বায়া বাবাজী
গীতা রাউথ
ছেলে বয়স থেকেই অভাব অনটন নিত্য সঙ্গী।তখন সবে মাত্র তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে ধীরেন। বারিক পরিবারের মেজো ছেলে। মেধার খামতি নেই ছেলেটির মধ্যে।স্বয়ং মা সরস্বতী যেন তার মাথায় এসে বসেছেন ।
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনের পথে। হঠাৎ পিতা পরলোকগমন করেন। টিবি সংক্রামিত ছিলেন। শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যাও ছিল । পরিবার ঘোর অন্ধকারে ডুবে গেল।তিন ছেলের এখনও নাবালক কাটেনি।কিভাবে সংসার চলবে ।
পিতা রাজেন্দ্র খুব নম্র ও বিনয়ী ছিলেন ।সবার সাথে সদ্ভাব চোখে পড়ার মতো। বেশ নামডাক ছিল তাঁর।লোকের বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়তো সে। দিনমজুরি ছিল পেশা।জমিদার বাবুদের বাড়িতে কাজ করতে হতো পেটের জন্য।
"যারা যারা পয়সা এনেছে তারাই পরীক্ষা দেবে" -- কালী মাস্টার ক্লাসে হুকুম দিলেন।বাকিদের জন্য পরীক্ষা বন্ধ। তৃতীয় শ্রেণী থেকে চতুর্থ শ্রেণীতে তারা উত্তীর্ণ হতে পারবে না ।
অগত্যা ধীরেন বই স্লেট নিয়ে বাড়িতে চাল বস্তায় মুখ চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলো।
"কি হয়েছে নুনু বল" - মায়ের কোথায় কোন উত্তর দেয়না ছোট্ট ধীরেন।
অনেক জোরাজোরি করার পর বলে ," মা আমি আর স্কুল যাবো না।" মাষ্টার বলেছে যারা পয়সা দেয়নি তারা ফেল।পরের ক্লাসে উঠতে পারবে না।
লক্ষ্মীর ঝাপিতে চারআনা পরে আছে ।পরীক্ষার ফি কোথা থেকে দেবে চূড়ামণি?
পরে দিয়ে দেবো মাস্টারকে বলে দিবি যা।ধীরেন গোঁ ধরে বসে আছে ।কিছুতেই স্কুলে গেলো না।
পরে মা গিয়ে স্কুলে পরীক্ষার ফি দেয়।চতুর্থ শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে ধীরেন।
গোপালপুর গ্রামে হাই স্কুল নেই। চার কিলোমিটার দূরে বালিপুর হাই স্কুলে যেতে হয়।কিন্তু কিভাবে যাবে ? বাবা অকস্মাৎ গত হয়েছেন।বাড়িতে অভাব।অন্ন জোগাড়ের তোড়জোড় শুরু হয়।
অবিবাহিত কাকা সতীশ তিন ছেলের অবিভাবক হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করেন।মা কালীর সাধক ছিলেন সতীশ ।সবাই বাবাজি বলে ডাকে তাঁকে। ঘর সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস হওয়ার ইচ্ছে হয়েছে অনেকবার।কিন্তু অনাথ শিশুদের মুখের দিকে তাকিয়ে সে আর হল না।
কোনমতে চাষবাস করে সংসারের হাল টানে সতীশ।
পরীক্ষিত জমিদার একশত বিঘা জমির মালিক। জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত সরকারের নতুন আইন অনুযায়ী ব্যক্তিগত সম্পত্তি দশ বিঘার বেশি রাখা বেআইনি । সেই সূত্রে দাদা ও নিজের মিলিয়ে আড়াই বিঘা জমি চাষ করে কোনমতে সংসার চলে।
মা কালীর সাধনা করেন সতীশ।গুরুর নির্দেশিত পথে ঈশ্বর সাধনা করার ব্রতী নেন তিনি । রামেশ্বর নিকটস্থ পুরুষোত্তমপুর গ্রামে থাকেন রমাকান্তবাবু।অত্যন্ত ধার্মিক তিনি। মা কালীর একান্ত উপাসক ।
এই সপ্তাহ নিরুদ্দেশে থাকার পর মা কালীর মূর্তি নিয়ে বাড়িতে হাজির সতীশ। গেরুয়া পোশাক পরিহিত সন্ন্যাসী বেশ ধারণ করেছে সে। সেই থেকে তার নাম হলো সতীশচন্দ্র বাবাজী। নিজ হস্তে কালী পুজো করে এলাকায় নামডাক ছড়িয়ে পড়ে । অনেকে তাঁকে বায়া বাবাজি নামেও ডাকেন।
===================
গীতা রাউথ
বারোমানিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন