় তৈরি করে আসছেন। এই রথ নির্মাণ কয়েক শতাব্দী ধরে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে লোকশিল্পের এক অভিনবত্বের নিদর্শন হয়ে উঠেছে। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কারুকার্য আর সুনিপুণ সজ্জা যুগ যুগ ধরে দেশ আর বিদেশের মানুষকে আকর্ষণ করেছে। তবে রথযাত্রার এই ৮০০ বছরের যাত্রা সব সময় যে মসৃণ ছিল তা কিন্তু নয়। বিশেষত বিভিন্ন সময়ে রথযাত্রাকালীন যে সমস্ত দুর্ঘটনা ঘটেছে সেসব শুধু ভয়াবহ তাই নয় অত্যন্ত কষ্টেরও বটে। ১৮০৩ সালে ইংরেজ সৈন্য মারাঠাদের হাত থেকে পুরী দখল করে। সেই সময় থেকে বিভিন্ন খ্রীষ্টীন মিশনারী এই শ্রীক্ষেত্রে উপস্থিত হন এবং রথযাত্রাকালীন পরিস্থিতি লক্ষ্য করেন। তাদের লেখনী থেকে জানা যায়, সেই সময়েও রথযাত্রায় যেমন দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন ধরনের মানুষ আসতেন তেমনি এসেছেন ভারতের বাইরের থেকেও, বিশেষেত কাবুল-কান্দাহার থেকে আসতেন বহু মানুষ। রথযাত্রার দিন এক বিশাল এক জনসমুদ্র আছড়ে পড়ত পুরী স্বর্গদ্বারে। নিয়ন্ত্রণহীন এই বিপুল জনসমাগম একদিকে যেমন রথযাত্রার আনন্দে মশগুল হয়ে যেত, অন্যদিকে তেমনি তৈরি হত এক ভয়ানক পরিস্থিতি। এত মানুষের সমাগমে তৈরি হত স্থানাভাব, খাদ্যাভাব। আর পানীয় জলের হাহাকার তো ছিলই। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ধরনের রোগ, বিশেষত কলেরায় মারা যেত বহু মানুষ। রাস্তার দু-ধারে পড়ে থাকত মৃতদেহ, কয়েকদিনের মধ্যে যেগুলো পচে দুর্গন্ধে ভরিয়ে দিত বাতাস। ১৮৩৮ সালে কলকাতার আর্চ বিশপ বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান থেকে এই তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি তাঁর লিখিত প্রতিবেদনে পুরীতীর্থকে বলেন মৃত্যুপুরী বা "ভ্যালি অফ ডেথ"। স্মিথ ও গ্রীন নামে দু-জন ইংরেজ পাদ্রিও রথযাত্রার সময় মন্দিরের প্রবেশ পথে প্রায় দেড়শ নারী-পুরুষকে পদপিষ্ট হয়ে মারা যেতে দেখেন। তাদের লেখা থেকে জানা যায় অনেক অন্ধভক্ত রথের চাকার নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেন। হান্টারের লেখা ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়, রথযাত্রায় আগত মানুষের সাতভাগের একভাগ মানুষ মারা যেত রোগাক্রান্ত হয়ে আর অনাহারে। তাঁর মতে এই মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় বারো হাজারের কম হবে না। খ্রীষ্টান মিশনারীদের ব্যাপটিস্ট মিশন থেকে প্রকাশিত এক প্রচার পুস্তিকায় উইলিয়াম কেরি লেখেন, জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উপলক্ষে অন্তত বারো লক্ষ মানুষ আসতেন পুরীতে। ১৮১৩ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত এক গ্রন্থে রেভারেন্ড ক্লডিয়াস বুকানন লেখেন, শুধুমাত্র হিন্দুধর্মের মানুষরাই যে পুরীর রথযাত্রায় আসত তা নয়, অন্য বহু ধর্মের মানুষও এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সামিল হতেন। 
 
   রথযাত্রা উপলক্ষে শুধু পুরী নয়, আরও অনেক জায়গাতেই বিপুল সমারোহ হয়, যার মধ্যে মাহেশ, ইস্কনের রথের কথা বলা যায়। এখন নতুন করে দীঘায় প্রতিষ্ঠিত জগন্নাথ মন্দিরের থেকে রথযাত্রাও মানুষের অন্যতম আকর্ষণের বিষয় হয়ে উঠেছে। 


------------------

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন