পুরাণ কথা (দুই)
-------------------------------------------------------------------------------------------
গত সংখ্যায় লিখেছিলাম দ্বাপরের শেষে কিভাবে হয়েছিল কলির প্রবেশ। আজ পুরাণের কলির অবতারের কথা উঠে আসবে।
'ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ'-সহ আরও কয়েকটি পুরাণ এই চার যুগ সম্পর্কে বিস্তারিত পাওয়া যায় যে বৈদিক সময়-ভাবনা অনুসারে কাল চক্রাকারে আবর্তিত হয়। অর্থাৎ সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি পর পর আসে। কলি যুগের পরে আবার সত্য যুগ ফিরে আসে। 'মহাভারত' থেকে জানা যায়, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ ঘটেছিল দ্বাপর যুগের শেষে। শ্রীকৃষ্ণের দেহত্যাগের মুহূর্ত থেকেই কলি যুগ শুরু হয়। বিষ্ণু পুরাণ"' অনুযায়ী ব্রহ্মা সত্যযুগে সমস্ত সৃষ্টিকর্ম করেন এবং কলিতে সমস্ত সৃষ্টি উপসংহার করেন। আজ চার যুগ আর কলির সমাপ্ত কিভাবে হবে সেই সম্পর্কে কিছু লিখব। তার অগে চার যুগের কথাই একটু আলোচনা করে নেই । অনেকেরই জানেন যে সত্য যুগ হল হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, চার যুগের প্রথম যুগ। সত্যযুগ অবতার সংখ্যা ছিল চার। মৎস্য (মাছ), কুর্ম (কুমির), বরাহ (শুকর), নৃসিংহ (মানুষ ও সিংহের সমন্বিত রূপ)। ছয় জন শাসক। বলি, বেণ, মান্ধাতা, পুরোরবা, ধুন্ধুমার, কাত্তাবীর্য্য অর্জুন। শুধু পুণ্য ছিল, পাপ ছিল না। প্রাণ ছিল মজ্জায়। মৃত্যু ছিল ইচ্ছাধীন। সোনার পাত্র ব্যবহার করা হত। বেদ ছিল সামবেদ। তীর্থ ছিল পুষ্কর তীর্থ। তারক ব্রহ্মনাম ছিল- নারায়ণ পরম বেদ, নারায়ণ পরম অক্ষর, নারায়ণ পরম মুক্তি, নারায়ণ পরম গতি।
##
ত্রেতা যুগ হলো , চার যুগের দ্বিতীয় যুগ। এই যুগের পালনকর্তা বিষ্ণুর তিন অবতার যথাক্রমে বামন, পরশুরাম এবং রাম। পুণ্য তিন ভাগ, পাপ এক ভাগ। সূর্য বংশের শাসক- ব্রহ্ম, মরীচি, কাশ্যপ, সাবর্ণিক, মনু, ধনু, সুষেণ, হরিদাস, যৌবনাশ্ব, মুচুকুন্দ, শতবাহু, বেন, পৃত্থু, ইক্ষাকু, দ্যোতকর, কৎসর্প, শ্রেষ্ঠধর, ককুৎস্থ, শতঞ্জীব, দণ্ড, হরিষ, বিজয়, হরিশচন্দ্র, রোহিতাশ্ব, মৃত্যুঞ্জয়, মহাপদ্ম, ত্রিশঙ্কু, উচ্চাঙ্গদ, মরুৎ, অনরণ্য, বিকর্ণবাহু, সগর, অংশুমান, অসমঞ্জা, ভগীরথ, অশ্বঞ্জয়, মণি, দীলিপ, রঘু, অজ, দশরথ, শ্রীরাম, লব, কুশ। প্রাণ ছিল অস্থিতে। বেদ ছিল ঋগ্বেদ। রূপার পাত্র ব্যবহার করা হত। তীর্থ ছিল নৈমিষ অরণ্য। তারক ব্রহ্মনাম- রাম নারায়ণ মুকুন্দ মধুসুদন। কৃষ্ণ কেশব কংসারে হরে বৈকুণ্ঠ বামন।
###
দ্বাপর যুগ
দ্বাপর যুগ হলো , চার যুগের তৃতীয় যুগ।
এই যুগের অবতার সংখ্যা দুই। শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধ। পুণ্য অর্ধেক, পাপ অর্ধেক। শাসক ছিল-শাল্ব, বিরাট, হংসধ্বজ, কুশধ্বজ, ময়ুরধ্বজ, বভ্রুবাহন, রুক্ষাঙ্গদ, দুর্যোধন, যুধিষ্ঠির, পরিক্ষিৎ, জনমেজয়, বিষকসেন, শিশুপাল, জরাসন্ধ, উগ্রসেন, কংস। প্রাণ ছিল রক্তে। বেদ ছিল যজুর্বেদ। তামার পাত্র ব্যবহার করা হত। তীর্থ ছিল কুরুক্ষেত্র। তারক ব্রহ্মনাম- হরি মুরারী মধু কৈটভ অরি, গোপাল গোবিন্দ মুকুন্দ শৌরি, নারায়ণ কৃষ্ণ বিষ্ণু যজ্ঞেশ।
####
কলি যুগ - কলি হল, চার যুগের শেষ যুগ। পুণ্য এক ভাগ, পাপ তিন ভাগ। অবতার কল্কি। মানুষের আয়ু একশ বিশ বছর প্রায়, কোথাও অাবার অাছে একশ বছর। মানুষের শরীরের আয়তন নিজের হাতে সাড়ে তিন হাত । প্রাণ অন্নে। তীর্থ গঙ্গা। সব পাত্র ব্যবহার করা হয়। ধর্ম সংকোচিত। মানুষ তপস্যাহীন, সত্য থেকে দূরে অবস্থানরত। রাজনীতি কুটিল। শাসক ধনলোভী। ব্রাহ্মণ শাস্ত্রহীন। পুরুষ স্ত্রীর অনুগত। সৎ মানুষের কষ্ট বৃদ্ধি। দুষ্টের প্রভাব বৃদ্ধি। বিষ্ণু পুরাণ মতে কলিকালের মানুষ ধর্মের জন্য অর্থ খচর করবে না। ধর্মগ্রন্থের প্রতি মানুষের আর্কষন থাকবে না। মাতাপিতাকে মানবে না। পুত্র পিতৃহত্যা বা পিতা পুত্র হত্যা করতে কুন্ঠিত হবে না। মানুষ বৈদিক ক্রিয়া আচার সমূহ করবে না। ধর্মানুসারে কেউ বিবাহিত থাকবে না। স্ত্রীলোকরা কেবল চুলের বাহদুরী করেই নিজেকে সুন্দরী বলে মনে করবে। ধনহীন পতিকে স্ত্রীরা ত্যাগ করবে। আর ধনবান পুরুষরা সেই স্ত্রীগণের স্বামী হবে। কলিযুগে ধর্মের জন্য ব্যয় না করে কেবল গৃহাদি নির্মাণে অর্থ ব্যয় করবে। মানুষ পরকালের চিন্তা না করে কেবল অর্থ উর্পাজনের চিন্তাতেই নিরন্তর নিমগ্ন থাকবে। কলিযুগে নারীরা সাধারনতঃ স্বেচ্ছাচারিণী ও বিলাস উপকরণে অতিশয় অনুরাগিণী হবে এবং পুরুষরা অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জন করতে অভিলাষী হবে। সুহৃদদের প্রার্থনাতে মানুষ নিজের অনুমাত্র স্বার্থ পরিত্যাগ করবেনা। অসমর্থ মানুষরা ধনহীন হয়ে নিরন্তর দুর্ভিক্ষ ও ক্লেশ ভোগ করবে। কলিকালে মানুষ স্নান না করে ভোজন করবে। কলিকালে স্ত্রীলোকরা নিতান্তই লোভী হবে, বহু ভোজনশীল হবে। স্ত্রীরা দুহাতে মাথা চুলকাতে চুলকাতে অনায়াসে পতি আজ্ঞা অবহেলা করবে। নিজের দেহ পোষণে ব্যস্ত থাকবে, নিরন্তন কঠোর ও মিথ্যা বাক্য বলবে। আচারহীন ব্রাহ্মণ পুত্ররা ব্রহ্মচারীর বেশ ধারন করে বেদ অধ্যয়ন করবে। গৃহস্থরা হোমাদি করবেন না এবং উচিত দানসমূহও প্রদান করবেন না। মানুষ অশাস্ত্রীয় তপস্যা করবে। কলিকালে অাট থেকে দশ বছরের বালকেরাও সহবাস করবে। কখনও কখনও দেখা যাবে পাঁচ থেকে সাত বছর বয়সের বালিকারা সন্তান প্রসব করবে। মানুষের বুদ্ধি অতি অল্প , তাঁদের ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তি অতিশয় কুৎসিত, তাদের অন্তকরণ অতিশয় অপবিত্র হবে। আর অল্প কালেই বিনাশ লাভ করবে। যখন পাষন্ড লোকের প্রভাব অত্যন্ত বাড়বে, সমাজের ভালো লোক কোন দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকবে না। সৎ মানুষদের কষ্ট বেশি দেখা যাবে। অল্প বৃষ্টি হবে, কলিকালে ফসল কম হবে। মানুষ শ্বশুরের অনুগত হয়ে, কার মাতা কার পিতা এরকম কথা বলবে। সুন্দরী স্ত্রী যার তার সাথে বন্ধুত্ব হবে, নিজ ভাইয়ের সাথে শত্রুভাব পোষন করবে। ভাগবতে বলা আছে ছলনা, মিথ্যা, আলস্য, নিদ্রা, হিংসা, দুঃখ, শোক ভয়, দীনতা প্রভৃতি হবে এযুগের বৈশিষ্ট্য। এবার একটা গল্প দিয়ে শেষ করছি। মহাভারতের যুদ্ধশেষে একদিন পঞ্চপাণ্ডব ( যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব) ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রশ্ন করেন যে "কলিযুগ কেমন হবে" ?
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন পাঁচ ভাইকে এক জঙ্গলের ভেতর পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন পথ দিয়ে হেঁটে জঙ্গলের ভেতরে কি দেখলেন তা ফিরে এসে তাকে বলতে বললেন।
যুধিষ্ঠির ওই পথে হেঁটে যাওয়ার সময় একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করলেন -একটা হাতি কিন্তু তার দুটি শুঁড় । এই কথা এসে জানালেন শ্রীকৃষ্ণের কাছে ।
উত্তরে: শ্রীকৃষ্ণ বলেন, "কলি,যুগের মানুষ হবে ঠিক এই রকম । তারা মুখে বলবে এক, কিন্তু কাজের সময় হবে আলাদা ।"
ভীম দেখতে পেলেন,একটা গরু তার বাছুর কে আদর করছে চেটে চেটে,কিন্তু এত বেশি চাটছে যে বাছুরটির গায়ের ছাল উঠে গিয়ে রক্তপাত শুরু হয়েছে । ভীম এই কথাটা শ্রীকৃষ্ণের কাছে জানালেন ।
উত্তরেঃ শ্রীকৃষ্ণ বলেন, "কলি যুগের মাতা,পিতা হবে ঠিক এইরকম । মাতা,পিতার অন্ধ স্নেহ ও অতিরিক্ত ভালোবাসাই তাদের সন্তানদের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠবে। এতে সন্তানরা বিচার বুদ্ধিহীন ও পরনির্ভরশীল ভাবে গড়ে উঠবে। আগামীতে যা স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবন যাপনে তাদের জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে।"
অর্জুন দেখতে পেলেন, একটি নদীতে একটি পচাগলা মৃত ছাগল, আর ওই ছাগলের উপর বসে আছে একটা শকুন । কিন্তু ওই শকুনের ডানায় লেখা আছে বেদ মন্ত্র।
উত্তরেঃ শ্রীকৃষ্ণ বলেন, "কলিযুগের কিছু ভন্ড সাধকেরা হবে ঠিক এই রকমের। অর্থাৎ দেশ ও সমাজে যাদের ধার্মিক ও জ্ঞানী হিসেবে খ্যাতি থাকবে, কিন্তু তাদের প্রকৃত মানসিকতা হবে শকুনের ন্যায় ।"
নকুল দেখতে পেলেন, যে এক বিশালাকার পাথরের খন্ড পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু কোন বিশালবৃক্ষ তাকে আটকাতেই পারছে না । অবশেষে সামান্য একটা দুল্পা(গুল্ম) গাছের তলায় এসে আটকে যায় ।"
উত্তরেঃ শ্রীকৃষ্ণ বলেন,"কলিযুগের মানুষের পাপের পরিমাণ হবে ওই পাথরের সমান। কিন্তু কোনো মানুষ যদি এই হরিনাম রূপী দুল্পা গাছটিকে ধরতে পারে, তাহলে সর্ব বিপদ থেকে রক্ষা পাবে ।"
সহদেব দেখতে পেলেন একটা বিশাল গভীর কূয়া । কিন্তু অবাক হয়ে দেখলেন ওই কূয়ার শেষ প্রান্তে বিন্দুমাত্র জল নেই।
উত্তরেঃ শ্রীকৃষ্ণ বলেন, "কলিযুগের কিছু বাড়ি হবে বিশাল আকৃতির ও মানুষের ধনসম্পত্তি থাকবে ওই গভীর কূয়ার সমান, কিন্তু ওই বাড়ি ও ধনসম্পত্তি মালিকের মধ্যে বিন্দু মাত্র কোন সুখ থাকবেনা ।"
যাইহোক মনু সংহিতায় বলা হয়েছে যে সত্যযুগে তপস্যা, ত্রেতায়ুগে জ্ঞান, দ্বাপরয়ুগে যজ্ঞ এবং কলিতে দানই প্রধান হয় প্রতি কলিকালে। কলিযুগের শেষের দিকে আবির্ভূত হবেন কল্কি অবতার মানে কল্কি দেব। কল্কি অবতার কলি যুগের অবসান ঘটিয়ে সত্য যুগ শুরু করবেন। কল্কি হচ্ছেন ভগবান বিষ্ণুর সর্বশেষ রূপ। হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের পুরাণ থেকে জানা যায় কল্কি অবতার সাদা ঘোড়ার পিঠে খোলা তরবারী হাতে আবির্ভূত হবেন। সুতরাং।প্রাচীন শাস্ত্রসমূহ মানে পুরাণের বর্ণনা থেকে জানা যাচ্ছে, এই যুগান্তে মহাপ্রকৃতিগত পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। পরিবেশ ও প্রকৃতিতে সুদূরমেয়াদী পরিবর্তন ঘটতে শুরু করবে। পুরাণের কোনও কথাকে অবিশ্বাস করছি না। কারণ অবিশ্বাস করতে যে যুক্তির প্রয়োজন তা আমার জানা নেই।তবে এতটুকু বলতে পারি যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে তাই একদিন ধ্বংস হবে। এই ধ্বংস মানে কিন্তু জিরো হয়ে যাওয়া নয়, ধ্বংসের অর্থ হলো রূপান্তর। তবে আগামী সংখ্যায় বেদান্তে, বিজ্ঞানে দর্শনে কল্কি অবতারের বর্ণনা তুলে ধরার ইচ্ছে রইল।
------------------------------------------------------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন