Featured Post

প্রবন্ধ ।। মা সারদা - চিন্ময়ী ।। সত্যেন্দ্রনাথ পাইন

মা সারদা

মা সারদা - চিন্ময়ী

সত্যেন্দ্রনাথ পাইন

   

     প্রয়োজনের নদীটা খরস্রোতা; প্রাপ্তির দিগন্তে সর্বদা মরুভূমির হাহাকার।
      এই হাহাকারের মাঝে তৃষ্ণার্ত মানুষ খোঁজে একটুখানি শীতলপানীয়। কোথায় কখন মিলবে, কে দেবে সেই বাঁচার মঙ্গল সুধা????
  মা- ই পারে কেবল অভয় অংকে তার বুকের সুধা পানে সন্তানকে অভয়বাণী শোনাতে।
   আর আমরা সকলে তো সেই মায়ের ই অবোধ সন্তান।
 যার স্তনামৃতে আমাদের আক্ষেপ, বিক্ষেপ,কান্না, চাঞ্চল্য, বিশ্বাস -- অবিশ্বাস, সুখ- দুঃখ, আলো- আঁধার বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে না। শুধুই নির্ভয়, নিষ্কলঙ্ক সেই অঙ্ক‌ ।মা যে সর্বদা করুণাময়ী।
   এখানে কোনো শঙ্কা নেই ভয় নেই। আছে কেবল অশেষ আশ্রয়, সুস্থ্ আলোর উদ্ভাস।
    মা-- ই পারে এই যুগ যুগান্তের বন্ধন অটুট রাখতে। এই শক্তির গোলকে তিনিই তো কখনও কৃষ্ণ প্রেমিকা রাধা, কখনও লক্ষ্মী নামে বৈকুন্ঠে নারায়ন ঘরণী,, ব্রহ্ম লোকে কখনো বা সাবিত্রী, কৈলাসে হলেন শিবানী, সীতারূপে কখনও বা বনবাসী রামচন্দ্রের স্ত্রী, দ্বারকায় রুক্মিনী, কখনও  বা যশোদা, কখনো দেবকী - আর একালে যিনি শক্তিরূপিনী সারদা জননী     মা-সারদা রূপে দেখা দিলেন দক্ষিণেশ্বরে।।
  যাঁর অপরূপ রূপে প্রাণের  পরশ খাদহীন খাঁটি সোনা। ইংরেজি ১৮৫৩ সালের ২২ ডিসেম্বর, বাংলার ১২৬০ সালের ৮ পৌষ বৃহস্পতিবার সেই মা কৃষ্ণ সপ্তমীর আঁধার ভেদ করে এই ধরাধামে আবির্ভূতা হলেন জয়রামবাটীর এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে। সারদা মনি দেবীর পিতা হলেন রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মাতা শ্যামা সুন্দরী দেবী।
   মাত্র পাঁচ বৎসর বয়সে তৎকালীন বাংলার সামাজিকতায়  বোধকরি তাঁর বিবাহ হয় কামারপুকুরের ক্ষুদিরাম চাটুজ্যের তৃতীয় পুত্র তেইশ বৎসর বয়সী গদাধরের সাথে।
       গদাধর অটল। কেউ বলে পাগল- খ্যাপা। যাঁর নেই কোন ভাবের অভাব। যিনি জলের মত স্বচ্ছ, কুসুমের মতো কোমল।। যাঁর স্পর্শে স্বয়ং স্বামীজীর শরীর থেকে বিদ্যুৎ বহ্নি বয়ে ছিল। 
       যিনি পরে হলেন শ্রীশ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ। তাঁকে মা সারদা প্রশ্ন করেছিলেন, " ওগো, আমি তোমার কে?"।  
       ধ্যানগম্ভীর ভাব মুগ্ধ তপস্বী রামকৃষ্ণ বলেছেন --" " তুমি  আমার বানী, বিদ্যা, সরস্বতী । তুমি আমার জ্ঞান, প্রজ্ঞা, জ্যোতি। তুমি সারদা, তুমি অপরূপা। তুমি সুন্দরী।" কিছু ক্ষণ বিরতি থাকার পর বলেছেন -- যে মা মন্দিরে আছেন, তিনিই এই শরীরের জন্ম দিয়েছেন ও এখনও নবতে( নহবতে) আছেন"।----
এই কথা বলতে বলতে আভূমি প্রণত হয়েছিলেন রামকৃষ্ণ জননী মা সারদার চরণযুগলে। সারদা চমকে উঠলেন, বিস্মিতা হলেন। কুন্ঠিত কন্ঠে, বলেছেন -  " "ছিঃ, ও কী হচ্ছে? আমি যে তোমার দাসী!" রামকৃষ্ণ বলেছেন --" না, তুমি আমার আনন্দময়ী"।
     তারপর সেই রাতে একাকিনী মা সারদার কাছে একান্ত নিরালায় ঠাকুর রামকৃষ্ণ।
       গভীর রাত। চারিদিকে রাত্রিকালীন নিস্তব্ধেতা। কেউ জেগে নেই। কেউ দেখতে ও পাবে না। শুধু আকাশের বুকে এক ফালি চাঁদ আর মিটিমিটি তারার নির্ভীক নির্বাক দৃষ্টি। শিরশিরে হাওয়ায়   শোনা যায় গঙ্গার উচ্ছ্বাস, উদ্দাম।
   মা সারদা ঘুমে অচৈতন্য। ঠাকুর যেন অতন্দ্র প্রহরী ।
   ওরে মন, চেয়ে দ্যাখ্ , দেখছিস? যৌবনের জোয়ার, ফোয়ারা? অতসী অধরে কেমন লালসার রোমাঞ্চ মাখা।। ছিলে টানা ধনুকের মত ভ্রূযুগল ,উন্নত নাক। সমতল বক্ষের মাঝে দুধারে দুটো মঙ্গল কুম্ভ।যেন সমুদ্রের খুব গভীরে ডুব দিতে আসা কোনো যৌবনের জোয়ার আছড়ে পড়ছে। আকুলি বিকুলি করছে দুই যৌবনের জোয়ার।
      দেহের প্রতিটা পাপড়িতে  পাপড়িতে  অপরূপ স্নিগ্ধ মধুর আকর্ষণ।  এটাই তো প্রকৃষ্ট সময় ভোগ করার।
     ঠাকুর মনকে কড়া শাসনে বাঁধতে বাঁধতেও বারবার প্রত্যাঘাত খেয়ে ক্ষতবিক্ষত। বলেছেন - যা, এগিয়ে যা। কাছে যা। আরো কাছে। ঐ নিটোল স্তনবৃন্তে ফুটে ওঠ ফুলের মতো, মদনের সাথে মিতালী কর। নারীকে জড়িয়ে ধর আচ্ছা করে। দুটি দেহে, দুটি প্রাণ মিলে মিশে এক হয়ে যাক। অঙ্গে অঙ্গে মিশে ফুটে উঠুক জৈবিক প্রেমের তৃপ্তি।
       এতো বিয়ে করা নারীর শরীর। লোকে যাকে  পরম উপাদেয় ভোগ্য রূপে পেতে লালায়িত।মন রে, গ্রহণ করবি,  না কি বর্জনের আনন্দে বধির হবি?  কামনার মালা পরাবি, নাকি অসীম প্রেমের ফুল ছড়াবি? রতি পতি হবি, না মদনকে ভস্ম করে প্রেমময় নাম নিবি? 
  ঠাকুরের মনতটে এরকম হাজার প্রশ্ন আছড়ে পড়ে। থরথর করে কেঁপে কেঁপে ওঠে সারা শরীর। শুকিয়ে যায় গলা।
      চিন্তা থামিয়ে রামকৃষ্ণ ভাবছেন, " কাম ভোগ করে কি নিবৃত্তি হয় কামের?"
  "না।"
   ভোগে রতির বিস্তার আর ত্যাগে নিরবচ্ছিন্ন আনন্দ।
অনন্ত সুখ, অশেষ তৃপ্তি ‌।
 শ্রীরামকৃষ্ণ মুহূর্তে মুখ ফিরিয়ে নিশ্চুপ, নির্বাক, অনড়, নিথর, নিষ্পন্দ;! বিচ্ছুরিত হলো স্নিগ্ধ জ্যোতি।
 মা সারদা ঘুমে ভেঙে বললেন, " এখনো ঘুমাওনি তুমি? রাত কত?""
কোনো জবাব না পেয়ে ভয় পেয়ে গেলেন। বাইরে  কালীর মাকে  বললেন -- "শীগগির ভাগ্নেকে খবর দাও উনি যেন কেমন হয়ে গেছেন"। হৃদয় তৎক্ষণাৎ ছুটে এসে মামার কানে শোনালেন, মায়ের মাতৃ মন্ত্র। ধ্যান ভাঙলো ঠাকুরের। বলে উঠলেন --" না, না, জৈব প্রয়োজন নেই। আমি চাই দৈব। দৈব ই হবে আমার জীবনের ধ্রুবতারা"!  একদিন সারদা মা ভয়ে ভয়ে ঠাকুরের কাছে প্রশ্ন করলেন, তাই তো, ছেলে পুলে একটাও হবেনি, সংসার ধর্ম বজায় থাকবে কিসে?
   শ্রীরামকৃষ্ণ মুহূর্তে উত্তর দিলেন -- তুমি মা হতে চাও?
 বিশ্বচরাচরের হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ তোমার সন্তান। তুমি বিশ্বজননী জগদ্ধাত্রী। --- জয় মা, জয় মা।
     কিন্তু এই ভাব- আন্দোলনে তাঁর সহধর্মিণীর যে অসামান্য অবদান আছে ভক্তমহল তখনও বুঝতেই পারেনি। সেই জন্য অবতার পুরুষের কাছে মানুষ সত্যকে মিথ্যা, আর মিথ্যাকে সত্য বানানোর জন্যে কোনো না কোনোভাবে মিথ্যাচার করে। এবং চিনতে দেরী হয়। গীতায় ভগবান  বলেছেন -- 
 অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতাম। 
   পরং ভাবম জানন্তো মম ভূতামহেশ্বরম"। ৯/১১
 আমাদের মতো অজ্ঞান মানুষ অবতারগনকে মানব দেহ বিশিষ্ট বলে উপহাস করে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস কেও মানুষ চিনতে ভুল করেছিল-- ব্যতিক্রমী ছিলেন শুধু স্বামী বিবেকানন্দ।!
 ঠাকুরের অন্য ঐশ্বর্য ছিল না।  অসীম আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্যের অধিকারী ছিলেন। যিনি মুহুর্মুহু সমাধিস্থ হতেন--  যা দেখে লোকে বিদ্রুপ করে বলতো -- সাতবার মরে , সাতবার বাঁচে। অথচ তাঁর মুখনিসৃত মন্দাকিনী পান করে অনেক  পন্ডিত-- মূর্খ মুগ্ধ হয়ে যেতেন!   এমন গদাধরকেও মানুষ  অবতার রূপে চিনতে পারেননি। আর মা সারদা তো বাইরে লোকের সাথে কথাই বলতেন না।যাঁর মধ্যে কোনো ঐশ্বর্য ছিল না সেই মাকে লোকে চিনবে কীকরে!? তাছাড়া, মাকে লোকে না চিনতে পারার কারণ , মা নিজেই " "লজ্জাপটাবৃতা'  থাকতেন‌ দক্ষনেশ্বরের ঐ ছোট্ট ঘরটায় ‌ তাঁকে বাইরের কেউ দেখতেই পেত না।
 এমনকি দক্ষিণেশ্বরে র কালীবাড়ির খাজাঞ্জিও বলেছেন -- "তিনি আছেন শুনেছি, কিন্তু কখনো দেখতে পাইনি"।
 মনে হয় স্বয়ং ঠাকুরের  ইচ্ছা ছিলো আধ্যাত্মিক কথায় অসম্পূর্ণ সারদাকে বাইরে র সংসারের কোলাহল থেকে মুক্ত রাখা। তাই একটু একটু করে তাঁকে গড়েছেন সম্পূর্ণ লোকচক্ষুর অন্তরালে। তারপর তিনি যখন প্রকাশিত হলেন তখন মানুষ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে। । মাতৃ লীলা আস্বাদন করে পরিতৃপ্ত হলো। অবশ্য যাঁর যেমন আধার সেই ভাবে।
 এই যার যেমন আধার কথার  মধ্যেই স্বয়ং স্বামীজী শিবানন্দকে বলেছেন -- দাদা রাগ কোরোনা ‌ তোমরা এখনও মাকে চিনতে শেখোনি। অতএব আমার মতো অকৃতি অধমরা যে সীমিত বুদ্ধি দিয়ে শ্রী মায়ের অসীম মহিমা  যে অসম্পূর্ণ ভাবেই জানব এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
   মায়ের মহিমা একমাত্র যিনি সঠিক রূপে জেনেছিলেন তিনি স্বয়ং রামকৃষ্ণ আর তাই তিনি গাইলেন ---
  আমি সব সাধনার ইতি খুঁজে 
     পেলাম তোমার মাঝে 
 তোমার পায়ের ধ্বনি আমার 
      বুকের মধ্যে বাজে।
 তুমি আমার বেদ ও বিবেক স্মৃতি শ্রুতি সব
   তুমি আমার পাপ পূণ্য দুঃখ ও বৈভব।
তুমি শিব, তুমি কালী, কৃষ্ণ রাধিকা
তোমার মাঝে সদাই যেন----
        আমার ভূবন রাজে।।
তুমি আমার রস ও রসিক
       পরা -প্রেম- রতি
তুমি আমার সুর ছন্দ
        তাল মান যতি ।
 তুমি স্বর্গ, তুমি নরক, তুমি মন্ত্র গুরু
তুমি আমার শেষ ও অশেষ তুমি সাগর মরু।
তুমি শক্তি, তুমি ভক্তি মুক্তি আরাধিকা 
তোমার মাঝে আমায় দেখি নানা রূপের সাজে।।

কিংবা -- । 
   যা করার করিবে কালী
       আমি কি তার জানি
দাসখতে করেছি স ই
        ব-- কলম আনি।
তারিই দেয়া বিধি বিধান 
 সে যদি না করে প্রমাণ
 আমার ঠেকা নেইতো কিছুই 
         চিনি চরণখানি।
এবার ভাবনা আমার নয়তো 
             ভাবতে হবে তার।
দায় দায়িত্বের বোঝাবুঝি
       নেইতো আমার আর।
সুখ দুৃঃখ মান অপমান 
জানেনা তো আমার এ প্রাণ
পেলে রাঙা চরণ দুটি 
  তবেই ধন্য মানি।
 আর ঐ রাঙা চরণযুগলে ঠাকুরের ইচ্ছা হলো ১৮৭২ সালে খ ৫ জুন বাংলার ১২৭৯ ২৪ জৈষ্ঠ্য মাসের এক অমাবস্যার রাতকে  বেছে নিলেন । ছিলো যেদিন ফলহারিনী কালীপূজার রাত।
        ঘুটঘুটে অন্ধকার। নির্জনে নিশীথে আবাসিক হবেন বিশ্বজননী।--- সাড়া দিলেন ভক্তের ডাকে। যাঁর হাসিতে সারা পৃথিবী হাসে আর বিষাদে বিশ্ব হয়ে যায় আন্ধকারময়।
 হৃদয় পূজো করবেন মন্দিরে আর ঠাকুরের পূজো হবে এক রুদ্ধদ্বারের অন্তরালে।
     কে নেবে সেই পুষ্পাঞ্জলি! 
    নেবেন মা সারদা।
   বিশ্বমাতৃরূপে হবেন সংস্থিতা। শক্তি রূপিনী শক্তিধর করবেন  স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত। করলেন ষোড়শী পুজো। ফলহারিনী কালীপূজার বিধান মেনে।
       রাত তখন ৯ টা। 
 ঠাকুর পূর্বমুখে আর পশ্চিম  মুখে বসালেন মা সারদাকে। ছিলনা মত্ততা, ছিল অনির্বচনীয় আনন্দের উষ্ণ প্রস্রবণ।।
     সারদা মনির চরণ যুগলে আলতা পরিয়ে, কপালে সিঁদুরের টিপ দিয়ে, নতুন বসনে ভূষিত করে সারলেন ষোড়শী পুজো। পশ্যাচার , বীরাচার  আর দিব্যা চারের মধ্যে দিয়ে ভেদ করলেন ছয় চক্রকে । মিষ্টি মুখে দিয়ে বললেন --" খাও" তারপর একটা পানের খিলি।
    জেগে উঠলো সন্তানভাব। মায়ের বুকে প্রবাহিত হলো
 মাতৃ স্নেহ। পত্নী রুপান্তরিত হলেন জননী তে। উচ্চকন্ঠে
ঠাকুর রামকৃষ্ণ পাঠ করলেন, " হে বালে, হে সর্ববশক্তি অধীশ্বরী মাতঃ, ত্রিপুরা সুন্দরী, সিদ্ধিদ্বার উন্মুক্ত করো
 শরীর থেকে মন থেকে সবকিছুই পবিত্র করে ইহাতে আবির্ভূতা হয়ে সর্ব কল্যাণ সাধন করো"!
    ধীরে ধীরে জাগ্রত হলো ঠাকুরের কুলকুন্ডলিনী শক্তি। ঠাকুর তন্ময়, মৃন্ময়, মুগ্ধ। মাতৃ দর্শন করে আনন্দ বিহ্বল। আনন্দে চরণ পদ্মে বিসর্জন দিলেন জীবনের সব কিছু। যাঁর সূক্ষ্ম সুর হলো সমর্পন।
      শিব নিজেকে  সমর্পণ করেই শক্তি রূপিনী কালীর পদতলে যেমন শব হয়েছেন আমাদের ঠাকুরও তেমনি শক্তি রূপিনী মা সারদা র কাছে আত্মসমর্পণ করে শব হতে চেয়েছেন।
      তাই আত্মভোলা অসহায় বালক ভেবে শ্রী শ্রী মায়ের মতই সেবা করতে লাগলেন মা সারদা বালক গোপালের মতো ঠাকুরের ।পৃথক অস্তিত্বের এক ই ধারা বিরাজমান যেন ।
     মহাজ্ঞানী ঠাকুরের ভাবোন্মত কন্ঠে ধ্বনিত হলো তাই, " হে সর্বমঙ্গলের মঙ্গল স্বরূপে, হে  সর্ব কর্ম নিষ্পন্ন কারিনী, হে শরণ দায়িনী, ত্রিনয়নী, শিবসোহাগিনী গৌরী তোমাকে প্রণাম,  তোমাকে প্রণাম।
       শ্রীরামকৃষ্ণ বাহ্যজ্ঞান হীন সমাধিস্থ । সারদা মনিও আর শুধু সারদা নন। সাক্ষাৎ শ্রী মা। জগৎ জননী শ্রী মা।
রাত্রি তৃতীয় প্রহরে এবার ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস শ্রী মাকে নহবতে যেতে  নির্দেশ করলেন।
 শ্রী মা বাইরে  এসে  বিশ্ব ভোলার উদ্দেশ্যে নিবেদন করলেন তাঁর আন্তরিক প্রণাম। সূত্রপাত হলো্  নবজীবনের । চৈতন্যের আকাশে সূর্য উঠলো।সহস্রারে হলো  তাঁর স্বচ্ছন্দ গতাগতি।  বিচিত্র রূপ। পরম শক্তি রূপিনী রূপে প্রকাশিত হলেন শ্রীশ্রী মা সারদা মনি।
     মৃন্ময়ী সারদার আত্মপ্রকাশ হলো চিন্ময়ী রূপে। একেবারে জীবন্ত, জাগ্রত, রক্তে মাংসে গড়া হাজার লক্ষকোটি মানুষের  জননী রূপে। সতের মা অসতেরোও মা যে তিনি। 
     তাঁর কাছ থেকেই মানুষ শিখলো, খুঁজে পেল অযুত প্রশ্নের উত্তর। মিললো সমস্তই সমাধান।
 শ্রী মাকে দেখতে দলে দলে দর্শনার্থীদের ভিড় । তারই মাঝে কেউ কেউ বলে উঠলো - মেয়ে হয়ে জন্মে যদি সংসার ই না পেলে তাহলে আবার জীবন কী?  
     ঠাকুর সব বুঝতে পেরে ওদের কথায় কান  না দিতে মা সারদাকে বারণ করেছিলেন। --- ... আমার সব আছে, তবে ভগবানের জন্য সর্বশক্তি দিয়ে তাঁর কাছে রেখেছি।
 মা বলে উঠলেন -- "যে যা খুশি বলুক, আমি তোমার  সাধন পথে চিরদিন সঙ্গিনীর  মতো জেগে থাকবো"।
    ঠাকুরের কোনো দুঃখে মাও মনে মনে বড়ই আঘাত পেতেন। তাই বলতেন- ঠাকুর আমায় কোনদিন ফুলের ঘা টি পর্য্ন্ত দেননি" এমন যে মা তাকে একবার ভাগ্নে হৃদে কটাক্ষ করলে  ঠাকুর বলেছিলেন -- "ওরে হৃদে, ( নিজেকে দেখিয়ে,) একে তুই  তাচ্ছিল্য করে কথা বলিস বল।ওকে( শ্রী মাকে) আর কখনও এরকম কথা বলিসনি, এর ভেতরে যে আছে সে ফোঁস করলে হয়তো রক্ষা পেলেও পেতে পারিস কিন্তু ওর ভেতরে যে আছে, সে ফোঁস করলে তোকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু মহেশ্বর ও রক্ষা করতে পারবেনি।"
    শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের কাছে এত সম্মান পেলেও মা সারদা কিন্তু ঠাকুরের সেবিকা ছাড়া  নিজেকে কিছুই ভাবতেন না। স্থূল দেহসুখ তো দূরের কথা, সূক্ষ্মভাবে জাগতিক বাসনাও কোনোদিন মনে স্থান দেননি। আজকের বিশ্বায়নের যুগে যার মূল্য অসীম এবং বিরল দৃষ্টান্ত।-- তাইতো তিনি বিশ্ববন্দিতা , আরাধ্যা জগজ্জননীশ্রীমা। যিনি বলেছেন --" অপরের দোষ দেখোনা। আগে নিজের দোষটা লক্ষ্য করো" তিনি ছিলেন রামকূষ্ণগতপ্রাণা"।
 তাই রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের কথা -- তুমি মাথায় ঘোমটা টেনে নিঃশব্দে নারীদের দিকে লক্ষ্য করো। নারীর জগৎ তোমার জগৎ, নারীর এই অপবাদ ঘোচানো তোমার কাজ।। , "" দিনকা মোহিনী, রাতকা বাঘিনী"। মা হয়ে পরিবারের আত্মপ্রকাশ ঘটুক।
 আর সেই মন্ত্র দীক্ষিতা হয়ে শ্রীমাও বুঝিয়ে দিলেন নারী অবলা নয়, সবলা । শক্তি নিয়ে খেলা! মা- ই শেখালেন, সংসার হোলো স্টেপিং স্টোন।'
 স্বামীজী বলেছেন -" শক্তি বিনা জগতের উদ্ধার হবে না। ঠাকুরের  শক্তি মা সারদা, বুদ্ধের যেমন সুজাতা। তাই ঠাকুর এলেন, মাও এলেন।
১৮৫৫ সালের ৩১ মে, রানী রাসমনি দক্ষিনেশ্বরে মা ভবতারিণী র মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ঠাকুর এলেন তাঁর দাদার হাত ধরে। দাদা হলেন পুরোহিত , আর ঠাকুর হলেন মায়ের বেশকারী। তারপর দাদার অসুস্থ হবার কারণে ্ কেনারাম ভট্টাচার্য্য র কাছে দীক্ষা নিয়ে পূজারী হলেন আমাদের ঠাকুর রামকৃষ্ণ। 
    ঠাকুরের ইচ্ছাতেই পুরুষ নির্মিত শাস্ত্রের মুখে ঝামা ঘষে দিলেন।  সঙ্গে অবশ্যই মা সারদা ছিলেন। সে সময় ধর্মের জগতে সহধর্মিণীর স্থান ছিল না। নারীদেহ যে অশুদ্ধ।শাস্ত্রে অধিকার নেই। ওঁ কার নারীর জন্যে যে অনিয়ম। শালগ্রাম শিলা স্পর্শ করা চলবে না। দেবী দুর্গা ,কালী , জগদ্ধাত্রী পূজা করবেন শুধু পুরুষ। না ব্রাহ্মণীর স্ত্রী। এখানেই ইতি টানলেন রামকৃষ্ণ। সঙ্গে নিলেন    মা সারদা কে। 
 শ্রীরামকৃষ্ণ হলেন জগদ্গুরু আর দেবী হলেন মা-- সারদা। জগৎ জানে স্বামী স্ত্রী। আধ্যাত্মিক কথায় গুরু শিষ্যা। ঠাকুর জীবনের সবচেয়ে বড় হলো তাঁর প্রথম শিষ্যা হলেন মা সারদা আবার প্রথম গুরু হলেন নারী। পুরুষ শাসিত সমাজের মূলে কুঠারাঘাত। লোকে বিদ্রুপ করে উন্মাদ বললেও তাঁর দৃষ্টিতে সারদা হলেন সংযোগ, দেবী সরস্বতী, দেবী দুর্গা । স্বামীজীর কথায় যেন 'জ্যান্ত দুর্গা।'স্বামী আবেদা নন্দের কথায় মা সারদা র প্রধান অস্ত্র হলো তাঁর অপার স্নেহ। 
সারদা হলেন সচ্চিদানন্দময়ী। এই সৃষ্টি যেন তাঁর জীবজগতের স্থূল বিগ্রহ।।
  শ্রীল অক্ষয় কুমার সেন তাঁর অমর লীলা কাব্য শ্রীশ্রী রামকৃষৃণ পুঁথি তে যে সারদা বন্দনা করেছেন তার পৃষ্ঠা ৫৯ তে পাই--
 খেলার ডালি মা তোমার সৃষ্টি খানি।
লীলাময়ী লীলা পরা লীলা স্বরূপিনী ।।
একা তুমি অদ্বিতীয়া আপন মায়ায় 
ধরিয়াছ বহুরূপী জগৎ লীলায়।।
আপনার অখন্ডত্ব করি খন্ড খন্ড 
গেছো অগন্য আমি রুচিতে ব্রহ্মাণ্ড।
গুপ্তভাবে আপ্তলীলা করো গো জননী 
মায়ায় তোমার জীবে করে " আমি , আমি"!
 শ্রীশ্রী মায়ের কাছেই শুনেছি জগৎ কি তোমার  পর? তাঁকে আপন করে নিতে শেখোঊজু থেকে সরিয়ে নিলেন ঠাকুর ।। শ্রীমা নির্জনে সরে গেলেন। নিশ্চল নিথর শ্রীরামকৃষ্ণ যেন সারদাকে বলে গেলেন, আমি কিছু করিনি, তোমাকে এর চাইতে অনেক বেশি য়করতে হবে।" শয়নে রইলেন নরেন্দ্রনাথ।
 ঐ সালের ১৫ ভাদ্র মা গেলেন বৃন্দাবনে। সঙ্গে নিলেন স্বামী যোগানন্দ, অভেদানন্দ, অদ্ভুতানন্দ, লক্ষ্মীদেবী, গোলাপ মা আর বিষ্ণু দেবী। তারপর কাশীধাম, সর্বত্রই দেখেছেন ঠাকুরের বিগ্রহ। তাঁর কাছেই শুনেছেন, শিখেছেন নানা দেশ থেকে অনেক সন্তান আসবে -- তাদের জন্যে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে দিতে হবে।
    আজ মায়ের বাড়িটাই উদ্বোধন পত্রিকা অফিসে পরিণত।  যাঁর প্রথম সম্পাদিকা হন যোগিনী মা সারদা প্রসন্ন। যাঁর সন্ন্যাসী নাম  স্বামী ত্রিগুণাতীতা নন্দজী।।
 আমাদের ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবের ছিল সমাধি, সংগীত, কীর্তন, কথকথা অশেষ ভাব ও প্রকাশ। মায়ের ছিল, কর্মে ভরা একখানা তরতাজা জীবন। যাঁর পাথেয় হলো দুঃখে র নামাবলী আর মুখে রামকৃষ্ণ ধ্বনি। এই মায়ের কাছেই রইলো অনন্ত ঠিকানা। ‌যিনি জড় না হয়েও সারা বিশ্বে দাঁড়ালেন সচল শক্তি নিয়ে।
এমন মা ও আমাদের ছেড়ে সকলকে বিষণ্ণ করে এক অবসন্ন অপরাহ্ন বেলায় অন্তরীক্ষে বিলীন হলেন।
 যাঁর কাছে এসে ছিল মুসলমান, শিখ, গুজরাটী, এবং পাশ্চাত্যের দেশগুলো থেকে ও। যেমন মার্গারেট আলভা( নিবেদিতা) প্রভৃতি অসংখ্য নরনারী।
   জয়রাম বাকী থেকে বিষ্ণু পুর স্টেশনের মাঝে একটা আশ্রমে মা ঠাকুরের পাশে নিজের ফটো বসিয়ে নিজেই পুজো করেছেন আত্মদর্শনের অঙ্গীকারে। যেখানে শিখলাম তিনিই শ্রী আবার তিনিই ফ্রী। যেন নিজের মধ্যেই অরূপের দর্শন।।।
 মাতৃ অন্তর ঝংকৃত হলো।- শুনতে পেলাম-"আমি 
 মা, জগতের মা, সকলের মা। ----" তিনি যে স্বরূপের ঘণীভূত প্রতিমূর্তি। তাঁকে দর্শনে, চিন্তনে ও মননে ইষ্ট শক্তি জন্মে। তাঁর ঢরণবন্দনায় ছিন্ন হয় সকল বন্ধন । তিনি যে পরমা প্রকৃতি মানসী দেবী। তাঁকে জানাই শতকোটি প্রণাম। গাইতে ইচ্ছে করে ---
     অকূলের কূল তুমি,     অগতির গতি
      তব পদে সদা যেন        থাকে মোর মতি
       কত রূপে কতভাবে     এসেছো মা তুমি 
     বারেবারে তাই মোরা           তোমারে যে নমি।
      অসতেরর মা তুমি              সতেরো তো মা
বুঝতে না পারি,  মাগো।        তোমার মহিমা ।
জ্ঞান দাও, ভক্তি দাও।          দাও ভালোবাসা 
সহ্য শক্তি দাও মোদের         দাও মৃদু ভাষা ।
ভক্তিভরে যেই জন  করে           তোমার পূজন। 
জনম  সফল তার                   সার্থক জীবন। 
  মনপ্রাণ তব পদে                  করিনু অর্পণ 
সদা হৃদে থাকে যেন               তোমার চরণ।।
            ১৮চৈত্র - ২৫ চৈত্র ১৪১৫ বঙ্গাব্দ। 
                প্রণাম মাগো তোমায় প্রণাম। 
 
============
 
 সূত্র --- আদ্যাপীঠ মাতৃপূজা পৃষ্ঠা ৬১
    পৌষ সংখ্যা __১৪১৫!
 আরও--- 
    ১!সবার মা সারদা - মৃণালকান্তি দাশগুপ্ত।
 ২; ভবাণি ত্রিমনি রত্নম- সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, 
৩! অভিলাষ-& শ্রীরামকৃষ্ণ প্রেমবিহার ১৪১২( ৮ম),  ১৪১৪ (১০ম)
 প্রণব পত্রিকা ভারত সেবাশ্রম সংঘ ১৪২৩!
 

 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৯তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮০তম সংখ্যা ।। কার্তিক ১৪৩১ অক্টোবর ২০২৪

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

মুদ্রিত নবপ্রভাত উৎসব ২০২৩ সংখ্যার ডাউনলোড লিঙ্ক

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী