Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

গল্প ।। সুরজিৎ দাস



                           চেনা-অচেনা


    ট্রেন এসে থামল ধুপগুড়ি স্টেশনে। আন্দাজ তখন সকাল আটটা।

    বলে রাখা ভালো আমি একা ছিলাম না, সঙ্গে ছিল আমার স্ত্রী মৌসুমী আর আমার ছেলে পরিমল। এটা দুর্গা পুজোর আগে বেড়াতে যাওয়া ।লোকে যাই বলুক সত্যি কথা বলতে কি বাঙালির শ্রেষ্ঠ পূজা দুর্গাপূজায় বাড়ি -ঘর-দুয়ার ছেড়ে বাড়ির বাইরে যাওয়া আমার পছন্দ নয়। তাই অফিসের বেশ কয়েকদিনের ছুটি পাওনা ছিল তারই কিছুটা ব্যয় করে রওনা দিলাম ডুয়ার্সের দিকে।

    জায়গাটা আমার স্ত্রী মৌসুমীর'ই পছন্দের। সত্যি কথা বলতে কি পাহাড়ি এলাকা এত সুন্দর হয় তা আমার আগে জানা ছিল না। সারা রাতের ট্রেন জার্নিং-এর পর এক জায়গায় এসে বুঝতে পারলাম ট্রেনের গতি আগের তুলনায় অনেকটাই কমে এসেছে। জানালার ফাঁক দিয়ে হালকা ঠান্ডা বাতাস প্রবেশ করছে। তখন দেখলাম আমার স্ত্রী ওপরের বিছানা থেকে কখন নেমে পড়েছে। বাকিরা তখনও বেশ স্বচ্ছন্দে কম্বল চাপা দিয়ে ঘুমোচ্ছে।

    বিছানায় পরিমলকে একা দেখে বেশ কিছুক্ষণ জেগেই পড়ে রইলাম। কতক্ষণ কেটে গেছে জানিনা, এক সময় ট্রেনের এক হ্যাঁচকা ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে যেতেই ধড়ফড় করে উঠে দেখি আমারই পায়ের তলায় মৌসুমী জানালা খুলে বসে রয়েছে। একরাশ ঠান্ডা কুয়াশা প্রবেশ করছে খোলা জানালা দিয়ে।

  আমি চশমাটা চোখে দিয়ে দেখি ট্রেন শিলিগুড়িতে থেমেছে ।ট্রেন থামতেই একদল হকার কামরায় ঢুকে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই কামরার মধ্যে দেখা দিল ব্যস্ততা।

     ট্রেন এর পর থেকেই যেন ক্রমশ আস্তে আস্তে চলতে থাকে। বুঝতে পারলাম একে  পাহাড়ি এলাকা, তার উপর কুয়াশা। ট্রেনের গতি আস্তে হওয়াটাই স্বাভাবিক। মাঝে মাঝে গায়ে  হালকা ঠান্ডা বাতাস যেন হাত বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। দূরে পাহাড়ের সারি;  তাতে সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোথাও বা ট্রেনের ধার দিয়ে বয়ে গেছে স্বচ্ছ নদীর ধারা । পাহাড়ের বুক চিরে আঁকাবাঁকা পথ ধরে ট্রেন চলেছে। কোথাও বা লাইনের পাশে লেখা' হাতি পারাপারের জায়গা আস্তে চালান'। যেন এটাই একটা সাইড টুর হয়ে গেল আমাদের।

     আগে থেকেই আমাদের সব ঠিক করাই ছিল। ধূপগুড়িতে নামতেই দেখি ট্রেন প্রায় ফাঁকা হয়ে গেল। যে যার জিনিসপত্র নিয়ে নেমে পড়েছে স্টেশনে । স্টেশন একটু ফাঁকা হতেই একজন কাঁচা-পাকা দাড়ি গোঁফ যুক্ত মাঝ বয়সী ভদ্রলোক এসে বললেন "আপনি সৌরভ গাঙ্গুলী?" অবশ্য আমি যেভাবে বাংলায় বললাম সেভাবে তিনি বলেননি, তিনি  খোদ হিন্দিভাষী। হিন্দিতেই তিনি বললেন "ব্যানার্জি লজ থেকে আমাকে পাঠিয়েছে।"  অবশ্য হোটেল থেকে আমার গাড়ি পাঠানোর  কথা ছিল।

    তিনি হিন্দিতে বললেও প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন বাঙ্গালি। সে পরিচয় পেলাম গাড়িতে উঠে। তিনি এবার স্পষ্ট বাংলা ভাষায় বললেন আমি খুব খুশি হয়েছি।  আমি বাঙ্গালিদের খুব পছন্দ করি। কারণটা জানেন?
-না। কেন?
-কারণ ,এর আগে আমি অনেকদিন কলকাতায় ছিলাম। তাদের আপ্যায়ন আমি কোন দিন ভুলতে পারবো না।

   নানা প্রসঙ্গের পর গাড়িটা লাটাগুড়ির স্টেশনের নিচে সাবওয়ে দিয়ে গিয়ে লজের এর সামনে এসে থামলো।

    জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। চারিদিকে পাহাড়ি গাছপালা রয়েছে; আবার অনেকটা আমাদের পাড়াগাঁয়ের মতোই  লজের সামনেই রয়েছে খাল। খালের অপর দিয়ে গেছে লাটাগুড়ির রেললাইন।

   গাড়ি থেকে নামতেই এক বয়স্ক করে লোক এসে বললেন -"ভঞ্জ লাগেজগুলো নামা ।" আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন-" আসুন আপনি আমার সঙ্গে আপনার কিছু  অফিশিয়াল কাজ আছে। আমি মি .মল্লিক। কিছু অফিশিয়াল কাজ সেরে চলে গেলাম আমাদের কটেজে। ছোট ছোট পাথরের ঢালা রাস্তা। আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে ঘর রেখে  নমস্কার জানিয়ে চলে গেল ভঞ্জ।

    পরিমল তখনও বেশ ক্লান্ত ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই বিছানায় শুয়ে পড়ল।

    ঘর গুলো বেশ পরিপাটি করে সাজানো গোছানো। এই ঘরটি মাটি থেকে থামের সাহায্যে হাত চারেক উঁচুতে অবস্থিত। ঘরের ভিতরে সবকিছুর ব্যবস্থা রয়েছে।

    বিকেল তখন চারটে বাজবে। আজকে কোনো বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা নেই‌। কাজেই চারপাশটা দেখার জন্য বেরোতে যাব এমন সময় দেখি চাকর ভঞ্জ পিছু থেকে ডেকে বললো" বাবু চা খেয়ে যাবেন?"

    বিকালে চায়ের নেশা আমার বরাবরই নেই, তবু বললাম" হ্যাঁ হলে ভালোই হয়।"
 
   মৌসুমী মৃদু হেসে বলল -"কী ব্যাপার।  অন্যদিন খেতে চাও না আজ এক ডাকেতেই হ্যাঁ বললে।"

     "পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন অভ্যাসটাও পাল্টাতে ইচ্ছে হল" একবার মুচকি হেসে বললাম।

    পড়ন্ত রোদের আলো মৌসুমীর মুখে পড়ে এক অস্বাভাবিক সুন্দর লাগছে। ঠোঁটে হালকা গোলাপি আভা যেন শিশির ভেজা পদ্ম। মৌসুমীর কানে কানে বলতে যাবো এমন সময় ভঞ্জ এসে সব বরবাদ করে দিল।

    ভঞ্জ বেশ হাসিখুশি মানুষ ।বয়স্ক। এসে থেকে সে যেন আমাদের যত্নের দিকে বেশ নজর দিচ্ছে। এরই মধ্যে আমার স্ত্রীর মন ছুঁয়ে গেছে সে। এমন সময় সে বলে বসল-" বাবু এখানে বাজারে যাবেন? বেশ ভালো লাগবে।"

   " চলুন না বেশ হয়" চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলল"আমরাও নতুন, আমাদের চিনিয়ে দেবেন সবকিছু ,কেমন।"

   ভঞ্জ আমার ছেলে পরিমলকে দেখিয়ে বলল-" দাদাবাবু আপনার ছেলে ? কি নাম?"
- পরিমল
- বেশ সুন্দর । কী দাদুভাই কেমন লাগছে।

   পরিমলের বয়স বছর চারেক। কথা বললেও কথাগুলোর জড়তা ভাব কাটেনি। সে বলল "খুব ভাল লাগছে।"

      পথে যেতে যেতে ভঞ্জ এটা সেটা নানা কথা বলছে। এবার দেখছি সে যেন আস্তে আস্তে পরিমলকে ও  বশ করে নিয়েছে, নানা কথার ফাঁকে।

     আশ্চর্য ! মনের ভিতরটা কয়েকবার খোঁচা দিয়ে উঠলো। এই কিছুক্ষণের মধ্যেই মৌসুমী, পরিমলকে বশ করে নিল ! তবে কি সে বশীকরণ জানে? না না এ -কিরকমে হয়।

      বাজারে ঢুকতেই দেখলাম যেন আজ থেকে কুড়ি-প৺চিশ বছর আগে ফিরে গেছি আমাদের গ্রামের হাটে। মাটির ছোট ছোট চালাতে দোকান বসেছে, জামা-কাপড় ঝুলছে সার দিয়ে। বেশ লোকজন । মাঝে মাঝেই পরিমলকে দেখেছি।  এখন সে ভঞ্জের কোলে।  চলতে-ফিরতে বারবার কেমন যেন সন্দেহ জাগছে আমার মনে।

      সন্ধ্যা থামতেই লজে ফিরে আসি। মনের ভিতরটা কেমন যেন খচখচ করছে। তবে কি পরিমলকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইছে ।

     মৌসুমী বাথরুম থেকে ফ্রেস হয়ে এসেছে। পরিমল ভঞ্জের কিনে দেওয়া ট্রয়-ট্রেনটাকে নিজের মতো করে বিছানার উপর কু-ঝিক-ঝিক শব্দ করে চালাচ্ছে।

   মৌসুমী আমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরে জিজ্ঞাসা করল-" কী ব্যাপার বলতো? কিছু হয়েছে নাকি?"

    মৌসুমিকে কী সবটা বলবো! না না, থাক। বলে কোন কাজ নেই, আগে দেখাই যাক না।

" তুমি একটু ঘরেই থাকো । আমি আসছি ।"

    ম্যানেজারের ঘরের কাছে যেতেই দেখি ভঞ্জ আর ম্যানেজার নিজেদের মধ্যে হাসছে আর গল্প করছে। একটু আরি পেতে শুনলে কেমন হয়! আমাদের বিরুদ্ধে  কী  কিছু ষড়যন্ত্র করছে নাকি?

     কান পাততেই শুনতে পেলাম মি. মল্লিকের গলা-" তবে ভঞ্জ আবার তুমি সবকিছু ফিরে পাবে। কেমন লাগছে পুরনো স্মৃতি ফিরে পেতে?"

    "মি. মল্লিক দারুন লাগছে। পরিমলকে দেখলেই যেন আমার সেই সুবিমলের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।"

    দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর ভঞ্জ বলল "যাক সে কথা যা হারিয়ে গেছে তা তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তবে কি বলুন তো নামের কী আশ্চর্য মিল- পরিমল- সুবিমল চমৎকার মিল "।

   এবার আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম আমার কান ক্রমশ গরম হয়ে যাচ্ছে; মাথার ভেতর সব কিছু  কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। চোখ, মুখ গরম হয়ে আসছে।

    নিজেকে যেন সামলাতে পারলাম না । দরাম করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ি।

    আমাকে ওইভাবে আসতে দেখে মি. মল্লিক ও ভঞ্জ অবাক হয়ে বললেন " কি হয়েছে আপনার! কিছু সমস্যা!?"

    জানিনা তখন আমাকে কেমন দেখতে লাগছিল। ঘরের ভিতরে যেতে আমার মনে হল- না ,থাক; শত্রুপক্ষকে বুঝতে দিলে হবে না আমি ওদের মতলব বুঝে ফেলেছি। তাই নিজেকে একটু সামলে নিয়েই  বললাম " না না তেমন কিছু নয়। তা কি কথা হচ্ছিল?"

     তখন একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল "এই কালকে গরুমারা অরণ্যে আপনাদের যাওয়ার নিয়েই কথা হচ্ছিল ।"

   ভঞ্জ বলল "কাল একটু ভোর ভোর বেরুলেই  ভালো হয়। রোদ উঠে গেলে আর পশুদের নাও দেখা যেতে পারে ।"

   নিজের মধ্যে অস্বস্তিটা কাটাতে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে মি. মল্লিকের সামনে বসে পড়লাম ।

   ভঞ্জ বলল" বাবু আপনার বাড়িটা কোথায় যেন ?"
- তারকেশ্বর
-"বাবার ধাম "মি. মল্লিক বললেন" ওখানে সবাই বাবার আশীর্বাদপুষ্ট কি বলেন সৌরভ বাবু"।

    একটু থতমত খেয়ে কাষ্ঠ হাসি হেসে বললাম- "আজ্ঞেহ্যাঁ"

    ভঞ্জ বলল "আচ্ছা বাবার দুধপুকুরে কী সত্যিই দুধের পুকুর" একটু থেমে " মানে দুধপুকুরে কি দুধ আছে!"

--"না , দুধ নেই, শুধুই গঙ্গাজল আছে"।

     মি. মল্লিক হেসে বললেন" মানে  বাগবাজারে বাগ নেই বউবাজারে বউ নেই তেমন অবস্থার।"

      সত্যি বলতে  ঘরের পরিবেশটা বেশ গরম হয়ে উঠেছে ।আমার গায়ের জামাটা ভিজে সপসপ করছে।

     কাজেই একটু হেসে বললাম "আচ্ছা মি. মল্লিক ঘরের স্ত্রী-ছেলে একা আছে চলি"একটু খানি ভঞ্জ দিকে তাকে বললাম- "চলি ভঞ্জবাবু"।

   বাইরে আসতেই দেখলাম পূর্ণিমার চাঁদ মধ্যাকাশে, বাইরে ঠান্ডা হাওয়া এক নিমিষেই প্রাণ জুড়িয়ে  দিয়ে গেল।

    ঘরে গিয়ে দেখি মৌসুমী আর পরিমল টিভি দেখছে।

    আমাকে দেখেই মৌসুমী বলল "কি ব্যাপার?  কি হয়েছে বলতো?"

      "কই কিছু না তো" একটু অন্য দিকে তাকিয়ে বললাম "ম্যানেজারের কাছে গিয়েছিলাম কাল আমরা গরুমারা অরণ্যে যাচ্ছি, কেমন ।"

    মৌসুমী একগাল হেসে বলল" ঠিক আছে। এবার বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।"

    রাত তখন সাড়ে দশটা বাজেছে পরিমল খেয়ে শুয়ে পড়েছে মৌসুমী বিছানা করছে। চোখের ঘুম যেন আমার ছুটে গেছে। বাইরে পূর্ণিমার জ্যোৎস্না। চাঁদের আলো পাহাড়ের গায়ে গিয়ে পড়েছে,এক অসামান্য রূপের সৃষ্টি করেছে। চারিদিক নিস্তব্ধ ,তার মাঝে দূর থেকে ভেসে আসছে ময়ূরের ডাক ।

    রাত তখন কটা জানিনা। আমার চোখে ঘুম নেই, এই বেশ ভালো আছি। ঘরের বাইরেআমি পাহারায় ,ভিতরে মৌসুমী পাহারা দিচ্ছে। একবার দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলাম  রূপালী চাঁদের কিরণ কাঁচের জানালা ভেদ করে মৌসুমীর সমগ্র শরীরটাকে যেন ঢেকে দিয়েছে, মাঝে মাঝে বুকের ওঠানামা, ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ।অপূর্ব। তারই পাশে পরিমল গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন।

    ভোর তখন কটা খেয়াল নেই। যখন উঠলাম তখন ঝিপঝিপ বৃষ্টি পড়ছে বাইরে ।

    মৌসুমীর ঘুম ভেঙে গিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলল "কই গো শুনছো, আজ আর মনে হয় আমাদের যাওয়া হলো না, বাইরে বৃষ্টি পড়ছে ।"

     মনে মনে বেশ স্বস্তি পেলাম। যাক আজকের দিনটা তো কাটালো।  আর কোনো ক্রমে কালকের দিনটা কাটাতে হবে, কাল সন্ধ্যায় ট্রেন; তারপর আর কি ।

   মৌসুমীকে একটু বুকের কাছে টেনে নিলাম। আমার গরম নিঃশ্বাস তার ঠান্ডা মুখে পড়ছে। এই বেশ ভালো লাগছে।

    বৃষ্টি যখন থামল তখন সকাল দশটা বাজছে। মি. মল্লিকের কাছে যেতেই, মি. মল্লিক আফসোসের সুরে বললেন "সৌরভ বাবু আমরা খুব দুঃখিত ।কিন্তু কি করবো বলুন তো যদি বৃষ্টি পড়তে শুরু করে --"

      "না না , আপনারা আর কি করবেন। এসব তো তার ই ইচ্ছা! তিনি যদি না চান তো কারুর কিছু করার ক্ষমতা নেই।" প্রসন্ন হাসি হেসে বললাম ।

    বেলা অনেক হল , ভঞ্জের কোন দেখা নেই। অবশেষে দেখলাম দুপুরের খাবারের টেবিলে ।
কেমন যেন শুকনো শুকনো লাগছে মুখটা। শুকনো লাগারই তো কথা। আজ তাদের কেমন সব মতলব বানচাল হয়ে গেল ।

    পরদিন সকাল হতে না হতেই বেরিয়ে পড়লাম বিন্দু জলপ্রপাত দেখার জন্য।

     ভঞ্জ সামনে ড্রাইভারের পাশে বসে। আমি আমার স্ত্রী আর পরিমল মাঝে সিটে বসে আছি ।

     সত্যি বলতে, আজ সকালটা কেমন যেন অন্যরকম লাগছে । পাহাড়ি রাস্তা ভুটানের বর্ডার পৌঁছাতেই বেশ খানিকক্ষণ কেটে গেল। কিন্তু কী অপূর্ব দৃশ্য! তলায় ছোট ছোট বাড়ি, গাছপালা, মাঝে মাঝে পাহাড়ের গা ঢেকে দিয়ে যাচ্ছি কুয়াশার চাদর। তারপর আর আরোও এগিয়ে গেলাম। গাড়িটা যেন পাখির মত মেঘের ভেতর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, অসাধারণ সেই মুহূর্ত।

       একসময় গাড়ি এসে থামল  বিন্দু জলপ্রপাতের সামনে।বিকট আওয়াজ।  গাড়ি থেকে নামতেই  ভঞ্জ বলল -"বাবু আমি পরিমলকে দেখছি আপনারা আসুন। "

    না না ,তা তো দেওয়া চলে না। কায়দা করে সামলাতে হবে। ব্যাটা খুব চালাক। কোলে করে চম্পট দেবার মতলব করছে ।

     তাই একটু হাসি টেনে বললাম" না না ভঞ্জ তুমি কেন। তার চেয়ে এক কাজ করো, এই ক্যামেরাটা নিয়ে আমাদের কয়েকটা ছবি তুলে দেবে?"

     ভঞ্জ একগাল হেসে বললো "বেশ তো  দিন না। আমি এককালীন অনেক ছবি তুলেছি। দিন আমাকে" সাগ্রহে সে আমার কাছ থেকে নিয়ে নিল ক্যামেরাটা।

     বেশ চালাক। কেমন হাসিমুখে উত্তর দিতে হয় তাও জানে , আসল কথা হলো অভিনয়। অভিনয় না জানলে ছেলে চুরি করবে কেমন করে ।

     তবে হ্যাঁ কথায় বলে না, বড় কিছু পেতে হলে ছোট কিছু যাক না ; ক্ষতি কী । পরিমল তো আর আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে না ।

    বিকালে ট্রেনের আগেই রওনা দিলাম স্টেশনে। মি.মল্লিকও গেছেন ট্রেনে তুলতে। ভঞ্জের দেখা নেই ,তবে কি এরা শেষ চেষ্টায় আরোও একবার করবে নাকি!

      না , কিছুতেই হয় না। আর কয়েকটা মিনিট সাবধানে থাকতেই হবে আমাকে। সৌরভ বাবু মনে মনে ভাবলেন।

      ট্রেন আসতেই মি. মল্লিক ট্রেনে তুলে দিলেন। জানালার ধারের সিটে সৌরভ বাবু বসে। এখন তিনজনেই বসে আছি একই সিটে ।মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি না তো!।

     ট্রেন ছাড়ার  মুখেই ভঞ্জ এসে বললো" সৌরভ বাবু আপনার ক্যামেরাটা আর ছবিগুলো আমি প্রিন্ট করাতে গিয়ে ছিলাম তাই দেরি হয়ে গেল। "

     আজ ভঞ্জকে বড্ড নিরাশ দেখাচ্ছে। গায়ের জামাটা ভিজে গেছে। চোখদুটো কেমন যেন ভেজা ভেজা ।

    হাতে একটা খাম ও ক্যামেরাটা দিয়ে দিল।

      এবার তাদেরও একটা কিছু দেওয়া দরকার। যাক এই ক্যামেরাটা দিলে  এমন কি আর হবে। আমি ভঞ্জের হাত থেকে শুধু খামটি তুলে নিয়ে বললাম "ভঞ্জ তুমি আমাদের জন্য অনেক করেছো ।তার মূল্য দিয়ে আমি তোমাকে  ছোট করতে চাই না , বরং এই ক্যামেরাটা রেখে দাও। প্রকৃতির সুন্দর সুন্দর ছবি তুলবে।"
         ট্রেন  চলতে শুরু করেছে। মি. মল্লিক ও ভঞ্জ প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে রয়েছে ।
    ট্রেনের গতি এখন বেশ বেড়েছে, তিনজনে কামরায় পাশাপাশি বসে । খামটা খুলতেই দশ-পনেরোটা ছবি বেরিয়ে এলো, সঙ্গে একটা চিঠি।

প্রিয় বন্ধু,
তুমি হয়তো আমাকে চিনতে পারোনি, আমি তোমাকে ঠিকই চিনেছি ।
আচ্ছা ,তোমার মনে পড়ে আজ থেকে দশ বছর আগে শুকতারা পত্রিকার 'বন্ধুর চিঠির' কথা। তোমার সঙ্গে আমার সেই বন্ধুত্বতা  হয় চিঠির মধ্য দিয়ে। মাঝে দীর্ঘদিনের নানা কারণে  আর যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব পর হয়নি।
   তাই আজ তোমাকে দেখে আমার সংশয় হয়েছিল  আমি সাহস করে কিছু বলতে পারিনি।
       তাই তোমাদের না বলেই ফটোর এক কপি আমার কাছে রেখে দিলাম।
                                                       ইতি
                                            ভঞ্জন লাল বিহারী

সৌরভ ভেজা চোখে চিঠিটাকে আঁকড়ে ধরে থাকে।
                                ----@-----

                    
নাম:- সুরজিৎ দাস
ঠিকানা:- আঙ্গারু , হুগলি, চেচুয়া,৭১২৪০২
ফোন নম্বর:-৭৮৬৬৮৬৭০৮৭


মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩