আলোর স্বর
এস. আজাদ
কার্তিকের রুগ্ন বিকেলের মরা রোদ সবে গলির মুখে ঢলে পড়েছে যেন ঘুমন্ত আদুরে
বেড়াল। ছুঁয়ে দিলেই ফুসমন্তর ! চায়ের দোকানের ফুরফুরে আড্ডাটা তখনো জমে ওঠেনি
ঠিকমতো, কিন্তু রনির মনে এক অস্থির ঝড়। তার হাতের মুঠো শক্ত হয়ে আসছিল।
ফোনটা কানে ধরে, — "হ্যালো, তুই কোথায়? একবার পাড়ায় আয় তো।"
ও প্রান্তে তখনো কোনো উত্তর আসেনি। রনির বুক ধড়ফড় করছিল। সে শুনতে পাচ্ছিল
নিজেরই দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ। ততক্ষণে গলির মুখে শুয়ে থাকা হুলোটা লেজ
ফুলিয়ে তাড়া করা সূর্যের আলোটুকু প্রায় নিভে এসেছে।
— "কেন, কি হয়েছে?"
— "রাজুদার লোফার উচ্চিংড়ি মার্কা ছেলেটা, যেটা কদিন ধরেই মন্টিকে উত্যক্ত
করছিল... সে আজ সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে," রনি প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল।
তার গলার স্বরে তীব্র ক্ষোভ আর একরাশ অসহায়ত্বের মিশেল।
একটু চুপ করে রনি আবার বলতে শুরু করল, — "আমাদের ড্রাইভার বাপ্পা গাড়িটা
গ্যারেজে ঢোকাচ্ছিল। আর ওই ছোঁড়াটা অটো ড্রাইভারি শিখছিল গলির ভিতর। সময় মতো
ব্রেক কষতে না পেরে জোড় ধাক্কা দিয়েছে। বাপ্পার পা কেটেছে। গাড়ির ব্যাক লাইট
ভেঙেছে। ছোঁড়াটাকে টাইট দেয়ার একটা ভালো সুযোগ পেয়েছি। তুই তাড়াতাড়ি চলে
আয়।"
ফোনটা নামিয়ে রাখতেই রনির হাত কাঁপছিল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল বাপ্পার
বিধ্বস্ত মুখটা, তার কাটা গোড়ালি দিয়ে ঝরা রক্তের গাঢ় লাল ছোপ শ্বেত পাথরের
গোটা মেঝে জুড়ে ছড়ানো । রনি বাপ্পাকে ছোটবেলা থেকেই চেনে। শান্ত, নিরীহ
ছেলেটা, কারো সাতে পাঁচে নেই। নিজের কাজটুকু গুছিয়ে করে, ব্যাস। আর সেই
বাপ্পার ওপর এমন আঘাত? রনির ভেতরে জ্বলে উঠল এক চাপা আগুন। রাজুদার ছেলেটা,
পাড়ার সবার কাছে যে 'উচ্চিংড়ি' নামেই পরিচিত, তার বাড়াবাড়িটা আজকাল মাত্রা
ছাড়াচ্ছিল। মন্টি, তাদের পাড়ারই মেয়ে, সবে কলেজে উঠেছে। কদিন ধরেই ছেলেটা
তাকে অযথা জ্বালাতন করছিল। মন্টি লাজুক স্বভাবের, কাউকে কিছু বলতে পারত না।
কিন্তু পাড়ার অনেকেই খেয়াল করছিল ছেলেটার কাণ্ডকারখানা। সবার ভেতরেই একটা
চাপা বিরক্তি জমছিল, কিন্তু সরাসরি প্রতিবাদ করার সাহস কেউ দেখাচ্ছিল না। কারণ
ছেলেটার পেছনে রাজুদা, স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যক্তি, আছেন।
রনির মনে পড়ল, গত সপ্তাহে মন্টি একবার কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছিল। রনি
সেদিন তার মা'কে বলতে শুনেছিল, "ওই ছেলেটা মন্টিটাকে আবার বিরক্ত করেছে।" রনি
তখনো তেমন পাত্তা দেয়নি, ভেবেছিল হয়তো সামান্য কিছু। কিন্তু আজ বাপ্পার
রক্তাক্ত চেহারা দেখে তার ভেতরের সুপ্ত ক্ষোভটা যেন জেগে উঠল। সে বুঝতে
পারছিল, আজ আর চুপ করে থাকা যাবে না। আজই হয়তো সেই দিন, যখন এই অন্যায়ের
প্রতিবাদ করতে হবে। তার ভেতরে জমে থাকা যাবতীয় হতাশা, আর পারিপার্শ্বিকতার
প্রতি ক্ষোভ যেন বিস্ফোরিত হতে চাইছিল। এই একটা ঘটনা, যেন বহুদিনের জমে থাকা
ধুলো ঝেড়ে ফেললো, আর সেই ধুলোর আড়ালে লুকিয়ে থাকা অন্যায়ের প্রতি ঘৃণাটা
স্পষ্ট করে তুললো।
রনির ফোন পেয়ে মিনিট পনেরোর মধ্যেই রবিন এসে হাজির হলো। তার চোখেও একই রকম
আগুন, মুখে চাপা রাগ। তার কপাল কুঁচকে ছিল, যেন সমস্ত অপ্রীতিকর ঘটনার ভার তার
ওপর এসে পড়েছে। "কী হয়েছে রে, সবটা খুলে বল।" রবিন সরাসরি জানতে চাইল, তার
কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট অধৈর্য।
রনি সমস্ত ঘটনাটা খুলে বলল। বাপ্পা কিভাবে শান্তভাবে গাড়ি গ্যারেজে
ঢোকাচ্ছিল, আর কীভাবে সেই ছেলেটা বেপরোয়াভাবে অটো চালাতে গিয়ে ধাক্কা
মারল। "ও তো ইচ্ছে করেই মেরেছে রে রবিন," রনি গুমরে উঠল, তার কন্ঠস্বর হতাশায়
ভারি। "বাপ্পা বারবার বারণ করছিল, 'আস্তে চালা, গলিটা সরু!' কিন্তু কে শোনে
কার কথা!" রনির কথাগুলো যেন তার ভেতরের তীব্র মানসিক যন্ত্রণা আর ক্রোধের
বহিঃপ্রকাশ।
রবিনের চোয়াল শক্ত হয়ে এল। তার মুখমণ্ডল পাথরের মতো দৃঢ় দেখাচ্ছিল। "ওই
হারামজাদাটাকে আজ একটা শিক্ষা দিতেই হবে। পাড়ায় এমন নোংরামি আর চলতে পারে
না।" রবিন দীর্ঘদিনের পাড়ার ছেলে। সেও এই ধরনের অন্যায় বরদাস্ত করতে পারত
না। তাদের শৈশব কেটেছে এই গলিতে। পাড়ার প্রতিটি ইঁট, প্রতিটি কোণায় তাদের
স্মৃতি জড়ানো। সেই পাড়ায় এমন অনাচার, তাদের রক্তের মধ্যে বিদ্রোহ জাগিয়ে
তুলছিল। তাদের নিজেদের অস্তিত্বের সঙ্গেই যেন পাড়ার সম্মান আর শান্তি জড়িয়ে
ছিল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পাড়ার আরও কয়েকজন ছেলে এসে জড়ো হলো। সুনীল, টনি, আর
আকাশ। সকলের মুখেই একরকমের দৃঢ়তা। তাদের চোখের তারায় একই রকম ক্ষোভ আর
প্রতিবাদের ভাষা। সকলেরই মনে এক প্রশ্ন, কেন এই ছেলেটা বারবার পার পেয়ে যায়?
কেন তার অন্যায়ের কোনো বিচার হয় না? এই প্রশ্নগুলোই তাদের একজোট করেছে আজ।
তাদের মধ্যে এক অদৃশ্য শক্তি কাজ করছিল, যা তাদের ব্যক্তিগত ভালো লাগা-মন্দ
লাগার ঊর্ধ্বে এক বৃহত্তর সামাজিক চেতনায় রূপান্তরিত হচ্ছিল। যেন প্রত্যেকেই
তাদের নিজেদের অপমানের হিসেব মেটাতে এসেছিল আজ।
সুনীল বলল, "রাজুদার ছেলে বলে কি সব কিছু ছেড়ে দেব নাকি? বাপ্পা তো পাড়ার
ছেলে। ওর সাথে এমন হবে, আর আমরা চুপ করে থাকব?" তার কথায় যেন একটা স্ফুলিঙ্গ
ছিল, যা বাকিদের মনেও আগুন ধরিয়ে দিল। তার স্বর ছিল দৃঢ় এবং অনমনীয়, যা
অন্যদের মধ্যেও সাহস সঞ্চার করছিল।
টনি, যে পাড়ায় একটু ঠাণ্ডা মেজাজের ছেলে হিসেবে পরিচিত, সেও আজ শান্ত থাকতে
পারল না। তার ভেতরের ক্রোধ তার শান্ত স্বভাবকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। "বাপ্পাকে
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে?" সে জানতে চাইল। রনি জানালো, "হ্যাঁ, বাপ্পা
নিজেই কষ্ট করে হাসপাতালে গেছে। আমাদের খবর দিয়েছে।" টনির প্রশ্ন ছিল উদ্বেগ
এবং ক্রোধের মিশ্রণ।
মনের ভেতরে এক ধরনের মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল। একদিকে বাপ্পার জন্য উদ্বেগ,
অন্যদিকে সেই ছেলেটার প্রতি তীব্র ঘৃণা। আর এই ঘৃণাই আজ তাদের একত্রিত করেছে।
তারা জানতো, রাজুদা প্রভাবশালী, স্থানীয় এম এল এ, কাউন্সিলর ও চেয়ারম্যানের
আশীর্বাদ আছে তার মাথায়। কিন্তু তাদের ভেতরের ন্যায়বোধ আজ আর কোনো প্রভাবের
কাছে মাথা নত করতে রাজি ছিল না। তাদের একত্রিত শক্তি যেন এক অদম্য প্রতিরোধ
গড়ে তুলছিল।
সূর্য তখন পুরোপুরি ডুবে গেছে। নতুন হিমের গন্ধ নিয়ে রাতের আঁধার নেমেছে
পাড়ায়। কিন্তু তাদের মনে এক ভিন্ন ধরনের আলো জ্বলছিল। তারা একতাবদ্ধ। আর এই
একতা তাদের সাহস জোগাচ্ছিল। তারা জানতো, হয়তো আজ তারা একটা বড় সমস্যার মুখে
পড়তে চলেছে, কিন্তু সেই সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য তারা প্রস্তুত। তাদের
প্রত্যেকেরই মনে ছিল এক গভীর মানসিক দ্বন্দ্ব – ভয় আর প্রতিবাদের আকাঙ্ক্ষা।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদের আকাঙ্ক্ষাই জয়ী হয়েছিল।
তারা ধীর পায়ে এগিয়ে চলল সেই জায়গার দিকে, যেখানে সেই উচ্চিংড়ি মার্কা
ছেলেটা প্রায়ই আড্ডা দিত। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সুচিন্তিত, কিন্তু ভেতরে
ভেতরে এক চাপা উত্তেজনা কাজ করছিল। তাদের মনে হচ্ছিল, আজ শুধু বাপ্পার ওপর
হওয়া অন্যায়ের বিচার নয়, আজ পাড়ার সকল অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সময়
এসেছে। মন্টির লাজুক মুখটা, বাপ্পার রক্তাক্ত পা, আর রাজুদার ছেলের বেপরোয়া
হাসি—সবকিছু মিলেমিশে তাদের ভেতরে এক অভূতপূর্ব শক্তি জুগিয়েছিল। আজ এই
উচ্চিংড়ি মার্কা ছোঁড়াটাকে একটা উচিত শিক্ষা দিতেই হবে। আর সেই শিক্ষাটা
শুধু তার জন্য নয়, পাড়ার সকল অনাচারের বিরুদ্ধে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
তাদের মনে একটা কথাই ঘুরছিল, "আর না! অনেক হয়েছে!" তাদের পদধ্বনি যেন রাতের
নিস্তব্ধতা ভেঙে এক নতুন প্রতিজ্ঞার সুর বাজাচ্ছিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন