google-site-verification=aFCzFTmuVjPqPlrdWXeJSj2r_EMig_cypLnlmiUQpw0 re গল্প ।। কলুর স্বপ্ন-সাফাই ।। অনন্যা সেনগুপ্ত - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

মঙ্গলবার, ১৭ জুন, ২০২৫

গল্প ।। কলুর স্বপ্ন-সাফাই ।। অনন্যা সেনগুপ্ত


কলুর স্বপ্ন-সাফাই 

অনন্যা সেনগুপ্ত 


লোকেদের চারটি এঁটো-কাঁটা ঘেঁটে ঘেঁটে সারা জীবন কাটিয়ে দিচ্ছি। লোকের থেকে শাপ কুড়িয়েছি, শুধু একটার বেশি দুটো যুক্তিসংগত কথা বলতে গিয়ে। 'ভেজা ময়লা আলাদা আর শুকনো প্যাকেট, প্লাস্টিক, ন্যাকড়া  আলাদা' আরে এটুকু মাথায় ঢোকাতে কটা বি.এ., বি.টি.  লাগে?  এই নাকি আপনারা শিক্ষিত ভদ্রবাড়ির বউ ! পড়ার পর পড়া চালিয়েছেন, আমাদের ঘরের বউদের মুখের ভাষা, আপনাদের ঘরের উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের মুখে শুনে বলে ওঠেন, 'ওই ছোটোলোকদের ভাষা বলতে হয় তো ঝুপড়িতে যাবি!' আর ঝুপড়ির মানুষদের ছাড়া আপনাদের চলবে?

এই ঝুপড়ির জীবন আমার জীবন। নাম কলু দাস, বাবার নাম নিমাইচরণ দাস, ঠিকানা –৯০/১,শ্যামপুর  রেলবস্তি।  আপনাদের বিশ্বাস যে আমরা হাড়বজ্জাত, নোংরা, আমাদের মুখের ভাষা শুনলে সরস্বতীর পাপে আমাদের, আমাদের সন্ততিদের বিদ্যাবান, বিদ্যাবতী হওয়া হলো না। আপনাদের বিশ্বাস টলানোর মত সাধ্যি আমাদের আছে? 

 আমার বাবা ক্লাস ফোর অব্দি টেনেটুনে পড়েছিল। সাফাইকর্মীর কাজটা প্রথমে বাবা করত। তারপর ঢুকল মা। আমার আর দাদাকে মানুষ করার চাপ। সবটাই শোনা বাবার মুখে। আমি হরিহর উচ্চবিদ্যালয়ে ষোলো বছর বয়সে নাইন পাশ করে,পড়া ছাড়ি। আমি এই কাজ করছি আজ কুড়ি বছর হলো। 

নোংরা ঘাঁটার কাজ আপনারা করলে, আমরা এসি ঘরে টেবিল চেয়ারে বসে রোজকার ভালো ভালো টিফিন খেয়ে কাজে বসতাম, বউকে দামী দোকানের শাড়ী পরিয়ে বাড়ির বিবি সাজিয়ে রাখতাম, ছেলেমেয়ে গুলোকে নিয়ে বড় বড় গেটওয়ালা তেতলা বাড়িতে থাকতাম, হ্যাঁ আমার এই কথায় বিশ্বাস রাখতে পারেন।  

আজ আমার বয়স উনচল্লিশ। বিয়ে করেছি আমাদেরই ঝুপড়ির তিনটে বাড়ির পরের মেয়ে টিয়াকে। ওর রংকটা শাড়ি, আমাদের ময়লা জামা, নোংরা ধুলোয় বাচ্চাগুলোর গুলিখেলা, এগুলো আমরা সাধ করে করি। 

কি যে ভালো লাগে, সে কাজ । সক্কাল সক্কাল মানে গিয়ে হল একেবারে ভোর ভোর, সুর্য উঠি উঠি ভাব ঠিক তখন বউকে ছেড়ে উঠতে হয়, কিছুদিন যাবত পাওয়া সরকারি নাম লেখা জামা গলিয়ে পরছি। দিয়ে ঠেলাগাড়ির ঠিকানায় পৌঁছে যাই। আমি স্বপ্নে দেখি আস্তাকুঁড়, দুঃস্বপ্নে দেখি আমার ছেলে রানাও এই কাজ করছে। ঠেলাগাড়ি নিই শুধু আমি না, পোলাই, শুলু, মন্টু, শ্যামা। এরা সবাই আমাদের বস্তিরই লোক। 

যেখানে ছিলাম, সেই ঠেলাগাড়ি নিয়ে ভোলার দোকানে বসে চা খেয়ে বাড়ি বাড়ি ময়লা তুলতে বেরিয়ে পড়ি। আমার  ছেলেবেলা থেকে বিশ্বাস যে ওই রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে ধারে যে পচা ময়লার আস্তাকুঁড়ের গন্ধে আপনাদের 'ওয়াক ,থু, ছিঃ'  বেরিয়ে আসে, সেইখানে আমি নির্ঘাত জন্মেছিলাম। 

নইলে, আমিও মানুষ হয়ে রক্ত, মাংস, হাত,  পা, সব নিয়েই জন্মালাম তবু আমায় আজ অব্দি কেন এই কাজ করতে হবে? আমি চাইলেও কেন আপনাদের মত করে বাঁচতে পারি না? 

ঐ সুন্দর, মার্জিত ভাষায় কথা বলতে কোন স্কুল শেখায়? আমাদের স্কুলে শিখেছি  রিকশাওয়ালা, মেথরদের ভাষা।আমার খুব প্রিয় বন্ধুটির  বাবা ছিল রিকশাওয়ালা। 'ওরা কাজ করে', 'সাম্যবাদী', 'পড়তে জানে এক মজুরের প্রশ্ন' এই কবিতা গুলো আমার খুব প্রিয় কবিতা। বাংলা পড়তে পারায় আমার সমস্যা ছিল না ভাগ্যিস, নইলে এই জীবন-যন্ত্রণার কথা কিভাবে বলতাম? 

ভদ্রলোকের ভাষা শেখার স্কুলে ভর্তি করার স্বপ্ন ভুল বশতঃ দেখে ফেলি। 

আমার বাবার একাজ করে কেটেছে ,কেটেছে আমার মায়েরও। আমিও এইভাবেই চলছি। টিয়া দুবেলা রান্না করে ,ছেলেটাকে দেখাশোনা করে। আমি ময়লা তোলার কাজ করি বলে, প্রথম প্রথম এক বিছানায় ওর ভীষণ ঘেন্না হত। 

সক্কাল থেকে যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঠেলাগাড়িতে পচা শাক সব্জি,তরকারি, পচা মাছ,মাংস, পচা দুর্গন্ধযুক্ত ভাত বয়ে বয়ে নিয়ে যায়, দুর্গন্ধপূর্ণ মেয়েলি ন্যাকড়ার  প্যাকেট বয়ে বেড়ায়, তার গা থেকে কিসের গন্ধ বেরোবে? টিয়া-টাই বোকা। একটা ছেলের মা হয়ে গেল, অথচ এই সোজা হিসেব গুলো কেন বোঝে না ও? 

সব ভদ্রলোক খারাপ হয় তা আমি বলিনা, তবে আমি খারাপদের দেখেছি বেশি। রোজকার রোজ ময়লা দেবে না, সক্কাল সক্কাল মহারাণীদের ঘুম ভাঙে না, কেউ বলবে, 

'কলুদা, কি বাঁশি বাজাও যে  সে বাঁশির  আওয়াজ বাড়ি ঢোকে না?'

আমি আগে চুপচাপ সব কথা সহ্য করতাম। কিন্তু এখন আমি দিই উত্তর। আমাদের মুখ আপনারা ভয় পান, আমি বুঝি। 

মাইনে বাড়ানোর অনুরোধ কতবার আমরা জানিয়েছি, সে আমি গুনতি করে এখন বলতে পারব  না, তবে সে অনেকবার। 

কাজ কামাই করলেই ভদ্রলোকের বউ গুলো যা মুখ করে কথা বলে, ভয় দেখায় পৌরসভায় গিয়ে অভিযোগ জানাবে নাকি, আমি আগে ওদের সব কথায়  ভয় পেয়ে যেতাম, এখন জানি শ্যামাদা আছে।  তাই রক্ষে। 

বেশি বললে, দেখে নেব।ওর মামাশ্বশুরের এক চেনা লোকের স্থানীয়  নেতাকে ধরা আছে,তার আশীর্বাদের হাত আমাদের মাথার ওপর। তাই আমাদের দলের সব লোকেরা শ্যামাদাকে সম্মান করে খু-উ-উ-ব।

সেই  ঝুপড়িতে জন্ম হওয়া অব্দি দেখেছি, স্কুলে পড়া থেকে কোনো ভদ্রলোকের সুন্দরী মেয়ে আমাদের দিকে ফিরে তাকায়নি। কোনোদিন আমাদের সাথে ভদ্রলোকেরা  চা খায়নি। কোনোদিন বউদের সাথে সিনেমা দেখতে যাওয়া হয়নি। বস্তিতে আবার নোংরাতোলার ছেলের  সাথে প্রেম ! কেউ শুনেছে আজ অব্দি? 

টিয়ার আগে আরেকজন আমার নজর কেড়েছিল আরেকজন । টকটকে ফর্সা একটা লম্বা গড়নের মেয়ে, চুড়িদার,ওড়না,আর একটা কালো টিপ আর কিছুই লাগত না মেয়েটার। আমাদের অনেক বন্ধুরা তাদের পছন্দের মেয়েদের সাথে অসভ্যতা করতে যেত, চড় থাপ্পড় খেত। ওই আত্মাভিমান ওদের ছিল না, কোনটা অপমান ওরা আর নতুন করে বুঝতে চায়নি। জন্ম থেকে মা, বাবার  অসম্মান দেখে মানুষ হয়ে গেছে। তাই কোনটা ভালো কথা, আর কোনটা খারাপ কথা ওরা আলাদা করতে পারেনি কোনোদিন। 

ভীষণ ভাবে চাইতাম, একদিন যদি সেই মেয়েটা আমার সাথে একটু হেসে কথা বলে। 

  দূর থেকে দেখেছি। ছুটত ট্রেন ধরতে আমাদের বস্তির পাশের রাস্তা দিয়ে। মাথায় বাঁধত সুন্দর একটা লাল ক্লিপ। কোনোদিনও আমার দিকে তাকায়নি। আমি পড়া ছাড়লাম যেই, তবে থেকে টানা কতদিন ঠিক নটা দশের লোকাল ধরার টাইমে আমি জানলায় তাকাতাম। মেয়েটা ছুটত ব্যস্ততায়। নামকরা কোনো কলেজে পড়ত নিশ্চয়ই  আজ সে কোনো ভদ্রঘরের বউ হয়েছে। তবে আমি  স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। মেয়েটা আমার স্বপ্নে কাছে  আসত। কিন্তু সত্যিকারের জীবনে আমার কাছে আসেনি। আসবে না।  

আমাদের ঘর নোংরা, আমাদের বস্তি নোংরা,আমাদের বউরা নোংরা, সন্তানেরা নোংরা তাই মিশতে দিতে নেই, যদি এই নোংরার ছোঁয়া লেগে যায়, নাহ সে এক সাংঘাতিক কান্ড। 

আমাদের প্রেম থাকতে নেই। আমাদের দুঃখ থাকতে নেই, আমাদের মনখারাপ থাকতে নেই, আমাদের মোটা মাইনে থাকতে নেই। আমাদের সবসময় হাসি মুখে, হাসতে হাসতে ময়লা তুলতে যেতে হয়, হাসতে হাসতে ময়লা আলাদা করে ফেলতে যেতে হয়। 

হাসতে হাসতে রাস্তার ধুলো,‌ অগুনতি অচেনা  মানুষের কফ,থুতু, কুকুরের পায়খানা পরিষ্কার করতে হয়।

তারপর বাড়ি ফিরে স্নান করে নিজেকে করতে হয় পরিশুদ্ধ। সাবান ঘষে হাত পা হেজে যাচ্ছে। প্যাকেট প্যাকেট সাবান, ধূপকেনার খরচ আমি সামলাতে পারি না। টিয়ার আবার ঈশ্বরে আলাদাই ভরসা। ওর বিশ্বাস, আমাদের একমাত্র ছেলে রানা একদিন কলেজে ভরতি হয়ে, ভালো চাকরি করবে। আমি জানি সেটা সম্ভব নয়, রানাকে  আমি পড়া  দেখানোর সময় পাইনা। ওকে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করব ভেবেছি, হরিজন বিদ্যালয়ে। ও পড়তে চায় না । ঠিক মত এক থেকে একশো গুনতে শেখেনি,লিখতেও না। একটা টিউশন জোগাড় করব ,হ্যাঁ তাড়াতাড়ি খুব। চোখের সামনে আরেকটা সাফাইকর্মী আমাদের এই বংশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে কিনা আমি জানি না। 

আমাদের বস্তির ছেলেমেয়েগুলোর দৌড় ওই ক্লাস ফোর কি ফাইভ, ব্যাস তারপরেই 'নষ্ট ছেলে'-দের দলে নাম লেখানোর  দরুণ 'ভালো' কিছু আর করা হয়ে ওঠে না।

আমি পড়তে চেয়েছিলাম আরো অনেকদূর, কিন্তু পয়সার দরকারে আমায় এই পেশায় নামতেই হত। হলোও তাই। 

ভদ্রবাড়ির ছেলেদের মত প্রেম করতেও চেয়েছিলাম, চেয়েছিলাম একটা ভালো দোতলাবাড়িতে থাকতে। টিয়াকে সাজিয়ে রাখতাম, রানাকে পড়াতাম ভালো ইস্কুলে। আমাদের ঠিকানাটা হত এই শ্যামপুর বস্তির পুরো অন্যদিকে। কোনো যোগাযোগ থাকত না এখানকার সাথে। কিন্তু আমি এমনি পাগল, যে ভুলে যাই সবটাই আমার কল্পনা।

চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে ফারাকটা আজো বুঝলাম না। 

আমাদের লাজ নেই, শরমও না। সবার সামনে স্নান করে, গামছা পরে ঘরে জামাকাপড় পরে বস্তির বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারতে হয়, হাসিমুখে মদ খেতে হয়।

সাধুদার নাতি বক্স আনল, গান বাজালো। রাতে একটু আনন্দ করে, মুরগীর ঝোল দিয়ে  এক থালা গরম ভাত খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়তে হয় ওই মিথ্যে স্বপ্ন গুলো দেখার জন্য। 

আমার পাশে টিয়া আছে, আছে চারবছরের রানা। কাল আমায় উঠতে হবে, ভদ্রবাড়ির মেয়েদের হাতে আবর্জনার বালতি থেকে আবর্জনা গুলো আমার ঠেলাগাড়িতে ওঠাব। পারলে স্বপ্ন দেখার চোখকে উপড়ে টেনে ফেলে দেবো। আশীর্বাদ করবেন, যেন আরো বেশি হাসিখুশি থাকতে পারি। 


-সমাপ্ত-


অনন্যা সেনগুপ্ত 

৮০/১,  জি.টি. রোড, বৈদ্যবাটী হুগলি




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন