দুর্নীতি : জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে
শ্যামল হুদাতী
এক জার্মান সংস্থা ট্রান্সপ্যারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ১৮০ দেশের ওপর দুর্নীতির সমীক্ষা করে তার ফলাফল প্রকাশ করে প্রতি বছর। যত কম নম্বর পায় সে দেশ তত দুর্নীতিগ্রস্ত। গতবছরের বিচারে ভারতের স্থান ৯৩ যা গত বছরের তুলনায় মাত্র এক পয়েন্ট কম। ভারতের সঙ্গে এক পর্যায়ে আছে কাজাখস্তান, লেসোথোর, মালদ্বীপের মত ছোট এবং অনুন্নত দেশ। ব্রাজিল আর্জেন্টিনা রাশিয়া তুরস্ক আরো নিচে।
আমাদের দেশের আর্থিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা হলো পশ্চিমি দেশের মতো হওয়া। একটু ঘুরিয়ে বললে, ভারতের বর্তমান সরকারের লক্ষ্য হলো আর্থিকভাবে আমেরিকা কাছাকাছি যাওয়া। আর রাজনৈতিকভাবে চীন বা রাশিয়ার মতো। এই মুহূর্তে চীনের উন্নয়নে যা চিত্র তাতে ভারত আগামী ১০ বছরে আর্থিক শক্তি চিনের সমগোত্রীয় হতে পারলে - অনেকটা পাওয়া হয়ে যাবে।
কি কারণে আমাদের উন্নতি বাধা প্রাপ্ত হচ্ছে - এর প্রধান কারণ দুর্নীতি। গত ১২ বছরের তথ্য অনুযায়ী ভারত একশোর মধ্যে ৩৬ পেয়েছে ২০১২-১৩ সালে যা বেড়ে ৪১ হয়েছে ২০১৮ সাল। কিন্তু তারপর থেকেই আবার নম্বর কমতে শুরু করেছে এবং অবস্থান খারাপ হয়েছে দিনকে দিন। যে সমীক্ষার ভিত্তিতে এই মূল্যায়ন - তারা দেশ জুড়ে মানুষকে প্রশ্ন করে যে সরকারি দুর্নীতি সত্যিই দেশের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করেছে? ২০২৩ সালে ৮৯ জন উত্তরদাতা স্বীকার করেছেন যে ইদানিং দুর্নীতি বর্তমানে মাথা চাগাড় দিয়ে উঠেছে আমাদের সমাজে। গত এক বছরে সরকারি পরিষেবা পেতে কি ঘুষ দিতে হয়েছে - এই প্রশ্নে ৩৯ জন উত্তরদাতা হ্যাঁ বলেছেন। এই পরিসংখ্যান সর্বভারতীয়। পরিমাণ এবং ব্যবস্থাপনা ব্যক্তি কেন্দ্রিক নয় বরং একেবারে প্রাতিষ্ঠানিক। যেমন ধরা যাক বেআইনি বাড়ি তৈরির খবর পৌর সংস্থার সর্বোচ্চ স্তরে জানিয়েও তা বন্ধ করা যায় না। এর কারণ হলো সর্বোচ্চ নিয়ামক জানেন এ দুর্নীতি সহ সকল দুর্নীতিগ্রস্তদের ভোটেই ক্ষমতা আসা যায়। কতিপয় নিয়ম মেনে চলা, নিয়মিত কর দিতে থাকা বাসিন্দাদের ভোট না পেলে কিছু যায় আসে না। আবার পুরসভা করের খাতায় নাম তুলতে গেলে বা রেজিস্ট্রেশনের সময় ঘুষ দিতেই হবে। আপনার বাড়ির পরিমাণ অনুযায়ী ঘুষ ধার্য হবে। না দেওয়া পর্যন্ত মিউটেশনের প্রশংসাপত্র বেরাবেই না । অনেক নেতাই কিছুদিন ঘুষের টাকা রাজভোগ, তারপর জেলের ভাত খাচ্ছেন । কিন্তু তাতে তথাকথিত ছোট-বড় দুর্নীতি কমছে কি?
কোন রাজনৈতিক দল ঘুষেতে প্রশ্রয় দেবে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেবে এবং মুহূর্তে তাদের সঙ্গে তারা মিশে যেতে দ্বিধা করবে না। দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিলে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি কিন্তু স্বল্প মেয়াদে কোটি কোটি টাকা রোজগার করে নিতে পারলে পরে পদচ্যুত হলেও ক্ষতি নেই। রাজনৈতিক দল দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে কিন্তু তাদের দায়িত্ব ছোট ছোট রাজনৈতিক পর্বে বিস্তৃত ।এই পর্বগুলোর ভারসাম্য দুর্নীতি ধরনের পরিমাণ থেকে মূলত আসে বলে বিশ্বাস।
দুর্নীতি ছোট বা বড় যে কোন পর্যায়ে সমাজের পক্ষে সমান ক্ষতিকারক। থানা পুলিশ কোর্ট- কাছারি ছোট পরিষেবাতে আবদ্ধ থাকলেও এই দুর্নীতি প্রচন্ড ক্ষতিকারক। বিভিন্ন ছোট দুর্নীতিতে যে পরিমাণ টাকা হস্তান্তর হয় তাতে এই দুর্নীতি বিভাজন করা শক্ত হতে পারে। চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা তোলা, রেশন কার্ড ,গরু পাচার করা, ত্রাণের ত্রিপল চুরি করা ইত্যাদি চরিত্রগতভাবে ছোট দুর্নীতি মনে হলেও এখানে জনগণের অনেকাংশ এই দুর্নীতির বেড়াজালে আটকে যায়। এই ক্ষেত্রে অনেকে স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ করছে, ফলে দুর্নীতিজনিত টাকার অংক প্রচুর পরিমাণ। দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে দেশের দীর্ঘমেয়াদে লোকসান এবং দুর্নীতিজনিত টাকার অংক মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
যে দেশগুলো দুর্নীতিমুক্ত বলে পরিচিত তারা অধিকাংশই উত্তর বা পশ্চিম ইউরোপের দেশ যেমন এক নম্বরে আছে ডেনমার্ক দুই ফিনল্যান্ড তারপর নিউজিল্যান্ড নরওয়ে সিঙ্গাপুর সুইডেন জার্মানি ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব দেশগুলো উন্নয়নের নির্দিষ্ট ধাপগুলো পেরিয়ে আসতে হয়েছে সময়ের সঙ্গে। পারিপার্শ্বিক কারণে সম্পদের প্রচুর প্রাচীন মৌলিক অবস্থানের সহায়তায় তারা এগিয়ে গিয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে উন্নয়নের গতি রুদ্ধ বা স্লথ হয়েছে পরাধীনতার যুদ্ধ, মহামারী,দেশভাগের ক্ষেত্রে ইত্যাদি ইত্যাদির কারণে। উন্নতির ধাপগুলোর সঙ্গে পশ্চিম দেশ নির্দিষ্ট লক্ষ্য দুর্নীতি কমাতে পেরেছে কিন্তু উন্নয়নশীল দেশ পারেনি। তা প্রধানত সম্ভব হয়েছে রাজনৈতিকভাবে পশ্চিমে দেশগুলো উন্নত গণতন্ত্র কায়েম করতে পেরেছে বলে। সামাজিক চিন্তাবিদরা দাবি করেন যে সত্যতা ও তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং তাকে সামাজিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে দুর্নীতি রোখা সম্ভব।
আমাদের দেশে এখন কি দুর্নীতি স্বাভাবিক হয়ে গেল? মনে পড়ছে মাত্র এক যুগ আগে তখন আমি চাকরির সূত্রে দিল্লিতে, তখন আন্না হাজারে লোকপাল বিল প্রণয়নের দাবিতে অনশনে বসেছিলেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সারাদেশে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক প্রতীক। সেই আন্না হাজারে এখন ভারতের সামাজিক রাজনৈতিক পরিসর থেকে নির্বাসিত। সেই আন্দোলনে তার ছায়াসঙ্গী ছিলেন যে অরবিন্দ কেজরিওয়াল লোকপাল বিলটাকে লিখিত রূপ দেওয়ায় যার ভূমিকা ছিল অবিসংবাদী। কিন্তু কি আশ্চর্য আজ তিনি ও দুর্নীতি অভিযোগে অভিযুক্ত। এর আগেও দু-দুটি বিধানসভা নির্বাচনে দুর্নীতি হয়ে উঠেছিল অন্যতম মুখ্য ইস্যু অথচ নির্বাচনের ফলাফল তার কোন প্রভাবই পড়েনি। দুর্নীতিতে আমজনতার আদৌ কি কিছু আসে যায়?
তবে একটা সময় ছিল যখন আমাদের দেশে দুর্নীতি খুব একটা স্বাভাবিক বিষয় ছিল না। বোফর্স কেলেঙ্কারিতে তোলপাড় হয়েছিল দেশ। পশু খাদ্য কেলেঙ্কারি আলোচনা করলে সবার আগে সিবিআই অফিসার ডক্টর বিশ্বাসের নাম সবার আগে মনে পড়ে। তিনি তার ডাইরেক্টরের কথা অমান্য করে পাটনা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন এবং লালু প্রসাদ যাদবের মত জন নেতাদের জেলে পাঠাতে বেশি বেগ পাননি। দুর্নীতি আজকের মত এতখানি সামাজিক মান্যতা পায়নি কিন্তু দুর্নীতির সঙ্গে লোক লজ্জার কোন সম্পর্ক আজ আর নেই। এমন হল কেন ? আমার মনে হয় আমাদের জনগণ আজ বোধহয় মোটামুটি সহমত হয়ে গেছে যে দুর্নীতি আমাদের সামাজিক অঙ্গ!
সবচেয়ে মজার ব্যাপার এই যে আদালতে চাকরি হারানো স্কুল শিক্ষকদের নিয়ে শহরে, গ্রামগঞ্জে বিভিন্ন নিম্নবিত্ত মানুষদের মধ্যে কৌতূহলের অভাব নেই। কিছু ক্লাব সদস্যদের অভিমত যে সব জায়গাতেই টাকা দিতে হয় , ১০ টাকার রোজগার করতে চাইলে ২ টাকা ঘুষ দিতেই হবে এটাই সর্বভারতীয় নিয়ম।
আমাদের দেশে কালো টাকার মালিকরা দিব্যি আছেন। বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে অনায়াসে বিদেশেও চলে গেছেন কেউ কেউ। এভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইটা যে সম্পূর্ণ ফাঁপা একথা সাধারণ মানুষ বুঝেছে । ঘর করতে শিখে নিয়েছে - বুঝে গেছে ১০ টাকা রোজগার করতে গেলে দুটাকা ঘুূষ দিতেই হবে।
রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরাও এই সারসত্য বুঝে গেছেন যে সাধারণ মানুষ দুর্নীতির প্রশ্নে আর তেমনভাবে বিচলিত নয়। ভোট বাক্সে দুর্নীতি আর এদেশে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। সে জায়গাটি দখল করে নিয়েছে আইডেন্টি পলিটিক্স। তাই সহজেই বলে দেওয়া যায় যে যোগ্য প্রার্থীর মত অযোগ্য প্রার্থীর পাশে সরকার থাকবে। দুর্নীতিকে সরকারি সিলমোহর দেওয়ার এই স্পর্ধা কিছু বছর আগেও বিরলই ছিল। আজ আর নেই। কারণ যাদের ভোটে ক্ষমতার অংকের ফলাফল নির্ধারিত হয়, সেই সব জনগণদের আর দুর্নীতি নিয়ে আর কোন মাথা ব্যাথা নেই - বলেই আমার মনে হয়।
*চিত্রঃ সংগৃহীত
-----------------------------------
শ্যামল হুদাতী
357/1/13/1, Prince Anwar Shah Road,
P.O. Jodhpur Park,
Kolkata - 700 068
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন