বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকার
পাভেল আমান
পরিবেশের গুরুত্ব প্রাসঙ্গিকতা প্রাত্যহিক জীবনে তাৎপর্য নিয়ে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এ যেন একই ছবির পুনরাবৃত্তি। চারিদিকে যেভাবে পরিবেশের অবনমনে সীমাহীন দূষণ তাপমাত্রা যেভাবে উর্ধ্বমুখী হচ্ছে সহনশীলতার বাইরে গিয়ে ক্রমশ মরুভূমির তাপমাত্রা কি স্পর্শ করছে সে দিক থেকে আমরা গভীর সংকটের অতল গহবরে তলিয়ে যাচ্ছি। পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা পরিবেশের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা যত্নশীলতা প্রাত্যহিক জীবনে পরিবেশের নিরবচ্ছিন্ন ভূমিকা সর্বোপরি পরিবেশের প্রতি আমরা কতটা আন্তরিক ও মানবিক হয়ে উঠেছি। সেই প্রশ্নগুলোর যথার্থ উত্তর আমরা কি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছি।
কেবলমাত্র একটি গাছ লাগানো পরিবেশ দিবস সম্পর্কে কিছু গাল ভরা উপদেশ মূলক বক্তব্য প্রদান প্রচারাভিযানের মধ্যে দিয়ে বিশ্ব পরিবেশ দিবস যথার্থভাবে পালিত হয় না। এখানে শুধুই লৌকিকতা আনুষ্ঠানিকতা সেই দিবসের তাৎপর্য ও বাস্তবায়নের সুষ্ঠু প্রাত্যহিক অঙ্গীকার খুব একটা পরিলক্ষিত হয় না। দিনকে দিন যেভাবে পরিবেশ ভয়াবহ ভাবে দূষণের কবলে আক্রান্ত হচ্ছে ভেঙে যাচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য সবুজ শস্যশ্যামলা পৃথিবী হয়ে উঠছে নিরন্তর আবাসযোগ্য আমাদের প্রত্যেকেই আরো একটু বেশি সহানুভূতিশীল মানবিক চেতনা বোধের সঞ্চারনে পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হয়ে উঠি। জেনে বুঝে সজ্ঞানে আমরা অবিরাম ভুল করছি পরিবেশের সতেজতা নির্মলতা সবুজের সমরোহ অবলুপ্তি ঘটলে মানব সভ্যতাও সংকটের গভীরে তলিয়ে যাবে। প্রাণের স্পন্দন ক্রমশ নিঃশেষ হয়ে যাবে। পরিবেশের প্রতি স্বেচ্ছাচারিতা দায়িত্বজ্ঞানহীনতা সর্বোপরি আত্মঘাতী মুলক আচার-আচরণ ও মনোভাব আমাদেরকে অস্তিত্বহীনতার মুখে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
বলা যেতে পারে নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনছি। এখনো সময় আছে দল বেঁধে হাতে হাত রেখে সচেতন হয়ে পরিবেশের সুস্থতায় দূষণের হাত থেকে রক্ষার্থে আমাদের কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। সৃষ্টির শুরু থেকেই পরিবেশের সঙ্গে প্রাণীর মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার ওপরেই তার অস্তিত্ব নির্ভর করে আসছে। পরিবেশ প্রতিকূল হলে জীবের ধ্বংস ও বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। পরিবেশের ওপর নির্ভর করে মানুষ, অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রাণী-জীবনের বিকাশ ঘটে। তাই পরিবেশ ও মানুষের মধ্যে রয়েছে এক নিবিড় যোগসূত্র। কিন্তু নানা কারণে পরিবেশদূষণ সমস্যা প্রকট হওয়ায় মানবসভ্যতা আজ চরম হুমকির সম্মুখীন। এ থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে চলছে নানা ধরনের গবেষণা। আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন পরিবেশ-প্রকৃতি। কিন্তু প্রতিনিয়ত এ পরিবেশকে আমরা নানাভাবে দূষিত করে আসছি।
বিশ্বজুড়ে এখন পরিবেশদূষণের মাত্রা ভয়াবহ। পরিবেশদূষণের উল্লেখযোগ্য কারণের মধ্যে রয়েছে অত্যাধিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও বনভূমি উজাড়, প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার, দ্রুত শিল্পায়ন, সার ও কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, শিল্প-কলকারখানার বর্জ্য, গাড়ির বিষাক্ত ধোঁয়া, ওজোন স্তরের ক্ষয়, অ্যাসিড বৃষ্টি, অপরিকল্পিত গৃহনির্মাণ, দারিদ্র্য, প্রসাধনসামগ্রী, প্লাস্টিক দ্রব্যের ব্যবহার ইত্যাদি। ভয়াবহ পরিবেশদূষণের কবলে পড়ে আজ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। অপেক্ষা করছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এক মহাধ্বংস! আজ জলে বিষ। বাতাসে আতঙ্ক। মাটিতে মহাত্রাস।
গত ৬০ বছরে ৮০টির বেশি প্রজাতির প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কয়েকশ প্রজাতির গাছপালা বিলুপ্ত। বিশ্বব্যাপী পরিবেশদূষণ নিয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসংঘ ৫ জুনকে ঘোষণা করেছে 'বিশ্ব পরিবেশ দিবস' হিসেবে। বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের নেপথ্যের ইতিহাস একটু আলোচনা করা যাক। ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের মানবিক পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির উদ্যোগে প্রতিবছর ৫ই জুন সারা বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে এ দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। তবে প্রথম পরিবেশ দিবস উদযাপিত হয় দুবছর পর ১৯৭৪ সালে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত কয়েকটি শহরের মধ্যে একদম প্রথম দিকে আছে আমাদের কলকাতা। ঘর থেকে বের হলেই মুখোমুখি হতে হয় দূষিত এবং স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর পরিবেশের সাথে।
পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা, এর উন্নয়নের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি এখনই।উন্নয়ন এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির অন্ধ দৌড়ে আমরা পরিবেশের উপাদানগুলিকে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেছি। ভোগবাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে ভোগের অনিয়ন্ত্রিত অভ্যাসের কারণে সম্পদের সীমাহীন শোষণের প্রবণতা এর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। এই শোষণ এমন মাত্রায় বেড়েছে যে আমাদের পরিবেশের উপাদানে ভারসাম্যহীনতা বাড়ছে। আসলে, পরিবেশ যেভাবে পৃথিবীতে পাওয়া সমস্ত জীবকে প্রভাবিত করে, ঠিক একইভাবে এটি সমস্ত জীবের কার্যকলাপের দ্বারা প্রভাবিত হয়। অর্থাৎ পরিবেশ ও সকল জীবের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এটা সব পারস্পরিক ভারসাম্য উপর নির্ভর করে। এমতাবস্থায় মানুষের কর্মকাণ্ড যখন অনিয়ন্ত্রিত এবং প্রকৃতির বিরুদ্ধে, তখন এই ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং পরিবেশ নানা সমস্যায় ভুগতে শুরু করে। মানুষের কার্যকলাপ দায়ী প্রকৃতি একই নীতির অধীনে সমস্ত জীবের উদ্ভব করেছে, সমস্ত পরিবর্তনশীল এবং স্থির জীবের অস্তিত্ব একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। কিন্তু সমস্যা শুরু হয়, যখন মানুষ নিজেকে পরিবেশের অংশ মনে না করে তার প্রয়োজন অনুযায়ী বিকৃত করতে শুরু করে। এসব কর্মকাণ্ড প্রকৃতির রূপকে সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে দিয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে পৃথিবীর সর্বত্র দেখা যেত নদী, পাহাড়, বন ও জীবজন্তুর সংখ্যা কমতে থাকে। এতটাই যে কিছু বিলুপ্ত হয়ে গেছে আবার অনেকে বিলুপ্তির পথে।
মনে হচ্ছে মানবসমাজ প্রকৃতির বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করেছে এবং নিজেকে প্রকৃতির চেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। জেনেও প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হয়েও তারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারবে না।দূষণ রোধে সম্ভাব্য সব ধরনের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। উন্নয়নের জন্য প্রকৃতির ধ্বংস বন্ধ করতে হবে। গাছ, নদী, পুকুর, জমি, জল, বন ও প্রাণী প্রজাতি বাঁচাতে হবে। আমাদের সেবনের অভ্যাস রোধ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য আমাদের কিছু দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। হাজার বছর ধরে প্রকৃতি আমাদের দিয়ে আসছে এবং আমরা নিচ্ছি। আমরা কি পারি না, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থেকে, তাঁকে রক্ষার অঙ্গীকার নিতে?
প্রতি বছর, বিশ্ব পরিবেশ দিবস পরিবেশগত সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য একটি নির্দিষ্ট থিমের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। ২০২৪ সালের জন্য, প্রতিপাদ্য বিষয় হল "ভূমি পুনরুদ্ধার, মরুকরণ, এবং খরা স্থিতিস্থাপকতা।" মরুকরণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য জাতিসংঘের কনভেনশন হাইলাইট করে যে বিশ্বের ৪০% পর্যন্ত ভূমি অবক্ষয়িত হয়েছে, যা বিশ্ব জনসংখ্যার অর্ধেককে প্রভাবিত করছে। উপরন্তু, ২০০০ সাল থেকে খরার পুনরাবৃত্তি এবং সময়কাল ২৯% বৃদ্ধি পেয়েছে। অবিলম্বে ব্যবস্থা না নিলে, খরা ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশকে প্রভাবিত করতে পারে। আমাদের চক্ষু নিমেষে ঘটে চলেছে নিদারুণভাবে প্রকৃতিকে মেরে আরো উন্নতভাবে বাঁচার লড়াই।
রাজধানী দিল্লিতে তাপমাত্রা ৫২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে। ভারতবর্ষের বেশিরভাগ রাজ্যে তীব্র দাবদাহ চলছে। পানীয় জলের সংকট তীব্রতর হচ্ছে। বছরের পর বছর অস্বাভাবিকভাবে তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। ঘরে ঘরে এসি লাগিয়ে তাপমাত্রার হাত থেকে বাঁচার হাস্যকর প্রয়াস চলছে। কিছুদিন পরে এসি আর কাজ করবে না। তাহলে প্রতিকার কি? প্রতিটি সরকার আইন করে জনসাধারণের নিকট ব্যাপকভাবে প্রচার করুক বৃক্ষ রোপনের জন্য। শুধু তাই নয়, বৃক্ষ রোপন কর্মসূচি যারা পালন করেন তাদের সমর্থনে প্রশাসন সর্বতোভাবে পাশে থাকুক। এলাকার মানুষের দায়িত্ব তাকে রক্ষা করা। কোনভাবে যদি তাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে ধ্বংস করা হয় তাহলে অপরাধীদের শাস্তির বিধান রাখা হোক। সরকারি উদ্যোগে ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলিকে উৎসাহিত করা হোক। প্রয়োজনে তাদের সরকারি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া হোক।
সবচেয়ে বড় কথা শুধু বৃক্ষরোপণ করলেই হবে না, তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব সকলের - এই সচেতনতার খুব অভাব। শুধু ভাসা ভাসা বিজ্ঞাপন বা বক্তব্যের মাধ্যমে নয়, চারা গাছ রক্ষা করা জনগণের দায়িত্ব এবং গরু ছাগল ইত্যাদি পশুদের হাত থেকে চারা গাছকে রক্ষা করার দায়িত্ব প্রত্যেকের। কোন ভাবে তা বিঘ্নিত হলে যারা দায়ী তাদের শাস্তির বিধান রাখা হোক। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দেখেছি হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি আমরা পালন করি, চারদিক ঘিরে রক্ষা করার যথেষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় তা সত্ত্বেও মানুষের চরম অবহেলা এবং অবজ্ঞায় সেই গাছগুলিকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা করা যায় না। তার জন্য সরকার এবং প্রশাসনকে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। না হলে সার্বিকভাবে তা সফল করা কোনভাবেই সম্ভব নয়।
আসুন সবাই মিলে প্রকৃতিকে বাঁচানোর আন্দোলনে শামিল হই। সরকারকে, প্রশাসনকে এ বিষয়ে ভাবতে বাধ্য করি। পরিশেষে আরও একটা কথা জোরালো ভাবে ব্যক্ত করতে চাই আমরা যদি দায়িত্বশীল সচেতন মানবিক না হয়ে উঠি তাহলে আমরা পরিবেশের সবুজ হীনতার মধ্যে দিয়ে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনবো। অস্তিত্ব রক্ষার্থে আসুন আমরা সকলেই এই পৃথিবীতে বাসযোগ্য করে তুলতে আমাদের সমবেত অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন ঘটায়। এছাড়া আমাদের সম্মুখে আর বিকল্প কিছু নেই। বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের মধ্যে দিয়ে এটাই হোক তবে আমাদের নিবেদিত প্রাণ বাস্তবিক শপথ।
চিত্রঃ সংগৃহীত।
=================
পাভেল আমান -হরিহরপাড়া- মুর্শিদাবাদ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন