আফ্রিকার লোককথা ।। হেঁটে যাওয়া মড়া ।। বাংলা রূপান্তর : চন্দন মিত্র - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

Thursday, July 18, 2024

আফ্রিকার লোককথা ।। হেঁটে যাওয়া মড়া ।। বাংলা রূপান্তর : চন্দন মিত্র

আফ্রিকার লোককথা

হেঁটে যাওয়া মড়া

বাংলা রূপান্তর : চন্দন মিত্র

 

আপনারা ইগাল সিদাদ-এর নাম শুনেছেন কি? বোধহয় শোনেননি। তাঁর মতো ভীতু মানুষ সেই সময়ের সোমালিয়ায় আর একজনও ছিল না। ইগাল ছিলেন একজন যাযাবর পশুপালকউট, ভেড়া, গরু-ছাগল দেখভাল করে তাঁর সময় বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই কেটে যেত। অবশ্য কোথাও স্থায়ীভাবে বসবাসের উপায় তাঁর ছিল না। গোষ্ঠীর অন্যান্য লোকদের সঙ্গে এক চারণক্ষেত্র থেকে অন্য চারণক্ষেত্রের সন্ধানে তাঁকেও তাঁবু গুটিয়ে পরিবার নিয়ে রওনা দিতে হত। হিংস্র জীবজন্তুর হানা ছাড়াও পশুপালকদের জীবনের সব থেকে বড়ো হুমকি ছিল দস্যুদলের হামলা। ইগাল খুব বেকায়দায় পড়ে যেত এইসব বিপর্যয়ের সময়।

    একদিন দুপুরে ইগাল তাঁবুর ভিতরে বিশ্রাম নিচ্ছেন এমন সময় তাঁর স্ত্রী এসে তাঁকে বললেন, 'তুমি এখানে মড়ার মতো ঘুমোচ্ছো, এদিকে গ্রামে দস্যুদল ঢুকে পড়ল বলে, তাড়াতাড়ি ওঠো লড়াইয়ের প্রস্তুতি নাও।'  

স্ত্রীর কথা বিশ্বাস করার মতো মনের জোর ইগালের ছিল না। তিনি পাশ ফিরে শুয়ে কম্পিত স্বরে অনুযোগের সুরে বললেন, 'তুমি মাঝেমধ্যে এমন ভয়ংকর সব গল্প ফেঁদে কী লাভ পাও বলো তো! ভয়ে আমার গা-হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।'

এবার ইগালের স্ত্রী কর্কশ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন, 'আমি তোমাকে রূপকথার গল্প শোনাতে আসিনি, যা বলেছি সবটাই সত্যি। পড়শিদের কাছে খবর পেয়ে আমি তোমাকে সজাগ করতে এসেছি। তৈরি হয়ে নাও তুমি এই পরিবারের কর্তা তোমাকেই আমাদের পরিবার ও সহায়সম্পত্তি রক্ষা করতে হবে।'

আসন্ন বিপর্যয়ের কথা ভেবে ভয়ে ইগালের হাত-পা পেটের ভিতর ঢুকে যাওয়ার জোগাড় হল। পরিবার বা ধনসম্পদ রক্ষার কথা তাঁর মাথায় এল না, কীভাবে নিজের প্রাণটুকু বাঁচানো যায় সেই চিন্তাই প্রধান হয়ে দাঁড়াল। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রতিবেশীদের আর্তচিৎকার শোনা গেল। ইগালের মাথায় একটা বুদ্ধি এল। তিনি নিজেকে একটা মাদুরে জড়িয়ে নিয়ে স্ত্রীকে বললেন, 'এবার জোরে জোরে মড়াকান্না শুরু করো।'

তাঁর স্ত্রী স্বামীর কথামতো কাঁদতে শুরু করলেন। মাদুরের ভিতর থেকে ইগাল উপদেশ দিলেন, 'গিন্নি এত আস্তে নয়, আরও জোরে, যেন সকলে ভাবে আমি সত্যি সত্যি মারা গেছি।'  

একটু পরেই দস্যুদল ইগালের তাঁবুতে পৌঁছে গেল। দস্যুসর্দার ইগালের স্ত্রীর কান্নার কারণ জানতে চাইল। ইগালের স্ত্রী দুচোখ ভিজিয়ে ভেজা গলায় বললেন, 'আমার স্বামী আর নেই। আমি কী নিয়ে থাকব, তাই কাঁদছি হুজুর।'  

সর্দার শুধোল, 'তা কখন মরল ?'   

ইগালের স্ত্রী পড়লেন বিপদে। ইগাল তাঁকে মরার সময়টা বলে যাননি।

এদিকে সর্দারের জিজ্ঞাসা শুনে ইগালও পড়লেন ভাবনায়। তাঁর স্ত্রী যদি ভুলভাল একটা সময় বলে তাহলে আর রক্ষা নেই। স্ত্রীকে বলার সুযোগ না-দিয়ে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য ইগাল মাদুরের ভিতর থেকে বলে উঠলেন,

'গিন্নি, বলো, আমার স্বামী গতকাল মারা গেছে।'

সর্দার ধরে ফেললেন, ইগাল আসলে মড়ার অভিনয় করে বাঁচতে চাইছেন। তিনি হেসে দলের লোকদের বললেন, 'এই সবাই দেখে যা একটা মড়া নড়াচড়া করছে, আবার কথাও বলছে। ওকে ছেড়ে দে, ওকে মেরে লাভ নেই ও তো এমনিতেই মরে আছে।'

    সোমালিয়ার লোকেরা এই গল্পটা শ্রোতাদের শুনিয়ে বলেন, 'কোনো মানুষেরই ইগালের মতো  এতটা ভীতু হওয়া উচিত নয়। অন্তত নিজের পরিবারকে রক্ষা করার মতো হিম্মত প্রত্যেক মানুষের থাকা দরকার, নচেৎ তাকে দেখিয়ে লোকেরা মজা করে বলবে 'দ্যাখ দ্যাখ মড়া হেঁটে যাচ্ছে।'  

 ================

চন্দন মিত্র

ভগবানপুর (হরিণডাঙা)

ডায়মন্ড হারবার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা। 

No comments:

Post a Comment