Featured Post
সমরেশ বসুর "আদাব" : শ্রমজীবী মানুষের মনুষ্যত্বের দলিল ।। আবদুস সালাম
- লিঙ্ক পান
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
সমরেশ বসুর "আদাব":
শ্রমজীবী মানুষের মনুষ্যত্বের দলিল
আবদুস সালাম
বাংলা ছােটোগল্পের ভুবনে এক অসাধারণ সাহিত্য প্রতিভা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন সমরেশ বসু। সাম্প্রতিক কালের বাংলা সাহিত্যের তিনি এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তীকালে বাংলা কথাসাহিত্যে যে ত্রয়ী-বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবির্ভাব হয়েছিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় 1929, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় 1936,তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় 1942। তারা বাংলা সাহিত্যকে বঙ্কিম রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্রের বাইরে এক নবতর শক্তি ও সামর্থ্য দান করেছিলেন সন্দেহ নেই। তবে তার পরবর্তী পর্বে বাংলা সাহিত্যে শক্তি ও সামর্থ্যের বিচারে যথার্থ স্বীকৃতিযােগ্য সাহিত্যফলক হিসাবে সমরেশ বসুর নামটি উঠে আসতেই পারে। সমরেশ এক স্বতন্ত্র ধারার লেখক।
বাংলাসাহিত্যের বিতকির্ত এবং উজ্জ্বল নক্ষত্র কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসু (1924-1988) অবিভক্ত ভারতের ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের রাজনগর গ্রামে তিনি জন্মেছিলেন। তার প্রকৃত নাম 'সুরথনাথ' আর ডাকনাম ছিল 'তড়বড়ি' । আরো মজার বিষয় 'সমরেশ' নামটি দিয়েছিল, তারই বন্ধু এবং স্ত্রীর ভ্রাতা দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়।
সাহিত্য ক্ষেত্রে 'কালকুট' এবং 'ভ্রমর' ছদ্মনাম দুটো ব্যবহার করতেন। বাইশ বছরের একজন তরুণ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমিকায় লেখেন 'আদাব' গল্পটি ।'পরিচয়' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় (1946-এর শারদীয় সংখ্যায়) "আদাব"। শারদীয়া সংখ্যায় প্রকাশিত অচেনা লেখকের গল্প।প্রথম গল্প প্রকাশের সাথে সাথে পাঠক-সাধারণের কাছে আলোচিত হতে থাকেন। প্রথম গল্পেই তিনি মানুষের মননের ভিত্কে নাড়িয়ে দেন। পরিচিত হয়ে ওঠেন গাল্পিক সমরেশ বসু হিসেবে। লোকমুখে আলোচনা হতে থাকে এবং চর্চার কেন্দ্র হয়ে ওঠেন।সাহিত্যিক মহলে কানাঘুষা চলতে থাকে।
"আদাব "গল্পের কি এমন আছে যা নিয়ে সাহিত্যিক মহল নড়েচড়ে বসেছে। অবশ্যই কিছু নতুন মাল মশলা আছে যা এর আগে তেমন ভাবে কেউ লেখেনি।
সমরেশ বসু বহু কালজয়ী উপন্যাসের জনক। তার উপন্যাসের সংখ্যা একশোর ও বেশি। তিনি গল্প দিয়ে হাত পাকান নি। বরং উপন্যাস দিয়েই পাঠকদের দরবারে হাজির হয়েছিলেন।
1947 থেকে 1988 পযর্ন্ত বিয়াল্লিশ বছরের সাহিত্য জীবনে নামে-বেনামে গল্প এবং উপন্যাসের গ্রন্থের সংখ্যা দুইশত পঁচাত্তরটির কাছাকাছি ।'আদাব' দিয়ে শুরু এবং অসমাপ্ত রেখে গেলেন 'দেখি নাই ফিরে'।
, তাঁর অধিকাংশ গল্পে সংবেদনশীল ও বলিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। ছোটদের জন্য গোয়েন্দা কাহিনীতে তার বিচরণ ছিল, যা বড়দেরও আকৃষ্ট করত। শিশু সাহিত্যিক না হয়েও গোগোল সিরিজের শিশু-উপন্যাসগুলোতে তার দক্ষতা স্পষ্ট। বিষয়-আঙ্গিক মানবভাবনা-জীবনচেতনা যেমন এসেছে সমরেশে বসুর গল্পে, তেমনি কালচেতনা তার গল্পের প্লটকে জারিত করেছে। সাম্প্রতিক বিষয়কে সময়ের কাছে নিয়ে স্থাপন করা হলো তাঁর গল্পের অভিনবত্ব। তাঁর ছয় খন্ডে প্রকাশিত গল্পসংগ্রহে দুই শতাধিক গল্পের হদিস পাওয়া যায়।
দারিদ্র্যের সঙ্গে তাকে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করতে হয়েছে। তাঁর জীবন সংগ্রাম শুরু হয়েছিল কৈশোরে, তাই লেখাপড়ায় বেশি দূর এগোতে পারেনি ।, নিতান্ত অল্প বয়সে প্রেমে পড়ে বিয়ে করেছিলেন । সংসার চালানোর তাগিদে ডিম বিক্রেতার পেশায় নিয়োজিত হন। চাকরি করেছেন ছোট-বড় অনেক। বামপন্থী রাজনীতি করতেন, জেল খেটেছেন কয়েকবার। তারপরও সাহিত্যকের জীবনের শ্রেষ্ঠতর কাজ বলে বিবেচনা করেছেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই সময় ঘটে গিয়েছে পৃথিবীর উপর ধ্বংস ও নির্মাণের খেলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ঘটে গেছে বিরাট পরিবর্তন প্রচলিত ধ্যানধারণা গ্যাছে দুমড়ে মুচড়ে মুছে গেছে। অস্থির, অসংলগ্ন ,অমানবিকতা প্রভৃতির জন্ম দিয়েছে এই সময়। মানুষের জীবনযাত্রা নিয়েছে শঠতার প্রশ্রয় ।
বিশ্বের দরবারে মানুষের নৈতিকতা দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে গিয়েছে । শেষ
"আদাব" বাংলাসাহিত্যের কালজয়ী একটা গল্প, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরপরই 1946এর 16 আগস্টে অবিভক্ত মুসলিম লীগ 'প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসে'র ডাক দেয়, তারপর শুরু হয় হিন্দু-মুসলমানের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, ইতিহাসে যাকে বলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ক্রমে তা সারা ভারতে ছড়িয়ে যায়, উভয়ের মধ্যে অবিশ্বাস-ঘৃণা দ্বেষ-হিংসা আক্রোশ আর সন্দেহ প্রবলভাবে দেখা দেয়, 'আদাব' সেই পটভূমিতেই নিমির্ত। দা-সড়কি ছুরি-লাঠি যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে হিন্দু-মুসলমান পরস্পরকে নিধনে উন্মাদ, দাঙ্গাকারী মানুষ মুহূর্তে যেন সব জানোয়ারে রূপায়িত হয়েছে। পৈশাচিক আগুন আর উল্লাস চারদিকে, মরণভয়ে শিশু-নারীর আত্মচিৎকার, কারফিউ এবং 144 ধারা, এর মধ্যে দুজন শ্রমিকের পরিচয়, কেউ কাউকে চেনে না, একজন সুতাকলের মজুর আরেকজন নায়ের মাঝি কাকতালীয়ভাবে দুজনের মধ্যে অবিশ্বাসের মধ্যে একটা মেলবন্ধন রচিত হয়, কারণ তারা দুজনই শ্রমিক, দিনমজুর ।পরবর্তি সময়ে নিজেদের পরিচয় বেরিয়ে এলেও ক্রমে তা সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতির আলোতে তাদের দেখতে পাওয়া যায়, কেউ কারো ক্ষতি করবে না এমন বিশ্বাস নিয়ে গল্পটি এগোয়।, মাঝি এক সময় পোলা-মেয়ে বউয়ের কাছে ফিরে যেতে চায়, কারণ আগামীকাল ঈদ, সুতাকলের শ্রমিক তাকে যেতে দিতে না চাইলেও আনন্দের পরব বলেই ছেড়ে দেয়। তারা দুজনে আদাব সম্ভাষণ করে ।কিন্তু সুতাকল মজুরের বুক কষ্টে এবং উত্তেজনায় বুকের ভিতর টনটন করে, ভয়ে আর অনুকম্পায় তার গলা ভরে ওঠে। তারপর মাঝি অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। সমরেশ বসু এ গল্পে সাম্প্রদায়িকতার চিত্র যেমন চিত্রায়িত করেছেন, তেমনি মানুষের ভেতর যে অন্ধকার আছে সেদিকটাও তিনি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। নতুন হাতের গল্প তবুও মুন্সীয়ানা অনেক বলিষ্ঠ।, গল্পের ছত্রেছত্রে মানুষেরই সম্প্রীতির বাতাবরণ সৃষ্টি করেছেন সুচতুর ভাবে। তাঁর বার্তা ছিল প্রকৃতপক্ষে মানুষই মানুষের পরম আত্মীয় ।মানবধর্ম বা মানবপ্রেম যা বলা হউক না কেন, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নয়, নয় কিছু মহীয়ান। এভাবেই গল্পেএক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছেন। মানবিকতা যে রাজনৈতিক ক্ষমতার লোভে ভাগবাটোয়ারা ও ভুলুন্ঠিত হয় এই গল্পে সমরেশ বসু সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন। এই গল্পের মূল উপজীব্য হলো দারিদ্র্য । আর এই দারিদ্র্য সব সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে ভুলিয়ে দেয়। দারিদ্র্য তখন স্বমহিমায় উচ্চারণ করে আমরা তোমায় ভুলছি না ভুল বোনা। দারিদ্র্য তুমি যুগ যুগ জিও। "আদাব" গল্পটি মেহনতি মানুষের মনুষ্য যন্ত্রণার দলিল একথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
###
- লিঙ্ক পান
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন