google-site-verification=aFCzFTmuVjPqPlrdWXeJSj2r_EMig_cypLnlmiUQpw0 re থ্রিলার গল্প ।। আলোয় ঢাকা অন্ধকার ।। ইয়াছিন ইবনে ফিরোজ - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

মঙ্গলবার, ১৭ জুন, ২০২৫

থ্রিলার গল্প ।। আলোয় ঢাকা অন্ধকার ।। ইয়াছিন ইবনে ফিরোজ

আলোয় ঢাকা অন্ধকার 

ইয়াছিন ইবনে ফিরোজ 

আগস্টের এক মধ্যাহ্নে, ঢাকার রোদ যেন আগুন ছুঁড়ছে,আকাশ থেকে তাপ আর তীব্রতায় কাঁপছে পুরো শহর। শাহবাগের মোড়ে লাল শাড়ি পরা এক তরুণী মাইক্রোফোন হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে কালো সানগ্লাস, ঠোঁটে তপ্ত লিপস্টিক, কপালে বড় লাল টিপ, মাথা উঁচু করে বলছে, "আমরা সবাই বেশ্যা, বুঝে নেবো হিস্যা।" চারপাশে মানুষের ঢল। কেউ মোবাইল দিয়ে ছবি তুলছে, কেউ ভিডিও করছে, কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভ চালু করে দিয়েছে। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ বারবার ঝলকাচ্ছে। তার পেছনে বিশাল ব্যানার,
"নারী স্বাধীনতা আন্দোলন–প্রজন্মের কণ্ঠস্বর।"
তার নাম মার্জিয়া প্রভা। স্লোগান-দানের নতুন আইকন। এক দশকের মধ্যে এমন তেজদীপ্ত নারীবাদী কণ্ঠ এই শহর কখনো দেখেনি। পাশ থেকে এক মিডিয়া রিপোর্টার প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, "আপনার ভাষা একটু বেশি কটু ও কর্কশ নয় কী?" মার্জিয়া হেসে বলে, "আমাদের কণ্ঠ কটু ও কর্কশই হবে, কারণ যুগ যুগ ধরে ওরা আমাদের দমন করেছে। ভাষা যদি শিষ্ট হয়, দাসত্ব কখনো ছাড়বে না!" চারপাশে হাততালি পড়ে। তরুণরা স্লোগান তোলে। কিন্তু সেই হাসির কোণে ও উত্তেজনার গভীরে কেউ বুঝতে পারে না তার ভিতরে যে একটা অন্ধকার গুহা আছে। সেটা কারও চোখে পড়ে না।
সেই দিন রাত। ঢাকা থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে মৌলভীবাজার। পুরনো একতলা ভাড়া বাড়ি, শীতাতপহীন ঘরে ফ্যান ঘুরছে অসুস্থ ছন্দে। গাঁজার ধোঁয়ায় ঘরের বাতাস ভারী, বিছানার চাদর এলোমেলো, কার্নিশে ঝুলছে একটি ব্লুটুথ স্পিকার নিয়মিত ছুটছে হিপহপ বিট। তিনজন ছেলে রায়হান আনসারি, সজিব তুষার, আর এক অচেনা যুবক হেসে হেসে গাঁজা টানছে। তারা এখন ক্লান্ত, মাদক তাদের শরীরে ঢুকে গেছে, অথচ চোখের লালচে চাহনি বলে, রাত এখনও শেষ হয়নি। কোণার সোফায় বসে আছে নিশাত ইসলাম অসহায়ের মতো কাঁপতে থাকা একটা শরীর। তার ঠোঁট শুকিয়ে গেছে, চোখ ঝাপসা। সে বলছে, "আমি আর পারছি না। আমাকে যেতে দাও।"
রায়হান এগিয়ে আসে, মুখের খুব কাছে গিয়ে বলে,
"একটু পরেই ঘুম পাবে, শুয়ে পড়ো।" নিশাত ঘাড় ঘুরিয়ে চেয়ে থাকে বিছানার দিকে, চোখে বিভ্রান্তি, জিজ্ঞাসা করে, "বিছানাটা কোন দিকে?" সবার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে মার্জিয়া প্রভা,বসন্তরাঙা কুর্তি পরে, চোখে গাঢ় কাজল। সে হালকা হাসে। দু'জন ছেলে নিশাতকে ধীরে ধীরে ঘরের ভেতরে নিয়ে যায়।
দরজা বন্ধ হয়। তারপর শোনা যায় একের পর এক  চিৎকার, কান্না, "ওদের থামাও! মার্জিয়া, PLEASE!"
কিন্তু মার্জিয়া তখন দরজার বাইরে বসে। তার হাতে ফোন। সে ফিল্টার দিয়ে সেলফি তুলছে। স্ট্যাটাস লিখছে, "বন্ধুদের সাথে আড্ডা। লাইফ ইজ বিউটিফুল। " পরদিন ভোরে নিশাত কাঁপছে। তার ঠোঁটে রক্তের দাগ। চোখের নিচে কালো ছাপ। রায়হান তার ফোনে একটি ভিডিও খুলে দেখায়,"দেখ, কাল রাতের স্মৃতি। কাউকে বললে ভাইরাল করে দেব। তোর পরিবার, সমাজ সব শেষ!" নিশাত চিৎকার করে উঠে পড়ে, দরজা খোলার চেষ্টা করে। তখনই মার্জিয়া এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। "চুপ থাক নিশাত। বেঁচে থাকতে হলে এইভাবেই লড়তে হয়। যুদ্ধ এভাবেই লড়তে হয় ।" নিশাত বোবা হয়ে পড়ে। আর মার্জিয়া? সে ঢাকায় ফিরে এসে সরাসরি টক শোতে বসে, বড় বড় কথায় গরম করে টেলিভিশনের পর্দা,"নারী স্বাধীনতা মানে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো!"

অন্যদিকে, গার্মেন্টস কর্মী রেশমা আক্তার ফুটপাতে বসে আছেন । তার ছোট মেয়ে জিজ্ঞাসা করে, "আম্মু, আজ কি মাংস খাব?" রেশমা চুপচাপ চোখের জল মুছেন । তার তিন মাসের বেতন আটকে আছে, কারখানা মালিক শ্রমিকের টাকা বিদেশে পাচার করছে আর বিন্দাস ঘুরে বেড়াচ্ছে । অন্য আরেক প্রান্তে, ১৪ বছরের আছিয়া খাতুন ধর্ষণের পর হাসপাতালে মারা যায়। তার বাবা চিৎকার করে বলেন, "কেউ কি ন্যায়  দেবে?" এটা নিয়ে মার্জিয়ার মাথাব্যথা নেই। তার সব প্রচেষ্টা ও কষ্ট সব অন‍্য দেশের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাইতো সে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বলছে,"পাহাড় থেকে সেনাশাসন হটাও, নারীর জন্য বাংলাদেশ মুক্ত করো!" তার কাছে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, পাহাড়ের সাথে নারী স্বাধীনতার সম্পর্ক কী? যেখানে নারীরা স্বাধীন, সেখানে নতুন করে কোন ধরনের নারী স্বাধীনতা চাচ্ছে? কেউ জানে না, সেই "মুক্তির দূত"-এর হাতেই হয়তো নিশাতের গলা আজ চিরতরে চুপ। রাত গভীর। নিশাত নিজের মোবাইলে একবার দেখছে সেই ফুটেজ। বারবার ডিলিট করতে চাচ্ছে, পারছে না। তার চোখে জল, ঠোঁটে রক্তের স্বাদ।
সে ফিসফিস করে নিজেকেই বলে "সত্যটা সবাই জানুক,একদিন ঠিকই মুখোশ খুলে যাবে।"

রুমানা আফরোজ সকাল থেকেই অস্থির। Daily Horizon পত্রিকার ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার হিসেবে তার খ্যাতি আছে, কিন্তু এই কেসটা আলাদা। প্রথমে সে শুধু প্রোগ্রামের কাভারেজে গিয়েছিলো,মার্জিয়া প্রভার নারী সম্মেলনে। কিন্তু ভেতরের কিছু কথোপকথন তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুণীর চোখে ভয়,একটা নিরব আর্তনাদ, যা স্লোগানের ভিড়ে ডুবে গেছে। নিশাত। নামটা তখনো জানত না রুমানা, কিন্তু তার চোখ বলেছিল, "আমি কিছু বলতে চাই, পারছি না।" সেদিনের রাতে রুমানা তার ডেস্কে বসে ভিডিওগুলো ঘাঁটছিল। একটা ভিডিওতে খুব সাদামাটা স্কার্ফ পরা মেয়েটিকে দেখা গেল, হঠাৎ প্ল্যাকার্ড নামিয়ে নিচু হয়ে গেলো, যেন কাঁদছে। "এই মেয়েটা ঠিক কোন ভূতের পাল্লায় পড়েছে?" রুমানা মনে মনে বলে। রুমানা পরদিনই যায় মৌলভীবাজারে। স্থানীয় সাংবাদিক বন্ধু জাহাঙ্গীর তাকে নিয়ে যায় সেই ভাড়া বাড়িটির সামনে, যেখানে আগের সপ্তাহে "ছোট্ট গেট টুগেদার" হয়েছিল। এলাকাবাসী মুখ খুলতে চায় না। শুধু এক বৃদ্ধা কাজের মহিলা মুখ নিচু করে বলে,"সেই রাতে খুব চিৎকার শুনছিলাম মা, মেয়ে চেঁচাচ্ছিল, 'HELP ME!' তারপর আর কোনো শব্দ না। সকালে গাড়ি চড়ে ঢাকা চলে যায়।" রুমানার গা কেঁপে ওঠে। সে স্থানীয় থানায় যায়। কোনো অভিযোগ নেই। কেন নেই? কে থামিয়ে রেখেছে? ঢাকায় ফিরে এসে রুমানা নিশাতকে খোঁজে। কয়েকদিনের পরিশ্রমে এক বন্ধুর মাধ্যমে তার সঙ্গে দেখা হয়। নিশাত চুপ। তার চোখে ভয় আর বিশ্বাসঘাতকতার জ্যামিতি আঁকা। রুমানা ধীরে বলে, "আমি কোনো মিডিয়ার জন্য নয়, তোমার জন্য এসেছি। যদি তুমি মুখ না খোলো, ওরা আরও শত শত নিশাত তৈরি করবে।"
নিশাত ভাঙে, হু হু করে কাঁদে। তারপর বলে, "তুমি জানো, কী ভয়ংকর একাকীত্ব? যাকে তুমি আপু ডাকো, যার সাথে রাত্রি কাটাও, যার হাত ধরে বিপ্লবের মিছিল করো, সে যদি এক রাতে তোমাকে নরকে ঠেলে দেয়?" "মার্জিয়া বলেছিল, চুপ থাক, যুদ্ধ এমনই হয়। আমি কী যুদ্ধ করছিলাম, না কি বিক্রি হচ্ছিলাম?" পরদিন Daily Horizon-এ প্রথম পাতায় রুমানার কলাম ছাপে,"নারীবাদ নয়, এটি ব্র্যান্ডিং। নারীর দেহকে স্বাধীনতা নামে পণ্য বানিয়ে বেচাকেনা করা হচ্ছে। এই আন্দোলন নয়, এ হলো ভোগবাদের হোর্ডিং।" "যে নারী নিজেই আরেক নারীর নির্যাতনে নীরব থাকে, সে কখনো মুক্তির কণ্ঠস্বর হতে পারে না। যিনি মঞ্চে স্লোগান দেন আর বন্ধ ঘরে ভিক্টিমকে ফেলে সেলফি তোলেন, তিনি মুক্তির দূত নন, তিনি অন্ধকারের মুখোশ।"
সেই লেখাটা ভাইরাল হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয় বিতর্ক। মার্জিয়া প্রভা সরাসরি ফেসবুক লাইভে এসে বলে,"আমাকে ষড়যন্ত্রের শিকার করা হচ্ছে। এই তথাকথিত সাংবাদিক একটা ভুয়া কাহিনি বানিয়ে আমাকে নিশানা করছে!" কিন্তু রুমানা হাল ছাড়ে না। সে বলে,"যে সত্যের গলায় ক্যামেরা চেপে রাখা হয়, সেখানে কলমই একমাত্র অস্ত্র। আমি সত্যের পক্ষে দাঁড়াবো, যদি একা দাঁড়াতে হয় তবুও।" সেদিন রাতে নিশাত ফেসবুকে একটা ছোট পোস্ট দেয়,
"তুমি যাকে আইডল ভাবো,
 সে হয়তো তোমার সবচেয়ে বড় ভয়।
 মুখোশ না ছিঁড়লে, 
মেয়েরা নিরাপদ নয়।"
পোস্টটা রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যায়।
কেউ এখন বলছে,"নারীবাদ নয়, সত্যবাদ হোক নেতৃত্ব।"
 নিশাতের পোস্টের পর রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যায়।
কেউ সমর্থন করছে, কেউ কটাক্ষ করছে। "মেয়েটা খ্যাতির লোভে নাটক করছে" , কেউ লিখেছে।  আরেকজন কমেন্ট করেছে, "তুমি কীভাবে প্রমাণ করবে?" নিশাতের বুকের ভেতর তখন কেবল একটা ভিডিও। রায়হান আনসারি যেটা দেখিয়ে ভয় দেখিয়েছিল "ভাইরাল করে দেবো" সেই ভিডিও এখন তার হাতেই। সে জানে এটা পোস্ট দিলে সে হয়তো নিজেই ধ্বংস হবে, আবার না দিলে অন্য মেয়েরা বাঁচবে না। ঢাকার এক নামি ক্যাফেতে রায়হান বসে আছে, হাতে সিগারেট, সামনে ল্যাপটপ। তার পাশে বসে আছে সজিব তুষার,ভয়হীন, দম্ভে ঠাসা। রায়হান বলে, "ও মেয়েটা ঝামেলা করছে। বুঝিয়ে বলো, দরকার হলে টাকা দাও।" তুষার হেসে বলে, "টাকা না নিলে অন্যভাবে বোঝাতে হবে।" তারপর তারা একজন লোককে কল করে। লোকটা বলে "আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলনের নেত্রী মার্জিয়া আপার সম্মান নষ্ট হলে আমাদের গ্লোবাল ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পরিস্থিতি সামলাও। দরকার হলে 'দুর্নীতিগ্রস্ত সাংবাদিক' বলে প্রচার চালাও।" সবাই একে অপরকে বাঁচাতে চায়। সিস্টেম, মিডিয়া, এনজিও সব যেন এক অদৃশ্য চক্রে জড়ানো। রুমানার পত্রিকা অফিসে হঠাৎ বসে উচ্চপর্যায়ের মিটিং। প্রধান সম্পাদক বলেন, "তুমি কার বিরুদ্ধে লিখছো জানো? ওরা শুধু অ্যাক্টিভিস্ট না,ওদের ফান্ড আসে বিদেশ থেকে, পেছনে বড় বড় রাজনৈতিক মুখ আছে। তোমাকে পেছনে টানতে বলছি না, কিন্তু সাবধানে চলো।" রুমানা মাথা নিচু করে বলে,"তাহলে আমরা কোন সাংবাদিকতা করছি, যেখানে সত্যের দরজা খুলতেই বলা হয় 'ধীরে হাঁটো'?" এক রাতে, নিশাত একটি ল্যাপটপ নিয়ে বসে। বাম হাত কাপছে, ডান হাতে মাউস। ভিডিও ফোল্ডার খুলে। একটা ক্লিপ ওপেন করে দেখে নিজেকে, কাঁদছে, অনুরোধ করছে। দরজা বন্ধ। শব্দ রেকর্ড হয়েছে"HELP ME!" আর তার বাইরে সেলফি তোলা হেসে ওঠা মার্জিয়া।
হঠাৎ সে একটা ইমেইল পাঠায়,"আমি আর ভয় পাই না।" দুপুর ২টা। Daily Horizon এর অনলাইন পোর্টালে ভিডিও পোস্ট হয় "মার্জিয়া প্রভা, নারীবাদের মুখোশ খুলে দিলো এক ধর্ষিতার কান্না"
সাথে রুমানার প্রতিবেদনঃ যেখানে নারীই নারীর শত্রু, সেখানে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই এক ভণ্ডামি মাত্র। মুক্তি চাও? আগে মুখোশ সরাও। এরপর প্রতিবাদ করো।" ভিডিও দেখা হয় ৭ লাখ বার এক ঘণ্টায়। মার্জিয়ার মুখে হাসি নেই। নিশাতের ভয় নেই। রুমানার কলম থেমে নেই। নিশাতের ভিডিও প্রকাশিত হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মাথায় মার্জিয়া প্রভা একটি আইনি নোটিশ পাঠায় "ভিডিও ম্যানিপুলেটেড, সম্মানহানির অভিযোগে মানহানির মামলা।" টেলিভিশনে, অনলাইনে, ইউটিউব লাইভে বলতে থাকে,"এটা আমাকে থামানোর ষড়যন্ত্র। আমি নারী অধিকার আন্দোলনের প্রধান মুখ, তাই আমাকে টার্গেট করেই এমনটা করছে।  কিছু নারীবাদী সংগঠন তার পক্ষে দাঁড়ায়। তারা পোস্ট দিয়ে মার্জিয়ার পক্ষ নেন। কিন্তু কেউ জিজ্ঞেস করে না,"নিশাত কোথায় ?"
রুমানা আফরোজ এখন নিশাতের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আইনি সহায়তা দিচ্ছে "মানবাধিকার সহায়তা কেন্দ্র"। এক তরুণ আইনজীবী, আরিফ বিন কাদের, এগিয়ে আসে,"আপু, আমি বিনামূল্যে নিশাতের পক্ষে দাঁড়াবো। এটা শুধু এক মামলা নয়, এটা একটা বিপ্লবের সূচনা।" আদালতের সামনে মিডিয়া ভিড় করছে। ক্যামেরার লেন্স নিশাতের দিকে। কিন্তু আজ নিশাত চোখ নামিয়ে রাখে না। আদালতে বিচারক প্রশ্ন করেন,"ভিডিওতে আপনার মুখ দেখা যায় না, শুধু কণ্ঠস্বর। আপনি কিভাবে প্রমাণ করবেন যে আপনি সেই ভিকটিম?" নিশাত গলা শক্ত করে বলে, আপনার প্রশ্ন ঠিক। কিন্তু আমি জিজ্ঞেস করি, যে লোকেরা ভিডিও করছিল, তারা কিভাবে নিশ্চিত ছিল এটা ভাইরাল করলে আমার জীবন শেষ হবে? তারা জানত, আমি-ই সেই মেয়ে। তাই তো?" আদালত স্তব্ধ। রুমানার চোখে পানি। 
রায়হান ও তুষার গা ঢাকা দেয়। তাদের লোকজন বলে,"ছেলেগুলো বিদেশে পড়ছে, অনুপস্থিত।" কিন্তু এক হ্যাকার দল (যারা নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে কাজ করে) রায়হানের পুরনো চ্যাট ফাঁস করে,"তোদের ভিডিও আছে না? না মানলে ছেড়ে দে ভাইরাল।" এইবার আর কোনো সন্দেহ থাকে না। পাবলিক রোষে ফেটে পড়ে। টিভি লাইভে একজন বৃদ্ধ কাঁদতে কাঁদতে বলেন,"আমি রিকশা চালাই, আমার মেয়ে গার্মেন্টসে কাজ করে। ওরা বলে, মেয়েরা বাইরে এলে নিরাপদ। কিন্তু কেউ বলে না, ওদের পাশে দাঁড়াও। প্রগতিশীল মুখই যদি ধর্ষক হয়, তাহলে আমরা কার কাছে যাবো?" ২ মাসের শুনানির পর আদালত অন্তর্বর্তীকালীন রায় দেয়, রায়হান ও তুষারকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিতে হবে। মার্জিয়া প্রভার বিরুদ্ধে 'অবৈধ ভিডিও প্রচার ও মানসিক সহিংসতার' চার্জে তদন্ত চলবে। নিশাত রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আইনি সহায়তা পাবে। এক সন্ধ্যায় রুমানা ও নিশাত চায়ের দোকানে বসে আছে। চারদিকে আলো, মানুষের মুখে আলো। নিশাত ধীরে বলে,"ভেবেছিলাম আমার গল্প কেউ শুনবে না।" রুমানা বলে, "তোমার কান্না আমাদের রক্তে আগুন ধরিয়েছে। তুমি ছিলে শিকার, এখন তুমি আলোর উৎস।" দূরে ব্যানার ঝুলছে, "নারী স্বাধীনতা মানে অন্য নারীর কান্না নয়। নিরবতা নয়, মুখোমুখি হও।"
  
 
রায়হান আনসারি ও সজিব তুষার গ্রেপ্তারের পর গণমাধ্যমে তাদের মুখ ছড়িয়ে পড়ে। পরিবার, রাজনৈতিক গডফাদার, সব পক্ষেই চাপে পড়ে যায়।
 একের পর এক NGO, "নারী মুক্তির" সংগঠন গা ঢাকা দেয়। মার্জিয়া প্রভা নিখোঁজ হয়। একদিন সন্ধ্যায়, এক হোটেলের ঘরে তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ।ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা।
 তার পাশে পাওয়া যায় একটি চিরকুট, "আমাকে বানানো হয়েছে প্রতীক, কিন্তু আমি তো নিজেই জানতাম না আমি কে।" রুমানা আফরোজ এবার একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ডকুমেন্টারি প্রকাশ করেন।
 "মুখোশের পেছনে মুখ" তাতে তুলে ধরা হয়ঃ নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের ভণ্ডামি,ক্ষমতার গোপন ব্যবসা
 এবং সেইসব মেয়েদের গল্প, যারা সত্য বলার শাস্তি পেয়েছে। এই ভিডিও দেখে দেশজুড়ে শুরু হয় নতুন বিতর্ক, নতুন চিন্তা। নারীবাদের নামে ব্যবসা। এই প্রশ্ন প্রথমবার জনমানসে আলোচিত হয় খোলাখুলিভাবে।
 ৬ মাস পর। নিশাত এখন "আলোর মুখ"নামে একটি সংগঠন শুরু করে, "আমরা নারীদের নই, অন্যায়কে শত্রু হিসেবে দেখি।" সেখানে কাজ করছে ধর্ষণ থেকে বেঁচে ফেরা নারীরা, গার্মেন্টস কর্মীরা, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারা প্ল্যাকার্ডে লিখছে,"ভুক্তভোগীকে নয়, অপরাধীকেই লজ্জা দাও।" "আলোকিত মানুষ চাই, মুখোশপরা নয়।" ২ বছরের আইনি লড়াই শেষে আদালত ঘোষণা দেয়, রায়হান আনসারি ও সজিব তুষারকে ১০ বছরের কারাদণ্ড। মার্জিয়া প্রভাকে 'অপরাধে পরোক্ষ সহায়তার' দায়ে ২ বছরের প্রবেশন ও জনসম্মুখে ক্ষমা চাইতে হবে। প্রথমবার কারও "সমাজকর্মী" পরিচয়ে দায় এড়ানো হয়নি। জনগণ হাততালি দেয় না, শুধু চুপচাপ দেখে, এই সমাজ, মুখোশ ছিঁড়তে শিখেছে। রুমানার টেবিলে একটি চিঠি আসে, নাম নেই, ঠিকানা নেই। "আপু, আমি রিকশাচালকের মেয়ে। আমি এখন আর ভয় পাই না। ক্লাসে প্রথম হই। নিশাত আপুকে দেখে বুঝেছি, বেঁচে থাকা মানে চুপ থাকা না,লড়াই করে দাঁড়িয়ে থাকা। আপনি আর নিশাত আপু, আলোর মতো। রুমানা জানে, আছিয়া মারা গেছে। কিন্তু সে চিঠি নামিয়ে চোখ মুছে বলে,"মরে গেলেই কেউ মরে না। কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে যায় বাতাসে, ইতিহাসে।"
 
  
==================
ইয়াছিন ইবনে ফিরোজ 
দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। 


 
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন