Featured Post
প্রবন্ধ ।। একটি ভাষার মৃত্যু ।। সবিতা বিশ্বাস
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
লিচো |
একটি মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে
সঙ্গেই
নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল একটি ভাষা
নামকরণে রয়েছে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল একটি ভাষা, এটি না বলে বলা চলে মৃত্যু ঘটল একটি ভাষার | হ্যাঁ, এখানে গ্রেট অন্দামানিজ পরিবারের প্রাচীনতম ভাষা “সারে” র কথাই বলা হচ্ছে | অন্দামানি ভাষা হল এক জোড়া ভাষা নিয়ে গঠিত একটি ভাষা | গ্রেট অন্দামানিজ “নেগ্রিট” এবং “ওগান” ভাষা | এই পরিবারেরই প্রাচীনতম ভাষা ছিল ‘সারে’ ভাষা |
২০১০ সাল অবধি এই পরিবারে ছিল আন্দামানের প্রাচীনতম চারটি ভাষা | জেরো, সারে, খোরা এবং বো | ওই বছরেই আন্দামান থেকে মুছে গিয়েছিল খোরা এবং বো | যে ভাষাটি নিয়ে আমরা আলোচনা করছি সেই ‘সারে’ ভাষায় কথা বলতে পারতেন মাত্র একজন | তিনি লিচো | লিচো ছিলেন রাজা জিরাকের প্রথম সন্তান | বয়স হয়েছিল ষাট বছর | যক্ষা ছাড়াও হৃদযন্ত্রের অসুখে ভুগছিলেন তিনি | এরমধ্যে থাবা বসাল করোনা | যদিও কোভিড—১৯ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ মহল নিশ্চিত নন | ৪ঠা এপ্রিল মৃত্যু হয় লিচোর | তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু ঘটল আন্দামানের প্রাচীনতম ভাষা সারের |
এখন প্রাচীন গ্রেট অন্দামানিজ ভাষা হিসেবে বেঁচে রইলো “জেরো” | এই ভাষায় কথা বলতে পারেন মাত্র তিনজন | তাদের প্রত্যেকেরই বয়স পঞ্চাশের উপরে | সকলেই বিভিন্ন অসুখে আক্রান্ত |
রাজা জিরাকের প্রথম কন্যা লিচো জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৬০ সালে | তিনি পোর্টব্লেয়ারে বাস করতেন | খুবই বুদ্ধিমতী ছিলেন তিনি | তার অবদান রয়েছে গ্রেট অন্দামানিজ ভাষা ও ব্যাকরণ তৈরিতে | তিনি কাজ করেছেন আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের শিক্ষা দপ্তরে | ভাষাবিদ অনবিতা আব্বিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন ‘সারে’ ভাষায় | অনবিতা আব্বির সেই গ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে ২০১৩ সালে |” Dictionary Of The Great Andamanese Language” একমাত্র এই গ্রন্থটি নথি রূপে ‘সারে’ ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখলো | লিচো ‘সারে’ ভাষা ছাড়াও জেরু, পুজুক্কর, অন্দামানিজ হিন্দি ভাষা জানতেন |
লিচোর জন্মের সময়ে অর্থাৎ ১৯৬০ সালে গ্রেট অন্দামানিজ ভাষার বক্তা হিসাবে জীবিত ছিলেন ১৯ জন| বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র তিনজন ছাড়া বাকিরা সকলেই মারা গিয়েছেন |
সাধারণভাবে ভাষার মৃত্যু একটি ধীর ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া | পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি দু সপ্তাহ অন্তর একটি করে ভাষার মৃত্যু ঘটে | ভারতে এই মুহুর্তে বিপন্নপ্রায় ভাষার সংখ্যা ১৯৭ টি | আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড চালু হবার পর থেকেই আন্দামানের আদিবাসী মানুষ বিপন্ন | কারণ তারা প্রকৃতিকে গায়ে জড়িয়ে বেঁচে থাকে | বাইরের মানুষের অনুপ্রবেশের কারণে তারা যক্ষা, সিফিলিসের মত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত | ২০০২ সালের সর্বোচ আদালতের রায়ের পরেও রমরম করে চলছে আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড | ক্রমাগত বেড়ে চলেছে পর্যটন | এর ফলে দূষণের প্রভাবে মানুষগলো শ্বাসরোগে আক্রান্ত |
বলার অপেক্ষা রাখে না, করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে | ওখানে যদি কমুনিটি সংক্রমণের মতো বিষয় ঘটে তাহলে দ্বীপের আদিবাসী মানুষগুলোর জীবন সংশয় হয়ে উঠবে | সেই সঙ্গে সংকটে পড়বে তাদের মুখের কথিত ভাষাগুলো | এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু মহামারীর সময়ে সাধারণ মানুষের চেয়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠির মৃত্যুর হার ছিল চারগুন বেশি |
এই দ্বীপপুঞ্জে আছে ওঙ্গে এবং জারোয়া আদিবাসী সংস্কৃতি | এই দুই সম্প্রদায় মিলিয়ে রয়েছে প্রায় ৬৭০ জন মানুষ | আং ভাষা পরিবারের মানুষ এরা | উত্তর সেন্টিনাল দ্বীপে বাস করে সেন্টিনালিজরা | কিন্তু তারা নিজেদের সভ্য মানুষদের কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছে | তাদের দ্বীপের কাছাকাছি গেলেই বিষাক্ত তীরের ফলার আঘাতে মৃত্যু নিশ্চিত | তাই তাদের সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত কিছুই জানা সম্ভব হয়নি | বাকি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন্ হয়ে থাকার কারণে তারা অসুস্থ হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও সভ্য মানুষ জানতেই পারবে না তাদের কথা |
কিন্তু যারা আমাদের সামনে আছে, তাদের বাঁচানোর দায়িত্ব আমাদের | প্রানোচ্ছল এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার দায় দায়িত্ব নিতেই হবে সভ্য মানুষদের | ইতিমধ্যে যথেষ্ঠ দেরী হয়ে গেছে | এখনো সতর্ক না হলে হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা এই সংস্কৃতির বিনাশের জন্য দায়ী থাকবে আধুনিক সভ্য মানুষ | নিশ্চয়ই আমরা তা হতে দিতে পারিনা |
‘সারে’ ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও হাজার হাজার বছরের প্রাণোচ্ছল প্রাচীন গ্রেট অন্দামানিজ ভাষা হিসাবে বাঁচাতেই হবে ‘জেরো’কে | সেই ভাষার পরম্পরাকে |
-------
তথ্যসূত্র—সংবাদপত্র এবং অন্তর্জাল
======================- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন