Featured Post

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। নবপ্রভাত ৮৫ ।। চৈত্র ১৪৩১ মার্চ ২০২৫

ছবি
  সূচিপত্র নিবন্ধ ।। মরিয়ম মির্জাখানি: এক অনন্য গণিতসূর্য ।। ... নিবন্ধ ।। নারী দিবসে যা ভাবা উচিত ।। বিশ্বনাথ পাল প্রবন্ধ ।। প্রাচীনকাল থেকে নারীরা অবহেলিত, বঞ্চিত,... নিবন্ধ ।। আমার চোখে আদর্শ নারী ।। জয়শ্রী বন্দ্... ফিচার।। এই মুহূর্তে বাংলা সাহিত্যে নারীদের লেখালেখ... আফ্রিকার লোককথা ।। করোটিকে বিয়ে করা অবাধ্য মেয়েটি ... ছোটগল্প ।। মানবী ।। ভুবনেশ্বর মন্ডল নিবন্ধ ।। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অন্যতম নারী মু... নিবন্ধ ।। প্রিয় মহিলা সাহিত্যিক আশাপূর্ণা দেবী ।। ... গল্প ।। উই ওয়ান্ট জাস্টিস ।। রবীন বসু প্রবন্ধ ।। নিপীড়িতা ।। শ্যামল হুদাতী ফিচার ।। রমণী রতন ।। মানস কুমার সেনগুপ্ত প্রবন্ধ ।। নারী সমাজ : তখন-এখন ।। তপন মাইতি নিবন্ধ ।। বহমান কালের ধারায় নারী ।। দীপক পাল গল্প ।। আমার দুর্গা ।। অঞ্জনা গোড়িয়া (সাউ) গল্প ।। যোগ্য জবাব ।। সমীর কুমার দত্ত ছোটগল্প ।। আমি দুর্গাকে দেখেছি।। চন্দন দাশগুপ্ত গল্প ।। সম্পর্ক ।। গৌতম সমাজদার কবিতা।। নারী মানে ।। গোবিন্দ মোদক কবিতা।। নারী ।। সমর আচার্য্য ছড়া ।। নারী অসামান্যা ।। সৌমিত্র মজুমদার কবিতা ।। নারী দিবসে ।। বিবেকানন্দ নস্কর কবিতা ।। না...

প্রবন্ধ ।। কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার ।। অঞ্জনা দেব রায়

সমরেশ মজুমদার

কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার

অঞ্জনা দেব রায়  


বাংলা সাহিত্যের জগতে এক অন্যতম কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার (১৯৪৪-২০২৩)। তাঁর কথার কারখানার মূল উপাদান ছিল মানুষ। আর সেই মানুষকে দেখার জন্য নির্মম ও নির্মোহ ভাবে সাহিত্যিকের অন্তর্দৃষ্টি ছাড়া আর অন্য কিছু গ্রহণ করেননি।  তা সে উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ এবং মৌষলকাল-এর চতুর্ভুজ হোক বা সাতকাহনের নারী-কথা হোক।

        তাঁর কথা ও দেখার শুরুটা হয়েছিল দেশ পত্রিকাতে । ১৯৬৭ থেকেই তাঁর দেশ পত্রিকার সাথে সংযোগ।  গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি তাঁর প্রচণ্ড আসক্তি ছিলো । সাহিত্যজীবনে পদার্পণের আগে ১৯৬৫ সাল নাগাদ বন্ধুস্থানীয়দের সাথে একত্রে 'শাতকর্নি' নামের একটি নাটকের দল তৈরি করেছিলেন তিনি। বিমল করের একটি গল্প অবলম্বনে পিয়ারিলাল বার্য নাটকে নামভূমিকায় অভিনয়ও করেন তিনি । সে সময় দেশ পত্রিকার যাত্রা- নাটক বিভাগের সম্পাদক প্রবোধ চন্দ্র অধিকারী সমরেশ মজুমদারকে নাটকের জন্য গল্প লেখায় অনুপ্রাণিত করেন। তার প্রথম গল্প "অন্যমাত্রা" লেখাই হয়েছিল মঞ্চনাটক হিসাবে, আর সেখান থেকেই তাঁর লেখক জীবনের শুরু। তাঁর লেখা গল্প অন্যমাত্রা ছাপা হয়েছিল ১৯৬৭সালে।  অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের লেখায় সমরেশ মজুমদার পড়েছিলেন, 'শুরু করা উচিত চুড়া থেকে'। তাঁর প্রথম গল্প দেশে ছাপা হওয়ার পর থেকে আট বছরে প্রায় চব্বিশটা ছোট গল্প বেরোয় দেশ-এ। সাগরময় ঘোষের সান্নিধ্যে দেশেই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস দৌড় ১৯৭৫ সালে। বিভিন্ন মানুষের সান্নিধ্য কী ভাবে সমরেশ মজুমদারের  অন্তর্দৃষ্টিকে তৈরি করেছিল, তা বোঝা যায় ১৯৮৯সালে তাঁর প্রথম ধারাবাহিক উপন্যাস  উত্তরাধিকার লেখার প্রেক্ষাপটটি থেকে। জনপ্রিয় এই উপন্যাসের পর আরো দুটি পর্ব লেখেন তিনি 'কালবেলা' ও 'কালপুরুষ' নামে।  সাগরময় ঘোষ সমরেশ মজুমদারের কাছ  থেকে ধারাবাহিক উপন্যাস চেয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন, 'জীবনে যাঁদের দেখেছ, তাঁদের নিয়ে গপ্পো তৈরি করো'। এই পরামর্শটা বোধ হয় মাথায় রেখেছিলেন সমরেশ বাবু । আর তাই তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস-চতুষ্ক, গর্ভধারিণীতে বামপন্থী, দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকে দেখেন নিজস্ব আঙ্গিকে। আবার নারীকেও ভাবেন, দেখেন নিজের মতো করে। তাই 'কা্লবেলা''র চরিত্র মাধবীলতাকে ৪২ বছর ধরে ভাবিয়েছিল দু'টি অপমান। একটি অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় রাষ্ট্রীয় অত্যাচার। আর অন্যটি, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে অনিমেষের দেওয়া বিবাহ প্রস্তাব। আবার সাতকাহন-এ চা-বাগানে বড় হওয়া দীপাবলির ব্যক্তিজীবনের লড়াই ও আত্মপ্রতিষ্ঠা আমাদের সমাজের বহু নারীর কথা মূর্ত করে। শুধু ব্যক্তি নয়, সমাজটাকেও নারী কী ভাবে বদলাতে চায়, তার প্রমাণ ঠিকানা ভারতবর্ষ । সেই সঙ্গে নির্মোহ ভাবে দেশের অর্থনীতির ফোঁপরা অবস্থাটাকে দেখাতে চেয়েছেন দৌড় এর বিকাশ চরিত্রটির মধ্যে। মৌষলকাল-এ দেখাতে চেয়েছেন চারপাশে মূল্যবৃদ্ধি, জনতার  দীর্ঘশ্বাস।

        এই ভাবনা ও চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার অবলম্বন-ভাষা। চারপাশটাকে তিনি যে খুব ভাল চেনেন, তা বোঝা যায় তাঁর ভাষা ব্যবহারেও। কালপুরুষ-এর ঈশ্বরপুকুর লেনে বস্তিবাসী ছেলেদের সংলাপগুলি এর প্রমাণ। আবার উল্টো দিকে, কিশোর মনের জন্য তৈরি করেন 'অর্জুন'-গোয়েন্দার গল্প।

        তবে তিনি শুধু তাঁর লেখনী গল্প, উপন্যাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি; ভ্রমণকাহিনী থেকে গোয়েন্দাকাহিনি, কিশোর উপন্যাস, প্রবন্ধ, সমলোচনাতেও তাঁর কলম মনস্বী। বহু সংখ্যক সাহিত্যকীর্তির স্বীকৃতিও এসেছে নিজের নিয়মেই-আনন্দ পুরস্কার,  বঙ্কিম পুরস্কার, সাহিত্য অ্যাকাদেমি-সহ আরো নানা পুরষ্কার । তবে শেষ পর্যন্ত তিনি একটি যাত্রাপথের পর্যটক। যিনি দিয়ে যান আগামীর জন্য পরামর্শও 'জন্ম থেকেই দৌড়ে যাচ্ছি আমরা। প্রত্যেকেই একটা  লক্ষ্যের দিকে ছুটছি। একটু অসতর্ক হলেই হেরে যেতে হবে'।

        তাঁর লেখা প্রত্যেকটি উপন্যাসের বিষয় ভিন্ন, রচনার গতি এবং গল্প বলার ভঙ্গি পাঠকদের আকর্ষিত করে । চা বাগানের মদেশিয়া সমাজ থেকে কলকাতার নিম্নবিত্ত মানুষেরা তাঁর কলমে উঠে আসেন রক্ত-মাংস নিয়ে। তরাইয়ের চা-বাগান এলাকার দুই পৃথিবী । সচ্ছল বাবুপাড়া ও হতদরিদ্র কুলিবস্তি। কুলিবস্তির মেয়ে উনকি। উনকি মানে ভগবানের সন্তান ।কিন্তু ভগবানের মেয়ের ভাগ্য ভাল হয়নি।  সমরেশ মজুমদারেরে 'উনকি' উপন্যাসে দুঃখী এক মদেশিয়া মেয়ে হেঁটে চলে দিগন্তের দিকে । এছাড়া তাঁর  উপন্যাসগুলির মধ্যে সাতকাহন,তেরো পার্বণ, স্বপ্নের বাজার, উজানগঙ্গা, ভিক্টোরিয়ার বাগান,আট কুঠুরি নয় দরজা,অনুরাগ গর্ভধারিণী, বন্দীনিবাস, ফেরারী, হারামির হাতবাক্স, এই আমি রেণু, কলিকাতার নবকুমার, বাসভূমি, নিকট কথা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাঁর ট্রিলজি 'উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ' বাংলা সাহিত্য জগতে তাকে বিশেষ খ্যাতির অধিকারী করেছে। এছাড়া তিনি বেশ কয়েকটি টিভি সিরিয়াল করেছিলেন । তাঁর লেখা ছোটগল্পের মধ্যে অন্যতম কিছু গল্পগ্রন্থ হল-একাদশ অশ্বারোহী, যে যেরকম থাকে, চোখের জলে শ্যাওলা পড়ে না, গোপন ভালবাসা ইত্যাদি। এছাড়া তাঁর লেখা নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – স্বরভঙ্গ, আদিম খেলা , উল্লুক, বিরহের অন্তরালে ইত্যাদি। শিশু-কিশোরদের উপযোগী অ্যাডভেঞ্চারমূলক বহু গল্প লিখেছেন,তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জয়ন্তীর জঙ্গলে, জুতোয় রক্তের দাগ, হাঙরের পেটে হিরে, কালাপাহাড়, অর্জুন বেরিয়ে এলো, খুনখারাপি, ইত্যাদি।  

        অনেক অসাধারণ লেখনীর শব্দের এই রূপকার জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কার, অর্জন করেছেন। ১৯৮২ সালে আনন্দ পুরস্কার, ১৯৮৪সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরুস্কার ,বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার, দিশারী ও চলচিত্র প্রসার সমিতি –শ্রেষ্ঠ স্ক্রিপ্ট রাইটার-১৯৮২, বঙ্কিম কৃষ্ণদাস মজুমদার,শ্যামলী দেবীর সন্তান সমরেশ মজুমদার তাঁর মাস্টারমশাইয়ের নির্দেশ নিজের সৃষ্টির ক্ষেত্রে সারাজীবন অক্ষরে-অক্ষরে পালন করেছেন। আর তা করেছেন সমাজ,রাজনীতি, অর্থনীতিকে দেখার পাকদণ্ডী বেয়ে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করে সামগ্রিক ভাবে তিনি তাঁর মনন ও কথন-বিশ্বটি তৈরি করেছেন । আর এই বিশ্বের ভৌগলিকসীমা মূলত উত্তরবঙ্গ ও কলকাতা। তবে কালবেলায় বীরভুম, ঠিকানা ভারতবর্ষ-এ পুরুলিয়া, দক্ষিণবঙ্গের অনুষঙ্গও এসেছে নিজের মতো করে । শহরকেন্দ্রিক জীবনের আলেখ্য বারবার উঠে এসেছে তার লেখায়। যে কারণে তাকে আপাদমস্তক 'আরবান'লেখক বলে অনেক সময় বর্ণনা করা হয় । কিন্তু এরই পাশাপাশি নিজের শৈশব,কৈশোরের চা বাগানের জীবন, শ্রমিক, রাজনৈতিক নেতা থেকে ছোট ছোট চরিত্র ঘুরেফিরে এসেছে শুধু তাঁর প্রধান উপন্যাসগুলোতেই নয়, ছোটগল্পেও। ঘরোয়া আড্ডার সময়ও খুব মনোযোগ দিয়ে কৈশোরের চরিত্রগুলোকে তুলে ধরতেন তিনি। সকলের সাথে খুব সাধারণ ভাবে মিশতে পারতেন। সব সাধারণ মানুষই সমরেশ বাবুর লেখার বিভিন্ন চরিত্র হয়ে উঠেছিলো।

        উত্তরবঙ্গ থেকে সোজা উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুরে এসে নিজেকে এক আড্ডার বন্ধনে জড়িয়েছিলেন, যে আড্ডায় শিল্পি, শিল্পপ্রেমিক, সাহিত্যিক, সাধারণ মানুষ সবাই আসতেন, নির্ভেজাল আড্ডা হত, আনন্দ হত, আর সঙ্গে খাওয়াদাওয়া।  সকলের সঙ্গে সহজ ভাবে গল্প করা, আড্ডা মারা এমনকি যখন তিনি খ্যাতির চরম শীর্ষে, তখনও তিনি একই রকম। সমরেশ মজুমদারের উষ্ণতার অভাব আমৃত্যু অনুভব করবে সকলে, যদিও তিনি তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের জন্য চিরদিন সকলের মাঝে বেঁচে থাকবেন।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় লেখা

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

প্রচ্ছদ।। ৮৩তম সংখ্যা ।। মাঘ ১৪৩১ জানুয়ারি ২০২৫ ।। প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮১তম সংখ্যা ।। অগ্রহায়ণ ১৪৩১ নভেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮৪তম সংখ্যা ।। ফাল্গুন ১৪৩১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮২তম সংখ্যা ।। পৌষ ১৪৩১ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৯তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮০তম সংখ্যা ।। কার্তিক ১৪৩১ অক্টোবর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। নবপ্রভাত ৮৫ ।। চৈত্র ১৪৩১ মার্চ ২০২৫

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল