নাত জামাই
সুদামকৃষ্ণ মন্ডল
ভোট শব্দটা কানে পৌঁছালে সাধারণ মানুষ যেন বিষাক্ত সাপের পাশে আছে মনে করে । সে যেন খাটের উপরে শুয়ে আছে ; মশারির উপরে দীর্ঘাকার বিষাক্ত কালকেউটে অথবা ভয়াল গোখরো । হাত পা একটু নড়লেই মারবে ভয়ংকর ছোবল । এক খাবলা মাংস নেবার পরে বিষ শরীরে ছড়িয়ে গেলে মৃত্যু হবেই। পরিবার ভেসে যাবে । ক্ষমতায় থাকা নেতার দোর্দণ্ড প্রতাপ চেহারা সত্যিই তাই। গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে গণতান্ত্রিকতা প্রতিষ্ঠা করা সংসদীয় রীতি । ক্ষমতালোভীর এত বিকট বিষম চেহারা কেন ? পক্ষপাতিত্ব গ্রহণ এবং আত্মকেন্দ্রিক নাগরিক পরিষেবা যা কিছু তা উপভোগ করা । ফলে দলের প্রতি কারো ভরসা নেই । আপামর সর্বসাধারণের জন্য ধনী গরীব নির্বিচার করে বিলি বন্টন পরিষেবা হল নির্বাচিত প্রতিনিধিত্ব দলের কাজ । স্বার্থ-সর্বস্ব পক্ষপাতদুষ্ট বলেই এতই হিংসাশ্রয়ী প্রতিহিংসাপরায়ণ ।
তারই পরিপ্রেক্ষিতে শশাঙ্ক এ কয়েকদিন মনমরা হয়ে আছে। দেশ স্বাধীন , নাগরিকদের ভোটাধিকার স্বাধিকার । তাহলে কেন এই অরাজকতা ?
ওরা এসে প্রতি বাড়িতে টিকিট বিলি করে গেল । ভোটার লিস্টের সিরিয়াল নম্বর ধরে আধার কার্ড নম্বর সম্বলিত নাম ঠিকানা লেখা টোকন । ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে ক্রমান্বয়ে নির্বাচনী কর্মীদের কাছাকাছি পৌঁছে টোকন ধরে ক্রমিক নম্বর হাঁকালেই পোলিং এজেন্টরা মিলিয়ে নেবেন । সঙ্গে নির্বাচনী কর্মীরাও । এভাবে ভোটের বিধি ব্যবস্থা সার্বিকভাবে মেনে নিয়েছে । তাই নির্বাচনে লড়াই করা যে ক'টি দল আছে তাদের প্রার্থী যার যাকে ভালো লাগে বা মত আদর্শ বুঝে নাগরিকের স্বাধীন মৌলিক অধিকার ভোট দিয়ে সংবিধানপ্রদত্ত অধিকার প্রয়োগ করবে ।
শশাঙ্ক নির্ভেজাল মানুষ । সাথে পাঁচে থাকে না । একসময় শাসক দলে ছিল । মিটিং মিছিলে মেহনতির দলে ভিড়ে পুরো দস্তুর মত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করত। এখন সে চুপচাপ থাকে । কিন্তু গতরাতে তার পরিবারে সকলের আই কার্ড আধার কার্ডসহ সব নাগরিক পরিচিতির যাবতীয় নথিপত্র শাসক দলের হয়ে একদল হোমড়া চোমরা এসে নিয়ে গেছে । বিধু ওই দলে ছিল । পাড়ারই ছেলে মুখে মাস্ক পরিহিত সকলে । তখন শশাঙ্কের মা-বাবা চৌকিতে বসে নাতি- নাতনিদের নিয়ে হাসি তামাশায় ছিল । বিধুই এসেই বলল , বাড়িতে দেখছি সবাই আছো । ঠাকুমা-- তোমার পরিবারের সকল ভোটারের পরিচয়পত্রসহ সব ডক্যুইমেন্ট আজকে দাও । আগামীকাল ভোটের লাইনে দিয়ে দেবো । আমাদের বুথে জঙ্গি আশ্রয় নিয়েছে ।
চারিদিকে ভোটের সময় অপ্রীতিকর ঘটনার কথা সর্বজনবিদিত । সকলেই শান্তিতে থাকতে চায় । ফলে অনর্থক বিতর্কে না গিয়ে সুবোধ বালিকার মতো শশাঙ্কের বউ কঙ্কনা আলমারি খুলে সবকিছুই ধরিয়ে দিল ওদের হাতে । বিধুর দলে থাকা লব বলল , কালকে ভোট দিতে যাবে না । নাতি-নাতনি নিয়ে ঘরে যদি থাকতে চাও যাবেই না । ব্যস । নিশ্চিন্তে থেকো ভোটটা আমরাই দিয়ে দেব । প্রতি ঘরে ঘরে এইভাবে ওরা বলে একতরফা ভাবে ভোট আদায়ের ব্যবস্থা করেছে । তবুও যারা বুকে সাহস নিয়ে ভোট দিতে গেছে তাদের লাইনের পাশে কানে কানে বিধু বলল , ভোটটা যাকেই দাও- রেজাল্ট বেরোবার পরে তুমি বাড়িতে নিশ্চিন্তে থাকবে তো ? সেই ভেবে, তোমার ছেলে মেয়ে বউ বাচ্চা নিয়ে থাকবে ! শুনে অনেকেই লাইন ছেড়ে ঘরমুখী ।
অবস্থা বুঝে কর্তব্যরত পুলিশ এসে বলল, অ্যায় ভাই যাও না । নিজের ভোট নিজেকে দিতে দাও । বিধু পুলিশকে কাছে ডেকে বলল , বেতনটা আমাদের সরকার দেয় । কারোর বাবা দেয় না । বেশি কথা না বলে নিজের চরকায় তেল দিন । বাড়তি কিছু দেখলে ধুতি এনে হাতে ধরিয়ে কফিনে সেঁটে পাঠিয়ে দেব । আমাদের সব প্রস্তুত আছে।
শশাঙ্কের ভাই একটু দূরে থাকে । তার বউ মুখরা চালাক । সকাল সকাল ভোট দিয়ে বাড়ি ফিরে খাসি মাংস রান্না করবে। অনেক দিনের ইচ্ছে ওই দিন মাংস রান্না করে খাওয়াবে । লব নিরীক্ষণ করে দেখল পারমিতার খুব খুশি খুশি ভাব । কাছে গিয়ে বলল ; এখানে থাকো না তো ? এলাকার উন্নয়ন জানা আছে তো ? সব খোঁজ নিয়ে ভোটটা যেন ঠিক জায়গায় পড়ে ।
----- যান তো । আমার যেখানে খুশি ভোট দেবো । সে যেন ঝাঁঝিয়ে উঠল । কারণ লবের সঙ্গে আরও তিন চারজন বিরোধী মনোভাবাপন্ন ভোটারদের দাঁড়াতে দিচ্ছে না । বলছে -- কেস খাইয়ে দেবো।
----- যা করবে সে তো জানি । তোমরা শান্তিভাবে লাইনে দাঁড়াতে দেবে ? না অফিসার ডাকবো ?
----- অ্যায় খেয়াল আছে তো? তোমার বউকে চাকরিটা দিয়েছি ? স্কুলের মিড ডে মিলে রান্নার কাজটা ? .
-------. দিয়েছ বলে কি মাথা কিনে নিয়েছ ?
----- মাথা ? শোন মাথাটা এখানে নামিয়ে দেবো ; দেখবি ? তুই বের হ' একবার দেখাচ্ছি ।
পারমিতার পাশে গিয়ে বলল , কি ---ভাবলে কিছু ?
------ যারা ভালো কাজ করে তাদের ভোট চাইতে হয় না । তোমরা ভালো কাজ করলে ভোট চাইতে হচ্ছে কেন ?
------- ঠিক আছে ! যেন কোনওভাবে ফাঁসানোর কথা মাথায় খেলছে । কিংকরকে কাছে ডেকে বলল , শোন ক্যাম্পে মুড়ি বস্তার পাশে সাদা ব্যাগে নাড়ু আছে এর বাড়িতে দিয়ে আয়।
সেইমতো কিঙ্কর বাইকে উঠে ব্যাগ নিয়ে পারমিতার বাড়িতে ফুলের টবের পাশে রেখে দিয়ে এসে লবকে বলতেই --- সে ফোন করল সেক্টর অফিসে । গাড়ি ভর্তি পুলিশ এসে পারমিতাকে তুলে নিয়ে গেল বাড়িতে । পুলিশ ফুলের টবের পাশে থাকা ব্যাগ খুঁজে হাতে হাতে পেয়ে পারমিতাকে গ্রেফতার করল । বিধু অজয়কে হাতে ব্ল্যাক টেপ ধরিয়ে দিয়ে বলল, তিন নম্বর বোতামের উপর এটা সেঁটে দিয়ে আসবি । যাতে প্রধান প্রতিপক্ষের সিম্বলে আর কেউ বোতাম টিপতে না পারে । অজয় তাই করে বাইরে এসে বলল বিধুকে । অজয়কে বলে দিল , বেনুকে বলিস দুটো সাড়ে সাতশ' দেবে । আর হ্যাঁ - আমাদের কর্মীদের খাওয়া মল্লিক বাবুদের বাড়ির উঠানে হচ্ছে । খেয়ে যাস কিন্তু । পাটনাই খাসি মাংস ভাত ! ওদিকে শোরগোল পড়ে গেছে । সবাই বিস্মিত! পারমিতাসহ তার স্বামীকে পুলিশ নিয়ে গেল । বুথের মধ্যে খবরটা হাওয়া পৌঁছানোর আগে ভোটারের কানে কানে পৌঁছে গেল । সাংবাদিকরা এসে হাজির । তারাও প্রতিটা চ্যানেলে প্রচার করতে লাগল। শাসক দলের প্রার্থী উচ্চ পদস্থ নেতৃবর্গ কর্মীদের উৎসাহ দিতে এসে গেল । বিরোধী শিবিরের একাধিক প্রার্থী বিষয়টা অনুধাবন করে এলাকায় আসলেও তাদের ব্যারিকেড করে কাউকে ঢুকতে দিল না । ভোট বাক্সে ভয় দেখিয়ে সবার ভোট আদায় করে নিচ্ছে ।
----- আচ্ছা সুরেশবাবুর মা তো ভোটটা দিল না । বিধু বলে কর্মীদের টোটো নিয়ে যেতে বলল। একটু পরে সঙ্গে তার নাতনি বয়স্কা বৃদ্ধা মা আসতেই বিধু অফিসারের কাছে নিয়ে গেল । পোলিং স্টাফেরা ভয়ে সিঁটিয়ে আছে । বোমার খবর পেয়ে কোনওরকম সময় অতিক্রম করলেই বউ- বাচ্চা -মা-বাবা -স্বজনের সঙ্গে দেখা মিলবে । তারাও জীবন বাজি রেখে এই প্রহসনে সামিল । বিধুর আচরণ কথাবার্তা অনুভব করে তারাও এলাকার দাদা মনে করেছে । দাদাগিরি তো কেবল শাসকের হয় । ফলে বিধু বুড়ীর হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেল। প্রিজাইডিং অফিসার বলল , আপনার কে ?
----- স্যার আমি ওনার নাতজামাই । মানে - হবো ; তবে হবু নাতজামাই ।
ঋতুর মনের মধ্যে আগুন জ্বলছে । রাগান্বিত হলেও সংযত । গায়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল ।
----- উনি কে ? উনি কি দেখতে পাবেন ? অফিসার বলল ।
----- না -না-না ঠাম্মা আমি ভোটটা দিয়ে দিই । আমিতো আপনার নাত জামাই । বিধু গো -চিনতে পারছেন না ? আসুন আমার সঙ্গে আসুন । আপনার ভোটটা আমি দিয়ে দিচ্ছি। ঠিকমতো বোতাম টিপতে পারবেন না ।
সেকেন্ড পোলিং অফিসার হাসতে হাসতে বলল , সত্যিই আপনার চয়েস আছে বিধুবাবু ।
----- চয়েজ থাকবে । থাকবে না ? ঋতু এখন কলেজে পড়ে বলে ইয়েটা হচ্ছে না । ততদিনে কলকাতার বাড়িটা এসি বসিয়ে নিই । আমার চাকরিটাও একটু কম নম্বরের জন্য হচ্ছে না ; ভোটটা জিতিয়ে দিলে উচ্চ নেতৃত্ব চাকরিটা পাকা করিয়ে দেবেন বলেছেন।
বিধু ঋতুর ঠাকুরমার ভোট দিয়ে বেরিয়ে আসল। তিনদিন পরে বিধুর দলবল বিজয় মিছিলে আবীর মেখে ডিজে বাজনা বাজিয়ে যাচ্ছে সঙ্গে আরো কত লোক ! যে ভোট দেয়নি সেও যাচ্ছে শুধু আতঙ্ক আত্মরক্ষার জন্য । উল্লাসে আনন্দে গ্রামগঞ্জে কেউ কিছু কথা বলছে না । =================
সুদামকৃষ্ণ মন্ডল
গ্রাম: পুরন্দর পুর (অক্ষয় নগর)
পোস্ট : অক্ষয় নগর
থানা : কাকদ্বীপ
জেলা : দঃ চব্বিশ পরগণা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন