নিন্দা সহ্য করতে হয়েছিল বিশ্বকবিকেও
অনিন্দ্য পাল
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বকবি আখ্যা পেয়েছিলেন, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হয়ে বিশ্ববাসীর হৃদয় জয় করেছিলেন কিন্তু বাঙালির কাঁটার খোঁচায় বিদ্ধও হয়েছিলেন বহুবার। সমসাময়িক পত্রপত্রিকা এবং আলোচনা থেকে বোঝা যায়, একটা সময় বাঙলাদেশে রবীন্দ্রানুরাগীর তুলনায় রবীন্দ্রবিদ্বেষীদের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল।
১৮৯৬ সালের মে মাসে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত বিখ্যাত 'দাসী' পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের সদ্য প্রকাশিত কাব্যসংকলন "চিত্রা"র একটা সমালোচনা প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধের লেখক একজন অল্পবয়সী, মাত্র বছর তেইশের যুবক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। পরবর্তী সময়ে যাঁকে আমরা বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প ও উপন্যাস লেখক হিসেবে অত্যন্ত মুন্সিয়ানার পরিচয় দিতে দেখব। দেখবো বাঙালি তাঁকে বাংলা সাহিত্যের "রত্নদীপ" আখ্যা দিয়ে মাথায় করে রেখেছে।
তিনি লিখলেন, " যাঁহারা বাংলা সাহিত্যের সংবাদ রাখেন, তাঁহাদের মধ্যে এখন দুইটি দল। একদল রবীন্দ্রনাথের সপক্ষে একদল বিপক্ষে। প্রথম দলের অধিকাংশই সুশিক্ষিত মার্জিতরুচি নব্যযুবক - ইঁহারা সকলেই একপ্রকারের লোক। দ্বিতীয় দলে অনেক প্রকারের লোক - মনুষ্যের চিড়িয়াখানা।
(ক) বৃদ্ধ - তাঁহাদের কানে দাশু রায়ের অনুপ্রাস ভারতচন্দ্রের শব্দ পারিপাট্য এমনই লাগিয়া আছে, যে অপর কিছু একেবারে তুচ্ছ বলিয়া বোধ হয়… তাহা ছাড়া তাঁহাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ এক মহাদোষে দোষী - তিনি অল্পবয়স্ক যাহাকে এখন উলঙ্গাবস্থায় পথে খেলা করিতে দেখিতেছি, আমি বৃদ্ধ হইলে এবং সে যুবক হইলে যদি কেহ আসিয়া আমাকে বলে- দেখুন অমুক এমন হইয়াছে; হয়ত আমি বলিব - কে অমুক? আরে না না, ওসব বাজে কথা, বৃদ্ধের কাছে যাহা পুরাতন তাহাই প্রাণপ্রিয় মনে হয়, নূতন (তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী ভিন্ন) কিছুই ভালো লাগে না। সুতারাং নব্যকবির রচনা কেমন করিয়া ভাল লাগিবে?
(খ) প্রৌঢ় - ইঁহারা রবীন্দ্রনাথের কাব্যকে ছেলেমানুষী বলিয়া উড়াইয়া দেন, তাহার কারণ হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র ইঁহাদের হৃদয়বীণার যে তন্ত্রীগুলিতে আঘাত করিয়া টুং টাং শব্দ বাহির করিয়াছিলেন, সেই তন্ত্রীগুলিই এখন এমন ঢিলা হইয়া পড়িয়াছে যে, রবীন্দ্রনাথের আঘাতে ছড়ছড় শব্দমাত্র করিয়া থামিয়া যায়।
(গ) যুবক - যুবকের মধ্যে যাঁহারা রবীন্দ্রনাথের বিপক্ষে, তাঁহার কেহ কেহ ব্যর্থকাম কবি। ইঁহারা যাহা হইতে চেষ্টা করিয়াছিলেন, তাহা হইতে না পারিয়া যে হইয়াছে তাহার প্রতি নিন্দা করিয়া সান্ত্বনা ও আত্মপ্রসাদ লাভ করিয়া থাকেন। মানুষ যখন প্রতিযোগিতায় হারিয়া যায়, তখন যে জিতিয়া যায় তাহার প্রতি তাহার বিজাতীয় বিদ্বেষ হইয়া থাকে- এটা নিতান্ত স্বাভাবিক। আমাদের কলেজের কতগুলি যুবক অকালে নিতান্ত জ্যাঠা হইয়া পড়িয়াছে, তাহারা রবীন্দ্রনাথের নিন্দা করে। এই সকল যুবককে চিনিবার কতকগুলি লক্ষণ এখানে নির্দেশ করিতেছি। (১) তাহারা অশ্লীল কথা কহিয়া মনে করে ভারি রসিকতা করিলাম। (২) পথেঘাটে ভদ্রলোকের মেয়েছেলে দেখিলে কুৎসিত হাসি তামাশা করে। (৩) কোনও নূতন ভাল বিষয়ে কাহারও চেষ্টা দেখিলে তাহাকে বিদ্রূপ করে। … এটা আমি বিশেষ লক্ষ্য করিয়া দেখিয়াছি, যাহারা রবীন্দ্রনাথের ভক্ত, তাহারা ভারি গোঁড়া। কেহ যদি রবীন্দ্রনাথের বিপক্ষে একটি কথা বলিল, অমনি রণংদেহি রণংদেহি বলিয়া তাহারা গর্জন করিয়া উঠে। বোধহয় এই কারণেই যাহারা বিপক্ষে তাহারাও ঘোরতর বিপক্ষে। অনেক ছাত্রাবাসে রবীন্দ্রনাথের কবিতা সম্বন্ধে আলোচনা আরম্ভ হইয়া শেষকালে শত্রুপক্ষ মিত্রপক্ষে হাতাহাতি হইয়াছে শুনিয়াছি। অনেকে রবীন্দ্রনাথের পক্ষে যুদ্ধ করিতে এতই প্রস্তুত, যে সহসা মনে হয় লোকটা ম্যানিয়াগ্রস্ত। ইহার কারণ কি? বঙ্গের আর কোনও লেখকের ত এরূপ দৃঢ়বিভক্ত শত্রুপক্ষ-মিত্রপক্ষ নাই।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা সমুদ্রের মত বাহিরে দাঁড়াইয়া অপেক্ষা করিতেছে। যদি কাহারও হৃদয়বাঁধে একটু ছিদ্র থাকে, সেই পথ দিয়া অল্প অল্প জল প্রবেশ করিতে আরম্ভ করে। ক্রমে ছিদ্র আরও বড়, আরও বড়, আরও বড় হইয়া পড়ে, তখন হৃদয়টা জলপ্লাবিত হইয়া যায়। আর যাহার হৃদয়বাঁধে ছিদ্রই নাই, তাহার কোনও ল্যাঠাই নাই। তাহার ভিতর এক ফোঁটা জলও প্রবেশ করিতে পারে না। এমন লোক তর্ক করিয়া সেই সমুদ্রের অস্তিত্ব লোপ করিবার চেষ্টা তো করিবেই!!"
১৮৯৭ সালে প্রকাশিত হল রবীন্দ্রনাথের 'চৈতালি' কাব্যগ্রন্থ। এটাও পড়লো বিপুল সমালোচনার মুখে। এক তরুণ সাংবাদিক হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে চৈতালি কাব্যের এমন সমালোচনা করে বক্তৃতা করলেন যেটাকে সমালোচনা না বলে নিন্দা বলাই ভাল। এরপর 'দাসী' পত্রিকাতেও হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ চৈতালি কাব্যের ধারালো সমালোচনা লিখলেন। সেটা ছিল অত্যন্ত নিম্নস্তরের প্রবন্ধ - বিদ্বেষ ছাড়া যেটাতে আর কিছুই ছিল না। এ প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথকেও কষ্ট দিয়েছিল।
হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষের এই উৎকট সমালোচনা পড়ে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় অত্যন্ত রেগে গেলেন। তিনি সেই সময়কার বিখ্যাত মাসিক "প্রদীপ" পত্রিকার (বাংলা ১৩০৬ সনের আষাঢ় সংখ্যায়) লিখলেন একটা কবিতা। কবিতাটার নাম ছিল "একটি কুক্কুরের প্রতি" । এই কবিতাটা একটু অদ্ভুতভাবে পত্রিকার শেষ পাতার সঙ্গে জোড়া ছিল। একটা চৌকো কাগজে লেখা কবিতাটার উপরে একটা পাতলা সেলোফেন জাতীয় কাগজের আচ্ছাদন ছিল। এই কবিতাটা রবীন্দ্রনাথের ভক্ত এবং রবীন্দ্রনাথ বিদ্বেষী উভয়ের মধ্যেই একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে পেরেছিল। কবিতাটা এই রকম:
একটি কুক্কুরের প্রতি
চিরদিন পৃথিবীতে আছিল এক প্রবাদ
কুকুর চিৎকার করে চন্দ্রোদয় দেখি
আজি এ কলির শেষে অপরূপ একি
কুক্কুরের মতিভ্রম বিষম প্রমাদ।
চিরদিন চন্দ্রপানে চাহিয়া চাহিয়া
এতদিনে কুক্কুর কি হইল পাগল?
ভাসিছে নবীন রবি নভঃ উজলিয়া
তাহে কেন কুক্কুরের পরান বিকল?
নাড়িয়া লাঙ্গুলখানি ঊর্ধ্ব পানে চাহি
ঘেউ ঘেউ ভেউ ভেউ মরে ফুকারিয়া।
তবু তো রবির আলো ম্লান হোল নাহি,
নাহি হোল অন্ধকার জগতের হিয়া।
হে কুক্কুর ঘোষ কেন আক্রোশ নিষ্ফল
অতি ঊর্ধ্বে পৌঁছে কি কণ্ঠ ক্ষীণবল?
এই কবিতা পড়ে রবীন্দ্র বিদ্বেষীদের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী মুখপত্র "সাহিত্য"র সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি একটা চমৎকার মন্তব্য করলেন, " … কবিতাটির "রবি" ও "ঘোষ" এই দুইটি শব্দে বেশ বুঝা যায়, শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমালোচক কোনও ঘোষ ( শ্রীযুক্ত হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ?) ইহার লক্ষ্য। পবিত্র সাহিত্য ক্ষেত্রে এইরূপ মোসাহেবি ও মেছুনির ভাষার যুগপৎ আবির্ভাব দেখিয়া শঙ্কা হয়, আবার কি কবির গান ও খেউড় বাংলা সাহিত্যের আসরে অবতীর্ন হইবে? ভগবান রবিবাবুকে এই "অন্ধভক্তের" হস্ত হইতে রক্ষা করুন।
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির বিপক্ষে কোন কথা বলা যাবে না, এরকম কথা কোন উন্মাদও বলবেন না একথা নিশ্চিত। তবে সেই সময়ের পত্র-পত্রিকা পড়ে যতটা বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে যারা কলম ধরেছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই জ্ঞানী-গুণী মানুষ ছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকের রচনা বা সৃষ্টি আজও মানুষের কাছে সমাদৃত হয়। অথচ রবীন্দ্রবিদ্বেষীদের এই বিরূদ্ধতা তা কিন্তু নিদারুণ ভাবেই ব্যর্থ হয়েছিল। আসলে সেই সব সমালোচকদের বেশিরভাগ সমালোচনাই ছিল অত্যন্ত নিম্নস্তরের, উদ্ভট, উৎকট, কষ্টকল্পনা, অপ্রাসঙ্গিক, বিদ্বেষে পরিপূর্ণ এবং কখনো কখনো ন্যুনতম সাহিত্যিক সততার পরিপন্থী।
"বঙ্গদর্শন" পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ দায়িত্ব নিলেন, ১৩০৮ বঙ্গাব্দে। বছর চল্লিশের রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই নবপর্যায়ের বঙ্গদর্শন প্রকাশিত হতে থাকে। বঙ্গদর্শন পত্রিকার ১৩০৮ বঙ্গাব্দের বৈশাখ থেকে ১৩০৯ কার্তিক পর্যন্ত "চোখের বালি" উপন্যাসটা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। আর এই উপন্যাসের কয়েকটা ধারাবাহিক অংশ পড়েই সেই যুগের বিখ্যাত একজন সাহিত্যিক-সমালোচক এবং "সাহিত্য" পত্রিকার সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি রবীন্দ্রনাথের উপর একেবারে খড়্গ হস্ত হয়ে উঠলেন। "চোখের বালির" বিরুদ্ধে সাহিত্য পত্রিকার একটা সংখ্যায় বিরাট একটা সমালোচনা লিখলেন। তাতে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন, রবীন্দ্রনাথের হাতে বাংলাভাষাটারই বারোটা বেজে যাচ্ছে। উপন্যাসের সম্পর্কে বললেন, সেটা দারুণ অশ্লীল, লেখকের কল্পনাশক্তি বলে কিছু নেই। আরও অভিযোগ করলেন, এই লেখাটা আদৌ রবীন্দ্রনাথের নয়, অন্যের লেখা বেমালুম চুরি করে রবীন্দ্রনাথ নিজের বলে চালিয়েছেন।
লিখলেন, " আপতত মোটের উপর এই বক্তব্য, ভীরুতা, রুচিভ্রংশ, সত্যের অপলাপ, এবং সর্বপ্রকার সাহিত্য নীতির শৈথিল্য ষড়যন্ত্রে একজোট হইয়া রবীন্দ্রনাথের এই অতি কুৎসিত আখ্যানকে পূর্ণগ্রাস করিয়াছে। ইহার প্লট এবং নায়িকার নাম ও চরিত্রটি অপরের লিখিত ও পূর্বে প্রকাশিত একটি গল্পের নায়ক নায়িকা চরিত্রের অবিকল অনুকৃতি...। রবিবাবুর এই বই অতঃপর বঙ্গদর্শনে বাহির হওয়া বন্ধ হইলেই বোধ হয় ভাল হয়। তাঁহার এই চোখের বালি বঙ্গদর্শনের মুখে চুনকালী মাখাইয়া দিতেছে ।" এতেও ক্ষান্ত হননি তিনি, এরপরও তিনি জানালেন যে রবীন্দ্রনাথের এই 'চুরি' তিনি 'অক্ষরে অক্ষরে' ধরে দিতে পারেন। কিন্তু কেন সুরেশ সমাজপতি এই অভিযোগ করলেন? ব্যাপারটা ছিল এই রকম, "রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি" উপন্যাসটা প্রকাশিত হবার বছর খানেক আগে শ্রী পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের "উমা" নামে একটা উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল। এই দুই উপন্যাসের অক্ষরে অক্ষরে সাদৃশ্য হল উমার নায়িকাও বিধবা, চোখের বালির নায়িকাও বিধবা! আজকের দিনে দাঁড়িয়ে তাই রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে সুরেশ সমাজপতির প্লেজিয়ারিজমের অভিযোগ যে একেবারেই হাস্যকর তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু এই সমস্ত সমালোচনার মুখে রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? এর উত্তর পাওয়া যায় ১৩০৯ বঙ্গাব্দের ২০শে বৈশাখ আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের কাছে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটা চিঠি থেকে। সেখানে তিনি লিখেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে কোন বিদ্বেষমূলক মন্তব্য কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তিনি তো পড়েনই না, এমনকি আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদেরও ওই লেখা গুলো তাঁর সামনে আনতে বা ওগুলো সম্পর্কে আলোচনা করতে বারণ করেন। কারণ এতে তাঁর মানসিক স্থৈর্য বিচলিত হবার সম্ভাবনা থাকে।
===================
অনিন্দ্য পাল, চাম্পাহাটি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন