Featured Post

নবপ্রভাত পত্রিকার ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে গ্রন্থ-প্রকাশ : ১। সম্পূর্ণ পত্রিকার খরচে ও ২। পত্রিকার অনুদানে

ছবি
  নবপ্রভাত পত্রিকার ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে  গ্রন্থ-প্রকাশ বিষয়ক বিজ্ঞপ্তি ১। সম্পূর্ণ পত্রিকার খরচে এক ফর্মার ১০টি পুস্তিকা : এই প্রকল্পে লেখক-কবিদের থেকে কোনো খরচ নেওয়া হবে না।        পত্রিকার ৩০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে বইগুলি প্রকাশিত হবে। লেখক/কবিকে সশ্রদ্ধায় সৌজন্য সংখ্যা দেওয়া হবে।       যাঁদের আগে কোন বই হয়নি , তাঁরা অগ্রাধিকার পাবেন। নতুনদের উপযুক্ত লেখা না পেলে বাকিদের লেখা নিয়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরিত হবে।       লেখা সকলেই পাঠাতে পারেন। মেলবডিতে টাইপ করে বা word ফাইলে ।   ই-মেল : nabapravat30@gmail.com  (এবং হোয়াটসঅ্যাপেও)। বইয়ের শিরোনামসহ ১৫টি কবিতা বা ১৫টি অণুগল্প পাঠাতে হবে , শব্দ সংখ্যা বা লাইন সংখ্যার বাঁধন নেই । মনোনীত হলে মানানসই বইয়ের ফরম্যাটে যে কটি যাবে রাখা হবে ।       সঙ্গে লেখক পরিচিতি , ঠিকানা , যোগাযোগের ( কল ও হোয়াটসঅ্যাপ )   নম্বর ও এক কপি ছবি দেবেন। লেখক পরিচিতিতে অবশ্যই জানাবেন, এটি আপনার প্রথম প্রকাশিত বই হবে অথবা পূর্ব প্রকাশিত গ্রন্থতালিকা। অনলাইন বা মুদ্রিত পত্রিকা বা সমাজ - মাধ্যমে প্রকাশিত লেখাও পাঠানো যাবে । তবে কোনও গ্রন্থভুক্ত লেখা

গল্প ।। অপরাধ ।। স্তুতি সরকার

অপরাধ

স্তুতি সরকার



চিন্তিত মুখে অনিল কাছে টেনে নিল বিপাশাকে । চুমায় চুমায় ভরিয়ে দিল ওর নরম ওষ্ঠকে। স্বামীর বুকের ওপর মুখ গুঁজে তখনও কেঁদে চলেছে বিপাশা। ওর মাথার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে অনিল তখন বলে চলেছে, 'যে আসছে সে যেই হোক আমাদের কাছে সমান। আজ তোমাকে যারা বলছে বংশধর ছেলে চাই , কাল মেয়ে জন্মালে তারাই ওকে কোলে তুলে নেবে দেখো'। মনে মনে অনিল কিন্তু জানতো ছেলে না হলে ঘরে যে কতো অশান্তির ঝড় বইবে!
 

    আর তিন সপ্তাহ পরেই ঘটল সেই অঘটন। মেযের জন্ম দিল বিপাশা। সুন্দর ফুটফুটে নরম তুলতুলে যেন মোমের পুতুলটা। এক মাথা পশমের মতো কালো কোঁকড়ানো চুল। যেন মায়ের প্রতিচ্ছবি। কাপড়ে জড়িয়ে রাখা ছোট্ট পুতুল। ওমা! - এ কি? আবার ? এবার যে বিপাশার কোল জুড়ে আসলো-, সেটাও মেয়ে ? জমজ সন্তান ! পরেরটা কালো হত কুৎসিত । এ কি বৈপরীত্য দুজনের চেহারায়। সেদিন ছোটো মেয়েটার রূপ ধরে অনিল যেন বিপাশার বুকে মুখ লুকোতে চেয়েছিল।
 

    হাতের কাজ সব পড়ে রইল। আজ বিপাশাকে যেন কিসে ভর করেছে। বসে আছে তো আছেই , কেঁদে চলেছে তো কেঁদেই চলেছে। মৌ, মৌপ্রিয়া মায়ের একান্ত প্রিয় সেই কুশ্রী কালো মেয়েটা ঘরে ঢুকলো। মাকে দেয়ালে লাগানো ঘরের সেই বিরাট আয়নাটার ধারের চেয়ারে চুপ করে বসে থাকতে দেখেই সে বুঝে গেল মায়ের আজ মনটা আবার উতলা হয়ে আছে। 'মামনি, তুমি আজ আবার- একি তুমি কাঁদছো? কেন মামণি? আমরা তোমাকে বলেছিনা যে কাঁদতে তুমি একদম পারবে না? যে অসীম সাহসী মানুষ এতটা কঠিন পথ অতিক্রম করে এসে আজ মসৃন পথে পৌঁছে কেঁদে ফেলে , সে তো আমার মা নয় ? কি হয়েছে বলো মামনি'? আর বসে থাকা চলেনা । চোখ দুটো আঁচল দিয়ে মুছে আবার মৌপ্রিয়া কে জড়িয়ে ধরে হাপুস নয়নে কেঁদে ফেলে বিপাশা। অতি যত্নে 25 বছরের যুবতী কন্যাটি মায়ের মাথা নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরে নিজেও ছল ছল চোখে দাঁড়িয়ে থাকে। বহু বার শোনা কথা, বহু বার শুনে শুনে জানা হয়ে গেছে । মৌপ্রিয়া সব কিছু জানে মায়ের অতীত সম্বন্ধে।
 

    তখন ওরা দুবোন ছোট । মামণি যখন একা থাকে, ওদের দুজনকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে শুধু কেঁদে চলে অনবরত । সেটা আজ মনে পড়ে গেল । এর বেশি তারা কিছু বুঝতো না তখন।
কোমল কোমল হাতে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো মৌ। বহু বছর পর মেয়ের হাত ধরে অনিল যেন তার মাথার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। অনিলের হুবহু মুখের ছবি এই মেয়েটার মুখের মধ্যে । অনিলের দৃঢ়তা, অনিলের চিন্তাধারা অনুরূপ ভাবে মেয়েদের মধ্যে কোথা থেকে এসেছে । ধীরে ধীরে বিপাশা মৌ কে ছেড়ে , চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল । দিতি কি করছে ? দিতিপ্রিয়া কোথায় ? বিপাশার মনে পড়লো আরেক মেয়ের কথা । মায়ের দেওয়া আদরের 'মৌপ্রিয়া' আর 'দিতিপ্রিয়া' এই নাম দুটি মায়ের মনে শান্তির প্রলেপ এনে দেয়।
 

    বাড়িতে আজ পুজো পাঠ চলছে। প্রতি বছর এই বিশেষ দিনটিতে আজকাল পুজো হয়।তবে ছোট করে। আজ দুই মেয়ের 25 এর জন্মদিন আর স্বামীর মৃত্যু দিন ।সন্ধ্যেবেলা কিছু সিলেক্টেড নিমন্ত্রিত বন্ধু-বান্ধব আসবে বিপাশার দুই মেয়ের। সারাদিন ধরে আশ্রম কন্যারা খুব পরিশ্রম করেই পূজার জোগাড় করেছে, ফল কেটেছে, রান্নার জন্য তরিতরকারি কেটেছে , অতিথি অভ্যাগতদের আপ্যায়ন করেছে। চা করা থেকে কত কাজ। সকলে সুচারু ভাবে সম্পন্ন করেছে।
 

    শুরুটা কিন্তু এমন ছিলনা । দুই জমজ কন্যা সন্তানের মা , সন্তানদের জন্মের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাক্সিডেন্টে স্বামী মারা গেছেন । তখনো কেমন যেন ঘোরের মধ্যে রয়েছে বিপাশা ।শুধু জানতে পেরেছে তার দুই কন্যা সন্তান হয়েছে । কিন্তু বিশ্বাস আছে তার অনিল এর উপর । অনিল তাকে কথা দিয়েছে যে সব কিছু সামলে নেবে , যদি কোনো অঘটন হয়। অঘটন ? হ্যাঁ! অঘটনই তো। মেয়ে জন্মানোর অঘটন। মনটা তার চঞ্চল হয়ে উঠেছে ক্রমশ । এখনো আসছে না কেন অনিল? বাড়ির কেউ কেন তার বা বাচ্চাদের কোন খোঁজ খবর নিতে আসছে না ? মেয়ে হলেও ওরা কি অনিলকে ওর কাছে আসা বন্ধ করে দিয়েছে ? মাথাটা যেন ঘুরে যাচ্ছে। হসপিটালের নার্স বা আয়ারাও যেন তাকে দেখে যায় আর এভোয়েট করে সরে সরে যায় । ডাক্তার এবার তাকে ছুটি দিয়ে দিল। দুই মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে আজ বিপাশা। অভিমানে তার মনের মধ্যে ফুলে ফুলে কান্না আসছে । দলা পাকিয়ে যাচ্ছে মনের মধ্যে। অনিল আজও এলোনা।
 

    যথাসময়ে মমতাদি (বাড়ীর পুরনো কাজের লোক ) এসে উপস্থিত । বিপাশা সব গুছিয়ে বসে ছিল।বাচ্চাদের পরিষ্কার করে দিয়েছে হসপিটাল থেকে ।বাড়ি যাবে বিপাশা। অনেকদিন সিঁদুর পরেনি সে। বোধহয় ষষ্ঠী পুজো পর্যন্ত সিঁদুর পরতে নেই । ঠিক জানে না বিপাশা। বিপাশা বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল , 'মমতাদি আর কেউ আসলো না বাড়ি থেকে ? মেয়েদের বাবাও তো মেয়েদের মুখ দেখেনি এখনো পর্যন্ত মমতাদি, কেন '? এই মমতাদি শ্বশুর বাড়ির মধ্যে কাজের পুরনো লোক বলে সকলের মুখের উপর কথা বলতে পারে। বিপাশাকে সান্ত্বনা দিয়েছে অনেক সময় । মমতাদি বলল , 'বাড়ি চলো, বলছি'। হসপিটাল থেকে একটা আয়া ও ঠিক করা হয়েছে বাচ্চাদের দেখা শোনার জন্য। দু'জনতো, তাই। ছোট দেওর ও বসেছিল বাইরে। হাসপাতালের বিল মিটিয়ে । মমতাদিদের আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালো ছোট দেওর। বিপাশার বেশ প্রিয় দেওর ও। কিন্তু ওকেও কেমন যেন বিষন্ন মনে হল বিপাশার। তখনই ও বলে ফেলল , 'ছোট ঠাকুরপো , বাড়িতে কি কিছু হয়েছে ? তোমার দাদা ঠিক আছেন তো ? কেন একদিনও হসপিটালে আসলেন না?'ভাড়ার গাড়িতে উঠে বিপাশা বলল আমাদের গাড়ি কি হলো ছোট ঠাকুরপো ? তোমার দাদা কি হঠাৎ কোনো কারণে বাইরে চলে গেছেন অফিসের কাজে? মমতাদি মুখ ঝামটা দিয়ে উঠে বলল ,' আর বকবক করো না , উঠে পড়ো গাড়িতে '। যত বাড়ির কাছে আসে , বিপাশার মনে এক অদ্ভুত ভয় চেপে ধরে । কারণ তো কিছুই নেই । তবুও। কেউ কোন কথা বললে না সারাটা রাস্তায়। মমতাদির কোলে একটা শিশু , আয়া মাসির কোলে আর একটা । তারা পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে । বাড়ি যাবার প্রহর গুনছে।
 

    শ্বশুর-শাশুড়ি, খুড় শ্বশুর- খুড় শাশুড়ি এই দুই ভাইয়ের জয়েন্ট ফ্যামিলি। এমনিতে বেশ মিলমিশ আছে । রান্নাঘর এখনো পর্যন্ত পৃথক হয়নি । তবে বাড়িটা ঠিক মাঝখান থেকে ভাগ হয়ে গেছে । বাঁ দিকটা তার শ্বশুর এর অংশ আর ডান দিকটা খুড় শ্বশুরের । তবে তাদের কোনো ছেলে পুলে নেই বলে , এরা আশায় আছে পুরো বাড়িটা তারাই পাবে এক দিন , যদি না খুড় শশুর তার অংশটা অন্য কাউকে দিয়ে দেন বা বিক্রি করে দেন।
 

    বিপাশার কাছে সব কিছুই খোলসা হয়ে গিয়েছিল সেদিন বাড়ি ফেরার অনতি পরেই । লাঞ্ছনা গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছিল। ডাইনিদের ঝাঁটার বাড়ি মেরে বিদায়ের কথাও ঘোষণা করে ছিলেন বাড়ির গুরুজনরা , সেদিন।
 

    ছুটে আসছিল অনিল হসপিটালের খবর পেয়ে । মনটা অবশ্যই অন্যমনস্ক। এক দিকে বিপাশা , আর অন্য দিকে বাড়ি সামাল দিতে হবে । অনিল শিক্ষিত ছেলে। ও জানে এতে বিপাশার কোনো হাত নেই। ছেলেদের কারণে ছেলে বা মেয়ে জন্ম হয় । মেয়েদের এতে কোন হাত থাকে না । কিন্তু সমাজ-সংসার ছেলেটিকে দোষ না দিয়ে, শুধুমাত্র মেয়েদেরই দুষে চলে। তাদের পৌরাণিক বাড়ির মনোভাব , শুধুমাত্র প্রথম সন্তান যেন ছেলে হয় । বংশ রক্ষা হবে । গুরুজনেরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেখে যেতে পারবেন । চিন্তায় ছেদ পড়ে গেল । অনিলের তখন আর কিছু করার ছিলনা।, হসপিটাল প্রায় পৌঁছে গিয়েছিল । উল্টোদিক থেকে ছুটে আসে দৈত্যাকৃতি ট্রেলার গাড়ী। অনিলের গাড়িকে লক্ষ্য করেই যেন ছুটে এসে একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়ে ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা মেরে উল্টো দিকের ফুটপাতের ওপর উঠে, আরো কয়েকজন পথচারীকে গুঁড়িয়ে পিষে দিয়ে তখন থেমেছে। বিরাট বড় অ্যাক্সিডেন্ট । কিন্তু জনতা তৎপরতার সঙ্গে অনিলকে আর অন্যান্য পথ চারীদের সামনের হসপিটালে নিয়ে যেতে সময় নষ্ট করেনি। ডাক্তারবাবু তৎক্ষণাৎ অ্যাটেন্ড করলেন। অনিল ডাক্তার বাবুকে দেখে শুধুমাত্র বলার চেষ্টা করলো কিছু কথা , অস্পষ্ট - অতি -অতি অস্পষ্ট - ডাক্তার কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ । বিপাশার জীবনেও চরম বিপর্যয় নেমে আসে সেই দিনই । অনিল ছাড়া এই কুসংস্কার যুক্ত বাড়িতে, শাশুড়ি শ্বশুর এর গঞ্জনা শুনে বাঁচা দুর্বিষহ হয়ে উঠল তার জীবনে। প্রতিমুহূর্তে ডাইনি, ছেলেকে খেতে এসেছে। মেয়ে দুটো বাবাকে খেতে পৃথিবীতে আসলো । এমন সব বাক্যবাণে অতিষ্ঠ হয়ে সত্যিই কোথাও চলে যেতে মন চায় বিপাশার। কিন্তু মেয়েদের জীবনে তো হাত-পা বাঁধা।
 

    বাপের বাড়িতে বিপাশা একমাত্র মেয়ে । বাবা-মা গত হয়েছেন । মধুপুরে তাদের বাড়ি ছিল । সেই বাড়ি বিক্রি করে বাপের বাড়ির পাঠ চুকিয়েছে। এম এ পাস সে। সেলাই, আঁকা , ঘরের কাজ , গান, সবেতেই সে নিপুনা। কাগজের সম্বন্ধ দেখে তার বিয়ে ।অসামান্যা সুন্দরী সে। কিন্তু এমন কালো কুশ্রী বর, সেটাও কোন ম্যাটার করেনা তার কাছে । মানুষটা খুব ভালো । কদিনই বা তার বিবাহিত জীবন । খুব সুখের যে কেটেছে সে কদিন তা বলতে পারবে না বিপাশা । বিয়ের আড়াই বছরের মাথায় কনসিভ করল । তার আগে পর্যন্ত বাচ্চা হচ্ছে না বলে খোঁটা। তারপরে শুনতে হলো বাচ্চা যদি মেয়ে হয় , ঘরে স্থান হবে না । বিপাশা একার ঘরের একা মেয়ে, শিক্ষিতা, কিন্তু এত বড় ফ্যামিলিটার মধ্যেই বিপাশা আনন্দ খুঁজে নিতে চেয়েছিল । ওর লোকজন ভালোই লাগতো ।
 

    ক্লান্ত হয়ে চোখ বুজলো বিপাশা।মনের কোণে নানা কথার ভিড় । মধুপুরে বাপের বাড়ি বলে তেমন বন্ধু বান্ধব ছিলনা বিপাশার। মুশকিল-আসান হয়ে দেখা দিল বড় ননদ। ওর স্বামীরা দুই ভাই, দুই বোন । তার স্বামীর চেয়েও বড়, বড় ননদ একদিন হঠাৎ এসে বললো , 'বউ তুমিতো ভাল হাতের কাজ জানতে । আমাদের পাড়ার একটা সমিতি হয়েছে । তোমার মত বিধবা মেয়েদের সেখানে নানা রকম হাতের কাজ শেখানো হয় । আমাকে তাদের প্রেসিডেন্ট করেছে । নতুন তো , তাই আমারও ঘাড়ে একটু দায়িত্ব পড়েছে, ভালো ভাবে যাতে সংস্থাটা গড়ে ওঠে। তুমিতো খুব ভালো সেলাই , আঁকা , সব জানো , আমাদের একটু সাহায্য করো। মা , বাবা , কাকা , কাকিদের আমি সামলে নেব ।'
 

    সেই শুরু । মুশকিল-আসান হয়ে উঠল বিপাশা সেই সংস্থাটার। জীবনের একটা মানে খুঁজে পাচ্ছে এতক্ষণে বিপাশা । কত মেয়ে স্বামীহারা ,স্বামী পরিত্যাক্তা।ইতিমধ্যে বিপাশার দুই মেয়ে বড় হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে । শান্ত ও ধীরস্থির সহিষ্ণুতার প্রতিমূর্তি যেন মেয়েরা । সাত চড়েও রা কাড়ে না তারা। বিপাশা সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে শ্বশুর শাশুড়িদের মন জয় করতে থাকে ধীরে ধীরে। চমক ভাঙলো গুরুজনদের যখন ছোট দেওরের বিয়ে হল । দেখাশুনা করেই হলো । কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেই ছোট দেওর পৃথক সংসার করার বাসনায় আলাদা বাড়িতে চলে গেল বউকে নিয়ে । আর বাড়ীর সঙ্গে কোনো সম্পর্কই রাখলো না । মুখ ঝামটা দেওয়া ছোট ননদেরও ততদিনে বিয়ে হয়ে গেছে । শাশুড়ি শ্বশুররা ততদিনে আরোও বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ।শরীরের শক্তি চলে গেছে । কাজেই কাছের বলতে একমাত্র বৌমা আর নাতনিরাই ভরসা । দুই মেয়ে ও তাদের সংসার সামালে আর আসতে পারে না বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কাছে ।চারজনেই তখনও জীবিত । হা হুতাস করেন ছোট ছেলে আর মেয়েদের জন্য । যে বউকে উঠতে-বসতে ডাইনি অপবাদ দিয়েছিলেন তাঁরা, সেই বউ আর নাতনীদের সেবা শুশ্রুষাতেই তারা এতো দীর্ঘ জীবন লাভ করেছেন । সেবা-শুশ্রূষার কোন খামতি রাখেনি ওরা । ততদিনে মমতাদি বৃদ্ধা হয়েছে । বিপাশা মমতাদিকেও আত্মীয় জ্ঞানে সুস্থ করে বাঁচিয়ে রেখেছে । চলচ্ছক্তিহীন আজ মমতাদি । তাকেও কিন্তু কাজের লোক বলে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় নি ।
 

    একদিন দলাদলির ফলে বন্ধ হয়ে গেল ননদের সোসাইটিটা। বেশ ভালই চলছিল । বিপাশাকে ধরল সকলে। কি আর করে সে । বাড়ির গুরুজনদের বলে এই বাড়ির একতলায় একটা আশ্রম স্থাপন করলো স্বামীর নামে । সেখানে 15 জন থাকে যাদের কেউ কোথাও নেই আর সহায়-সম্বলহীনা। বাকিরা আসা-যাওয়া করে দিন গুজরান করে।
 

    একদিন একজন বয়স্কা মহিলা আসলেন গাড়ি চেপে । ধোপদুরস্ত বেশ ভূষা । বিপাশার সঙ্গে দেখা করলেন। ততদিনে বিপাশার মেয়েরা প্রায় সাবলম্বী হয়ে উঠেছে। মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । উনি বললেন ওনার নাম নিপা। নিপা মাসীমা বলে ডাকতে। যত্ন করে বিপাশা অফিস ঘরে এনে বসালেন ওনাকে। উনি যা বললেন তার সারমর্ম হল : ওনারা বিত্তশালী । স্বামী প্রচুর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী । বিরাট বাড়ী বরনগরে । ওনারা চাইছেন একটা বৃদ্ধাশ্রম করতে । সঙ্গে এরকম কিছু একটা যেটা বিপাশা করছে এতদিন ধরে । নিঃসন্তান ওনারা। টাকা পয়সা সব খরচা করে চালাবেন। লোকজন সব রাখবেন । শুধু দরকার বিপাশার মত দরদী মনের একজন মানুষকে । এত দিনে বিপাশা ও প্রায় গার্জেনহীণা। তার শশুরের বয়স ৯৮ বছর। শাশুড়ি ৮৯ পার করেছেন । ওই রকমই হবেন খুড় শ্বশুর আর খুড় শাশুড়ি। ওনারা নিজেদের ঘরেই বেশির ভাগ সময় দিন গুজরান করেন। বিপাশা বা নাতনিদের মুখের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকেন , কখন আসবে ওরা ওনাদের একটু সঙ্গ দিতে। নিপা মাসিমা কোন কথাই শুনলেন না । বিপাশাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন বরানগরের বাড়িতে , তার নতুন স্বপ্নের বৃদ্ধাশ্রমের জায়গা দেখাতে। শুরু হয়ে গেল বৃদ্ধাশ্রম। এতদিন একা ছিল বিপাশা। আজ নীপা মাসিমাকে সঙ্গে পেয়ে পরম মমতায় গড়ে তুললেন শান্তিকুঞ্জ। গরীব বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা এসে জুটল এবার।এত সুন্দর ব্যবস্থা দেখে , যেসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অবস্থাপন্ন , টাকা দিয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো অতিবাহিত করার আশায় , তারাও এখানে থাকবার জন্য দরখাস্ত করলেন । আবেদন মঞ্জুর হল। ক্রমে শান্তিকুঞ্জ কলেবরে বেড়েই চললো। আজ 25 বছরের মেয়েদের জন্মদিন, আর স্বামীর 25 বছরের মৃত্যু দিনটিকে একান্ত ভাবে নিজের মতো করে কাটাতে চেয়েছিলো সে। কিন্তু তাতো হওয়ার যো নেই। নীপা মাসিমা আছেন যে। এসে পড়েছেন বিপাশার কাছে। বিপাশার ঘরে।
 

    'ওঠো মা , চলো । তোমার জন্য যে শান্তিকুঞ্জের সকলে অপেক্ষা করছে।' সকলের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়ে নিজের দুঃখ কষ্ট নিজের মনের মধ্যে সযত্নে গোপন করে উঠে দাঁড়ালো বিপাশা। দুই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলল সে। শান্তিকুঞ্জের সকলের মনোরঞ্জনের জন্য। এখানেই তো জীবনের সার্থকতা! 


=================






মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। 'স্বাধীনতা, স্বদেশ ও স্বকাল' বিষয়ক সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩১ আগস্ট ২০২৪

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

নবপ্রভাত পত্রিকার ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে গ্রন্থ-প্রকাশ : ১। সম্পূর্ণ পত্রিকার খরচে ও ২। পত্রিকার অনুদানে

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান