ভজকেষ্টর কেচ্ছা
মিঠুন মুখার্জী
আজ যার কথা বলতে যাচ্ছি সে বিংশ শতাব্দীতে জন্মালেও একজন প্রাচীনপন্থী ঠকবাজ ও গুলবাজ। হাব-ভাব, পোশাক-আশাক, আচার-আচরণ কোনটার মধ্যে হাল আমলের ছাপ নেই। সবটাই পুরাতন রক্ষণশীল মানসিকতার মানুষ। নাম ভজকেষ্ট অধিকারী। হরিভক্ত ভন্ড এমন মানুষ এই যুগে খুবই কম দেখা যায়। একটা গেরুয়া থান কাপড় কোমড়ে জড়ানো, গায়ে একটা ফতুয়া, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কাঁধে একটা উত্তরিও, চোখে বয়স্ক মানুষদের মত চশমা তার। তার আবার একটা কাঁচ ফাটা। কপাল থেকে নাক পর্যন্ত রসকলি কাঁটা। গায়ের রং নাতিফর্সাকালো। চুলগুলো লেবুর তেল দিয়ে ঝুঁটি করে বাঁধা। নেশা বলতে সব সময় কাঁচা সুপারি দিয়ে পান চিবায়। পায়ে দেশি মুচির তৈরি একজোড়া হাওয়াই চপ্পল। বয়স মাত্র সাঁইত্রিশ বছর।
বাবা হরনাথ অধিকারী ছিলেন একজন চাল ব্যবসায়ী। তার সাথে সাথে কবিরাজি ও জ্যোতিষী বিদ্যাও চর্চা করতেন। মাস গেলে প্রচুর টাকা উপার্জন করতেন তিনি। তিনিও একজন বৈষ্ণব ছিলেন। কথায় কথায় 'রাধামাধব জয় যাদব'বলতেন।সংসারের অশান্তি, কেউ চলে গেছে, কারো বিয়ে হচ্ছে না, কাউকে বশ করতে হবে--- সবকিছুই হরনাথ করতেন। তার বিনিময়ে মোটা অংকের টাকা নিতেন মানুষদের কাছ থেকে। কারো সামর্থ্য না থাকলে সোজা কথায় জানিয়ে দিতেন--- "তিনি পারবেন না।" কত মানুষ চোখের জল ফেলেছেন। বলেছেন--- "বাবা, এত টাকা কোথায় পাবো!! যদি কিছু কম করেন।" তবুও চিড়ে ভেজে নি। হরনাথকে কঠোর মনের মানুষ বললেও কম বলা হবে। শুধু আজগুবি গুল মারতেন। বলতেন--- "আমি সবকিছু আমার গুরুদেবের কাছ থেকে শিখেছি। এগারো বছর বয়স থেকে ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত হিমালয়ের গুহাতে থেকে কঠোর পরিশ্রম করে গুরুর কাছে এই বিদ্যা শিখেছি। তাহলে তোমরা তোমাদের কাজের জন্য কেন টাকা দেবে না?" আসলে এগুলি সবই মিথ্যা কথা। সারাদিন ভজকষ্ট অধিকারীর বাবা হরনাথ অধিকারী প্রচুর মিথ্যা কথা বলতেন। কাজ না হওয়ার জন্য কত মানুষের কাছ থেকে তাকে গালাগালি ও অভিশাপ খেতে হয়েছে। ভন্ড, চিটিংবাজ, ঠকবাজ আরও কত কথা প্রতিনিয়ত শুনতে হয় তাকে। তবুও কোন কথাই তিনি গায়ে মাখেন না। কিন্তু ভগবান চোখ বন্ধ করে থাকেন না। তার বিচারের কাছে হরনাথকে মাথানত করে থাকতেই হয়। শুধু কবিরাজি নয় জ্যোতিষীগিরি করেও মানুষের হাত দেখে গ্রহের খারাপের কথা বলে, ভয় পাইয়ে দিতেন তিনি। তিনি প্রতিকার হিসাবে বহু মূল্যের রত্ন সাজেস্ট করতেন। অনেক কষ্ট করে ধার-দেনা করে সমস্যার সমাধনের আশায় মানুষেরা মূল্যবান পাথর নিতেন। কিন্তু কোন কাজ হতো না। হবে কি করে? কম দামি পাথর এক নম্বর বলে ভজিয়ে দিতেন তিনি। তার এই দুর্নীতি পরিবারের সবাই সামনে থেকে দেখতেন, কিন্তু কিছু বলার কারো সাহস ছিল না।
বাবার কাছ থেকে যে প্রবৃত্তি ছেলে ভজকেষ্ট পেয়েছেন তা হল, লোক ঠকানো। সর্বদা হরিনাম মুখে নিয়ে অকুণ্ঠ চিত্তে এই কাজ বছরের পর বছর বাপ- বেটা মিলে করে যাচ্ছেন। চালের দোকান উপলক্ষ মাত্র। আসল কাজ লোক ঠকানো। তবে মাঝে মাঝে বাপ- বেটার মধ্যে তুমুল বচসা বাঁধত ছোট ছোট কয়েকটা বিষয় নিয়ে। হরনাথ একমাত্র হরির সেবায় মুক্ত হস্তে খরচ করতেন। বাদবাকি সব ক্ষেত্রে কখনো হাতের মুঠো খুলতেন না। তাছাড়া তার মন যুগিয়ে যারা চলতে পারতেন, তাদের প্রতি খুশি হয়ে কখনো কখনো হাতের মুঠো খুলে দিতেন তিনি। তাই তাকে তেল দিয়ে চলতেন তার মেয়ে সবিতা, ছোট ছেলে রামকৃষ্ণ ও বউ সরমা।
কথায় বলে 'উৎপাতের ধন চিৎপথে যায়'। কথাটা সত্যি। সারা জীবনে লোক ঠকিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা ভজকেষ্টর বাবা উপার্জন করলেও রাখতে পারেন নি। 'চোরের উপর বাটপারি' করেছেন অনেকে। সমস্যা জীবনে অক্টোপাসের ন্যায় জড়িয়ে রয়েছে সবসময়। মেয়ে সংসার করতে পারে নি। তাই বাবার ঘাড়ে বসে অন্ন ধ্বংস করছে। ছোট ছেলের পঁয়ত্রিশ বছর বয়স হলেও এখনো বিয়ে হয়নি। আর বড় ছেলে ভজকেষ্ট তিন তিনটি বিয়ে করে আইনি জটিলতায় ফেঁসে আছেন।
বড় ছেলে ভজকেষ্ট অধিকারী বাবার কাছ থেকে জ্যোতিষীবিদ্যা শিখে বিভিন্ন গ্রামে ও শহরে চেম্বার খুলেছেন। বাবার চালের দোকানে তার মন নেই। তাই ভাই রামকৃষ্ণ বাবার সঙ্গে চালের দোকান দেখাশোনা করেন। সে কবিরাজি ও জ্যোতিষীর মতো লোক ঠকানো কাজ পছন্দ করেন না। সৎ পথেই চলতে চান। ধর্মের ছাড়পত্র শরীরে ঝুলিয়ে বাবা ও দাদার মতো ভন্ডামি করেন না।
ভজকেষ্ট প্রথম বিয়ে করেছিলেন পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথিতে। সেখানে হাত দেখতেন এক জুয়েলারির দোকানে। সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের হাত টিপে টিপে বিভিন্ন সমস্যার কথা বলতেন আর মনে মনে কামনা চরিতার্থ করতেন। অথচ শরীরের দিকে তাকালে বোঝার উপায় নেই যে রাধামাধবের সেবক সেজে এভাবেও ভন্ডামি করতে পারেন। রাধিকা নামের একটি মেয়ে একদিন হাত দেখাতে এসেছিলেন কাঁথিতে। তার হাত দেখে মিটিমিটি হেসে ভজকেষ্ট তাকে বলেন--- "নারী সুলভ কোমলতা, তার সঙ্গে আছে চপলতা। ভাবটা একটু চাপা। মনের কথা সবাইকে বলতে চাও না। অল্পতে খুব আনন্দ প্রিয় মানুষ। মনে ইচ্ছা আছে এটা করব, ওটা করব। কিন্তু ভাবাবেগ বেশি থাকায় বাস্তবে তা করে উঠতে পার না।" তার কথা শুনে মেয়েটি মৃদু মৃদু হাসে। তাকে আরো বলেন--- "কিছু মনে করো না, তোমার বাঁ বুকের দুধের উপর, ডান দিকের উরুতে ও নাভির নিচে তিল আছে। সুন্দর পুরুষ দেখলে কাম উন্মাদনা জেগে ওঠে।" এই কথাগুলো কোনটি ঠিক হয়, আবার কোনটি হয় না। মেয়েটা তার কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে যায়। এভাবেই আলাপ। তারপর ফোনে প্রেম ও কদিন বাদে বিয়ে হয়। মেয়েটিকে তিনি বলেছিলেন--- "আমার নিজের বাড়ি নেই। কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করে তোমায় এক মাসের মধ্যে নিয়ে যাব।বাবা-মা উত্তরপ্রদেশে থাকেন। বাবা সেখানে ডাক্তারি করেন। সে কলকাতায় একটা ছেলেদের মেসে থাকেন।" মেয়েটির বিশ্বাসের কোন মূল্য দেননি ভন্ড ভজকেষ্ট। বিয়ের পর একরাত মেয়ের বাড়ি কাটানোর পর সেই যে কাঁথি থেকে চলে এসেছিল আর কখনো সেখানে যাননি।
দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন শিলিগুড়িতে। তখন ভজকেষ্ট মাসে একবার এক সপ্তাহের জন্য শিলিগুড়িতে হাত দেখতে যেতেন। ওখানে একটা ভাড়া নেওয়া চেম্বার করেছিলেন। বলেকয়ে এক সপ্তাহের জন্যই একটু বেশি টাকা দিয়ে ঐ ঘরটি ভাড়া নিতেন। প্রত্যেক মাসের দশ থেকে সতের তারিখ এই ভাড়াটি নিতেন। একবার শিয়ালদহ থেকে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস ট্রেনে চড়ে শিলিগুড়ি যাচ্ছিলেন ভজকেষ্ট। মালদা থেকে একজন সুন্দরী মেয়ে ওই বগিতেই উঠেছিল। তার টিকিট ছিল ওয়েটিং লিস্টের। অল্প বয়সের মেয়েটিও বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেছিল। যাচ্ছিল শিলিগুড়িতে।বৈষ্ণব ভজকেষ্টর তাকে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খারাপ লেগেছিল। তাই তার সিটে তাকে ডেকে বসতে দিয়েছিলেন। গায়ে পড়ে আলাপ করে তার সম্পর্কে সবকিছু বলে দেন। তবে বেশিরভাগই মিথ্যা। মেয়েটির কাছ থেকেও অনেক কিছুই জেনে নেন তিনি। আসলে সুন্দরী মেয়ে দেখলে পুরুষদের কাম উন্মাদনা জাগার কারণে সহানুভূতি প্রকাশিত হয়। কিন্তু সাদামাটা কারোর প্রতি বা পুরুষের প্রতি পুরুষের এই সহানুভূতি জাগে না। মেয়েদের তো কারো প্রতিই সহানুভূতি জাগে না। পান চিবিয়ে বারবার পানের পিক ট্রেনের জানালা দিয়ে ফেলছিলেন ভজকেষ্ট। যেটা দেখে ওই মেয়েটির হাসির ও ঘৃণার উদ্রেক হয়েছিল। ভজকেষ্টর সাজগোজ ও পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে মেয়েটি মাঝে মাঝে হাসছিল।সে ভাবছিল---'এই যুগে এখনো এরকম মাল আছে!' বাবার কাছ থেকে গুল মারার স্বভাবটা পেয়েছিলেন ভজকেষ্ট। মেয়েটিকে নানান গুল মেরে ফোন নাম্বারটা সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। বলেছিলেন---"সে অবিবাহিত। একজন বৈষ্ণবী খুঁজছেন। শিয়ালদাতে দরকারে এসেছিলেন। থাকেন শিলিগুড়িতে। বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। এক বোন ছিল অনেক বছর আগে তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। মাসে কেটে ছেঁটে লাখ টাকা আয় করেন।"
পরবর্তীতে মেয়েটি প্রেমে পড়ে তার। যে ঘরটি ভাড়া নিয়ে হাত দেখতেন, সেটি দেখিয়ে বলেছিলেন, নিজের ঘর। এক মন্দিরে মেয়েটিকে বিয়ে করেন। দশবর্ধনে মেয়েটিকে বাপের বাড়ি দিয়ে বাজারে যাওয়ার নাম করে সেই যে চম্পট দিয়েছিলেন, আর কখনো শিলিগুড়িতে যান নি।
তৃতীয় বিয়েটি মহাজাকজমকের সঙ্গে দিয়েছিলেন ভজকেষ্টর বাবা-মা। ছেলের যে আগে দুবার বিয়ে হয়েছে, সে খবর চাপা দিয়েই এক প্রকার বিয়ে দিচ্ছিলেন তারা। ভজকেষ্টর মনের মধ্যে ছিল অসীম আনন্দ। ঠিক বিয়ের দিন সন্ধ্যেবেলা তার আগের দুটি বউ খোঁজখবর নিয়ে তাদের বাড়ির লোকজন নিয়ে পুলিশ সহ এসে উপস্থিত হয়। তখন তৃতীয় মেয়েটিকে সিঁদুর দান করা হয়ে গেছে। হরনাথ অধিকারী অনেক চেষ্টা করেছিলেন মোটা টাকা দিয়ে কেসগুলো চাপা দেওয়ার জন্য। কিন্তু পারেননি। শেষমেষ বলেছিলেন--- "তিন বউ নিয়েই আমার ছেলে সংসার করবে। দ্রৌপদী যদি পাঁচ স্বামী নিয়ে সংসার করতে পারে, তবে আমার ছেলের তো মোটে তিনটি বউ।" সবার সামনে বৌমা তিনজন পায়ের থেকে জুতা খুলে হরনাথ ও ভজকেষ্টকে সকলের সামনে খুব করে পিটিয়ে দিয়েছিল। পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল বাপ-বেটাকে। পয়সার জোরে ভালো উকিল ধরে জামিন পেয়েছিলেন তারা। তবে মাসে মাসে থানায় হাজিরা দিতে হতো তাদের।
এত অপরাধ করেও ভজকেষ্ট ও হরনাথের মধ্যে কোন অনুশোচনা ছিল না। হাব-ভাব দেখে মনে হতো, 'মহান কাজ করেছেন তারা। মাসে মাসে মামা বাড়ি যেতে হয়।' মেয়েলি কেসে জড়ানোর পরও মেয়েদের প্রতি নজর একবিন্দুও কমে নি ভজকেষ্টর। শুধু কথায় কথায় বলেন--- 'রাধামাধব থাকতে আমার চুল কেউ বাঁকা করতে পারবেনা।' একশ্রেণীর মানুষ আজও সমাজে আছেন যাদের শত অপমানেও কোন পরিবর্তন হয় না। লজ্জা-ঘৃণা-ভয় কিছুই তাদের নেই। মানুষ ঠকাতে বুক কখনো কাঁপেনা। ধর্মকে আশ্রয় করে, ঈশ্বরের নাম নিয়ে দুর্নীতি করাই এদের কাজ।
=================
মিঠুন মুখার্জী
নবজীবন পল্লী, গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগণা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন