বিবাহের বন্ধন
মিঠুন মুখার্জী
সেদিন ছিল বুধবার। ব্যারিস্টার দুলাল লাহিড়ীর ছোট ছেলের বিয়ে। বাড়িতে হই হই রই রই কান্ড। কখনো শঙ্খ বাজছে কখনো সকলে মিলে উলুধ্বনি দিচ্ছে। সারা বাড়িটার পরিবেশ মনোমুগ্ধকর। সকাল বারোটার সময় ব্যারিস্টার বাবু তার কয়েকজন আত্মীয়দের নিয়ে হবু ছোট বউমাকে আশীর্বাদ করতে যান। মেয়ের বাড়ি গাড়ি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শঙ্খধ্বনি ও উলুধ্বনি বেজে ওঠে। গাড়ি থেকে নেমে একে একে সকলে একটি ঘরে গিয়ে বসেন। ওই ঘরেই আশীর্বাদের সকল ব্যবস্থা করা হয়েছিল। গরমের সময় জ্যৈষ্ঠ মাস। একজন ঠান্ডা সরবতের ব্যবস্থা করেন। এরপর মেয়ে সুকন্যাকে নিয়ে আসা হয়। অসাধারণ সুন্দরী সুকন্যাকে দেখে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। শুধু সুন্দরী নয়, এই মেয়ে গুণবতীও। মাস ছয়েক আগে কলেজের চাকরিতে জয়েন্ট করেছেন। ইংরাজির অধ্যাপিকা। যদিও দুলাল লাহিড়ীর ছেলেও কোনো অংশে কমতি নন। ছোটছেলে স্বদেশ ডব্লিউ বিসিএস অফিসার। সবার প্রথমে সোনার নেকলেস দিয়ে ছোট বউমাকে আশীর্বাদ করেন স্বদেশের বাবা। মাথায় ধান-দুর্বা দিয়ে,প্রদীপের তাপ কপালে দিয়ে, মিষ্টি ও জল খাইয়ে যেমনভাবে সকলে আশীর্বাদ করেন, তিনিও তেমনি সুষ্ঠু আচার মেনে আশীর্বাদ করেন ও শেষে মাথায় হাত দিয়ে বলেন --- "সুখী হও, তোমার পদস্পর্শে আমার বাড়িতে স্বর্গ নেমে আসুক।" এরপর দুলাল বাবুর সঙ্গে থাকা আত্মীয়রা একে একে সুকন্যাকে আশীর্বাদ করেন ও নিজেদের পরিচয় দিয়ে নিজের নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী কন্যার হাতে টাকা দেন। তাদের আশীর্বাদের পর সুকন্যার বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজনেরা সুকন্যাকে আশীর্বাদ করেন। সুকন্যাও প্রত্যেকের পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করেন। এতবড় চাকরি করলেও মা-ঠাকুমার শেখানো সু-সংস্কারকে সুকন্যা একটুকুও ভোলেন নি। সারা বাড়ি বারংবার শঙ্খধ্বনি ও উলুধ্বনিতে ভরে যায়। মেয়ের বাড়ি তখন আত্মীয়ের সমাগমে মুখরিত। সুকন্যার দুই পিসি, দুই মাসি, দুই মামা, দুই কাকা এবং তাদের ছেলে - মেয়েরা মিলে বাড়িটাকে প্রাণবন্ত করে তুলেছেন। আশীর্বাদ হয়ে গেলে মেয়ের বাড়ির লোকেরা দুলালবাবুদের জলখাবারের ব্যবস্থা করেন। ফুলকো লুচি, চানা মশলা , দুরকম মিষ্টি ও সেভেন আপের ছোটো বোতল পরিবেশন করা হয়। জলখাবার খেয়ে দুলালবাবুরা ছেলের গায়ে হলুদের বাটিটা সুকন্যার পিসির হাতে দেন ও মেয়ের গায়ে ঠেকানো হলুদের বাটি নিয়ে গাড়িতে ওঠেন। মিনিট ত্রিশের মধ্যে তারা বাড়ি এসে যান।
দুপুর একটা নাগাদ মেয়ের বাড়ি আভ্যুতি পড়ানো হয়। এরপর সুকন্যার গায়ে বরের হলুদ লাগায় আত্মীয়স্বজন। সুকন্যার দুচোখে জল দেখা যায়। মা বলেন--- "এই পাগলী মেয়ে কাঁদছিস কেন? চিরকাল কি মেয়েরা মায়ের কাছে থাকে? স্বামীর বাড়ি তাকে একদিন না একদিন যেতেই হয়। ওটাই তো মেয়েদের আসল বাড়ি। যখন মন খারাপ করবে স্বদেশকে নিয়ে চলে আসবি।" বাজনা বাজিয়ে কলসি করে তুলে আনা জলে এরপর সুকন্যাকে স্নান করানো হয়। ওদিকে ছেলের বাড়িতেও আভ্যুতি পড়ানো হয়। তারপর ছেলের গায়ে হলুদ দিয়ে নদী থেকে তুলে আনা জলে স্নান করানো হয়।
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার সময় সুকন্যার দাদা সুদীপ্ত ও দুজন জামাইবাবু একটি আর্টিকা গাড়ি নিয়ে স্বদেশকে নিতে আসেন। গাড়িটি ফুল দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছিল। তারা আসার সময় একটা মিস্টির দোকান থেকে এক হাঁড়ি মিষ্টি নিয়ে আসেন। বাড়ির পাশের একজন কাকিমা স্বদেশকে খুব সুন্দরভাবে সাজান। রাত দশটায় বিয়ের লগ্ন ছিল। স্বদেশ সমস্ত নিয়ম পালন করে সাড়ে সাতটায় বাড়ি থেকে রওনা দেন। যাওয়ার সময় মাকে বলে যান --- " মা আমি এ বাড়ির লক্ষ্মীকে আনতে যাচ্ছি।" গাড়ি মাঝ পথে পাঞ্চার হয়ে যায়। শুভ কাজে বাঁধা অনুভব করে স্বদেশের মনের মধ্যে কেমন খচখচ করতে থাকে। সঙ্গে স্টেপনি থাকায় ড্রাইভার পনেরো মিনিটের মধ্যে চাকাটি পরিবর্তন করে নেন। আটটা চল্লিশে স্বদেশ সুকন্যাদের বাড়ির গেটের কাছে পৌঁছান। আগে থেকেই একগাদা ছেলে-মেয়েরা গেট আটকে দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়ের মা ও পিসি-মাসিরা স্বদেশকে বরণ করার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। খুব সুন্দরভাবে নিয়ম মেনে সুকন্যার মা স্বদেশকে বরণ করেন। মিষ্টি খেতে খেতে এই কদিন স্বদেশের পেট মোটা হয়ে গেছে। কোনো ভাবেই গেট দিয়ে স্বদেশকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়না। স্বদেশের কাছে কুড়ি হাজার এক টাকা দাবি করা হয়। কোনো সংকোচ না করে স্বদেশ বলেন --- " তোমরা আমাকে কোনো বিপদে ফেলবে না, তবে আমি যাওয়ার সময় তোমাদের কথা রাখব।" সকলে রাজি হওয়ায় স্বদেশকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয়। সুকন্যার এক জামাইবাবু স্বদেশকে হাত ধরে ভিতরে নিয়ে এসে সিংহাসনে বসিয়ে দেন।
এদিকে বিকেল চারটের সময় বিউটি পার্লার থেকে তিনজন বিউটিশিয়ান সুকন্যাকে সাজাতে আসেন। তাকে সাজাতে ও শাড়ি পড়াতে মোট দুঘন্টার মতো সময় লাগে। এত অপূর্ব সুকন্যাকে তারা সাজিয়েছিলেন দেখে মনে হচ্ছিল দুর্গা ঠাকুর। টানা টানা করে কাজল পড়িয়েছিলেন। লজ্জায় সারা মুখ লাল হয়ে উঠেছিল তার। সাড়ে ছটায় একটি ঘরে বড় লম্বা একটা সিংহাসনে এসে বসেন সুকন্যা। সারা গায়ে সোনার অলংকার ও নাকে একটি হীরের নাকছাবি। নিমন্ত্রিত ব্যক্তিরা উপহার নিয়ে আসেন। সেগুলো গ্ৰহন করে হাসি মুখে নমস্কার করেন সুকন্যা। সানাইয়ের আওয়াজ সমগ্ৰ বাড়িতে একটা মনোমুগ্ধকর পরিবেশের সৃষ্টি করে। সুকন্যার বোনেরা ও কয়েকজন বান্ধবী তার সঙ্গে ছিল বিভিন্ন সাহায্যের জন্য।
রাত নটা কুড়ি মিনিট নাগাদ সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে পুরোহিত বিয়ে পড়াতে বসেন। বরযাত্রীরাও তার মধ্যে এসে যায়। প্যান্ডেলের একপাশে বিভিন্ন খাওয়া - দাওয়ার স্টল বসানো হয়েছিল। যে যার পছন্দের স্টল থেকে বিভিন্ন রকমের খাবার খেতে থাকেন। ব্যারিস্টার দুলাল লাহিড়ী ও তার বড় ছেলে - বউমা সকলেই উপস্থিত ছিলেন। সুকন্যাকে প্রত্যেকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন স্বদেশের বউদি। ওদিকে সুকন্যার বউদিও তাদের বাড়ির লোক ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে স্বদেশের পরিচয় করিয়ে দেন। একটি সময় স্বদেশের পোশাক পাল্টে পুরোহিত বিয়ের স্থলে নিয়ে আসতে বলেন। সুকন্যাদের বাড়ি থেকে দেওয়া ধুতি - পাঞ্জাবি পড়ে বিয়ের পিঁড়িতে এসে বসেন স্বদেশ। মন্ত্রপাঠ করে বেশ কিছু নিয়ম পালন করার পর সুকন্যাকে পুরোহিত নিয়ে আসতে বললেন। পান পাতায় মুখ ঢেকে থাকেন সুকন্যা। সুকন্যার জামাইবাবুরা তার পিঁড়ি ধরে নিয়ে এসে স্বদেশের সাত পাক ঘোরায় এবং তারপর শুভদৃষ্টি হয়। এই দৃশ্যটি ভোলার নয়।
আমি স্বদেশের বন্ধু বিভাস। তখন আমি স্বদেশের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। ছেলে বড় না মেয়ে বড় দেখাতে গিয়ে দুজনকেই তুলে ধরা হয় । সুকন্যাকে প্রায় ছয়ফুট উপরে তুলে ধরা হয়েছিল আর স্বদেশকে পাঁচ ফুট। সুকন্যা পিঁড়ি থেকে পড়ে যাচ্ছিলেন। চিৎকার করে ওঠেন ও। সুকন্যার দাদা ওকে ধরে ফেলেছিলেন। আমি ভয় পেয়ে যাই। স্বদেশের মনটা একটু সময়ের জন্য খারাপ হয়ে যায়। এরপর সব ভুলে দুজনকে বিয়ের ছাতনা তলায় মুখোমুখি পিঁড়িতে বসিয়ে ঘটের উপর একজনের হাতের উপর অন্যের হাত রেখে মন্ত্রপাঠ করা হয়। এরপর দুজনকে পাশাপাশি বসিয়ে গাঁটছড়া বেঁধে, মন্ত্রপাঠ, সিঁদুর দান, হোমযজ্ঞ সব উপাচার নিয়ম মতো পালন করিয়ে পুরোহিত বিয়ে সম্পন্ন করেন। আমি তখন অবিবাহিত। পুরো বিষয়টি খুব মন দিয়ে দেখেছিলাম।
এদিকে বরযাত্রী ও কন্যার বাড়ির নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের খাওয়া - দাওয়ার পাট প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। স্বদেশ ও সুকন্যার খাবারের ব্যবস্থা সেদিন ঘরে হয়েছিল। ওরা দুজন খেতে গেলে আমি ও অন্যান্য বন্ধুরা খাবার প্যান্ডেলে গিয়ে খেতে বসি। খাওয়া - দাওয়া শেষ করে বিবাহ বাসর জাগার জন্য আমি ও অন্যান্য বন্ধুরা যে ঘরে স্বদেশ ও সুকন্যা বসেছিলেন সেখানে যাই। সারা রাত গান ও বিভিন্ন খেলার মধ্যে দিয়ে কেটে যায়। তবে আমি বাদে সকলেই কমবেশি একটু ঘুমিয়েছিলেন। কিন্তু বললে মানতে রাজি নন। সবাই বলে আমি চোখ বন্ধ করে সব শুনছিলাম, আমি ঘুমাই নি।
সকাল এগারোটায় বাসি বিয়ে শুরু হয়। কড়ি খেলা ও আংটি খোঁজা খেলা হয়। আমরা সকলেই খুব মজা করেছিলাম। স্বদেশ সুকন্যাকে জিতিয়ে দিয়েছিলেন। বিকেল পাঁচটায় সেজেগুজে মেয়ের বাড়ির বিভিন্ন নিয়ম পালন করে আমরা রওনা দিই। স্বদেশ আমার কাছে পূর্ব প্রতিশ্রুতি মতো কুড়ি হাজার এক টাকা দিয়ে বলেন --- "ভাই, আমার যারা গেট ধরেছিল তাদের এই টাকাটা দিয়ে দিস এবং আমার তরফ থেকে বৌভাতের নিমন্ত্রনটাও সেরে ফেলিস।" স্বদেশের কথা মতো আমি তাড়াতাড়ি কাজটা সেরে ফেলি। আমরা সুকন্যাদের বাড়ি থেকে বেরনোর আগে একবার মেয়ে-জামাই বরণ হয়েছিল। কুলোর মধ্যে পান, সুপারি, কলা, ধান ও প্রদীপ নিয়ে এই মাঙ্গলিক কাজ চলেছিল। বাড়ি থেকে বেরনোর সময় একবার কান্নার পালা চলেছিল। বাংলার ঘরে ঘরে এই চেনা ছবি কমবেশি সকলেই দেখেছে। মায়ের নাড়ি ছেঁড়া ধন মাকে ও আপনজনদের ছেড়ে অজানা - অচেনা একজায়গায় সারাজীবন কাটানোর জন্য চলে যাচ্ছে, চোখে তো জল আসবেই। গোধূলির সময় আমরা স্বদেশদের বাড়িতে পৌঁছেছিলাম। প্রথমে স্বদেশের মা ছোটো ছেলে ও বৌমাকে বরণডালা নিয়ে বরণ করেন। চারিদিক উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনিতে গমগম করে। তারপর একে একে ছেলের বাড়ির সমস্ত নিয়মগুলো ছেলে - বউমাকে দিয়ে পালন করান স্বদেশের মা ও ঠাকুমা। এরপর মন্দিরে গিয়ে তারা দুজন ঠাকুর নমস্কার করেন। পাড়ার একজন কাকিমা বলেই ফেলেন --- " দিদি তোমার ছোট বউতো রুপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী। কী সুন্দর দেখতে! আমার চোখ দুটো ওর উপর থেকে সরছে না।" এটা শুনে সকলে বলেন--"ঠিক বলেছেন দিদি ঠিক বলেছেন। আমাদের স্বদেশের সঙ্গে খুব মানিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে একেবারে লক্ষ্মী - নারায়ন জুটি।"
ঘরে ঢোকার সময় একটি বিপত্তি ঘটেছিল। শাড়িতে পা বেঁধে সুকন্যা বউদি পড়ে যাচ্ছিলেন। স্বদেশ তাকে ধরে ফেলেন। সবাই এটি নিয়ে বেশ হাসাহাসি করে। এদিকে স্বদেশের ভাই - বোনেরা গেট আটকে রেখেছিল। তাদের দাবি পূরণ না করলে তারা তাদের ঘরে ঢুকতে দেবে না। স্বদেশ কথা দেয়, সে তাদের মুখেও হাসি ফোটাবে। এরপর সাদা কাপড়ের উপর দিয়ে দুধ-আলতা জলে প্রথম বাঁ পা দিয়ে হেঁটে হেঁটে শ্বশুর বাড়ি প্রবেশ করেন সুকন্যা। স্বদেশের ঠাকুমা প্রায় একঘন্টা ধরে ছোট ছোট খেলা করায়। তার বিশ্বাস এই খেলা গুলোর মধ্যে দিয়ে বোঝা যায় দুজনের সম্পর্ক কেমন হবে। আমরা বন্ধুরা স্বদেশ ও সুকন্যার সঙ্গে অনেক ছবি তুলি। নতুন বউকে দেখার জন্য স্বদেশদের বাড়িতে সারা পাড়ার মেয়ে - বউরা ভিড় করেছিল। রাত দশটার সময় আমরা বন্ধুরা যে যার মতো বাড়ি ফিরে যাই। ওই দিনের রাতটা বর-বউয়ের মুখ দেখতে নেই, একসঙ্গে থাকতে নেই। ওই রাতটাকে কালরাত্রি বলা হয়। সুকন্যার সঙ্গে তার একজন পিসতুতো বোন এসেছিল। সুকন্যা ও সেই মেয়েটিকে একটি ঘরে শোওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন সুকন্যার জা।
পরদিন ছিল বৌভাত। প্রায় একহাজার লোকের ছিল নিমন্ত্রন। ব্যারিস্টার দুলাল লাহিড়ী তার বড় ছেলে ও স্বদেশকে নিয়ে কেনা কাটা থেকে শুরু করে সমস্ত কিছু দেখভাল করেন। বড় ছেলে তুষার ও ছোট ছেলে স্বদেশকে তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দেন। বাড়ির দিকটা সামলায় বড় বউ রুপা ও শাশুড়ি নিরুপমা দেবী। দুলাল বাবু শুধুমাত্র পরিবেশনের দায়িত্ব একটি ক্যাটারিং কোম্পানিকে দিয়েছিলেন। বাদবাকি সবই তারা সকলে মিলে সামলে নেবেন বলে ঠিক করেছিলেন। একে একে সব কাজই ঠিক মতো চলে। কিন্তু বেলা একটা বেজে গেলেও মাংস বিক্রেতা খাসি নিয়ে না আসলে দুলাল লাহিড়ীর খুব টেনশন হয়। তারসঙ্গে মাথা গরমও হয়ে ওঠে। দেড়টার সময় হেলতে দুলতে মাংস বিক্রেতা আসেন। তিনি বলেন --- 'ইঞ্জিন ভ্যান খারাপ হয়ে গিয়েছিল, ঠিক করে তাই আসতে হল।' লাহিড়ীবাবু বলেন --- "রাত আটটায় আমি প্রথম ব্যাচ বসাব। মাংস কাটবেন কখন আর রান্না করবে কখন। লোক খেতে না পেলে তো আমায় গালাগালি দিতে দিতে বাড়ি যাবে, আপনার তো কোনো সমস্যা হবে না।" এরপর মাংস বিক্রেতা বলেন --- " অত রাগ করলে হয় বাবু। পরিস্থিতি তো বিচার করবেন। এই তো আমরা এক্ষুনি শুরু করছি। আড়াইটার মধ্যে আপনার মাংস আমি রেডি করে দিচ্ছি।" খুব দ্রুত হাত চালিয়ে মাংস বিক্রেতারা তিনটের সময় মাংসকাটা শেষ করেন। স্বদেশের বাবার টেনশন কিছুটা দূর হয়। বিকেল চারটের সময় ক্যাটারিংয়ের ছেলেরা এসে উপস্থিত হয়। তারাও সন্ধ্যা সাড়ে ছটার মধ্যে খাবার জায়গা রেডি করে ফেলে। সব কিছু সাড়ে সাতটার মধ্যে রান্না হয়ে যায়। দুটি খাসি রেখে দিয়েছিলেন ব্যারিস্টার দুলাল লাহিড়ী মহাশয়। যদি রাতে কম পড়ে তবে কেটে রান্না করা হবে।
সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে সুকন্যাকে সাজিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়। একে একে লোকজন আত্মীয়স্বজন আসা শুরু করে। সেদিন বাড়ির ছেলেরা সকলে স্যুট প্যান্ট পড়েছিলেন। রাত নটায় কন্যা যাত্রীরা এসেছিলেন। পুলিশের বড়বাবু থেকে শুরু করে বিচারক, স্বদেশের পরিচিত অফিসারেরা বৌভাতে উপস্থিত ছিলেন। দেখে মনে হয়েছিল বিয়ে বাড়িতে চাঁদের হাট বসেছে। এক হাজার জন লোক নিমন্ত্রিত থাকলেও প্রায় বারোশো লোক হয়েছিল। বাড়ির লোক ও শেষের দিকে কিছু নিমন্ত্রিত ব্যক্তি ঠিকঠাক খেতে পারেন নি। দুলাল বাবু খুব লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলেন। তবে এমন হল কি ভাবে তা তিনি বুঝে উঠতে পারেন নি। আসলে তাদের নিমন্ত্রনের কোনো সঠিক হিসাব ছিল না। যে যেমন পেরেছে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। এক বালতি গরুর দুধে একটু খানি গরুর চোনার মতো ব্যাপার ঘটেছিল। এত ভালো ব্যবস্থা করেও, এতো টাকা খরচ করেও শুধুমাত্র সুপরিকল্পনার অভাবে লজ্জায় পড়তে হয়েছিল তাদের।
স্বদেশ ও সুকন্যার ফুলসজ্জার খাটটি আমরা বন্ধুরা মিলে খুব সুন্দর ভাবে সাজিয়েছিলাম। আমরা সকলে চলে গেলে ওই ঘরেই প্রথম বিবাহিত জীবনের পথচলা শুরু হয়েছিল তাদের। একটা হীরের আংটি দিয়ে স্বদেশ সুকন্যার ঘোমটা তুলে মুখ দেখেছিলেন। এই রাতটি তাদের দুজনের জীবনে চিরকালের মতো স্মরণীয় হয়ে যায়। বিবাহ বন্ধনের মধ্যে দিয়ে জীবনের ও সংসারের বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা দুজন।
====================
মিঠুন মুখার্জী
গ্ৰাম : নবজীবন পল্লী
পোস্ট+থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগণা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন