Featured Post

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৬তম সংখ্যা ।। আষাঢ় ১৪৩১ জুন ২০২৪

ছবি
  সূচিপত্র  প্রবন্ধ-নিবন্ধ-মুক্তগদ্য-ভ্রমণকথা মেল্লক গ্রামের মদনগোপাল জীউর মন্দির ।। সায়ন মণ্ডল কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার ... হেমন্ত মুখোপাধ্যায় : জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি ।। উজান... আমার রবীন্দ্রনাথ ।। সত্যেন্দ্রনাথ পাইন বৈকালিক বৈশাখ ।। ছন্দা দাম বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকার ।। পাভ... মে দিবস : অধিকারহরণ ।। শ্যামল হুদাতী শরীর ও মনের সুস্থতা ।। রতন বসাক মানুষ কী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নিকট ভৃত্যমাত্র? ।।... আমাদের পরিবেশ ভাবনা ।। মানস কুমার সেনগুপ্ত বিশ্বপ্রেম ।। আরতি মিত্র টান ।। মনোরঞ্জন ঘোষাল স্রষ্টার নিষ্ঠা ।। শংকর ব্রহ্ম বেগুনিয়া : বাংলার মন্দির স্থাপত্য ।। সু... ।। গল্প ।। বিকেল বাঁচাও আন্দোলন ।। সুবীর ঘোষ রাখে হরি তো মারে কে ।। সমীর কুমার দত্ত বিভ্রান্ত ।। রানা জামান সম্পর্ক ।। মাখনলাল প্রধান  ধারা মাস ঝরা মাস ।। প্রদীপ কুমার দে গল্পের মত অবিশ্বাস্য সত্য ।। বন্দনা সেনগুপ্ত ধর্মরাজ, লাখাই আর ডমরু সর্দারের গল্প... ভূতের বাচ্চা ।। নবী হোসেন নবীন গোধূলিবেলায় ।। সুচন্দ্রা বসু বিয়ে ।। রেজাউল করিম রোমেল ঘোড়ার ডিমের গল্প ।। প্রবোধ কুমার মৃধা নাত জামাই ।। সুদামক

কিশোর গল্প ।। ধর্মরাজ, লাখাই আর ডমরু সর্দারের গল্প ।। শাশ্বত বোস



ধর্মরাজ, লাখাই আর ডমরু সর্দারের গল্প

শাশ্বত বোস

পুজোর আগের এই সময়টাতে আকাশটার দিকে তাকালে, কেমন যেন কান্না পায় বাবলুর| রোদ বৃষ্টি মিলে কেমন যেন একটা লুকোচুরি ভাব| বিশেষ করে ভাদ্র মাসের শেষের দিকের দুপুরে, যখন দূরের আসমান চাচা দের পালংক্ষেত কিংবা বোসেদের পুরোনো খিড়কি পেরিয়ে যে পানের বরজ, তার উপর দিয়ে গুড় গুড় ঢাকের শব্দে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি আসে, তখন পুজোর দিনগুলোর কথা ভেবে ভারি মন খারাপ হয় বাবলুর| বছর দুয়েক আগের এরকম এক দুগ্গাপুজোর ষষ্ঠীর দিনে ওর বাবা মারা গেছেন হঠাৎ করে| সেই থেকে বাড়িতে মা-ভাই-বোন কে রেখে এসময়টা সে গ্রামে আসে একা, ধান ঝাড়াতে| জমার পুকুরে জাল দেওয়া হলে সে মাছ স্থানীয় আড়তে বেঁচে টাকা নিয়ে ফেরে| স্টেশনে নেমে মাঠের আল ধরে হাঁটতে হাঁটতে ইটাচুনা, মান্দারণ, বড় সরসা ডিঙোতে ক্রোশ দুয়েক পথ কখন যে পেরিয়ে যায়, খেয়াল থাকে না বাবলুর| পেটের ভেতর তখন তার যেন কয়েকশ ইঁদুর 'ওরাম কৈ' 'ওরাম কৈ' করতে থাকে| সকালের খেয়ে বেরোনো পাউরুটি-ঘুগনী ততক্ষণে পুরোটাই হাওয়া হয়ে গেছে| বর্ষা পেরিয়ে এসময়টা সকালের দিকে সূর্য্যের তাত অত গায়ে লাগে না| ক্ষেতের দিক থেকে আসা মেঠো হাওয়া গায়ে মেখে হাঁটতে কষ্ট হয়না বাবলুর| সামনেই বৈকুন্ঠের মাঠ| বারো বিঘের ক্যানেলের উপরের সাঁকোটা পেরিয়ে বাঁ দিক নেয় ও| এই ক্যানেলের পাশ দিয়ে সোজা হেঁটে গেলে, তালনা পেরিয়ে বেলতলা| এটাই বাবলুদের পূর্বপুরুষের ভিটে| বাবার মুখে শুনেছে, ওর দাদু সওদাগরী আপিসের চাকরী নিয়ে এই গ্রাম থেকে মফঃস্বলের দিকে চলে গিয়েছিলেন সেই কোনকালে| এখনো দেশের শরিকী জমি-পুকুরের কিছু ভাগ আছে ওদের নামে, সেই দিয়েই এখন ওদের দিন গুজরান হয় এক প্রকার| ক্যানেলের পাশ দিয়ে আসার পথে একটা শ্মশান পরে| শ্মশান এর পাশে বাবলুদের কিছুটা ক্ষেতী জমি আছে| প্রমান সাইজের থেকে কিছু ছোট তিলের গাছগুলোয় ফুল এসেছে, পুবের হাওয়ায় দোল খেয়ে হাঁটার পথের মানুষের গায়ে এসে পরে সুড়সুড়ি দেয়|আসার পথে ওদের ভাগচাষী ঝগরু আর তার ছেলে লাখাইকে দল বেঁধে কাজ করতে দেখলো বাবলু| লাখাই ওকে দূর থেকে দেখে হাসলো, বয়সে সে বাবলুর থেকে কিছুটা ছোটই হবে| এ বছর স্কুল ফাইনাল দেবে বাবলু| আজ বিকেলে ফুটবল মাঠে লাখাইকে নিয়ে নামবে ও| ব্যাটাচ্ছেলে বল নিয়ে ভয়ানক দৌড়ায়, বাবলু ওর সাথে দৌড়ে পেরে ওঠে না|
তেনাই এর মোর পেরিয়ে বাঁদা ঘাসের বনটাকে পাশে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো বাবলু| সামনেই বামুন পুকুর, তার পারেই ওদের বাড়ি| মোল্লার ঘাট থেকেই হাঁক পারে বাবলু, "সেজ্ ঠাকমা ও সেজ্ ঠাকমা, কোথায় গেলে গো সবাই? ও সুরি পিসি? ও রমা পিসি? আমি বাবলু গো|"
বাবলুর বাবার সেজ কাকার মেয়ে রমা, বাড়ির বেড়ার গেট খুলে এগিয়ে আসেন| পরনে তার আটপৌরে শাড়ি, মাথায় দুদিকে বিনুনী করা| বাবলুকে দেখে এগিয়ে এসে গাল টিপে দেন তিনি| মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বলেন, "কিরে বাবলা, এবারে দেরী করলি যে বড়! আয় ভেতরে আয়|"
ভেতর থেকে অশীতিপর এক বৃদ্ধা বেরিয়ে আসেন, হাতে অষ্টাবক্র লাঠিতে ঠক ঠক করে আওয়াজ হয় মাটিতে, চোখে ঝাপসা কাঁচের চশমা| "ক্যা রে? ক্যা এলি? বাবলা?"
বাবলু গিয়ে প্রণাম করে "হ্যাঁ ঠাকমা, কেমন আছো গো তুমি?"
"তা এবারে এতো দেরী করলি কেন বাপ? বারোয়ারী তলায় কাঠামোয় খড় বাঁধা হয়ে গেল তো, এক মেটেও শেষ হয়ে গেল বোধহয়"
"ইস্কুলে টেস্ট পরীক্ষা ছিল গো ঠাকমা, এবার তো ফাইনাল দেব গো!"
"ও তাই বল, আমি ভাবি ভাদ্দরের মাঝ হতে চললো, বাবলাটা এখনো এলুনি, হারুটাকে বললুম খবর দেতে, লক্ষ্মীপুজোয় তালবড়া করেছিলুম, ছেলেটাকে কটা দিতে পারলুমনি, তা বাছা তেঁতে পুড়ে এয়েচিস, মাদুরটা বিছিয়ে নিয়ে বস দিকিনি| ও সুরী একটু জল বাতাসা নিয়ে আয় না মা|"
ততক্ষনে বাড়ির ভেতর থেকে আরেক তরুণী বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন| বাবলুকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন "বাবলা, একটু জিরিয়ে নিয়ে বামুন পুকুরে একটা ডুব দিয়ে আয় দিকিনি, আমি ভাত বাড়ছি|"

বিকেলের দিকে হাফপ্যান্ট আর গেল বছরের একটা জামা গায়ে দিয়ে, বাবলু বেড়াতে বেরোল| ঝাঁপানতলার মাঠের দিকে যাবে একবার| কচুর লতা মাড়িয়ে, জুলু ঘাসের পথ বেয়ে এগোতে গিয়ে, প্যান্টের সেলাইয়ে একটা টান অনুভব করলো বাবলু| দু পায়ের মাঝের জোরের জায়গাটা আবার সেলাই করতে হবে| সঙ্গে করে আর বেশী জামা কাপড় ও আনতে পারেনি ও| আনবেই বা কিকরে? সর্ব সাকুল্যে মোট দুজোড়া জামা কাপড় ওর| বাবা মারা যাবার পর কাকার অন্নে যৌথ পরিবারে ঠাঁই হয়েছে ওদের| বেঁচে থাকার জন্য নিদারুন জীবন সংগ্রাম আর খাদ্যকষ্ট এখন ওদের নিত্য সঙ্গী| সংসারে আয় বলতে শুধু কাকা আর ভরসা এই দেশের ধান, আলু আর মাছ বেচার কটা টাকা, তাতেও আবার কত গুলো ভাগ| সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে যায় বাবলু, চোখ তার কখন খোলা আকাশের দিকে চলে গেছে| সেনেদের বাড়ির উঠোনের কামিনী গাছটা ভরে গেছে থোকা থোকা ফুলে, একটা মন কেমন করা মিষ্টি গন্ধ আসছে সেখান থেকে| পাশের মিত্তির দের বাগান থেকে একটা টিয়ার ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে| বাবলুর কিশোর মনে ইচ্ছে হয় ওদের বাসাগুলো দেখবার| ও যখন আরেকটু ছোট ছিল, তখন রমা পিসি আর সরলা পিসির সাথে একবার মিত্তিরদের বাগানের বড় জাম গাছটাতে উঠে, টিয়া পাখির বাসায় ছোট ছোট ছানা দেখেছিল| ছানাগুলোর তখনও চোখ ফোঁটেনি| হঠাৎ কে যেন মাথায় রামগাঁট্টা বসালো, পিছনে অনেক পাখির কচর মচর, আর তলায় সুরী পিসি দের খিলখিলানি হাসি, এর বেশী কিছু আর মনে নেই তার| ঝাপান তলার মাঠের দিকে যাবার পথে ঝগরুদের পাড়া| এই গাঁয়ে প্রায় দুটো আদিবাসী পাড়া বোসেদের দান করা| ঝগরুরা বেসরা, কোল সম্প্রদায়ের লোক| শীতের সময় ধান ঝাড়াতে এলে, বাবলু ওদের টুসু পরব দেখেছে| কেমন আদিবাসী মেয়ে-বউরা লাল পেড়ে শাড়ি জড়িয়ে, খোঁপায় লাল প্যারা ফুল লাগিয়ে, ক্যানেলের ধারে জমা হয়ে গান করে, নাচ করে| নতুন রোদে কালো শরীর এর উপর, নতুন সাদা পোশাকগুলো ঝলমলিয়ে ওঠে| ঝগরুর বাবা ডমরু সর্দার| গাঁয়ের লোকে ওকে এই নামেই ডাকে| খামোকা দড়ির মতন চেহারার বুড়ো লোকটাকে সবাই সর্দার বলে কেন, সেই নিয়ে বাবলুর মনে খুব কৌতূহল জাগে| সর্দার তো সাধারণত ডাকাত দলের মাথাকে বলে, বাবলু তাই জানে, তবে কি ডমরু ডাকাত? নাকি ও এই আদিবাসী বস্তির মাথা? প্রায় নব্বইয়ের কাছে বয়স, কিন্তু এখনও কি শক্ত শরীর লোকটার! লাখাই আর অন্যান্য সাঁওতাল ছেলেরা যখন মাঠে ফুটবল খেলে, ডমরুও তখন মাঠের ধারে বসে থাকে, চোখ লাল করে| লোকটা মনে হয় আফিমের নেশা করে কিংবা ছিলিমে করে গ্যাঁজা খায়| বাবলু শুনেছে এসব করলে লোকের চোখ লাল হয়| চৈত্র মাসে ঝাঁপানতলায় ডমরু চরকে ওঠে, পিঠ পেট ফুটো করে উঁচু মাচার উপর থেকে শূন্যে ঝুলে পরে| বাঁদনা পরবের দিনে এই ডমরুকেই সে দেখেছে সাদা ফতুয়া আর খাটো ধুতি পরে, কপালে লাল তিলক কেটে মোরগ লড়াই করাতে| তাকে ঘিরে তখন পুরুষ মহিলা মেশানো একটা দল ঘুরে ঘুরে, মাদল বাজিয়ে নাচ গান করে| বারোয়ারী তলার পুজোতে অনেক আগে পাঁঠা বলি হত| এই ডমরুই নাকি বলি দিত| বড় বড় পাঁচ ছয় কিলোর পাঁঠা একাই চ্যাংদোলা করে হাড়িকাঠে ঢোকাত, তারপর হাঁসুলীর এক কোপে ধর থেকে মাথাটা আলাদা করে দিত| সেসময় নাকি তার চোখদুটো জ্বলত, বলির রক্ত পাঁচ আঙুলে করে কপালে মাখা, সে যেন সাক্ষ্যাৎ অসুর! এসবই বাবলু ঠাকুমাদের থেকে শুনেছে| ঝগরুদের বাড়িটার গায়ে কি সুন্দর লতাপাতা আঁকা, কি সুন্দর তার রং| দেখে বাবলুর মফস্বলের ওদের বাড়ির কাছে, পোটোপাড়ার কথা মনে পরে| বামুনপুকুরে আজ নাইতে গিয়ে বাবলুর সাথে সেই কচ্ছপটার দেখা হল| এ ব্যাটা জলের অনেক নীচে থাকে, উপরের দিকে আসে না চট করে| তবে বাবলু দেখেছে ও বামুনপুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে যখন কোমরে গামছা জড়ায়, কচ্ছপটা ঠিক জলের অনেক তলা থেকে উঠে এসে মুখ বার করে| তারপর আস্তে আস্তে পাড়ে উঠে আসে চার পা বেয়ে| কচ্ছপটার এই বামুনপুকুরে অনেক দিনের বাস| এই চত্বরের জমিদার কুণ্ডুরা কোন এক রাসপূর্ণিমার আগে, ওকে এই পুকুরে ছেড়েছিল| এখনও রাসের সময় দেশে এলে, বাবলু দেখতে পায় কুন্ডুদের কুলপুরোহিত মাথায় পিছনে বিশাল টিকি দুলিয়ে, কপালে লম্বা তিলক এঁকে, বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ছে আর রাজবাড়ীর লোকেরা একটা বিশাল ছাতা মাথায় দিয়ে, পুকুরে চারামাছ আর কচ্ছপ ছাড়ছে| এই পুকুরে বাবলুদের মানে বেলতলার বোসেদের একটা ভাগ আছে| কিন্তু এই পুকুরে মাছ ধরা বারণ| বাবলু কচ্ছপটার জন্য বাড়ি থেকে লুকিয়ে শসা, গাজর নিয়ে আসে| প্রথম প্রথম ও ভয় পেত| এখন কচ্ছপটা ওর বন্ধু হয়ে গেছে, বাবলু শসাগুলো ওর মুখের কাছে ধরে আর কচ্ছপটা মুখ বাড়িয়ে ওর নরম মাড়ির দাঁত দিয়ে সেগুলো চিবোয়| আস্তে আস্তে ওদের বন্ধুত্ত্বের এই সমীকরণ কিন্তু গড়ে উঠেছে, লোকচক্ষুর আড়ালে| ওকে দেখলেই হয়তো আদিবাসী ছেলেরা খোঁচায় তাই ও সবসময় দেখা দেয় না| বাবলু তো ওর বন্ধু এখন| এই পুকুরের হাঁসগুলোকে চৈ চৈ বলে ডাকলেই বাবলুর দিকে চলে আসে সব দল বেঁধে| ডাকটা ও সুরিপিসির থেকে শিখে নিয়েছে| এই পুকুরে দুটো প্রমাণ সাইজের পোষা কাতলা মাছ আছে, নাকে রুপোর নথ পড়ানো| বছরে দু একবার ওদের জালে ধরে, মুখে ফুঁ দিয়ে ছেড়ে দেয় কুন্ডুদের জেলে| বাবলু ওদের মাঝে মাঝে দেখতে পায়, গায়ে একরাশ শ্যাওলার মাঝে রুপোলী ঝলক তুলে মাছগুলো যেন ওর মন খারাপের দিনে এসে কথা বলে যায় ওর সাথে| এই পুকুর, এই মাছ, এই কচ্ছপ-হাঁসের দল দেশে আসার অন্যতম আকর্ষণ বাবলুর কাছে| হঠাৎ বাবলুর মনে পরে বারোয়ারী তলার কথা| আসার পথে একবার ঢুঁ মেরেছিল, কানাই কুমোর একমেটে শেষ করে এনেছে প্রায়| ক্ষেতের এঁটেল মাটির সাথে ক্যানেল পাড়ের বালি মিশিয়ে, ছাঁচে পুড়ে রেখেছে| সামনের মজে যাওয়া পুকুর আর তার বুড়ো হয়ে যাওয়া শান বাঁধানো পাড়ের মাথার উপর দিয়ে আঁচল টেনে, সন্ধ্যে নামছে সবে| গৃহস্থ্যের বেড়া বেয়ে উপচে পড়ছে সাদা জবার দল| মনটা একটা অবোধ আনন্দে নেচে ওঠে বাবলুর| এই পথে, মাঠের শেষ প্রান্তে বুড়ো বটগাছটার প্রকান্ড শরীরের ডাল পালা পেরিয়ে ধর্মরাজ মন্দির পরে| বটগাছটার শরীর বেয়ে নেমে আসা ছায়ার মত ঝুড়িগুলো বেয়ে, কয়েকটা কালো শরীর ওকে এদিকপানে আসতে দেখে, ধুপধাপ মাটিতে লাফ মারে| একটা হাফ প্যান্ট পড়া ছেলে, আদুর গায়ে সাইকেলে হাফ প্যাডেল করতে করতে, বাবলুর ঠিক পেছনে এসে বেল দেয়| বাবলুর খুব রাগ হয়| বটগাছের লাগোয়া একটা প্রকান্ড অশথ্ব গাছের তলায়, একটা গোল মতন পাথরকে সিঁদুর পরিয়ে, লাল সুতো জড়িয়ে রাখা| সামনে অনেকগুলো মাটির ঘোড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে| ছোট্ ঠাকমা বলে, "ধম্ম রাজের থানে মানত করলে, রাজার মতন ছেলে হয়|"
ভাদ্র সংক্রান্তিতে ঘোড়া দিয়ে মানত করতে হয়, রাতভোর পুজোর পর ভোরের প্রথম আলোয় যার মানতের ঘোড়ার একটা পা ভাঙা পাওয়া যাবে, ধর্ম ঠাকুর তার ঘরে সাক্ষ্যাৎ সন্তানরূপে বিরাজ করবেন| বাবলুর ভারি হাসি পায়| ধম্মঠাকুর বুঝি ছোট ছেলে! সারা রাত ধরে মাটির ঘোড়াগুলো নিয়ে খেলা করে, একটার পা ই ভেঙে ফেলে! ঠাকমার মুখে বাবলু শুনেছে, ওর বাবাও নাকি এই থানের দোর ধরা| চড়কের দিনে, এই ধর্মরাজের থানে আলাদা গাজন বসে| ক্যানেলের ওপারে মহানাদ, এখানকার লোকে বলে 'মানাদে'| সেখানে জাগ্রত মহা শ্মশান থেকে যত অঘোরী তান্ত্রিকরা এসে যোগ দেয় সেই গাঁজনে| এই গাঁয়ের যত দুলে-বাগদী-কিস্কু-ওঁরাও দলে দলে সব যোগ দেয়| হাতে মরার খুলি নিয়ে নৃত্য করে, দেখলে গায়ে কাঁটা দেয়|

বারোয়ারী তলায় বাবলু যখন এসে পৌঁছাল, তখন পুরোপুরি সন্ধ্যে| একটা ৪০ ওয়াটের বালব ঝুলছে, কানাই কুমোর সে দিনের কাজ সেরে হাত ধুতে গেছে| অন্ধকারে দা খুড়ো সাক্ষাৎ ভুতের মত, একটা হুঁকো নিয়ে তাতে তামাক সাজছে| খিদে খিদে পাচ্ছিল বাবলুর, রাস্তার উল্টোদিকেই ওদের একটা ধানের পরা আছে| এদিককার জমির ধান এখানেই ঝাড়া হয়| সন্ধ্যেবেলাতে সেখানে খ্যাপা দা তেলেভাজা ভাজে| বাবলু সেখান থেকে দু পয়সার মুড়ি আর খান চারেক গরম গরম বেগুনী নিয়ে খুড়োর পাশটায় গিয়ে বসলো একটা নড়বড়ে বেঞ্চিতে| দা খুঁড়ো বাবলুকে ছোট থেকেই দেখছে| খুঁড়োর মেয়ে সুরী পিসিদের সাথে খেলতে আসতো| খুঁড়ো নিজে আগে জমিদার বাড়িতে গোমস্তার কাজ করতো, এখন কিছু জমি করেছে, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কিষেন দিয়ে চাষ করায়| বাবলুকে দেখে হুঁকোটা মুখ থেকে নামিয়ে খুঁড়ো বলে ওঠে, "কিরে বাবলা এত দেরী করলি কেনে? মাঠের ধান ঝাড়া সারা হয় গিলো তো!"
একমুঠো মুড়ি মুখে বাবলু জবাব দেয়, "ইস্কুলে ছুটি পড়ার পর কয়েকদিনের জন্য মামা বাড়ি গিছলাম গো! তাই দেরী হল একটু| খুঁড়ো তুমি আছ কেমন? বিলি পিসিরা সব কেমন আছে?"
হুঁকোয় টান দিতে দিতে খুঁড়ো উত্তর দেয়, "তা আছে একরকম!"
গ্রামের দিকে সন্ধ্যে নামলে ঝুপ করে আঁধার ঘনিয়ে আসে, আশেপাশের বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ ভেসে আসে| বাবলুর মনে হয় এসময় যদি খুঁড়োর কাছ থেকে একটা গপ্পো পাওয়া যেত, বেশ হত| খুঁড়ো গপ্পোও ফাঁদে দারুন| সাহস করে বাবলু বলে ফেলে সে কথা, "খুঁড়ো, অনেক বছর আগে এ গাঁয়ের রাজবাড়িতে একবার ডাকাত পড়েছিল না? শোনাওনা গপ্পোটা|" খুঁড়ো গাঁয়ের অনেক পুরোনো লোক, অনেক  কথা জানে| চোখের ছানি, মাথার টাক তো আর এমনি আসেনি| দা খুঁড়ো কোন কথা বলে না, হাতের হুঁকো টা নিয়ে ফুঁক ফুঁক ধোয়া ছাড়ে শুধু| বাবলু বোঝে আজ আর হবে না, খুঁড়োর মেজাজ নেই| হাতের ঠোঙাটা শেষ করে মুড়িয়ে পেছন দিকে ফেলে দিয়ে উঠে পরে বাবলু, পেছন থেকে দা খুঁড়োর গলা শুনতে পায়, "সে কয়েক যুগ পুব্বের কথা রে বাবলা| গাঁয়ে সেবার পোবল ক্ষরা, পুরা বোশেখ জষ্ঠি জুড়ে ঝড় জল হয় নাই, মাঠ কে মাঠ ফসল জ্বলি গেছে| তখন তো ক্যানেলটাও ছিল নি, এদিকে রায় নারায়ণের কড়া হুকুম, খাজনা ফাঁকি দেওয়া চলবেক নি| যদি একঘর পেজ্জ্বাও খাজনা কম দেয় তো, লাগাও চাবুক! তুলে নিয়ে এস ঘরের মেয়ে বৌগুলাকে| এই কুন্ডুদের দপদপা তখন! রাজবাড়ীর সুমুখ দিয়া পায়ে জুতা দিয়া যাবার অনুমতি নাই, জুতা মাথায় করি যেতি হবে| এইরাম এক জষ্ঠির দিনে রাজ পেয়াদায় গিয়া হাজির হইলো ডমরুর বাড়ি| চাষ বাবদ কিছু কজ্জ ছিল খাজাঞ্চিতে| ডমরু তখন জোয়ান মুরোদ, ধনুকের ছিলার মতন লিকলিকে চেহারা| ঘরে তার জোয়ান বৌ| বৌটারে তুলে নিয়া গেলো কুন্ডুদের নাচঘরে, পিছমোড়া করে চাবুক চালাল ডমরুর পিঠে, লাঠির ঘায়ে তার মাথা ফাটালো| তার কোঁকড়া চুল বাইয়া তখন তাজা রক্ত চুঁইয়ে পরতিসে| পরদিন বৌটার লাশ ভাসি উঠলো লাল দীঘির চড়ায়| ডমরু তো সেই থিকে নিখোঁজ! তার পর সংক্রান্তির দিনে আকাশ জুড়ে সবে জল ভরা মেঘে আনাগোনা শুরু করিছে| সেবার ছিল অমাবস্যার রাত, হঠাৎ আদিবাসী পাড়া জাগি উঠলো| কালো আকাশডাতে শুধু লাল আর লাল! মশাল হাতে রাতের আঁধার চিরে সবার আগে ডমরু| কবে যেন ফিরে আসিছে, কেউ টের পায় নাই, তলে তলে সে বস্তির সর্দার হইছে| হাতে বর্শা, বল্লম, তীর ধনুক আর টাঙ্গি নিয়ে পর পর দুটো পাড়া ঝাঁপায়ে পড়ল কুন্ডুদের ধানের গোলার উপর| ডমরুর চোখ যেন বনবিড়ালের মত জ্বলতিসে, সে চোখ শুধু রায় নারায়ণ রে চায়! কিন্তু তার পথ আটকায়ে দাঁড়ালো কালান্তক যম, 'ভৈরব'| রায়নারায়ণ তার আস্তাবল থিকে পোষা হাতিটারে ছাড়ি দিসেন ডমরুদের উপর| মনিবের জান বাঁচাতি ভৈরব তার বিশাল বপু নিয়ে ঝাঁপায়ে পরিছে, পায়ে করে দলতিসে ডমরুর দলের লোকেদেরকে| হঠাৎ হাতের কুঠারটা বিদ্যুতের মতন হাতিটার মাথার ঠিক মাঝখানে বসায়ে দিল ডমরু| একটা বিকট আওয়াজ কইরে জন্তুটা মাটিতে পইরে গেল| পরদিন কাক ভোরে রাজবাড়ীর ফটকে, রায়নারায়ণের মুণ্ডু ঝুলতি দেখা গিসলো| সেই থেকে আসে পাশের গেরামে ডমরু সর্দার আর তার ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর কথা চাউর হুই গেলো, জমিদার জোতদারদের গোলা লুঠত আর গরীব দুঃখীদের মাঝে বিলায়ে দ্যাত| পেরায় ৮০ টা খুনের মামলা সিলো উহার নামে, ডমরু সর্দারের মাথায় ইনাম ছিল তখখনকার দিনে ১০০০ টাকা| ইদিকে ভৈরবের মাহুত হাতিডার শোকে পাগল হুইয়া গিসলো| দিনরাত বিড় বিড় করি বিলাপ করত আর ডমরুরে শাপ কাড়তো| খুব ছোট বয়সে হাতিডারে নিয়া আসাম থেকি এই গায়ে আসিছিল তো, হাতিডারে নিজের মেয়ির মত করি আগলাত মাহুতডা| তারপর একদিন ডমরু ধরা পড়লো, দলেরই কে যেন ধরায়ে দিলো, ফাঁসির হুকুম হইলো| কি কইরা জানি সে সাজা মুকুবও হইয়া গেলো| যাবজ্জেবন খাটি আবার ফেরলো একদিন গাঁয়ে| সে তখন অন্য ডমরু, চোখে আর সেই আগুন নাই, চেহারায় ভাঙ্গন ধরসে| জেলে থাকতি ফাঁসুড়েদের কাছ থেকি কবচ তাবিজ শ্যাখছিল| এখন গাঁয়ের লোকেদের সেই তাবিজ দেয়, পাঁচজনায় কয় কাজও দেয় ওর তাবিজে, গাঁয়ের লোকে আজও ওরে সর্দার বলে মান্যি গন্যি করে|" একটানা এতক্ষন ধরে বলে খুঁড়ো এবার থামলো, একটা শুকনো দমকা কাশি এসেছে, ধরা গলার একটু বিশ্রাম চাই বোধহয়| প্রায় মন্ত্রমুগ্ধের মত এতক্ষন শুনছিল বাবলু| উঠে পড়লো এবার, কাল কাক ভোরে জেলেরা দীঘিতে জাল দেবে, ওকে হাজির থাকতে হবে সেখানে|

এর অনেক পর বর্গা রেকর্ডের সময়, ওদের জমিজমা সব তেভাগা হয়ে গেছিল ভাগচাষীদের ভেতর| ঝগরু, লাখাই সবাই সমান ভাগ পেয়েছিলো| আজ প্রায় ৩৪ বছর পর প্রৌঢ় চোখে সে সব স্মৃতি ভেসে ওঠে পদ্মপাতায় জমা বর্ষার জলের মত, যেন এই আছে এই নেই| এত বছর পর পুজোর সময় দেশে এসে, বারোয়ারী তলার তামসী দুর্গামূর্তির প্রতি নতজানু হয়ে ধর্মতলার দিকে এগোতে থাকে বাবলু| বারো বিঘের ক্যানেল টা প্রায় শুকিয়ে গেছে,সেখানে এখন দিব্যি ধান চাষ হয়, গরু চড়ে, ছেলে পিলেরা খেলাধুলা করে| সেই বিশাল বটগাছটা আর নেই| চৈত্রের কোন এক অনিবার্য্য ঝরে পরে গেছে বোধহয়! ঝগরুদের বাড়িটা একইরকম আছে| বাড়িটার চাল বেয়ে একটা চালকুমড়ো গাছ বাইছে নধর ফ্যাকরার জাল বুনে| একটি আদিবাসী রমনী যাপন শৈলীর দাগ রেখে উঠোনে গোবর নিকোতে ব্যস্ত| ঝগরু আর নেই, সে খবর বাবলু আগেই পেয়েছিল| বাড়িটার সামনে গিয়ে ধরা গলায় বাবলু ডাকে "লাখাই, লাখাই আছিস ঘরটো?"
দু তিনবার ডাকবার পর বাড়ির ভেতর থেকে শিরদাঁড়া নুইয়ে একটা ন্যুব্জ চেহারা, লাঠিতে ভর দিয়ে বেরিয়ে আসে| "অরে বাবলা দাদা না? কেতো বুড়া হইন গেছিস রে?"
চেহারাটা বাবলু চিনতে পারে অতীতের স্মৃতি থেকে| আজ থেকে চৌত্রিশ বছর আগে এই চেহারাটাকেই এ গাঁয়ের লোক ডমরু সর্দার বলে ডাকতো|

================


শাশ্বত বোস

পেশা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার

ডাক্তার বাগান লেন

পোস্ট- মল্লিকপাড়া

শ্রীরামপুর,হুগলী 





মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৬তম সংখ্যা ।। আষাঢ় ১৪৩১ জুন ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৫তম সংখ্যা ।। জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ মে ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত