Featured Post
প্রবন্ধ ।। শতবর্ষে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ।। সুবীর ঘোষ
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
শতবর্ষে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ । তাঁর শৈশব যৌবনের যে সময়কাল তখন প্রকৃতিতে এত বদল আসেনি । তখন ঋতুচক্রের একটা শৃঙ্খলা ছিল । বর্ষায় যেমন ঢল-নামানো বৃষ্টি হত তেমনি শীতকালে হাড়কাঁপানো ঠান্ডা পড়ত । সেপ্টেম্বর মানে ভাদ্র-আশ্বিনের শরৎকাল । আর মাস তিনেকের মধ্যেই সেই দুরন্ত শীত । নিরাশ্রয় ও দরিদ্র মানুষগুলোর কাছে শীত মানেই এক বিভীষিকা । কীভাবে কাটবে ওই দুস্তর রাত্রি ! কীভাবে কোথায় গেলে লুকিয়ে বাঁচতে পারবে তীব্র হিমেল হাওয়ার ছোবল থেকে সেই দুশ্চিন্তা বুঝি সারা জীবনেও ঘোচে না তাদের । এই ফাঁকে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা "শীত আসে" কবিতাটা পড়ে নেওয়া যাক্—
ভোর বেলা
রাস্তার ফুটপাতে
ন্যাংটো ছেলেরা
শীতকে ভয় দেখায়;
'শীত তুই এই দেশ থেকে
চলে যা! নইলে তোকে
বাঘে খাবে' ।
শীত যায় না
বাঘও আসে না বন ছেড়ে ।
যদি আসতো
ন্যাংটো ছেলেরা ভয় দেখাতোঃ
'বাঘ তুই
চ'লে যা , নইলে তোকে
শীতে খাবে !'
কবিতার প্রকাশভঙ্গি সরল । শব্দের কোনো জটিলতা নেই । কিন্তু শীতের ছোবলের মতোই তীক্ষ্ণ এর ব্যঞ্জনা , শ্লেষ এবং প্রতিবাদ । প্রতিবাদের কবিতা যে চীৎকৃত হতেই হবে এমন নয় । কবির মুন্সিয়ানা থাকলে শান্ত স্বরের মধ্যেই তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ করা যায় সমাজব্যবস্থাকে । কবির মতে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া নয় , প্রশ্ন করাটাই কবির ধর্ম ।
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গত শতকের চল্লিশ দশকের কবি। আমরা জানি ঐ চল্লিশ দশক ছিল এক অস্থির দশক । ভারত ছাড়ো আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে অন্যান্য স্বাধীনতা সংগ্রাম , স্বাধীনতা-উত্তর দাঙ্গা ও অভাব , ১৯৪৩-এর মন্বন্তর , দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইত্যাদি নানা ঘটনায় ভারত ছিল জেরবার । সেই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে কারোর পক্ষেই সরল কবিতাযাপন সম্ভব ছিল না । সঙ্গত কারণেই এক ঝাঁক তরুণ কবির মধ্যে এসেছিল প্রতিবাদ ও অধিকারচেতনার জোয়ার । কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন তেমনই এক কবি । তিনি লিখেছেন—"সময়,স্বদেশ, মনুষ্যত্ব—কবি,কবিতা ,কবিতার পাঠক—কোথাও যদি একসূত্রে বাঁধা যেত ?" আরো বলছেন – "চার দিকের নরকের মধ্যেও মানুষ স্বপ্ন দেখে" । তাঁর 'তিন পাহাড়ের স্বপ্ন' নামের কাব্যগ্রন্থে তাই জীবনের প্রত্যাশা ও পর্যালোচনাই ধ্বনিত হয়েছে ।
কবি লিখেছেন 'উলুখড়ের কবিতা' । এই উলুখড় অকিঞ্চিৎকর জীবনের নামান্তর । যাদের কথা ভাবার মতো সময় নেই সভ্য ভদ্র ব্যস্ত মানুষদের সেই অসহায় মানুষগুলোর সারাটা দিন কেটে যায় শুধু অন্ন চিন্তা করে ।
শুধু দুইবেলা দু'টুকরো পোড়া রুটি
পাই যদি তবে সূর্যেরও আগে উঠি ,
অথবা বেকারজীবনের পাঁচালি লিখতে গিয়ে কবি বলছেন—
আমাদের দিন বদলায় নাকো, মিতে !
হাঁ- করা জুতোটা অবাধ্য বড়ো , ভালো করে বাঁধো ফিতে !
নতুন দিনের নতুন স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে কবি বলছেন নভেম্বরের গানের কথা । কখনো নতুন চীনের কথা । এই দেশগুলিতেই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল অসাম্যহীন এক নবজীবনের প্রগতির কথা বলে । তাই তিনি সমতার কথা বলতে পেরেছেন অত্যন্ত সহজ ভাবে অথচ গভীরতায় ভরা দার্শনিক এক যাপন চিত্রের মধ্য দিয়ে ---
'ধর্ম যতদিন দুঃখী মানুষকে বেঁচে থাকার সাহস দেয়, ততদিন রাস্তা নিয়ে কারও সঙ্গে তার ঝগড়া থাকে না । রাস্তা কারও একার নয়' ।
জীবনকে তার অনাবিল সৌন্দর্যে দেখতে চাইতেন কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় । তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের ভাবনা ও ক্রিয়াকলাপ যদি স্বচ্ছ না হয় তা হলেই যত হানাহানির পরিসর তৈরি হবে । কবিতার মধ্য দিয়ে সে কথাই বলতে চেয়েছেন কবি ।
আমি অনেক হৃদয় দেখলাম
তোমার মতো গভীর কেউ না
আমি অনেক কবিতা জানলাম
তোমার পলিমাটির মতো না ।
এ কথা কবি নদীকে বলছেন । কবিতাটির নাম-'প্রার্থনাঃ নদীর কাছে' ।
কবি যাপনকে তুলে ধরেছেন কবিতার সৌন্দর্যের বিন্দুমাত্র হানি না করে । ক্ষুধার রাজ্যে তিনি কোনো শ্লোগান আঁকেননি কবিতায় । বরং স্থিতধীর মতো উচ্চারণ করে গেছেন তাঁর বিশ্বাসের কথা---
আমরা অনেক দিন
ক্ষুধার রাজ্যে নতজানু,
তারপর সইতে না পেরে
নিদ্রিত ছিলাম ।
ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের সময়ের কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় । তাই স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কবিতায় এসেছে মানুষের প্রথম দাবি খাদ্যের কথা । তাঁর একটি কবিতা আছে 'আশ্চর্য ভাতের গন্ধ' নামে । তাঁর অচঞ্চল অবলোকনের মধ্য দিয়ে কবি দেখেছেন সমাজে বঞ্চনা ও অসাম্যের ছবি ।
আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির আকাশে
কারা যেন আজো ভাত রাঁধে
ভাত বাড়ে, ভাত খায় ।
আর আমরা সারারাত জেগে থাকি
আশ্চর্য ভাতের গন্ধে,
প্রার্থনায়,সারারাত ।
অন্য একটি চমৎকার কবিতায় কবি অন্নবন্দনা করেছেন । অন্ন মানুষের প্রথম দাবি , প্রাথমিক অধিকার । কবিতাটি রচনার জন্য কবি ছান্দোগ্য উপনিষদ থেকে কথাসূত্র নিয়েছেন ।
'অন্নমিতি হোবাচ সর্বাণী হ বা ইমানি ভূতান্যান্নমেব প্রতিহরমাণানি জীবন্তি সৈষা দেবতা, প্রতিহারমন্বায়ত্তা তাঞ্চেদবিদ্বান্ প্রতিহরষ্যো মূর্ধা তে ব্যপতিষ্যৎ তথোক্তস্য ময়েতি তথোক্তস্য ময়েতি' ।
প্রতিটি জীবকেই খাদ্য গ্রহণ করে বাঁচতে হয় এবং খাদ্য সংগ্রহের জন্য প্রত্যেককেই পরিশ্রম করতে হয় ।
লোকসমাজে এই অন্নবন্দনা ঘুরে ঘুরে এসেছে । আমরা ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল পড়েছি । কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলছেন—
অন্ন বাক্য অন্ন প্রাণ অন্নই চেতনা ;
অন্ন ধ্বনি অন্ন মন্ত্র অন্ন আরাধনা ।
অন্ন চিন্তা অন্ন গান অন্নই কবিতা,
অন্ন অগ্নি বায়ু জল নক্ষত্র সবিতা ।।
এর পর উপনিষদে যা নেই কবি সেই জেহাদের বার্তা অন্তর্ভুক্ত করেছেন –
সে অন্নে যে বিষ দেয় কিংবা তাকে কাড়ে
ধ্বংস করো, ধ্বংস করো, ধ্বংস করো তারে ।।
এ কবিতা যখন লেখা হয় তার কিছুদিন পরেই পশ্চিমবঙ্গে শুরু হবে খাদ্য আন্দোলন ।
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অনেক ছোট কবিতা লিখেছেন । সেই সব কবিতাগুলো যেন বিদ্যুৎভরা । এমনই তাদের অন্তর্লীন শক্তি । তীব্র গতিতে ছুটে এসে পাঠকের প্রাণে বেঁধে । দেশের ব্যবস্থাগুলো যাদের দখলে তাদের কানে পৌঁছয় কী না তা অবশ্য জানা নেই ।
সারা দুপুর পাখিগুলি
রোদ পোহায় ;
সমস্ত রাত পাখিগুলি
শীত তাড়ায় ।
পাখির বদলে গৃহহীন মানুষ লিখলেও ঐ একই ছবি ফুটে উঠত । গৃহহীন ভিক্ষুকের কথাও তো বলেছেন সমান মমতায় –
আকাশে হাত বাড়ালে
হাসে সবাই আড়ালে ;
দুয়ারে হাত বাড়ালে
সবাই দেয় খিল ।
বলেছেন—'একবার মাটির দিকে তাকাও / একবার মানুষের দিকে' । সৎ মানুষ জন্মভুমিকে ভালোবাসে । শঠ ও প্রতারক ভালোবাসে শুধু নিজের স্বার্থকে । কবি তাই মানুষকে সাবধান করে দিচ্ছেন স্বদেশকে প্রকৃতভাবে চিনতে জানতে—
মানুষ রে, তুই সমস্ত রাত জেগে
নতুন ক'রে পড়,
জন্মভূমির বর্ণপরিচয় !
কবি তাঁর বিশ্বাসের প্রতি সৎ থেকেছেন আজীবন । ভাবতে চেয়েছেন পৃথিবীতে একদিন সুদিন আসবে । শোষণমুক্ত এক সমাজব্যবস্থার পত্তন হবে । সেই আশা দূরাশা কী না জানি না কিন্তু তিনি যে মানুষের কল্যাণকামনায় কোনো ফাঁক রাখেননি তা সুনিশ্চিত । কবি লিখেছেন ---
আয় কালবৈশাখী হাওয়া , ঝড় আন্
বুকের ভিতর, ভারতবর্ষকে দেখি অন্যভাবে , শপথে আলোকে ।
কে আর অনন্ত কান্না পুষে রাখে , পুড়ে যায় শোকে ?
চারদিকে নবজন্ম , দেশে দেশে শঙ্খ বাজে , শোনা যায় মানুষের গান ।।
কবিতাই ছিল কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে সত্য সন্ধানের মাধ্যম । কবিতার প্রতি তিনি সারা জীবন থেকেছেন অনুরক্ত ও বিশ্বস্ত । কবিতার মঙ্গলকারী শক্তির বিন্দুমাত্র হানি তিনি সহ্য করতে পারতেন না । কবিতার প্রতি অবজ্ঞা তাই তিনি নিজের প্রতি বঞ্চনা বলে মনে করতেন । এই মনোভঙ্গি থেকেই হয়তো তিনি লিখেছিলেন চারটি চমৎকার পঙ্ক্তি—
'কবিতা
তুমি কেমন আছো' ?
'যেমন থাকে ভালোবাসার মানুষ
অপমানে' ।
ভালোবাসার মানুষ অবহেলিত হলে অবসাদে ভোগেন , অভিমান হয় , তেমনই কবিতারও ।
কবিতার মতোই জীবনের প্রতিও কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সৎ, বিশ্বস্ত ও দায়বদ্ধ । তাঁর জীবন ছিল অনাড়ম্বর ছলনাবিহীন । একটি স্মৃতিচারণার সাহায্য নিয়ে কবিকে ব্যক্তিগতভাবে কিছুটা জানার চেষ্টা করব—
" বীরেনদা ছিলেন এক আপোষহীন তেজি লোক । অথচ ওঁর মুখের হাসি ও রসিকতা সব সময়ই অম্লান । আমাদের মতো অপোগণ্ডদের অবাধ আড্ডায় অকাতরে চা যোগান দিতেন রাণুবৌদি । যেই একজন ঢুকছে অমনি বীরেনদার হাঁক—রাণু আর এক কাপ—আজও যেন চোখে ভেসে ওঠে । যখনই বই বিক্রির সামান্য টাকা—তা দশ টাকা পনেরো টাকা, কারণ বইয়ের দাম তো এক টাকা দেড় টাকাই ছিল—দিতে গেছি। হাত বাড়িয়ে হাসিমুখে বলেছেন—আনছস্ , দে , কাজে লাগবো । কোনো সংকোচ নেই । একদিন দেখা করতে গেছি । বললেন—তোদের মন্ত্রীর কাছে আজ বই বিক্রি করে এলাম । সেই মন্ত্রী হলেন বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম অর্থমন্ত্রী, অশোক মিত্র । বীরেনদার রবীন্দ্র পুরস্কার পাওয়ার বেশ কিছুদিন পর দেখা করতে গেলাম । অনেকদিন দেখা করিনি বলে অনুযোগ করলেন । যখন বললাম—কিছুদিন তো আপনার এখানে বেশ ভিড় ছিল তাই একটু দেরি করে এলাম – একগাল হাসলেন । এইসব বিখ্যাত লোকদের সঙ্গে এমনি খোলামেলা কথা বলার সাহস পেতাম , কারণ ওঁদের বৈদগ্ধ্য ও আন্তরিকতায় এক ধরনের প্রশ্রয় থাকত হয়তো । ''
(উদ্ধৃতিটি উজ্জ্বল একঝাঁক পত্রিকার সেপ্টেম্বর ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত অধুনালুপ্ত দিনকাল পত্রিকার সম্পাদক বিকাশ পালের রচনা—বুড়ো হওয়ার আগেই থেকে নেওয়া ।)
***************************************************************
সুবীর ঘোষ // ৩০১ আশ্রয় অ্যাপার্টমেন্ট // গ্রুপ হাউসিং , বিধাননগর // দুর্গাপুর –৭১৩২১২ // চলভাষ---৯৯৩২৬৪০৯৪৯
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন