ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভ গাঙ্গুলী সম্বন্ধে যে কোনো তথ্য আমাদের কাছে অক্সিজেনের সমান। সৌরভ গাঙ্গুলীর ক্রিকেট জীবন বিশ্লেষণ করলে,আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতীয় ক্রিকেটে বাঙ্গালীদের অবস্থান যে কতটুকু সে সম্বন্ধে একটা সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। সেই দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিচার করলে ভারতীয় ক্রিকেটে সৌরভ গাঙ্গুলী এক ব্যতিক্রমী চরিত্র।বারবার ভারতীয় ক্রিকেটে তার লড়াইটা নতুন রূপে পেয়েছি। জীবনের শুরু থেকে লড়াইটা শুরু হয়েছিল। ১৯৮৯ সালে তাকে বেঙ্গল ক্রিকেট দলের হয়ে খেলার জন্য নির্বাচন করা হয়। ঠিক সেই সময় দাদা স্নেহাসিশ গাঙ্গুলিকে বেঙ্গল ক্রিকেট দল থেকে অপসারিত করা হয়। জীবনের ক্ষীন আশা টুকু ও শেষ হয়ে যায়। হাল ছাড়েননি তিনি। ১৯৯০_১৯৯১ সালে এই দুই বছর তার জীবনের চরম মুহূর্ত। রঞ্জি ট্রফিতে ধারাবাহিক পারফরম্যান্স করার জন্য প্রথমবার ভারতীয় ক্রিকেট দলে খেলার জন্য সুযোগ পান। কিন্তু ডেবিউ ম্যাচে মাত্র ৩ রান করে আউট হন। যার ফলে ভারতীয় দল থেকে বাদ দেওয়া হয় তাকে। আবার শুরু ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। পুনরায় তিনি রঞ্জি ট্রফি খেলতে শুরু করেন। সাফল্য আবার সামনে আসে। ১৯৯৩_৯৪,১৯৯৪_৯৫ এই দুই বছরে ডোমেস্টিক ক্রিকেটে ব্যাপকহারে রান করেন ধারাবাহিকভাবে। এছাড়া দিলীপ ট্রফি তে ১৭১ রানের সুন্দর ইনিংস খেলেন। পুনরায় তাকে হাজার ১৯৯৬ সালে ইংল্যান্ড সফরে ভারতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ দেয়া হয়।টিম থেকে বাদ পড়ে যাওয়ার পরেও ২০০৭ সালে যখন ভারতীয় দলে আবার সুযোগ পান তখন একসময় ক্যাপ্টেন হলেও তাকে বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিংয়ে পাঠানো হয়।তবে তাতে বিচলিত না হয়ে তিনি পারফরম্যান্স দিতে কসুর করেননি কখনো। সেই খারাপ সময়ে ডাবল সেঞ্চুরি করে কিছুটা সাফল্যের মুখ দেখেছিলেন।
ভারত তথা বিশ্ব জুড়ে বাঙালির জয় জয় কার। একদিকে বাঙালি অর্থনীতি বিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দোপাধ্যায় এর বিশ্ব শিরোপার খেতাব জয়, অন্য দিকে এক সময়ে বিশ্ব ক্রিকেটে দাপিয়ে বেড়ানো বাঙালি ক্রিকেটার সৌরভ গাঙ্গুলী র ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি পদ লাভ স্মরণীয় দিনের বরণীয় মুহূর্তের সাক্ষী থাকলো সমগ্র বিশ্ব। আন্তর্জাতিক স্তরে তার ক্রিকেট জীবন শুরুটা মোটেই ভালো ছিল না। ১৯৯৬ সালে তিনি জীবনের প্রথম টেস্ট খেলেন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। সেই থেকে লড়াইটা শুরু করেছিল। ভারতীয় ক্রিকেটে বাঙালিরা বরাবরই বঞ্চিত ও উপেক্ষিত। সেখান থেকে সৌরভ গাঙ্গুলী ক্রিজে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে লড়াইটা দিয়ে এসেছে বরাবর। এক সময় ব্যাট হাতে ক্রিজে দাঁড়িয়ে সারা বিশ্ব দাপিয়ে বেড়িয়েছে। যে সময় ভারতীয় ক্রিকেটের বহু ক্রিকেটার "ম্যাচ ফিক্সিংয়"কলঙ্কময় কর্মে জড়িয়ে পড়েছিলেন সে সময় তিনি ছিলেন নিখুঁত পরিপাটি। তার হাতে তুলে দেওয়া হয় দেশের অধিনায়কত্বের ভার। তার সময়ে বহু নতুন উদীয়মান তরুণ প্রতিভা নিজেদের জীবন প্রতিষ্ঠিত করেছিল ক্রিকেটের মাঠে। সেইসব ক্রিকেটাররা তাকে দেবতার আসনে বসিয়েছে। শচীন-সৌরভ জুটিতে মাইলফলক স্টোন পার করেছিলেন। পুরনো রেকর্ড ভেঙে,নতুন রেকর্ড গড়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। সেই ক্রিকেটের বরপুত্রর হাতে ধরে চালু হতে চলেছে বিশ্ব চর্চিত ও অপেক্ষিত গোলাপী বলের শুভ সূচনা। তাও আবার কলকাতার ইডেন গার্ডেনস। ভারত-বাংলাদেশের দিন রাতের প্রথম গোলাপী বলের এই টেস্ট ম্যাচে আমন্ত্রিত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে ভারতীয় ক্রিকেট। তার কান্ডারী সবার প্রিয় সৌরভ গাঙ্গুলী। আবারো সৌরভ গাঙ্গুলীর হাত ধরে বিশ্ব ক্রিকেটের দরবারে নতুন ভাবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবে ভারত তথা বিশ্ববাসী।
বাংলার সেরা, বাঙালির গৌরব, প্রকৃত রয়েল বেঙ্গল টাইগার এর নাম সৌরভ গাঙ্গুলী।
ক্রিকেট জীবনে তার পদচারণায়,ভাটার টানে ও ভারতে নতুন কাপ এসেছে। ২২ গজে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে লড়াই করেছ,মেরেছ,চার, ছক্কা। স্টেডিয়াম পার করা মনমুগ্ধকর ছয় মারার সাথে সাথে স্টেডিয়ামের সমস্ত দর্শক উঠে দাড়িয়ে হাততালি দিয়ে অভিবাদন জানিয়েছে। কমেন্টেটর বক্স থেকে ধারাভাষ্যকারদের মুখ থেকে বহুবার শোনা গিয়েছে_"oh my God, what a big six",this is Maharaj Sourav Ganguly"। ক্রিকেটে তুখোড় অনেক দাপুটে বোলার তার ব্যাটের ত্রাসে হারিয়ে গেছে ক্রিকেটের ইতিহাসে।অনেক পিচে বুঝিয়ে ছিলে তুমি ব্যাটের আসল মহারাজা। মহারাজের চিন্তা ধারায় এসেছে,ক্রিকেটে নতুন ধাপ। ভারতীয় ক্রিকেটে সে সময়ে এসেছিল নবজাগরণ। মহারাজা ছিলেন ক্রিকেটের আদর্শ নেতা।দিশা হীনদের শিক্ষা গুরু।উদীয়মান, প্রতিভার যোগ্য পূর্বসুরী যাদের ক্রিকেট ছিল দিনের শুরু। সৌরভ গাঙ্গুলীর হাত ধরেই উঠে এসেছিল যুবরাজ সিং জাহির খান মোহাম্মদ কাইফ হরভজন সিং এর মতো উদীয়মান তরুন প্রতি ভা রা।এক সময়ে কালো বাজারীদের জুয়ার টানে হ্যান্সি ক্রোনিয়ে থেকে শুরু করে মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন মেখেছে কলঙ্কের মাটি। কিন্তু মহারাজা চরিত্র দেশের অহংকার ছি ল নিখুঁত পরিপাটি। আজও মনে পড়ে ইংল্যাণ্ডের মাটিতে,ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি জেতার স্মৃতি। চোখে চোখ রেখে লড়াই করা বোধ হয় সৌরভ গাঙ্গুলির থেকে বোধহয় কেউ বেশি জানে না।বিদেশের মাটিতে ও সবার মন জয় করেছে। মহারাজা র ঝুলিতে হাজারো রেকর্ড গড়ে ফিরিয়েছ দেশের গৌরব। তিনি আর কেউ নন,বাংলা মায়ের দামাল ছেলে সবার প্রিয় দাদা সৌরভ গাঙ্গুলী আজ সবার চোখের মনি।
উপরোক্ত বর্ণিত সমস্ত তথ্যই সৌরভ গাঙ্গুলীর ক্রিকেট জীবনকে ঘিরে। কিন্তু ক্রিকেট জীবনের বাইরে ও একটা জগত আছে, সেটা হল মনুষ্য জগত। সেই জগতে আমাদের প্রিয় দাদা শুধুমাত্র একজন বিশ্বমানের ক্রিকেটার নন, একজন যোগ্য সমাজসেবী ও বটে। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে করোনা আবহাওয়াতে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে মনুষ্য জাতি। তাই করোনা সম্পর্কে নতুন করে বিশেষ কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। এই অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে দেশের সরকার লকডাউন ঘোষণা করেন।আর তাতেই সবথেকে বেশি শোচনীয় অবস্থা হয়ে পড়ে দীন দরিদ্র অসহায় খেটে খাওয়া মানুষগুলো। শুধু তাই নয় দেশের আর্থিক পরিস্থিতি বেশ খারাপ হয়ে পড়ছে ক্রমশ। দেশজুড়ে করনা মোকাবিলায় এগিয়ে আসছেন সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা। বিশেষ করে দেশের ক্রীড়াবিদরাও নিজেদের সাধ্যমত সাহায্য করছেন। সেই তালিকা থেকে বাদ যায়নি মহারাজা সৌরভ গাঙ্গুলী নাম। দীন দরিদ্র অসহায় মানুষগুলোর কথা ভেবে তিনি পঞ্চাশ লক্ষ টাকার চাল দানের কথা জানিয়েছেন। শুধু তাই নয় নিজের উদ্যোগে মোট ১৫ হাজার কেজি চাল বিতরণ করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই চাল থেকে বেলুড় মঠের মহারাজের হাতে তিনি দুই হাজার কিলো চাল তুলে দেন। এছাড়া তিনি চাল সাহায্য করেন রাসবিহারী মোড় সংলগ্ন ভারত সেবাশ্রম সংঘ তে, কলকাতার ইডেন গার্ডেন্স থেকেও চাল বিতরণ করার ব্যবস্থা করে দেন। শুধু তাই নয় কলকাতায় যে সকল এনজিও এই দুঃসময়ে গরিব মানুষের হয়ে কাজ করছেন, তিনি তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন। তাদের হাতে ও চাল তুলে দেন। লকডাউন এর শুরুতে_"আমরা কি চা খাব না"কাকার ভিডিও ভাইরাল হয়, সেই চা কাকার বাড়িতেও চাল পৌঁছে দেন। প্রিন্স অফ ক্যালকাটার এ হেন উদ্যোগকে দেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন অনুগামীরা কুর্নিশ জানিয়েছেন। বাংলা মায়ের কোলে এমন সন্তান আছে বলেই আজও বাংলা মা গর্বের সাথে মাথা উঁচু করে বেঁচে আছে। দাদার এমন উদ্যোগ চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে যে মানবিকতা আজও পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যায়নি। তাই তো এসময় মনে পড়ে যায় বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ভূপেন হাজারিকার কন্ঠে গাওয়া সেই গানটি,_"মানুষ মানুষের জন্য/জীবন জীবনের জন্য"।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন