ছায়া লেখক
অভীক মুখোপাধ্যায়
ফোনটা এল যখন তপন সদ্য টিউশানি করতে বেরোবে। কিন্তু ফোনটার পরে টিউশানি করতে যাওয়ার ইচ্ছেটাই আর রইল না। আনন্দে কি করবে সেটাই ভেবে উঠতে পারছিল না সে। সব্বার আগে তার ঘরের সরস্বতি ঠাকুরের সামনে একটা বড় করে পেন্নাম ঠুকে দুদ্দাড় করে নীচে নেমে সোজা মায়ের কাছে। রোজকার মত মা সেদিনও ছেলের জন্য জলখাবার বানাতে ব্যস্ত। এক ছুট্টে মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে তপন। আপাত গম্ভীর তপনের এ হেন ব্যবহারে মা তো বেজায় অবাক।
" কি হয়েছে রে তপু? শরীরটরীর সব ঠিক আছে তো?"
"মা! সিলেক্ট হয়ে গেছে! সিলেক্ট হয়ে গেছে!"
"কি সিলেক্ট হল রে ? পিএসসির রেসাল্ট বেরল বুঝি?" মা আন্দাজ লাগানোর চেষ্টা করে।
"আচ্ছা মা, তোমার মাথায় কি চাকরি ছাড়া অন্য কিছুই ঢোকে না? কোনো রেসাল্ট নয়, আমার উপন্যাসটা সিলেক্ট করেছে পাবলিশার। বই বেরোবে আমার, বই।"
"কি বলছিস রে! কবে বেরোবে? টাকা পয়সা কিছু দেবে তো?"
"মা, এখন টাকার কথা রাখ তো। প্রথম বই, প্রকাশক নিজে বের করতে চাইছে, ভাবতে পারছ!!!" তপন নিজের উত্তেজনা চেপে রাখতে পারে না। "তাড়াতাড়ি খাবার দাও, আমাকে এখনি ডেকেছে প্রকাশক। বেরতে হবে।"
"পড়াতে যাবি না? এবার কিন্তু এটাও যাবে। একটা কাজ কর, আগে পড়িয়ে নিয়ে ওখান থেকে সোজা চলে যা।" রুটি সেঁকতে সেঁকতে মা মন্তব্য করেন।
"মা, আমি এই টিউশানি করে বাঁচতে চাই না, আমি লেখক হতে চাই, লেখক। আর কতবার বলব!" তপন যেন ফেটে পড়ে। মাও আর কথা বাড়া্ন না, ছেলেকে তিনি ভালোই চেনেন। কিন্তু শুধু লিখে কি পেট চলবে? তাই না বলেও পারেননা। ছেলেটাও হয়ছে ঠিক বাবার মত, স্বপ্নের জগতে থাকতে ভালবাসে, বাস্তব বুদ্ধি একদমই নেই।
চুপচাপ খেয়ে উঠে যায় তপন, নিজের ঘর থেকে সাইড ব্যাগটা নিয়ে সোজা বেরিয়ে পড়ে। দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় শুনতে পায় মায়ের গলা
"দুগগা দুগগা, সাবধানে যাস বাবা, তাড়াতাড়ি ফিরিস"
মনের মধ্যের খুশি খুশি ভাবটা যেন কোথায় গায়েব হয়ে গেছিল মায়ের সঙ্গে কথা বলার পর, একটু ফ্রেশ হওয়া ভীষণ দরকার। প্রদীপদার চায়ের দোকানে দাড়িয়েই পড়ে তপন।
"একটা চা দাও তো প্রদীপদা।"
"আরে, সকাল সকাল এত সেজেগুজে চললে কোথায়?" চা বানাতে বানাতে প্রদীপদা জিজ্ঞেস করে।
"একজন প্রকাশক ডেকেছে, ওখানেই যাব একটু।"
"বাহ, খুব ভালো খবর, তো কিসের চাকরি বলেছে নাকি কিছু?"
"না না কোন চাকরি নয়, আমার লেখা একটা বই বের করবে তাই।"
"আরে ব্বাবা, সে তো বিরাট ব্যাপার, এবার তো তোমার নাম খবরের কাগজেও বেরোবে বল।" চায়ের ভাঁড় দিতে দিতে প্রদীপদা মন্তব্য করে।
তপনের মনটা ভালো হয়ে যায় আবার। একবার লেখাটা ছেপে বেরোক, হালচাল পড়ে যাবে চাদ্দিকে। হতে পারে খুব বড় প্রকাশক কিছু নয়, কিন্তু এরাই তো তার লেখার সঠিক মূল্যায়ণ করেছে। প্রথমে দশ বারোটা রিজেকসানের পর যখন একেবারে হতোদ্যম হয়ে পড়েছিল তখনই ফেসবুক পোস্ট দেখে পাঠিয়েছিল লেখাটা সপ্তাহ দুয়েক আগে, যদি বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে। আর তারপর আজকের ফোন।
অন্য সময় হলে সাধারণ বাস ছাড়া অন্যকিছুর কথা ভাবতই না, কিন্তু আজকের ব্যাপারটা আলাদা। তাই এসি বাসটায় উঠেই পড়ল তপন। সাধারণ বাসের তিনগুণ ভাড়া। টিউশানির টাকা পেতে এখনও কমপক্ষে দুসপ্তাহ , মাসের বাকিটা সিগারেটের বদলে বিড়ি দিয়েই কাজ চালাতে হবে। কিন্তু এখন ওসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নয়।
ঘন্টাখানেক বাদে কলেজস্ট্রীটের কাঙ্খিত ঠিকানার বাড়িটার সামনে পৌছে গেল তপন। বাড়িটা এখনও কিভাবে দাঁড়িয়ে আছে সেটাই বোধহয় পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য। অবশ্য অবাক হওয়ার তখনো অনেক বাকি। সরু এক ফালি দরজা দিয়ে ঢুকেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাইরে আলো থেকে এসে তপনের সবকিছুই কেমন যেন নিকষ কালো অন্ধকার মনে হল। চোখটা একটু সয়ে যেতে বুঝল একটা করিডরে দাঁড়িয়ে আছে, একটু এগিয়ে ওপরে যাবার সিঁড়ি। করিডোরটা মোটামুটি চওড়া কিন্তু দুদিকের দেওয়ালের ধারেই বইয়ের স্তুপ। কোনটা নতুন কোনটা পুরনো বোঝার উপায় নেই। মাথার ওপর তারের ফাঁক দিয়ে সিলিং দেখা যায় না। বইয়ের স্তুপকে কোনরকমে ম্যানেজ করে সে সিঁড়ির দিকে এগোয়। সিঁড়িরও সেই একই দশা। কোনরকমে একতলায় উঠে আবার লম্বা করিডোর, সেই বইয়ের স্তুপ, খালি মাঝে মাঝে দু একটা দরজা। কয়েকটা দরজার মাথায় বা পাশে ছোট্ট সাইনবোর্ড, বিভিন্ন প্রকাশক বা বিক্রেতার অফিসের নাম।
করিডোরের একদম শেষ মাথায় তপন খুঁজে পেল তার কাঙ্খিত নামটা। সাইনবোর্ডটা সম্ভবত স্বাধীনতার পর আর রঙের ছোঁয়া পায়নি, আর দরজাটার অবস্থাও তথৈবচ। মনে মনে সামান্য একটু দমে গেল যেন। কিন্তু সেটা মুহূর্তের জন্য, সামলে নেয় নিজেকে, " দিখাওয়ে পে মত যাও, আপনি আকল লাগাও"।
বন্ধ দরজায় হালকা করে টোকা মারে, কোন উত্তর নেই। একটু অপেক্ষা করে কড়াটা নাড়ে হালকা করে। নাহ, কোন উত্তর নেই। এবার একটু জোরেই কড়াটা নাড়ে। ভেতর থেকে একটা ভারি গলা শুনতে পায়, "ভেতরে আসুন, দরজা খোলাই আছে।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে তপন। চারিদিকে বই, শুধু বই, নতুন বইয়ের গন্ধ, কেমন যেন একটা ঘোর লাগে তার। মেঝেতেও পা রাখার জায়গা নেই, সর্বত্র বই, প্যাকিং কাগজ। কিন্তু কোন লোককে দেখতে পেল না সে। এদিক ওদিক দেখছে,সামনে বইয়ের স্তুপের আড়াল থেকে আবার সেই ভারি গলা, " এদিকে আসুন , কি দরকার? কাকে চাই?"
তপন এবার বুঝতে পারে সামনের বইয়ের স্তুপটা আসলে একটা বড় টেবিল। বই আর ফাইলে এমন ঢাকা পড়েছে যে উলটো দিকে কে বসে আছে দেখাই যাচ্ছে না। মেঝের বইপত্তর ম্যানেজ করে কোনরকমে উঁকি মারে টেবিলের ওপারে।
বয়স্ক এক ভদ্রলোক বসে আছেন সামনে খোলা ল্যাপটপ। বয়স যা মনে হল, ষাটের ওপরেই হবে, এক মাথা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া কাঁচা পাকা চুল, লম্বা জুলফি, সাদা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, দোহারা চেহারা।
"কি দরকার?" জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক।
" আমাকে ফোন করা হয়েছিল, আমার নাম তপন সরকার।" আমতা আমতা করে জানায় তপন। ফোনটা যখন এসেছিল, আনন্দের আতিশয্যে কে করেছিল ফোনটা সেটা জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছিল।
"আচ্ছা, আপনিই তপন সরকার! হ্যাঁ, আমিই কল করেছিলাম। চলুন বসা যাক পাশের ঘরে, এঘরে বসার জায়গা নেই একদম।" ভদ্রলোক চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ান।
ভদ্রলোকের পেছন পেছন বাইরে বেরিয়ে পাশের ঘরে ঢুকে তপনের আবার একচোট অবাক হওয়ার পালা। আগের ঘরটার ঠিক উল্টো। নিখুঁত পরিপাটি করে সাজানো। চার দেওয়ালে কাঁচের আলমারি ঠাসা বই, এক কোণে বিশাল নটরাজ মূর্তি, মনে হয় পেতলের। আর এক কোণে বিশাল টেবিল, সুদৃশ্য টেবিল ল্যাম্প, গদি আঁটা বিশাল চেয়ার।
ভদ্রলোক ঘরে ঢুকেই এসিটা চালিয়ে দিলেন। তপনের এতক্ষণে খেয়াল হল, সত্যিই বেশ গরম। উত্তেজনায় গরম ঠাণ্ডার বোধটাও যেন তার চলে গেছিল এতক্ষণ।
নিজে টেবিলে বসে, তপনকেও বসতে বললেন ভদ্রলোক।
"আমার নাম শশাঙ্ক লাহা, এই এস এল পাবলিকেসান আমিই চালাই। আমিই ফোন করেছিলাম আপনাকে।" ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দেন।
"আপনার লেখা আমার পছন্দ হয়েছে আর সেই কারণেই আপনাকে ডাকা। লেখা পড়ে আপনাকে বেশ পরিণত বয়স্ক মনে হয়েছিল, এখন দেখছি তো আপনার বয়স নেহাতই কম। তা বয়স কত আপনার? পঁচিশ?"
"না, এবার চব্বিশ হল, গত বছরই আমি মাস্টার্স কমপ্লিট করলাম।" তপন উত্তর দেয়।
"বাহ, বাহ, খুব ভাল, এত কম বয়সে এত পরিণত লেখা ভাবাই যায় না। তা কি করা হয়? মানে চাকরি বাকরি?"
"এখন কয়েকটা টিউশানি পড়াই, কয়েকটা চাকরির পরীক্ষা দিয়েছি.........।" পুরো কথাটা শেষ করতে পারে না তপন।
"হুম বুঝেছি, তা লেখা লিখি হচ্ছে কবে থেকে? আগে কোথাও ছাপা হয়েছে লেখা?"
"নাহ, সত্যি কথা বলতে কি, এটাই আমার প্রথম লেখা। দু একটা অণুগল্প বেরিয়েছে কয়েকটা অনলাইন ম্যাগাজিনে, কিন্তু সেগুলো বলার মত কিছু নয়।"
"কটা লেখা ছাপা হল সেটা বড় কথা নয়। যাক গে, তোমার উপন্যাসটা আমার ভালো লেগেছে, আমিই বের করব উপন্যাসটা।" ভদ্রলোক মানে শশাঙ্কবাবু গম্ভীর ভাবে জানালেন।
কথাটা শুনে তপনের মনের মধ্যে যেন অকাল দীপাবলি। মনের আনন্দ কোনরকমে চেপে বলে
"ধন্যবাদ স্যার, আমি আরও এইরকম লেখার চেষ্টা করব।"
শশাঙ্ক লাহা মাঝ পথেই তাকে থামিয়ে দেন, "আরে ধন্যবাদের আবার কি আছে! শোন ভাই, এই যাহ্, তুমি বলে ফেললাম, আসলে তুমি বয়সে অনেকটাই ছোট তো!"
না না স্যার, তুমিই ঠিক আছে" তপন সহাস্যে জবাব দেয়।
"শোন যেটা বলছিলাম, তোমার এই উপন্যাসটা আমি কিনছি। দশ হাজার দেব। কি রাজি তো?" টেবিলের পাশে রাখা একটা লোহার সেফ মত খুলতে খুলতে বললেন শশাঙ্কবাবু।
তপন ঠিক বুঝে উঠতে পারলনা কথাটা। কাঁচুমাচু করে জিজ্ঞেস করে," মানে স্যার, কিনে নেবেন মানে? বুঝলাম না ব্যাপারটা, মানে বই বিক্রি হলে তো......" শশাঙ্ক লাহা তাকে কথাটা শেষ করতে দেন না।
"শোন ভাই, তুমি নতুন লিখছ, কতজন তোমাকে চেনে? কে কিনবে তোমার বই?"
"কিন্তু স্যার আপনিই তো বললেন, আপনার পছন্দ হয়েছে, আপনিই বইটা করবেন" তপনের সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যায়।
"হ্যাঁ, ঠিক কথাই তো বলেছি, বইটা আমিই ছাপব, কিন্তু নামটা হবে এমন একজনের, যার নাম শুনেই লোক বই কিনবে। তাই বলছি, এই নাও দশ হাজার আর এগ্রিমেন্ট পেপার, সই করে দাও এখানে"
শশাঙ্ক লাহা এক তাড়া পাঁচশো টাকার নোট এগিদেন তপনের দিকে, সঙ্গে একটা ফর্মের মত কিছু।
তপনের চোখের সামনেটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যায়। নিজের নামে বই বেরোবে, ছাপার অক্ষরে নিজের লেখা, স্বপ্নগুলো সব যেন চুরচুর হয়ে যাচ্ছিল। টাকা তার দরকার, খুবই দরকার, কিন্তু টাকার জন্য নিজের স্বপ্ন বিক্রি করবে?
"কি হল, এত ভাববার কি আছে? দামে পোষাচ্ছে না?" শশাঙ্ক লাহার গলায় যেন একটা অধৈর্যের ভাব, বুঝতে অসুবিধে হয় না তপনের।
"না মানে আমি ভেবেছিলাম, আমার নামেই বেরোবে উপন্যাসটা, যেমন হয় আর কি!"
"শোন ভাই, একটা কথা বলি, এই লাইনে মাথার চুল পাকিয়ে ফেললাম, এই মোবাইলের জমানায় বড় বড় লেখকদের বই বিক্রি করতেই রাতের ঘুম উড়ে যাচ্ছে, সেখানে তুমি কে? চুনোপুঁটিও নও। নিজের নামে বই বের করতে চাইলে পকেট থেকে পয়সা ফেল, আমিই ছাপিয়ে দিচ্ছি।"
শশাঙ্ক লাহার কথাগুলো পুরোটা ঢুকল না তপনের কানে। তার চোখের সামনে তখন বছর দুয়েক আগের সেই রাত। লেখার টেবিলে বসে বাবা বলছিল , "আমাকে দেখে শেখ, খালি পেটে সাহিত্য হয় না। লিখছিস লেখ, মনের আনন্দে লেখ, কিন্তু পেট চালানোর জন্য শুধু লিখলে হবে না।"
তপন মুখ তুলে তাকায়, সামনের টেবিলের উল্টো দিকে যেন মা বসে। "তপু, একটু সিরিয়াস হ বাবা। শুধু লিখলে কি পেট চলবে? তোর বাবার মত ভুল করিস না বাবা।" তার চটকা ভাঙে শশাঙ্ক লাহার কথায়।
"কি ভাবছ টা কি ? আমার এত সময় নেই, কি করবে তাড়াতাড়ি বল?"
ঘণ্টা দুয়েক পরে তপন যখন বাড়ি ঢুকছে, মা দাঁড়িয়ে দরজায়,
" কি রে তপু? কোথায় ছিলি এতক্ষণ? তোর ফোনটাও বন্ধ।"
মায়ের পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢোকে তপন, কোন উত্তর দেয় না। ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করে মায়ের হাতে দিয়ে চুপচাপ ওপরে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।
ছেলের ব্যবহারে মা তো হতভম্ভ। এই তো সকালে এত আনন্দ করে বেরোলো! তপন ঘরের দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পর হাতের খামটার খেয়াল হয় মায়ের। খামটা খুলতেই চমকে ওঠেন, ভেতরে এক তাড়া পাঁচশো টাকার নোট।
------------------------------
অভীক মুখোপাধ্যায়
৩১/৩ রামনবমী তলা লেন
বালি হাওড়া
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন