google-site-verification=aFCzFTmuVjPqPlrdWXeJSj2r_EMig_cypLnlmiUQpw0 re গল্প ।। আত্মরক্ষার অধিকার ।। রণেশ রায় - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

মঙ্গলবার, ১৭ জুন, ২০২৫

গল্প ।। আত্মরক্ষার অধিকার ।। রণেশ রায়


আত্মরক্ষার অধিকার

রণেশ রায়


উনার নাম সুমন বোস। বয়স পঞ্চান্ন ছাপ্পান্ন হবে।  চব্বিশপরগনার আমতলায় নিজের পৈতৃক বাড়িতে স্ত্রী সুজাতা কন্যা কল্যাণীকে নিয়ে থাকেন। একটা বেসরকারি সংস্থায় চাকুরী করেন। অবস্থা খুব ভালো না হলেও খারাপ নয়। দিব্বি চলে যায়। ভ্রমণ রসিক মানুষ। ছুটি পেলেই পরিবার নিয়ে কোথাও না কোথাও বেড়াতে যাওয়া। স্ত্রী ঘর সামলান মেয়েকে নিয়ে। মেয়ে  দেখতে শুনতে তেমন না হলেও তার দৃপ্ত হাসিমুখ নজর কাড়ে। সে প্রথম বর্ষের কলেজ ছাত্রী নিকটবর্তী কলেজে বিষ্ণুপুর এলাকায়। পড়াশুনায় মোটামুটি। একটু বারমুখী ।  বাবার সঙ্গে খুব খাতির। ওর মায়ের অভিযোগ বাবার কাছে মেয়ে প্রশ্রয় পায় তাই পরশুনায় তেমন মন নেই। তবে মায়ের সাহায্যে যে সে তৎপর  সে বিষয়ে মায়েরও সন্দেহ নেই।  মেয়ে একটু  বহির্মুখী বলে মায়ের চিন্তা। বাবা মেয়ের এই ব্যাপারে নির্লিপ্ত। আর সেটাই মেয়েকে একটু বেয়ারা করে তুলেছে বলে মায়ের ধারণা। সব নিয়ে ভালো মন্দে সুমনবাবুদের সংসার।


সুমনবাবু মেয়ের বহির্মুখী কাজে উৎসাহ দেন সন্দেহ নেই। সেটা যেন তাঁর গর্ব আর সেটাই স্ত্রী সুজাতার রাগের কারণ। মেয়ে কল্যাণী পাড়ায় ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলায় উৎসাহী ছোট থেকেই। একটু বড় হয়ে পাড়ার বেশ কয়েকটি মেয়েকে নিয়ে একটা ফুটবন টিমও করেছে। আজকের বিভিন্ন এলাকায় মেয়েদের ফুটবল খেলার রেওয়াজ চালু হয়েছে। সুজাতার বাবা সুমনবাবুর তাতে খুব উৎসাহ। তিনি নিজে এককালে ভালো খেলতেন। ফুটবল তার অন্তপ্রাণ। মেয়ের মধ্যে সেটা বাঁচিয়ে রাখতে চান। তাই মেয়ের টিমের মেয়েদের সঙ্গে মাঠে নেমে পড়েন। এখন কার্যত এই দলের উনিই কোচ। আসেপাশে কয়েকটা অঞ্চলের মেয়েদের ফুটবলের একটা টুর্নামেন্ট চালু করেছেন সুমনবাবু নিজের বাবার নামে। এতে মেয়েদের কাছে উনি খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। তবে নিজের স্ত্রী সহ অন্যান্য মায়েদের এমন কী বাবাদের কাছেও উনি সমালোচনার পাত্র। তাদের ভাবটা হোল ফুটবল ছেলেদের খেলা সেখানে মেয়েদের উৎসাহ দিযে সুমনবাবু ওদের পুরুষালি করে তুলছেন। এই অভিযোগ কেউ কেউ সরাসরি করেন। কিন্তু সুমনবাবু তা গ্রাহ্য করেন না।  সুমনবাবুর ভাবনা অন্য খাতে বয়। তাঁর মতে সবাইকে পড়াশুনায় ভালো হোতে হবে তার কি মানে আছে।খেলাধুলাও জীবনের অঙ্গ। সেটা ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে। আর আজ পৃথিবী জুড়ে মেয়েদের ফুটবল খেলা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তিনি আরও মনে করেন শুধু লেখাপড়াতেই মেধা লাগে তা নয়। খেলাধুলাতেও মেধা দরকার। একই সঙ্গে শারীরিক ক্ষমতার সঙ্গে খেলাধুলায় মেধাকে একই সূত্রে  বাঁধতে হয়। যেমন ফুটবল খেলায় কোন খেলোয়াড়কে কিভাবে সেন্টার করে কোথায় বল সহখেলোয়াড়কে দিতে হয় তা নিয়ে তাকে তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেটা লেখাপড়ার থেকে কঠিন কাজ।


কল্যাণী ভালো নাটক করে। সে কলেজে একটা নাটকের দল করেছে। কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তার খুব উৎসাহ। নাটকের দল নিয়ে সে বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করে। ওদের দলের নাম ছড়িয়েছে আসে পাশে বিভিন্ন অঞ্চলে। এ সব ব্যাপারে কল্যাণী বেশী যুক্ত থাকায় লেখাপড়ায় তার উৎসাহে ভাঁটা। মায়ের সঙ্গে কল্যাণীর খিট খিটানি লেগে থাকলেও বাবার সঙ্গে সে সাবলীল। আর এ নিয়ে সুমনবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে মনোমালিন্য। তবে এই বিবাদ স্থায়ী হয় না। মেয়ে নাটক খেলায় যখন পুরস্কৃত হয় তখন তা তার মায়েরও গর্ব যা স্বামীর সঙ্গে বিবাদের ক্ষততে কিছুটা মলম লাগায়। তখন স্বামী স্ত্রী দুজনের মেল বন্ধন। মা পাড়ায় মেয়ের কৃতিত্ব নিয়ে গল্প করেন।


মেয়ের গরমের ছুটিতে সুমনবাবু স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে শিলং বেড়াতে যান। সুমন বাবু কোথাও বেড়াতে গেলে শহরের কেন্দ্রে থাকেন না। শহর থেকে দূরে সেখানকার মানুষের মধ্যে আশ্রয় নেন। শিলং এ তিনি লাইটুমুখরায় একটা এলাকায় উঠেছেন। এ আধাশহরে  খাসিয়া মানুষের বাস বেশী। সুমনবাবুর একটা ঝোঁক আছে অঞ্চলের আদিবাসীদের জীবনযাপন তাদের পরিবার জীবনের বৈশিষ্ট বোঝার চেষ্টা করা। সেটা করা সম্ভব তাদের প্রত্যক্ষ সম্পর্কে এসে।মেয়ে কল্যাণীরও এ ব্যাপারে আগ্রহ।


সুমনবাবুদের হোটেলে কর্মরত লোকজন সবাই প্রায় খাসিয়া । তাদের সঙ্গে পিতৃ কন্যা দুজনেরই বিস্তৃত আলাপ। দুজনেই অল্প সময়ে ওদের ঘনিষ্ট হয়ে ওঠে। ওদের মাধ্যমে আরও অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়। এই আলাপ পরিচয়ে দুজনেই বুঝতে পারে এই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর পরিবার এক ধরণের মাতৃতান্ত্রিক পরিবার। মেয়েরা পরিবারের ঘরে বাইরে কাজে পুরুষদের তুলনায় বেশী যুক্ত। তারা ব্যবসা বাণিজ্য আয় অর্জনের জন্য চাকুরীবাকরিতে যেমন যুক্ত তেমতি গৃহস্থালির কাজে যুক্ত। পুরুষরা সেই তুলনায় অলস জীবনযাপন করে।মদ গাঁজার নেশায় ডুবে থাকে। মহিলারা ঘরে বাইরে কাজ করলেও পুরুষদের হাতে নিগৃহীত নয় তা নয়। তারাও নারী নির্যাতন ভোগ করে। আরেকটা জিনিস দুজনেই লক্ষ্য করে যে মেয়েরা একধরণের বড় ছুরি আত্মরক্ষার জন্য সঙ্গে রাখে যাকে কুকরি বলে। এই কুকরি দেখতে সুন্দর। হাতল খুব শৈল্পিক। পাহাড়ে জঙ্গলে পশুর বিরুদ্ধে এটা আত্মরক্ষার হাতিয়ার। শুধু পশুর বিরুদ্ধে নয় স্বামী যখন মদ্যপ অবস্থায় বেপরোয়া হয় তখন তাকে নিরস্ত্র করার হাতিয়ার এই কুকরি।


দেখতে দেখতে সাতদিন কেটে যায়। ফিরে আসার আগে সুমনবাবু একটা সুন্দর কুকরি কিনে আনেন। ওটার ওপর কল্যাণীর খুব নজর। বেড়াবার এই কদিন বাবা মেয়ের যেমন ব্যস্ততা মা সুজাতার তেমন নীরবতা। তিনি এসেছেন বেড়াতে। তাঁর কাছে দর্শনের বিষয়গুলো বেশী আকর্ষণীয়। তাই এর মধ্যে হোটেল থেকে কোথায় কী দেখতে যাওয়া যায় সেটাতেই তাঁর বেশী কৌতূহল। তাই আগ বাড়িয়ে মানুষের সাথে আলাপে সময় নষ্ট করা তাঁর পছন্দের নয়। তবে সেটা নিয়ে তিনি বিশেষ সরব নন কারণ তিনি সংখ্যা লঘু।


সুমনবাবুরা ফিরে আসেন শিলং থেকে। আবার সেই অভ্যস্ত জীবন। স্ত্রীর অনুযোগ বিশেষ করে মেয়েকে নিয়ে। সুমনবাবুর প্রশ্রয় তাই মেয়ের পড়াশুনা নয়  শুধু খেলা আর নাটক। এ নিয়ে সুমনবাবু বেশী কথায় যান না। তাঁর নীরবতা সুজাতাকে বিদ্ধ করে। এই নীরবতা যেন বুঝিয়ে দেয় সুমনবাবু ভুল করছেন না মেয়েকে প্রশ্রয় দিযে। এদিকে আবার মেয়ের বেয়ারাপনা আবদার। সে শিলং থেকে আনা কুকরিটাকে যেন খেলনা মনে করে। ওটা হাতে নিয়ে ঘোরায় ওটা দিয়ে এটা ওটা কাটে। মা বকলে বাবা মৃদু গলায় মেয়েকে বারণ করেন কিন্তু জোরে কিছু বলেন না যেন ওটা এমন কিছু নয়। তাতে সুজাতাদেবী আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। মেয়ের হাত থেকে কুকরিটা কেড়ে নিয়ে মাকে নিরস্ত করেন সুমনবাবু।


কল্যাণীকে নিয়ে মা সুজাতার চিন্তার শেষ নেই। পড়াশুনায় তেমন মন নেই। বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা। ওর বিশেষ বন্ধু অভিনন্দন। ছেলেটা মন্দ নয়। ওকে এ বাড়িতে কল্যাণী নিয়ে এসেছে। প্রায়ই আসে। সুজাতা নিশ্চিত জানে না তবে অনুমান করে হয়ত একটা কিছু। কল্যাণী পরিষ্কার করে কিছু বলে না। আর সুমনবাবু নির্বিকার। সুজাতা এ বিষয়ে কথা তুললে উনি পাত্তা দেন না। বলেন, "বয়েস হয়েছে বন্ধু হবে না! বন্ধুত্বে ছেলে মেয়ের কী আছে? আর যদি দুজনের প্রেম হয়ে থাকে তাতে কী আছে? " সুজাতার সন্দেহ হয় সুমন বোধ হয় জানে। মেয়ের বাবার সঙ্গে যা ভাব তাতে হয়তো বাবাকে বলেছে। কিন্তু মা হয়েও তিনি জানেন না। একটা অভিমান সুজতার।


সামনে কল্যাণীর কলেজে বাৎসরিক অনুষ্ঠান। মহাসমারোহে চলছে নাটকের রিহার্সাল। রিহার্সাল দিযে কল্যাণীর বাড়ি ফিরতে দেরী হয়। সেই নিয়ে মায়ের সঙ্গে বাকবিতন্ডা। সুমননবাবু নির্লিপ্ত। তিনি জানেন বেশী দেরী হলেও অভিনন্দন বা কেউ পৌঁছে দেবে। তবে আজকাল রাস্তা ঘাটে মেয়েদের একা যাতায়াত ততটা নিরাপদ নয় সেটা সুমনবাবুও জানেন।  সুজাতার কাছে সেটাই ভয়ের কারণ। আর মেয়ের যুক্তি হলো যদি ভয়ে সিটকে ঘরে বসে থাকতে হয় তাতে মেয়েদের বিপদ তো কমবে না বরং বাড়বে। মেয়ের এই আপোষহীন মানসিকতাকে সুমনবাবু শ্রদ্ধা করেন। তাই নিজের মধ্যে অজানা ভয় কাজ করলেও  মেয়েকে এই নিয়ে তেমন কিছু বলেন না। আর সেটাই হলো অন্য সবার মত সুজাতার কাছে বাবার প্রশ্রয়। এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটে। কল্যাণী বাবার কাছ থেকে শখের কুকরিটা নিয়ে আর দিতে চায় না। নিজের কাছে রাখে। বাবাও তেমন জোর করে না। বরং একদিন বলেন ওটা তোর কাছে রাখ। তবে দেখিস উল্টোপাল্টা করিস না। মেয়ে বোঝে বাবা বলেন জায়গা মত ব্যবহার করিস। মনে হয় পাহাড়ি মেয়েদের যেমন আত্মরক্ষার্তে সঙ্গে কুকরি রাখতে দেখা যায় আর সেটা সুমনবাবু সমর্থন করেন তেমনি কল্যাণীর কুকরি রাখা উনি পরোক্ষে হলেও সমর্থন করেন । তবে সেখানে জঙ্গলে পশুরা থাকে। কিন্তু এখানে তো তা নয়। তবে? প্রশ্নটা কল্যাণী মনে পোষণ করে। কিন্তু এতে সুজাতার রাগ বাড়ে। এই নিয়ে সুমনবাবুর সঙ্গে তাঁর একপ্রস্থ বিবাদ। তাতে মেয়ে মজা পায়।


কলেজের অনুষ্ঠানের দিন এসে গেল। মেয়ের সঙ্গে বাবা-মা অর্থাৎ সুমন বাবু আর সুজাতা দেবীও মেয়ের অনুষ্ঠান দেখতে গেছেন। সারাদিন ধরে অনুষ্ঠানে গান নাচ আবৃত্তি নাটক, কী নয় ! ভালোই কাটলো। আর মেয়ে নাটকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার/অভিনেত্রীর  পুরস্কার পেয়েছে। বাবা মা দুজনেই খুব খুশি।পাঁচটা নাগাদ অনুষ্ঠান শেষ। বাড়ি ফিরতে হয়। মেয়ের সব গুছিয়ে বেরোতে দেরী হবে। সুজাতা দেবী আর সুমনবাবু বাড়ি ফেরেন। মেয়েকে ওর বন্ধুরা পৌঁছে দেবে চিন্তা নেই। তাও সুজাতা দেবীর চিন্তা যায় না। পথে ঘাটে মেয়েদের বিপদ তাকে তাড়া করে।


কাজ সারার সঙ্গে একটু আড্ডা। আর অভিনন্দনের সঙ্গে একটু আড়ালে কথা বলা। এসব শেষে ওরা মানে কল্যাণী আর অভিননন্দন বেরোয়। সন্ধ্যা পার। অন্ধকার হয়ে এসেছে। বাস স্ট্যান্ড প্রায় দেড় কিলোমিটার। দুজনে হালকা চালে হাঁটতে থাকে। কারও অন্য কোন দিকে খেয়াল নেই। দুজনের মধ্যে প্রাণের কথা। কিছুদূর এগোলে কল্যাণী পেছনে কারও কারও পদশব্দ শোনে। শব্দটা  যেন ক্রমে পরিষ্কার হোতে হোতে ঘাড়ে এসে পরে। কল্যাণী অভিনন্দনকে বলে। অভিনন্দন বুঝে কল্যাণীকে নিয়ে দ্রুত পা চালায়। পেছনের ছায়ামূর্তিগুলোরও গতি বাড়ে। মানসিক ভাবে কল্যাণীর যুদ্ধের প্রস্তুতি। ও আক্রমণের আশংকা করে। ওদের এই জায়গাটার সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছে। এখানে কিছু ছেলেকে রোজই কলেজ যাতায়াতের পথে দেখা যায়। কটু দৃষ্টি আর মুখে বেলাগাম কথা যেন ওদেরই লক্ষ্য করে। বলতে বলতে দুজন সামনে এসে কল্যাণীর হাত ধরে টানতে থাকে। একজন অভিনন্দনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বলতে থাকে কেন ও মেয়ে নিয়ে মেয়েবাজি করছে। কল্যাণীকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যেন ওর অপরাধ। ওরা এসেছে কল্যাণীকে উদ্ধার করতে। অভিনন্দন রুখে দাঁড়ায় কিন্তু পারে না পড়ে যায়। বাকী দুজন কল্যাণীকে টানতে থাকে সামনে একটা বাড়িতে ঢোকাবে বলে। কল্যাণী বেপরোয়া হয়ে ওঠে। হাত ছাড়িয়ে মুহূর্তের মধ্যে জামার তলায় লুকিয়ে রাখা  বাবার দেওয়া কুকরিটা বার করে চালিয়ে দেয়। সামনে ছেলেটার পেটে লাগে। ও লুটিয়ে পরে। অন্য ছেলেটা পালায়। ইতিমধ্যে অভিনন্দন দৌড়ে ছুটে আসে। কল্যাণীর হাত ধরে সরিয়ে নেয়। কল্যাণীর হাতে উদ্যত কুকরি। বীর পুঙ্গদের অবস্থা কাহিল। পালাতে পারলে বাঁচে। অভিনন্দন কল্যাণীকে নিয়ে সামনে দাঁড়ানো একটা রিকশায় উঠে বসে। কল্যাণী রক্তাক্ত। ও নিজেকে লুকোয়। বাস স্ট্যান্ডে রিকশা আসতে ওরা নেমে পরে। সামনে একটা পাবলিক টয়লেটে কল্যাণী যতটা পারে পরিষ্কার হয়ে নেয়। তাও ইতস্তত রক্তের দাগ। ওখান থেকে ওরা বাড়ি আসে।


ওরা বাড়ি ফেরে। বাবা মা অপেক্ষায়। এসেই কল্যাণী বাথরুমে ঢোকে। অভিনন্দন সুমনবাবুদের সঙ্গে এটা ওটা কথা বলে রাত হয়েছে অজুহাত দেখিয়ে চলে যায়। কল্যাণী বাথরুম থেকে  বেরিয়ে ঘরে যাবে তখন সুজাতা ওকে ধরেন। মুখ দেখে বোঝেন ওর কিছু একটা হয়েছে। উনার তীক্ষ্ণ চোখে ধরা পরে কাপড়ে লেগে থাকা রক্তের দাগ। মেয়ের কাছে জানতে চান কী হয়েছে। ইতিমধ্যে সুমনবাবু এসে পড়েন। মেয়ের হাত ধরে এনে সোফায় বসান। মেয়ে মুখ খোলে। ইতিবৃত্ত সব  বলে। কিছু লুকায় না। সে এও বলে কুকরিটা সঙ্গে থাকায় সে আত্মরক্ষা করতে পেরেছে। 

নিজের ইজ্জত বাঁচাতে পেরেছে। অভিনন্দনকেও তেমন কিছু করতে পারে নি। আরও বলে কুকরির আঘাতে একজন মারাত্বক আহত। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। সব শুনে সুজাতাদেবী উত্তেজিত। স্বামীকে লক্ষ্য করে বলেন,


"বলেছিলাম না ওর থেকে কুকরিটা নিয়ে নাও। ও যা মেয়ে! আমার ভয়টাই সত্যি হলো। এবার বোঝ ঠেলা। পুলিশ এলো বলে। ধরে নিয়ে যাবে। হাজত বাস। আমাদের মুখ থাকবে না। তারপরতো কোর্ট আছে। বিচারে কী হয়! আর ওই জখম ছেলে যদি না বাঁচে তবে তো সোনায় সোহাগা।"


সুমনবাবু ঠান্ডা মাথায় স্ত্রীকে বোঝাবার চেষ্টা করেন কিন্তু কে শোনে কার কথা। সুমনবাবুও উত্তেজিত হয়ে বলেন:


" কুকরিটা সঙ্গে থাকায় তো ও বেঁচে গেলো। না হলে কী হোতে পারতো একবার ভেবেছো। যদি যৌন নির্যাতন ঘটত তবে সেটা কী এর থেকে ভালো হতো?

ওকে এই গ্লাণি নিয়ে বাঁচতে হতো। এতে একটা মেয়ে মানসিক রোগে আক্রান্ত হোতে পারে। পাড়া প্রতিবেশী ওকে কী চোখে দেখতো? বরং যা ঘটেছে সেটা ওর পক্ষে সম্মানজনক । ওর প্রতিবাদটা সম্মান পাবে। কেউ আর অনুগ্রহের দৃষ্টিতে ওকে দেখবে না। "


ইতিমধ্যে ঘটনাটা গন্ধে গন্ধে রটে গেছে। কয়েকজন খোঁজ করতে এসেছে। সব শুনে সবাই ওকে বাহবা দেয়। কেউ কেউ বলে ভালোই হয়েছে। ওদের মেরে ফেলাই ভালো।


সুজাতা কিছুটা ঠান্ডা হন। বলেন:


" এবার কী করবে? থানা পুলিশ হবে। সামাল দেবে কী করে? "


সুমনবাবু বলেন, "পুলিশকে আসতে হবে না। আমিই ওকে থানায় নিয়ে যাব। ও থানাকে সব কিছু জানাবে। যদি মনে করে পুলিশ ওকে গ্রেপ্তার করবে। তারপর কোর্ট তো আছে। আমি উকিল, আমিই কেসটা নিয়ে লড়বো। আর জানতো সংবিধানে আত্মরক্ষার অধিকার স্বীকৃত বলে একটা কথা আছে। দেখা যাক।"


সুমনবাবু মেয়েকে থানায় যাবার জন্য প্রস্তুত হোতে বলেন। আর অভিনন্দনকে ফোনে কী যেন জানান।

মেয়ে প্রস্তুত হয়ে এলে ওকে নিয়ে বের হন। মেয়েকে বলেন কোন কিছু না গোপন করে যেন গুছিয়ে সব বলে। ভয় পাবার কারণ নেই। ওদের কলেজে আজ যে প্রোগ্রাম সেটার কথাও যেন জানায় যাতে পুলিশ বোঝে এতো দেরিতে ওখান দিয়ে ওরা আসছিল কেন।


সুমনবাবুরা থানায় পৌঁছান। ওখানে অভিনন্দন ওদের অপেক্ষায়। সুমনবাবু অভিনন্দনকে আসতে ফোনে বলে দিয়েছিলেন। উকিল হওয়ার দৌলতে উনি থানার সঙ্গে পরিচিত। তাই বড়বাবুর সঙ্গে দেখা করতে সময় লাগে না। বড়বাবুর ঘরে ঢোকেন। সঙ্গে মেয়ে আর অভিনন্দন। বড় বাবু সুমনবাবুদের বসতে বলে জানতে চান তিনি লোকজন নিয়ে হঠাৎ কেন। সুমনবাবু হাসতে হাসতে বলেন,


" আপনাদের যেন আমার কাছে মানে আমার মেয়ের কাছে যেতে না হয় তাই "


বড় বাবু বলেন, " কী রসিকতা করছেন? কী হয়েছে বলুন"


সুমনবাবু মেয়েকে দেখিয়ে বলেন:


" এই আমার মেয়ে আর ও ওর বন্ধু অভিনন্দন।

মেয়ে এক অপকীর্তি করেছে। আইন ভেঙেছে তাই ওকে আপনাদের হাতে তুলে দিলাম। "


বড়বাবু এবার গম্ভীর হয়ে বলেন,

''খুলে সবটা না বললে বুঝব কী করে"


তখন সুমনবাবু মেয়েকে সব বলতে বলেন।

মেয়ে আদ্যপান্ত সব বলে। অভিনন্দন সেখানে ছিল সব দেখেছে বলে জানায়। তখন সুমনবাবু বড়বাবুকে বলেন,


"নিয়ম অনুযায়ী যা করার করুন। আমি কোন আর্জি জানাচ্ছি না। তবে ওই ছেলেটি কিছু করেনি বরং ও ওই দুর্বত্তদের হাতে মার খেয়েছে। আইনের চোখে যদি কোন অপরাধ করে থাকে সেটা আমার মেয়ে করেছে।" বড়বাবু জানান মেয়ের নামে অভিযোগ তিনি পেয়েছেন। একটি ছেলে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ওদের বাড়ির লোক নালিশ করে গেছে।


সুমনবাবু বলেন, "আইন অনুযায়ী আপনার যা ব্যবস্থা করার সেটা করুন"


"আমাকে তো আপনার মেয়েকে গ্রেপ্তার করতে হয়। হ্যাঁ তবে ও নিজেই যখন এসেছে সব বলেছে তখন ওকে থানায় রাখবো না বেশিক্ষন। আজ না হলে কাল কোর্টে তুলব। জামিনের বিরোধিতা করব না"। বড়বাবু বলেন।


সুমনবাবুর উত্তর, "ঠিক আছে। আত্মরক্ষার চেষ্টা যদি অপরাধ হয় তবে সেটা হবে । তবে ওই ছেলেগুলোর নামে ওরাও মানে আমার মেয়ে আর ওর বন্ধু FIR করবে। আপনারা সেটা নিন সেটাই আমার বলার। তারপর বিষয়টা কোর্টের। আপনাদের আর কী করার আছে?  আমি অপেক্ষায় থাকবো সংবিধান সত্যি কী বলে "।


বড়বাবু বলেন, "দেখুন আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমাকে উর্দি পড়ে যা করতে হয় তাই আমি করব। তবে আমাদের তরফ থেকে আপনার মেয়ের প্রতি কোন অসম্মান করা হবে না।  হয়তো কালকেই জামিন পেয়ে যাবে। আর আপনাদের FIR আমরা নিলাম।"


ধন্যবাদ জানিয়ে অভিনন্দনকে নিয়ে সুমনবাবু ফিরে যান।  কল্যাণীর চোয়াল শক্ত।


----------------


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন