ভৌতিক গল্পের আড়ালে
সমীর কুমার দত্ত
স্টেশনের নাম বেলমুড়ি। হুগলী জেলার কর্ড লাইনে অবস্থিত একটি স্টেশন। এমন একটি নাম, যার উচ্চারণ উচ্চৈঃস্বরে কেউ কখনো করে না। কারণ কুসংস্কার বশতঃ জনশ্রুতি আছে —রাতের বেলায় ট্রেনে - কাটা পড়া ভূত ও শয়তান এই অঞ্চলে ঘোরাফেরা করে। কেউ তাই স্টেশনটির নাম উচ্চৈঃস্বরে উচ্চারণ করে না, করলে দুর্ভাগ্যের আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়ায়। হাওড়া থেকে কমবেশি ৪৬ কিমির মতো হবে।এই স্টেশনের নাম বলার প্রয়োজন পড়লে কেউ মধ্যবর্তী কোন নামের প্রক্সি দেয়।
এই স্টেশনের পূর্ব নাম ছিল —
'কৃষ্ণরামবাটি '। সুন্দর নাম নিশ্চয়ই। কালক্রমে ট্রেনে কাটা পড়ার সংখ্যা এতো বেশি হয় যে জায়গাটি ভৌতিক স্থানে পরিনত হয়।নামও পরিবর্তিত হয়ে বেলমুড়ি হয়ে যায়।এই স্টেশনে নেমে বাহাদুর পুর ও জৌ গ্রামের মাঝামাঝি গ্রামে বাসুদেব মেটে নামের এক ব্যক্তি কলকাতার বড় বাজারের এক কর্মস্থলে ডেলি প্যাসেঞ্জারী করে। বাড়ি থেকে স্টেশনে সাইকেল রেখে ট্রেনে করে হাওড়া। হাওড়া থেকে পদব্রজে কর্মস্থল। ফেরার সময় ওই একই ভাবে বাড়ি ফেরে। সকলে যে সময়ে ফেরে বাসুদেব সে সময়ে ফেরে না।ওভার টাইম করে লাস্ট ট্রেনে ফেরে। স্বভাবতই রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়।
অমাবস্যার রাত।হিমেল হাওয়া ছাড়তে শুরু করেছে।চতুর্দিক অন্ধকার হলেও ট্রেন চলাচলে ঠিকরে আসা আলো আর অদূরে উঁচু বাতিস্তম্ভ থেকে ক্ষীণ আলো এসে পড়ে রাস্তার বাম দিকের ঝিলের জলে । আর রাস্তার ডানদিকে কিছুটা দূরে আছে শ্মশান। কখনো সখনো দু একটা চিতা জ্বলতে দেখা যায়। এখনই স্টেশন চত্বর খাঁ খাঁ করছে। রাস্তাঘাট জনমানবশূন্য।
সেদিন বাসুদেব ট্রেন থেকে নেমে সাইকেলে চড়ে বাড়ির দিকে অগ্রসর হলো । কিছু দূর যাওয়ার পর ওর চলার রাস্তার সামনে দিয়ে একটা কালো বিড়াল,যার চোখ যেন জ্বলছে,রাস্তা কেটে দ্রুত বেরিয়ে গেল।কোন রকম ভ্রুক্ষেপ না করে বাসুদেব সাইকেল নিয়ে এগিয়ে চললো। কিছুদূর যাওয়ার পর বাঁ দিকের ঝিলের জলে সে যেন স্পষ্ট দেখতে পেল একটি বাচ্চা ছেলে জলে হাবুডুবু খাচ্ছে। একবার ভাবলো— কি না কি দেখেছে ।
এখন দেখতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। এমনিতেই ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে।রাতও অনেক হলো।তা
প্রায় ১২ টা হবে। এইসব ভেবে সে এগিয়ে যাচ্ছিল। কি মনে হলো —"যদি সত্যিই বাচ্চা ছেলে হয় ।আহা রে!"বলে আবার ফিরে এলো। তার মনে হলো, এ তো বাচ্চা ছেলে । যা ভাবা, সেই কাজ।ওর সঙ্গে একটা গামছা থাকতো। জামা কাপড় খুলে, সাইকেলটা গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে রেখে তার ওপর জামা কাপড় রাখলো। সাইকেলে চাবি দিলো না। রাতভিতে কেউ তো নেই ধারে কাছে। গামছা পরে সোজা নেমে গেল ঠান্ডা জলে। এমনিতেই কর্ম ঘর্মক্লান্ত ,বেশ আরাম লাগছিল। প্রথমে ওর মনে হয়ে ছিল
এই তো কাছে আছে ছেলেটি তারপর যতো সে এগিয়ে যায় ছেলেটিও এগোতে থাকে। এইভাবে অনেক সময় কেটে যায়।তারপর দেখে কেউ নেই। কোথায় গেলো ছেলেটা?
তার মনে হলো —এ কোন ভৌতিক ব্যাপার নয় তো ? ও কোন ভূত প্রেতের পাল্লায় পড়ে নি তো? কিছুটা ভয় পেয়ে ও জল থেকে উঠে এলো। উঠে দেখে আর এক বিস্ময়কর ব্যাপার।
সাইকেলে,মোবাইল ফোন,টাকার ব্যাগ কিছুই নেই।থাকার মধ্যে আছে জামা কাপড়। তো রীতিমতো অবাক হয়ে গেলো।কার পাল্লায় পড়লো রে বাবা।
বাসুদেবের গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল এই ভেবে যে সবকিছু খুইয়ে এতোটা পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে।তার ওপর আবার এই ভৌতিক উপদ্রব। রাস্তা জনমানবশূন্য কি আর করে জামা কাপড় ছেড়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। এবার ওর শীত শীত করতে থাকে।যাবার আগে পিছন ফিরে একবার দেখতে চেষ্টা করে। দেখে সেই কালো বিড়ালটি আবার ওর পিছনের রাস্তা কেটে চলে যায় শ্মশানের দিকে ।এবার সে পা চালিয়ে হাঁটতে থাকে। শ্মশানে তখন কোন চিতা জ্বলছিলো না। শ্মশান যেন কোন মৃতদেহের জন্য অপেক্ষা করছিলো।
এদিকে বাসুদেবের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা উদ্বিগ্ন হয়ে সদর দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছে আর নানারকম দুশ্চিন্তা করছে। ইতিমধ্যে স্টেশন সম্পর্কে রোমহর্ষক কাহিনীর সঙ্গে পাঠক পরিচিত হয়ে গেছেন। সুতরাং বাড়ির লোকের মনের অবস্থা কি হতে পারে তা পাঠক মাত্রই অনুভব করতে পারছেন। কিন্তু সাইকেল নিয়ে এগিয়ে দেখার মানসিক জোর না আছে ছেলের মধ্যে, না আছে বাড়ির আর কারোর মধ্যে। আতঙ্ক যেন তাদের তাড়িয়ে বেড়াতে লাগলো । বিপদজনক কিছু হলো না তো! বেশ কিছুক্ষণ পর একটা আবছা দেহ দূর থেকে এগিয়ে আসতে দেখা গেলো। ক্রমশঃ যতো কাছে আসতে লাগলো তত চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে এলো। স্ত্রী বলে উঠলো, "ওই তো তোর বাবা। কিন্তু সাইকেল কই?কিছু কি হয়েছে?"
বড়ো ছেলে বললো," হ্যাঁ,বাবাই তো।"
বাবা কাছে আসতে সকলে সমস্বরে জিজ্ঞাসা করলো, " এতো দেরি? সাইকেল কোথায়?"
বাসুদেব কোন কথা না বলে সোজা ঘরে ঢুকে গেলো আর সকলে বাসুদেবকে অনুসরণ করলো। ভিতরে ঢুকে সদর দরজা বন্ধ করে দিলো। ঘরে গিয়ে বাসুদেব সকল বৃত্তান্ত খুলে বললো। সব শুনে বাসুর বৌ বললো," তোমাকে কতোবার বলেছি, ওগো, অতো ওভার টাইম করো না। তা আমার কথা শুনলে তো।
—আমি সাধ করে ওভার টাইম করি? ওভার টাইম করি বলেই দুটো পয়সার মুখ দেখতে পাও ।
—তা জানি।কিন্তু এই রাতবিরেতে ভুত প্রেতের উপদ্রব, সেটাও তো দেখতে হবে। নাও নাও,রাত অনেক হয়েছে। আমি খাবার বাড়ছি বসে যাও।আবার তো সকালে বেরুতে হবে।
এখন হয়েছে কি, লাইনের ওপারে কেউ হয়তো এই পথ দিয়ে ফিরছিলো । সে ওই স্থানে সাইকেল,জামা কাপড় দেখে এবং আর কাউকে ধারে কাছে দেখতে না পেয়ে লোভ সামলাতে পারে নি। সাইকেল, মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ নিয়ে সোজা স্টেশনের দিকে চলে যাচ্ছিলো। হঠাৎ এক ছায়ামূর্তি লোকটির পথ রোধ করে দাঁড়ালো। ছায়ামূর্তি বললো, "যার জিনিস তুই চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছিস, সে এতো রাতে, ঠান্ডায় নিজের প্রানের ঝুঁকি নিয়ে একটা বাচ্চা ছেলেকে বাঁচাতে জলে ঝাঁপালো। যা ফিরিয়ে দিয়ে আয়।যেখানের জিনিস সেখানে রেখে আয়।তোর এই পাপের কাজের জন্য বাড়ি গিয়ে দেখবি তোর ছেলে আর বেঁচে নেই।" বলে সেই ছায়ামূর্তি অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো ।
লোকটি সাইকেল, মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ যা যা নিয়ে ছিল সব সেখানে যেমন ছিল তেমনি ভাবেই রেখে ভয়ে ভয়ে তার বাড়ির দিকে পা বাড়ালো ।
লোকটি আসলে চোর। চৌর্যবৃত্তি ওর পেশা। ভৌতিক উপদ্রবের মাঝেও রাতভিতে লোকের বাড়ি চৌর্যবৃত্তি করে বেড়ায়।লোকটি ভাবলো , ছায়ামূর্তি কি বলে গেল? ভাবতে ভাবতে সে বাড়ির দিকে দ্রুতপদে এগিয়ে যেতে লাগলো। ঘরে পৌঁছে দেখে তার অসুস্থ ছেলে তাদের ছেড়ে চলে গেছে। সে কান্নায় ভেঙে পড়লো।
শুতে দেরি হওয়ায় কারণে সকলেই প্রায় ঘুমে অচৈতন্য।কেবল বাসুদেব চোখ বুজে পড়ে ছিলো । সাইকেল,মোবাইল ফোন,টাকা পয়সা চুরি যাওয়ার কারণে সে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলো । ঠিক সেই সময় ছায়ামূর্তি বাসুদেবের সামনে এসে দাঁড়ালো। অন্ধকার ঘরের মধ্যে জাগ্রত বাসুদেব স্পষ্ট দেখলো ছায়ামূর্তি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাসুদেবের মুখ দিয়ে কোন কথা সরলো না। স্ত্রীকে ডেকে তুলবে তাও পারলো না।
ছায়ামূর্তি আস্তে আস্তে বলতে শুরু করলো, " ভোর হতে না হতে ঝিলের ধারে চলে যাবি।তোর সমস্ত ফেলে আসা জিনিস তোর জন্য অপেক্ষা করে আছে। আলো ফোটার আগে চলে যাবি, নইলে চোরের ওপর বাটপাড়ি হয়ে যাবে। তুই একটা বাচ্চা ছেলেকে ওই রাতে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বাঁচাতে জলে নেমে গেলি।
আর পেলি না, কেন জানিস ,ও হলো ,যে তোর জিনিস চুরি করেছিলো তার ছেলে। তার ছেলে তখন মারা গেছে। তাই তুই ওকে আর খুঁজে পাসনি। তবে তোর এই দুর্ভোগ কেন হলো, কারণ, কালো বিড়ালটি তোর রাস্তা কাটলো তোকে আটকাবার জন্য। আর তুই কিনা অবজ্ঞা করে চলে গেলি। তুই ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাবার পর পিছন ফিরে দেখেছিলি শ্মশানের দিকে রাস্তা কেটে বেরিয়ে যাওয়া সেই বিড়ালটাকে।ওই বিড়ালটাই হলো ওই শিশুটির প্রতিমূর্তি। শ্মশানের দিকে চলে যাওয়ার অর্থই হলো মৃত্যু সূচিত করা। আর যে তোর জিনিস চুরি করেছিলো, সে তার ছেলেকে বাঁচাবার চেষ্টা করেনি। তাই এইভাবে সে শাস্তি পেলো। আমি মৃত বা জীবিত সত্ত্বা নই। আমি হলাম বিবেক, যা সবার মধ্যে আছে, শুধু কাজে লাগায় না। বিবেককে জাগ্রত করার জন্যই শরীরী আত্মার ছায়ামূর্তির ভেখ ধরে আমার আর্বিভাব। মানুষ ভয় পেলে তবেই কারোর কথা শোনে। যতক্ষণ ভয় থাকে ততক্ষণ সে কারোর ক্ষতি করে না বরং উপকারই করে। কিন্তু আবার এই ভীতির সুযোগ নিয়ে কেউ যদি কারোর ক্ষতি করার চেষ্টা করে ,তার মধ্যেও ভীতির সঞ্চার করে তাকে তার কুকাজ থেকে বিরত করতে হয় এই ভেখ ধরে এসে। অনেক মহাণ মানুষ বলেছেন ভয়শূণ্য হতে।
কিন্তু কোন কিছুই শূণ্য হলে চলে না। ধর ,যদি ছেলেমেয়েরা তাদের পিতামাতাকে ভয় না করে, তবে তারা অবাধ্য হবে না কি? অথচ যাদের চরিত্র সুগঠিত তারা কখনও অবাধ্য হয় না। সুতরাং আগে চারিত্রিক গঠন, পরে ভয়শূণ্যতা। চরিত্র গঠনের সময় ভয়শূন্য হলে বিপথে চালিত হতে পারে।ভয় আর কিছুই নয়,ভয় হলো মান্যতা। " কথাগুলো বলে ছায়ামূর্তি অন্তর্হিত হলো।
ভোর হওয়ার পূর্বে কেউ জেগে ওঠার আগেই বাসুদেব ও তার বড়ো ছেলে সাইকেলে চড়ে
"বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর " প্রবাদে বিশ্বাস রেখে বেরিয়ে পড়লো। ঝিলপাড়ে গিয়ে তারা দেখলো তাদের জিনিস যথাস্থানেই আছে , যেমন ছিলো তেমন অবস্থায়। তারা উৎসাহিত হয়ে বলল, "অশুভ আত্মা যেমন আছে,শুভ আত্মাও তেমন আছে, যা মানুষকে সাহায্য করে।এদিকে সেই সন্তানহারা পিতা চলেছে মৃত সন্তানকে নিয়ে শ্মশানের পথে "বলো হরি, হরি বোল " ধ্বনিতে।
================
Samir Kumar Dutta
23/1/A, Mohanlal Bahalwala Road
P.O. Bally, Dist. Howrah 711201
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন