রাখি বন্ধন উৎসব
ভাই-বোনের প্রীতির সম্পর্কের উৎসব বলতেই ভাইফোঁটার পর যে উৎসবটির নাম মনে পরে তার নাম রাখি-বন্ধন | এমন দিনে দাদা বা ভায়ের মঙ্গল কামনায় রাখি নামে প্রবিত্র সুতো হাতে বেঁধে দেয় দিদি বা বোনেরা | রাখি হল এক শপথের প্রতীক | দিদি বা বোনকে আজীবন রক্ষা করার শপথ এই রাখি বন্ধন উৎসব |
বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসারে শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই উৎসব পালন করা হয় |রাখি পূর্ণিমার আরেক নাম শ্রাবণী পূর্নিমা বা সৌভাগ্য পূর্ণিমা | এই শ্রাবণী পূর্ণিমা বলার একটা কারণ আছে | রাখি পূর্ণিমার পাঁচ দিন আগে শ্রী কৃষ্ণের ঝুলন পূর্ণিমা শুরু হয়, আর সাত দিন পরে শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী পালন করা হয় | এই দুই লীলার মাঝে শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে রাখি পূর্ণিমা উৎসব উজ্জাপন করা হয় বলে এর আর এক নাম শ্রাবণী পূর্ণিমা |
ইতিহাস বলে চিতোরের বিধবা রানী কর্ণবতী মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের সাহায্য প্রার্থনা করে একটা রাখি পাঠান | তারপর থেকে এই রাখি বন্ধন উৎসব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে |
এই রাখি উৎসব সম্পর্কে আরও এক গল্প কথা প্রচলিত আছে |আমরা জানি 326খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করেন |সেই সময় রাজা পুরুর সাথে যুদ্ধ হয় | এই সময় আলেকজান্ডারের স্ত্রী রোজানা রাজা পুরুকে নাকি একটা পবিত্র সুতো পাঠান এবং অনুরোধ করেন আলেকজান্ডারের কোন ক্ষতি না করার জন্য | রাজা পুরু এই সুতোকে সম্মান করে আলেকজান্ডারের কোন ক্ষতি করেন নি |
পৌরাণিক ঘটনার মধ্যেও রাখি বন্ধনের উল্লেখ পাওয়া যায় | মহাভারতে তার নিদর্শন আছে | সেখানে দেখা যায় একটা যুদ্ধের সময় শ্রী কৃষ্ণের কবজিতে আঘাত লাগে | রক্তপাত শুরু হলে পান্ডবদের স্ত্রী দ্রৌপদী তাঁর আঁচল কিছুটা ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাতে বেঁধে দেন | কৃষ্ণ এটা ভেবে অভিভূত হন যে দ্রৌপদী তাঁর অনাত্মীয় অথচ কৃষ্ণের মঙ্গল চান | কৃষ্ণ তখন দ্রৌপদীকে বোন বলে ঘোষণা করেন |
বহু দিন পরে ঘটনা চক্রে ধৃতরাষ্ট্রের সভায় পাশা খেলার আসরে দ্রৌপদীকে নিগ্রহ করা হয় | সে সময় দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ করতে গেলে কৃষ্ণ দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা করেন | তারপর থেকে রাখি বন্ধনের কথা লোকের মুখে মুখে প্রচার হতে থাকে |
এ সব তো গেল অন্য কথা | এবারে আসল কথায় আসি |সালটা 1905, জুলাই মাস | লর্ড কার্জন বঙ্গ ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিলেন |আমরা জানি তখন বর্তমান বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ত্রিপুরা নিয়ে ছিল অবিভক্ত বাংলা| সেই বাংলাকে প্রশাসনিক কাজের সুবিধা হবার নামে ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় | তখন বাংলাই শ্রাবণ মাস চলছে | আর ঠিক সেই সময়েই ছিল রাখি পূর্ণিমা |অন্য রকম রাখি বন্ধনের কথা মাথায় এল রবীন্দ্রনাথের | কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ চাইলেন এবারে ভাই-বোনের মধ্যে নয়, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সৌভাতৃত্বের বন্ধন আরও মজবুত করতে হবে |রাখি বন্ধন হয়ে উঠুক হিন্দু -মুসলিম দুই ভায়ের বন্ধন | তাঁরা হাতে হাত রেখে সাম্রাজ্য বাদী শক্তির বিরুদ্ধে ছুড়ে দিক প্রতীকি প্রতিবাদ |
সারা বাংলা এক হয়েছিল সে দিন | একটা মানুষের ডাকে সারা দিয়ে আয়োজন হল মহান উৎসবের | এক সুন্দর সকালে এই বঙ্গভঙ্গের প্রতিরোধে রবীন্দ্র নাথ পালন করলেন রাখি বন্ধন | কলকাতা, ঢাকা, সিলেট থেকে হাজার হাজার হিন্দু ও মুসলমান ভাই ও বোনেদের আহ্বান করেন একতার প্রতীক হিসাবে রাখি বন্ধন উৎসব পালন করার জন্য | গান লিখলেন,
"বাংলার মাটি, বাংলার জল,বাংলার বায়ু, বাংলার ফল,
পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান "| কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ সে বার রাখি বন্ধনকে একটা সার্বজনীন উৎসবের রূপ দেন |
অবশেষে দীর্ঘ ছয় বছর পরে 1911সালে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ রদ্ করলেন বঙ্গ-ভঙ্গের সেই প্রস্তাব |
বাংলা ও বাঙালির কাছে তাই রাখি বন্ধন একটা দিনের উৎসব নয় | একটা সময়ের উৎসব| একটা আবেগের উৎসব| একটা অখণ্ড বাংলার উৎসব | দুই হৃদয়ের মিলন উৎসব |তাই বিশ্ব কবির রাখি বন্ধনের চিন্তা আজও আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক |
================
সুদর্শন মণ্ডল
মদনপুর, নদিয়া
ফোন :8293195177
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন