গোধূলি বেলায়
সুচন্দ্রা বসু
বিকেলের পরন্ত রোদ গায়ে মেখে বয়ে চলেছে গঙ্গা নদী। জলরাশিতে প্রতিফলিত মধুমিতার প্রতিচ্ছবি যেন রঙিন স্মৃতি কথা। মধুমিতার চোখে ফুটে ওঠে ফেলে আসা দিনগুলি।
যৌবন হারিয়ে আজ সে জীবনের প্রান্তসীমায়। সুখের সময় ছেড়ে এক ঝোড় হাওয়ায় একদিন সে নিজেই হারিয়ে যায় অজানার ভীড়ে।
সুন্দর মুখের মিষ্টি মধুর গানে জনগণ মুগ্ধ। জীবনে গানই ছিল তার একমাত্র খড়কুটো। গানের মাধ্যমেই আলাপ অভিরূপের সাথে। সে অসাধারণ তবলা বাজায়। একদিন এই গঙ্গার পাড়েই তার প্রথম উষ্ণতার ছোঁয়া পায় মধুমিতা। অভিরূপের হাতের মুঠোয় মধুমিতার হাত।
রবীন্দ্রভারতীর বাৎসরিক অনুষ্ঠানে প্রোগ্রাম করে আরও তার নাম ছড়িয়ে পরে। এদিক ওদিক নানা জায়গা থেকে প্রোগ্রামের ডাক এলে দুজনেই বেড়িয়ে যেত।
প্রোগ্রাম শেষ করে ফিরে আসত নিজের বাড়িতে। একবার তারা দুজনেই বম্বে ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রি থেকে প্রোগ্রামের ডাক পায়। দুজনেই
চলে যায় সেখানে। যাওয়ার আগেই বিয়ের দিন
ক্ষণ সবই ঠিক করে রাখে দুইজনে।
সেই মতো তাদের ফেরার টিকিট কাটা হয়।
বিয়ের পর অষ্টমঙ্গলার দিন মুম্বাই থেকে আবার মধুমিতার ডাক আসে বসন্ত উৎসব প্রোগ্রামের
জন্য। এদিকে হানিমুনের টিকিট কাটা হয়ে গেছে দার্জিলিং। অষ্টমঙ্গলার দিন রাতে ট্র্বেন।
দুজনে রওনা দিল দার্জিলিং, লামাহাট্টা, তিনচুলের পথে।
তিনচুলে হল দার্জিলিং জেলায় অবস্থিত একটি মনোমুগ্ধকর পাহাড়ি গ্রাম। তিনচুলে যাওয়ার পথেই Lover's meet point। দুপুরের খাওয়ার পরে, স্থানীয় গ্রামের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সুর খুঁজতে লাগলো পাখির কিচিরমিচির শব্দে। প্রাচীন পাইন গাছগুলো সেখানকার পরিবেশের শোভা বাড়িয়ে চলেছে।
এরপর তারা হোমস্টে ফিরে যাবে। তার আগে
ভোরবেলা গুম্বাদারায় সূর্যোদয় দেখবে। সেখানেই জলযোগ সেরে, আকর্ষণীয় Peshok Tea Garden, Lamahatta Park, Runglee Rungliot Tea Estate, Takda Heritage Bridge, and Takdah Orchid Center দেখতে বিকেল হয়ে যায়।
বিকেলে, মাউন্ট কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য এবং শান্ত চা বাগানের নির্জনতা ওদের অপূর্ব লেগেছিল।
এরপর Lepchajagat View Point, Ghum Monastery, Batasia Loop হয়ে রংবুলে। মনোরম চা বাগানের মাঝে রিসোর্টের মোহনীয় সৌন্দর্যে ওরা বিমোহিত। এই সুন্দর পরিবেশের অবিস্মরণীয় স্মৃতি নিয়ে ফিরে আসে দুজনেই নিজের ঠিকানায়।
এসব স্মৃতি মন বাগিচায় রেখে গানের ভুবনে হারিয়ে গেল মধুমিতা। মুম্বাই গিয়ে বসন্ত উৎসব অনুষ্ঠান শেষ করে একের পর এক আরও অনুষ্ঠান করে তার নাম ছড়িয়ে পরে । বসন্ত উৎসবে এক বিদেশি মিউজিক ডিরেক্টরের সঙ্গে আলাপ।
সেই বিদেশীে মিউজিক ডিরেক্টারের নাম তার রিচার্ড ডিউক। ইউরোপ যাওয়ার জন্য তিনি মধুমিতাকে আমন্ত্রণ জানায়। প্রথমে সে রিচার্ডকে এড়িয়ে যায়। কিন্তু রিচার্ড এতো সুন্দর কথা বলেন যে কেউ তার কথার জালে জড়িয়ে যায়। মধুমিতাও তার কথায় আকৃষ্ট হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় তার সঙ্গে ইউরোপ পাড়ি দেবে। রিচার্ড ডউকের সেখানে জানাশোনা থাকায়, কিছু দিনের মধ্যেই মধুমিতার ভিসা পাশপোর্ট পেতে কোন অসুবিধা হয়নি। রিচার্ডের তো ভিসা পাশপোর্ট ছিলই। মধুমিতার ভিসা পাসপোর্ট তৈরী হলে তারা ইউরোপের উদ্দেশে বিমানে চড়ে বসে। সুইজারল্যান্ডে এসে ওঠে রিচার্ডের বিলাস বহুল ভাড়া করা ফ্ল্যাটে। তারপর সেখান,থেকে তারা বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক অনুষ্ঠান করে। মধুমিতার আরও নাম ছড়িয়ে পরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।
সুখের আবেশে, আভিজাত্যের মোহে পড়ে, ধীরে ধীরে তার মন থেকে অভিরূপ মুছে যেতে থাকে। তার হৃদয় জুড়ে জায়গা করে নেয় রিচার্ড। তারা একসঙ্গে দম্পতির মতো জীবন যাপন করতে থাকে।
এদিকে মধুমিতার কোন খবর না পেয়ে অভিরূপ পাগলের মতো তাকে খুঁজতে থাকে। বোম্বের অলি-গলি চষে ফেলে। কোথায়ও তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। কেউ মধুমিতার কোন খবর দিতে পারে না।
রিচার্ড আর মধুমিতার আনন্দে দিন কাটতে থাকে ফ্রান্স প্যারিসসহ ইউরোপের নানা জায়গায় অনুষ্ঠান করে। সুখের আবেশে তাদের জীবন কাটতে থাকে। নির্দ্দিষ্ট সময় সীমা পার হয়ে গেলে আবার নতুন করে সময় সীমা লিখিতভাবে বাড়িয়ে নিয়ে রিচার্ড মধুমিতাকে কায়দা করে আটকে রাখে। একদিন মধুমিতাকে
নিয়ে সুইজারল্যান্ডের হোটেলে পার্টি দেয়। ওইদিন মধুমিতাকে জোর করে মদ খাইয়ে বেহুশ করে রিচার্ড সুইজারল্যান্ডের ফ্ল্যাট ছেড়ে বেপাত্তা হয়ে যায়।
হোটেলের মালিক সেখানকার প্রবাসী বাঙালী।
অনুষ্ঠান শেষে রিচার্ডের খোঁজ করে তাকে না পেয়ে , নিজের গাড়িতে করে মাঝরাতে রিচার্ডের ফ্ল্যাটে মধুমিতাকে পৌঁছাতে যায়। সেখানে গিয়ে
শোনে সেই ফ্ল্যাট রিচার্ড ছেড়ে দিয়েছে।
বাঙালী বাবু তখন মধুমিতাকে নিজের ফ্ল্যাটে
নিয়ে আসতে বাধ্য হয়।দিন দশ সেখানে থেকে
রিচার্ডের খোঁজ না পেয়ে মধুমিতা দেশে ফিরে আসে।
মধুমিতার মন বলছিল রিচার্ডের আমন্ত্রণে বিদেশে গিয়ে তার সব স্বপ্ন শেষ। সেখানেই মরীচিকার অলীক আহ্বানের ডাকে প্রলোভনের স্রোতে ভাসতে ভাসতে নিঃশেষিত হয় তার যৌবন। বুঝতে পারেনি আচমকা নিভে যাবে তার মরীচিকার আলো। এবার সে বুঝতে পারল যৌবনের উন্মাদনা তাকে কোথায় এনে ফেলেছে। এই বিশাল পৃথিবীতে সে হয়ে
গেল একদম একা।
সে জানতেও পারেনি অভিরূপ তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল। মুম্বাইয়ে এসে অভিরূপ ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রিতে খোঁজ করে ব্যর্থ হয় ।কোথাও খুঁজে না পেয়ে তাকে একরাশ দুঃখ ব্যাথা নিয়ে ফিরে গিয়েছিল নিজের বাড়িতে। এরপর থেকে প্রতিদিন গোধূলিবেলায় গঙ্গার পাড়ে বসে নির্জনে একা সময় কাটায়।
দেখতে দেখতে ত্রিশ বছর পেরিয়ে যায়, যৌবনের জৌলুশ হারায় । বিদেশি মিউজিক ডিরেক্টর কাজ গুছিয়ে তাকে ফেলে পালিয়ে যাবে ভাবতে পারেনি।
এবার সে শুনতে পেল গঙ্গার ছলাৎছলাৎ শব্দ। সেই শব্দের তরঙ্গে কাঁদতে থাকে মধুমিতা।
তার চোখ থেকে নিঃশব্দে ঝরতে থাকে জলের ধারা। মনে মনে সে শুধুই অতীতের কথা ভাবতে থাকে। আজ সে সব কিছু হারিয়ে এই জীবন জোয়ারে কোথায় গিয়ে মিলবে কোন মোহনায় , এর উত্তর খুঁজতে খুঁজতে ফিরে আসে গঙ্গার পাড়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়। বসে বসে গাইতে থাকে
এই সেই কৃষ্ণচূড়া যার তলে দাঁড়িয়ে,
চোখে চোখ, হাতে হাত, কথা যেত হারিয়ে;
আজ এখানে, আমার আশার সমাধি,
আশা নেই, ভালোবাসা নেই।
অভিরূপ প্রতিদিনের মতো সেদিন গঙ্গার পাড়ে
এসে গানটি শুনে চমকে ওঠে। গানের সুর যেদিক থেকে ভেসে আসছিল অভিরূপ সেদিকেই পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়। কাছে আসতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে স্বরটি। চিনতে তার ভুল হয়নি এতোটুকু।
তাই পিছন দিক দিয়ে নিজের হাতদুটো
মধুমিতার কাঁধে রেখে পুরুষালি কণ্ঠে বলল,
জীবনে তুমি , কি পেলে আর হারালেই বা কি ?
জীবন তোমার শেষ হয়ে গেছে কিছু আর বাকি
নেই কি করেই তা বুঝলে?
কথাটা শুনেই মধুমিতা কাঁধের উপর থেকে হাতদুটো সরিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই অবাক হয়ে যায়। একজোড়া হাত শক্ত করে চেপে ধরলো মধুমিতার হাত দুটিকে । মধুমিতার চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে অভিরূপ অশ্রুস্নাত চোখে বলে ওঠে,কোথায় ছিলে? একবারও মনে পড়ল না আমাকে? তোমার জন্য ত্রিশ বছর ধরে রোজ অপেক্ষা করেছি এখানে। মুম্বাই ছুটে গিয়েছিলাম তোমাকে ফিরিয়ে আনতে।
মধুমিতা তখন উঠে দুহাতে অভিরূপকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে । অভিরূপও তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে অঝোর ধারায়। গোধূলিবেলায় আবার মিলে যায় দুটি মন দুটি হৃদয়। এই নির্জন গঙ্গানদীর পাড়ে। ভাবনায় যেখানে জীবন শেষ হয়ে যায় , আবার সেখান থেকেই নতুন জীবনের শুরু।
===============
সুচন্দ্রা বসু
২৬৭/৫ জি.টি.রোড
পানপাড় শ্রীরামপুর হুগলি
পিন ৭১২২০৩
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন