আমি পেশায় মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টেটিভ। যাদের সংক্ষেপে এম আর বলে। আপনারা অনেকেই হয়ত ডাক্তার বাবুদের চেম্বারে বা হাসপাতালের আউট ডোরে আমাদের মত স্যুটেড বুটেড ফুলবাবু মার্কা এম আরদের দেখে থাকবেন। অবশ্য উপর থেকে যতটা ফুলবাবু মনে হয় ততটা ফুলবাবু আমরা নই। রোদে পুড়ে, জলে ভিজে আমাদের কাজ করতে হয়।
অনেক কষ্টে চাকরিটা আমি যোগাড় করেছি। এই চাকরিটা গেলে আর চাকরি পাবো না। কারন আমার বুদ্ধি কম। বারে বারে চাকরি যোগাড় করার মত বুদ্ধি আমার নেই। সত্যি বলতে কি গড়পড়তা বাঙালিদের থেকে বুদ্ধিতে আমি বেশ খাটো। বুদ্ধিহীনতার জন্য আমাকে পদে পদে হেনস্তা হতে হয়। কোনো রকমের ইশারা ইঙ্গিত বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। পরিস্কার করে বলে না দিলে জটিল কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারিনা। সেইজন্য অনেকে আমাকে আদর করে 'মাথা মোটা' বলে ডাকে। অনেকের ধারণা আমার ব্রেন, আমার হাঁটু বা গোড়ালির কাছাকাছি কোথাও আছে। সেইজন্য সময় মত কাজ করতে পারে না।
খুব পরিশ্রম করি আমি, যাতে চাকরিটা টিকে থাকে। দিন রাত ডাক্তার বাবুদের চেম্বারে চেম্বারে ঘুরে বেড়াই। অন্যান্য কোম্পানির এম আরদের সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় হয়। তাদের পরামর্শ নিই। এছাড়া যিনি আমাদের কাজের তদারকি করেন সেই ম্যানেজারও বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেন।
জয়ন্ত একজন এম আর। ভালো কাজ করে ভালো মাইনে পায়। কিন্তু তার মনে একটা দুঃখ আছে। তার বিয়ে হচ্ছে না! কেউ তাকে একটা মেয়ে দেখে দিচ্ছে না! মাঝে মাঝে সে আমার কাছে তার মনের দুঃখের কথা বলে হালকা হয়।
আমার মনটা ভীষণ নরম। অন্যের দুঃখ কষ্টের কথা শুনলে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। জয়ন্তের দুঃখের কথা বারে বারে শুনে আমার চোখে জল এসে যায়। একদিন আমি জয়ন্তকে পরামর্শ দিয়ে বলি, "অন্য কেউ দেখে দিচ্ছে না বলে দুঃখ করে লাভ নেই। তুমি নিজে চেষ্টা করো। মানে প্রেম ট্রেম করে দেখো। যদি বিয়ের ফুল ফোটে।"
- "সেই চেষ্টাও করেছি। বারে বারে করেছি। প্রতিবার মিস ফায়ার হয়ে গেছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দুবার মার খেতে খেতে বেঁচে গেছি। একবার এক বিবাহিত মহিলাকে বুঝতে না পেরে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। সেই মহিলা আমাকে ঠেলে খালে ফেলে দিয়েছিলো। চারজন ষন্ডা গুন্ডা মার্কা লোক খালের ধারে আমার জল থেকে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছিলো। ভরা শীতের রাতে আমি খালের জলে তিন ঘন্টা ঘাপটি মেরে বসেছিলাম। তারপর সারা শরীরে কাদা, পাঁক মেখে, ভেজা জামা প্যান্ট পরে, দু কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফিরেছিলাম। শীতের রাতে কাদা জলে তিন ঘন্টা ডুবে থাকার ফলে জ্বরে পড়লাম। সেই জ্বর সারতে দশ দিন লেগেছিলো। তারপর আমার মনে বিয়ের ইচ্ছা জাগলেও, আর কখনও প্রেম জাগেনি।"
আজ সকালে কাজে বেরিয়ে এক অদ্ভুৎ, অপার্থিব দৃশ্য দেখলাম। দেখি জয়ন্ত মোটর বাইক চালিয়ে যাচ্ছে। পেছনের সীটে তাকে জাপটে ধরে বসে আছে এক মহিলা। বেশ জোরে বাইক চালাচ্ছে জয়ন্ত। মুখ খোলা। দাঁতগুলো বেরিয়ে আছে। দুর থেকে বোঝা যাচ্ছে না জয়ন্ত হাসছে নাকি গান গাইছে! মহিলার মুখেও হাসি। অনেকটা সপ্তপদী সিনেমার উত্তম কুমার সুচিত্রা সেনের মত লাগছে দুজনকে। জয়ন্ত হাসুক বা গান করুক, যা করছে, মনে হচ্ছে মনের আনন্দে করছে। কিন্তু কে এই মহিলা? যেভাবে জয়ন্তকে জাপটে ধরে আছে, অন্য কিছুতো ভাবা যাচ্ছে না! তার মানে জয়ন্ত প্রেম করছে! আমারও দেখে বেশ ভালো লাগলো। বুঝলাম কান্নাকাটি ছেড়ে জয়ন্ত এবার পজিটিভ কিছু করছে।
জয়ন্তর আনন্দে আমিও আনন্দিত। বেশ ফুরফুরে লাগছে নিজেকে। হাঁটতে হাঁটতে আমি আমাদের কোম্পানির স্থানীয় ডিস্ট্রিবিউটরের অফিসে এলাম। দেখি জয়ন্ত এবং সেই মহিলাও সেখানে হাজির। জয়ন্ত সেই মহিলার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল, "ইনি শ্রীমতী রায়। আমাদের কোম্পানির ম্যানেজার।"
হায়! কি ভাবলাম! আর এখানে এসে কি শুনলাম! মুডটা একেবারেই অফ হয়ে গেলো। জয়ন্তর জন্য মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। কিছুই ভালো লাগছিলো না। কিছুক্ষণ পর ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সেখান থেকে।
রাস্তায় এসে দেখি কিছুদুরে সমীর যাচ্ছে। সেও একজন এম আর। তার সঙ্গেও একজন শ্রীমতি! মানে মহিলা! মানে লেডি ম্যানেজার! ওষুধ কোম্পানিগুলো কি এবার সব মহিলা ম্যানেজার রাখতে শুরু করলো। সমীরের কোম্পানির ম্যানেজার অনীলকে আমি চিনি। তবে কি তার কোম্পানি তাকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছে। অনীলের কথা ভেবে আবার আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। যতক্ষণ না ব্যাপারটা ঠিকঠাক ভাবে জানতে পারছি, ততক্ষণ মনটা ভীষণ অস্থির লাগছে! অনীলকে ফোন করে জানতে চাইলাম, "তোমাকে কি চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে? মানে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছে?"
- "নাতো! কেন?
- "তবে কি সমীর তোমাদের কোম্পানির চাকরি ছেড়ে অন্য কোনো কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে?"
- "না! সমীর চাকরি ছাড়েনি! কেন বলতো?"
- "এইমাত্র সমীরকে দেখলাম অন্য একজন ম্যানেজারের সঙ্গে কাজে যাচ্ছে!"
- "অন্য ম্যানেজার!"
- "হ্যাঁ ম্যানেজার। মানে লেডি ম্যানেজার। জয়ন্তদের কোম্পানিও একজন লেডি ম্যানেজার রিক্রুট করেছে, সমীরের সঙ্গেও একজন লেডি ম্যানেজার! অবাক হয়ে ভাবছি ফার্মা কোম্পানিগুলো কি করতে চাইছে? ছেলে ম্যানেজারদের ছাড়িয়ে দিয়ে লেডি ম্যানেজার রিক্রুট করার কারণ কি? আমারতো কিছুই মাথায় ঢুকছে না! তোমার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিল। এই বয়সে চাকরি হারালে কি করবে? তাই ফোন করলাম।"
- "তুমি ঠিক দেখেছো?" অনীলের গলাটা খুব গম্ভীর শোনালো। চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছে কিনা জানতে চেয়েছি বলে অনীল কি আমার উপর অসন্তুষ্ট হলো!
- "হ্যাঁ, এই মাত্র দেখলাম সমীর তার লেডি ম্যানেজারের হাত ধরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে।"
- "হাত ধরে?"
- "না, না, শুধু হাত ধরে নয়। ধরা হাত দুটোকে বেশ জোরে দোলাতে দোলাতে চলেছে দুজনে।"
- "বুঝেছি। সমীর ইদানিং কাজের সময়ে অন্য কাজ করে বেড়াচ্ছে। সেইজন্য ওর পারফরম্যান্স একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। এসব আমি একদম পছন্দ করিনা। হি মাষ্ট বি পানিশড। তুমি আমাকে ফোন করে খুব ভালো করেছো। তোমার সব কথা আমার ফোনে রেকর্ড হয়ে গেছে। ওগুলো কাজে লাগবে।"
বুঝতে পারছি অনীল বেশ রেগে গেছে। তবে আমার উপর, নাকি সমীরের উপর সেটা বুঝতে পারছি না। তবুও আমি চেষ্টা করলাম সমীরকে শান্ত করার। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, "না, না, অন্য কাজ নয়। পিঠে ব্যাগ নিয়ে সমীর অফিসের কাজেই যাচ্ছে। তোমাদের অফিসে কি ড্রেস কোড চালু হয়েছে?"
- "না! কেন এরকম অদ্ভুৎ প্রশ্ন করছো?"
- "দুজনকেই দেখলাম জিন্স এবং নীল টি সার্ট পরে আছে। এক্কেবারে ম্যাচিং। দেখে মনে হচ্ছে ওরা কোনো ফার্মা কোম্পানির স্টাফ নয়। কোনো সিনেমার নায়ক নায়িকা! হেব্বি লাগছে দুজনকে!"
- "কাজের সময়ে ভালোবাসাবাসি আমি কোনও মতেই বরদাস্ত করবো না।" বাঘের গর্জনের মত শোনাচ্ছে অনীলের গলাটা।
অনীলের কথার মানে মাত্রা কিছুই বুঝতে পারছি না! বললাম, "সমীর কিন্তু নিজের কাজকে খুব ভালোবাসে। আমার মনে হলো ঐ লেডি ম্যানেজারও খুব কাজ ভালোবাসে। সমীরের হাত ধরে কত কিছু তাকে বোঝাতে বোঝাতে চলেছে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেও কতকিছু বোঝাচ্ছে! তার মানে খুব কাজের মহিলা। একটুও সময় নষ্ট করতে চায় না। দেখে আমার খুব ভালো লাগলো।"
- "এবার আমি বোঝাবো, কত ধানের কত চাল।"
ক্রমশ যেন রেগে আগুন হয়ে উঠছে অনীল। কিন্তু এত রাগের কারণ কি, সেটাই বুঝতে পারছি না! একরাশ বিস্ময় নিয়ে আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, "অনীল, তোমার মত শান্ত ছেলে হঠাৎ এত রেগে যাচ্ছো কেন? ঐ লেডি ম্যানেজার কি তোমার উপর কোনো রকম অত্যাচার করেছে? মানে..."
আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে অনীল ফোনটা কেটে দিলো। অনীলের চাকরি যায়নি শুনে খুশি হলাম। কিন্তু শান্ত স্বভাবের অনীল আচমকা এতটা রেগে গেল কেন বুঝতে পারলাম না! অনীলের চাকরি আছে অথচ সমীরের সঙ্গে অন্য লেডি ম্যানেজার কাজে বেরিয়েছে! পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে রহস্যময় থেকে গেল! যাকগে ওদের ব্যাপার ওরা বুঝবে। ওদের কোম্পানির টাকা আছে, ওরা একটা কেন দশটা ম্যানেজার রাখতে পারে। ওসব নিয়ে আমার মাথা ঘামানোর দরকার নেই।
কিছুদিন পরে সমীরের সঙ্গে দেখা। সমীর সাড়ে ছফুট লম্বা। ওজন প্রায় একশো কেজির কাছাকাছি। অন্যদিকে আমি কেবল বুদ্ধিতেই খাটো নই। উচ্চতাতেও বেশ খাটো। আমার উচ্চতা পাঁচ ফুট থেকেও কিছুটা কম। আমাকে দেখেই সমীরের চক্ষুদ্বয় গোলাকার এবং রক্ত বর্ণ ধারণ করলো। তার নিঃশ্বাসে সঙ্গে আগুন এবং কান দিয়ে ধোঁয়া বের হতে লাগলো। সে হুঙ্কার ছেড়ে আমাকে বললো, "সবাইকে সব কথা বলার কি আছে?"
সমীরের রণহুঙ্কার শুনে বহমান বাতাস থমকে গেল! অশান্ত সাগরের ঢেউ শান্ত হয়ে গেল! মধ্য গগনের সুর্য চোখ বন্ধ করে নিলো! দিন দুপুরে অন্ধকার নেমে এলো চরাচরে! তারপর শুরু হলো ভয়ঙ্কর অসম যুদ্ধ। না, যুদ্ধ নয়। একতরফা প্রবল প্রহার, আর বিপরীত দিক থেকে প্রতিরোধের অক্ষম প্রচেষ্টা। ক্রমাগত মার খেয়ে চলেছি। কিন্তু কেন মার খাচ্ছি বুঝতে পারছি না!
ফল স্বরূপ এখন আমি হাত, পা, ঘাড়, মাথা, পেট, কোমর ভেঙে হাসপাতালের বিছানাতে শুয়ে আছি। ডাক্তার বাবু আমাকে কথা বলতে বারণ করেছেন। তবে সেটা কিছুদিনের জন্য, নাকি চিরদিনের জন্য সে নিয়ে প্রেসক্রিপশনে কিছু লেখা নেই।
।। সমাপ্ত ।।
দেবাংশু সরকার,
34/10/A, M.G.ROAD,
BUDGE BUDGE
KOLKATA -700137.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন