বর্তমানে শিল্পের আবর্জনার স্তূপ থেকে নিজেকে দূরে রেখে অন্ধকারের পথে দ্রিমিত কবি রাজাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়-এর নতুন কাব্যগ্রন্থ 'ভালবাসা মৃত্যুর মত সুন্দর।'
এর আগে তাঁর অপর দুটি লেখা কাব্যগ্রন্থ ' আমি বাড়ি ফিরিনি ' আর 'দীর্ঘশ্বাসের মত একা 'তে তাঁর কাব্য লেখনী প্রতিভার পরিচয় পেয়েছি । সাফল্যও দেখেছি সেই দুটির কাব্যের। এবারও যে তার ব্যতিক্রম হবে না পড়েই বুঝেছি ।
বাস্তবতা, পরাবাস্তবতার মিশেলে এক অদ্ভুত শৈল্পিক ভাবনা প্রচেষ্টা তাঁর লেখার ঘরানায় ফুটে ওঠে বার বার । আমরা যারা রোজ ক্ষত বিক্ষত হয়ে ... রোজ কয়েকবার নিজেদের আত্মা কে হত্যা করি,হতাশা, গ্লানি অভিমান অপমান ব্যর্থতা গুলো ট্রিগার টিপে তাক করে এগিয়ে আসে আমাদের দিকে, পৌঁছাবার আগেই আমরা নিজেরাই ছিনিয়ে নিয়ে গুলি চালিয়ে দিই কোনো সকাল কি বিকাল দুপুর কি মাঝরাতে... সেই তাদের জন্য এই কবিতা গুলো বোধায় থমকে জিজ্ঞাসা করে আমায় বুঝেছো তুমি?
হাসপাতালের কেবিন থেকে তীব্র আর্তচিৎকারে এর সময় মৃত্যুকে কাছে পাবার জন্য আকুল হয় মন, সুন্দর লাগে তখন মৃত্যুকে যেমন, হয়তো ভালোবাসাও ঠিক এমনই ! তার মৃত্যুর মতোই ছায়াপথ ঘেরা চির সুন্দর মুখ, শান্তি, স্বস্তি সাজানো তাতে !
একটু ভালোবাসা বদলে দেয় অনেক কিছু ! একটু ভালোবাসা জন্ম দেয় অনেক কিছুর,একটু ভালোবাসলেই এই পৃথিবীর ভিতর আরেক পৃথিবী গড়ে ওঠে , ভালবাসা পরের জন্মের জন্যও অপেক্ষা করায়।
ভালোবাসা পাওয়া দুর্লভ আজকের এই পাপের পৃথিবীতে ...। তাই ভালোবাসার একটা অনন্ত চাহিদা থেকেই যায় ,থেকেই যাবে !
তাই কবির আক্ষেপ ...
" তুমি নিজের কথা বললেই
শীতল হাত বন্দুক ঠেকিয়ে রাখে তোমার কন্ঠনালিতে
কবে যে শেষ পৃথিবীতে সূর্য উঠেছিল
রক্তাক্ত ক্লান্তি জানে উচ্চ রক্ত চাপ নয় ,
আরেকটু বেশি ভালোবাসা পেতেই পারতাম আমরা"
ইঁদুর দৌড় প্রতিযোগিতায় নাভিশ্বাস উঠতে থাকা
মানুষ দের দেখে কবির মনে ভাবনা ...
"সকাল বিকেল নিভছে জ্বলছে ,
শহর টার মতন
কতগুলো বছর হলো এই ভিড়ের মধ্যে ?
পাখির মতন ছুট্টে উড়ে বেরিয়ে পড়তে পারলেই হত,
সেটাই কি স্বাধীনতা ? "
"স্ক্যাম কবিতা প্রেম অপ্রেমের মাঝে চিত্র গ্রাহক বললেন স্মাইল প্লিজ । "
হাসি না থাকলে ছবি ভালো হয়না । ছবি কে সুন্দর করতে হয় হাসি দিয়ে যাতে ভিতরের অপ্রকাশিত কষ্ট গুলো না বোঝা যায় ।
কিন্তু কারো কারো হাসি আসে না । ছবি ভালো ওঠে না ।
মৃত্যুর খুব কাছে তারা যখন পৌঁছে যায় অনাবিল সুখে হাসি আসে ভীষণ তাদের সেদিন কিন্তু ছবি দারুন ওঠে ।( শুভ মৃত্যুদিন প্রিয়তমা )
গণ তন্ত্র কে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ছুঁড়ে দেওয়া কথা গুলো ...
" গণতন্ত্রের আকাশে চাঁদের মত ঝুলে আছে
হাজার হাজার অক্সিজেন সিলিন্ডার
তবুও শ্বাস নিতে পারছিনা
স্বাস নিতে পারেননি জর্জ ফ্লয়েড!"
( জর্জ ফ্লয়েড বলে কেউ ছিলেন না)
" বৃষ্টি নামলে বুঝতে পারি
পৃথিবীর জন্ম হয়েছে
রাত একা অপেক্ষা করে আমার জন্যে
পৃথিবীর ছায়া প্রবেশ করে আমার ভেতর "( অবোধ চোখ )
রাত ভর বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সত্যি তো পৃথিবী আবার জন্ম নেই । সুন্দর স্নিগ্ধ ...সবুজ শান্ত
আর সেই জন্ম তো মনেতেই হয় ,দেখার দৃষ্টিতে ...
কি সুন্দর কথা গুলো ....
তাই রাত অপেক্ষা করে একা সেই পৃথিবীর ছায়া নিয়ে ...
" পুরো পৃথিবী টা একটা আস্ত রেজিস্টার খাতা
আমার নাম নেই ,
বিনয় মজুমদারের না "( ব্যারিকেড)
উপেক্ষিত মানুষ ,কবি লেখক শিল্পী .সত্যি কি ব্যারিকেড ভেঙে এগোতে পারবে বা কেউ ভেঙে দেবে ওনাদের জন্য ! কে জানে ! হয়তো ! হয়তো বা না !
দূরত্ব বলতে বুঝি . "একটা ফাঁকা ক্যানভাস
একটা ফাঁকা সাদা দেওয়াল .."(পোস্ট ম্যানের ডেইলি সোপ) এক অসীম শুন্যতা যেন সে দূরত্বে। দূরত্বের রং কি সাদা ? হয়তো তাই! দূরত্ব মুছে গেলেই আবার সব রঙিন হয়ে ওঠে । দূরত্বে সব ঢেকে শুধুই সাদা... ! যেমন করে মৃত দের গায়ে সাদা চাদর ঢাকা থাকে। পৌঁছনো যায়না সে দূরত্বে।
সু সাইড টুরিস্ট এ বলেছেন
" সোনার চামচ মুখে দিয়ে না জন্মালেও হবে
মুখে সোনার কুলুপ বাধ্যতা মূলক
মুখোশের মতন।" ..
কথাটা আজকের অস্থির যুগে ভীষণ সত্য ।
আজ পর্যন্ত কত গুলো ছুরি আমাদের আঘাত করেছে আমরা মাঝে মাঝে দেখি তাদের কোনো গোপন ড্রয়ার খুলে , গুনি,সাজাই গুছিয়ে রাখি আবার ...কিন্তু পারিনা সেগুলো দিয়ে পাল্টা আঘাত করতে
"ছুরি গুলি নড়ে চড়ে বসে
কারো গায়ে লেখা বেইমানি ০৩.৪১
কারো গায়ে লেখা ভালোবাসা রাত ০৯.১৯
বন্ধুত্ব ,হেমন্ত কাল ,সকাল ০৮.২৬
ছুরি গুলি নড়ে চড়ে বসলে
সযত্নে ওদের কে সাজিয়ে রাখি "
( ছুরি দের দিন রাত্রি )
"পাখিটা আর ও উঁচুতে উড়তে চেয়েছিল
বুঝতে পারেনি আকাশ টা এক বিচ্ছিন্ন কারাগার।( প্যানচেটের আলো। )
যে কারাগার আকাশ থেকে আর ফেরা যায়না তাদের কে কি প্ল্যানচেটের আলোয় ধরা যায় ? জানা যায় কি কেনো ফিরতে পারছে না তারা?
পিতা সাহিত্যিক দেবাশিস ব্যানার্জি কে উৎসর্গ করে ধ্বংসের প্রতিযোগিতা তে লিখছেন ...
"কলকাতা মধ্যমেধায় ডুবে গিয়ে শুকনো ফুলের মালা গলায় পরে বসে আছে ।
ভুলে যেয়ো না খাঁচা ভর্তি পাখিদের আকাশে উড়িয়ে দিতে হবে তোমাকে।"
সস্তা জিনিসেই ভিড় বেশি ...এখন । মেধা হীন চটুল শিল্পী দের নিয়ে নাচানাচি চলে ! প্রতিভা এখানে উপেক্ষিত।
"মা কে বলতে ইচ্ছা করে
আমাকে এখান থেকে দূরে কোথাও নিয়ে চলো ।"
(মা, তুমি শান্ত স্বস্তির নিশ্বাস)
মা চিরকাল শান্তির জায়গা।
রুক্ষ শুষ্ক জমি দেখলেই
শুকিয়ে যাওয়া জলের রেখা খুঁজি আমি
ঠিক যেভাবে ভালোবাসা খুঁজি তোমার চোখে "
( গুল মোহর বাই লেন থেকে )
ভালোবাসা যখন প্রচণ্ড প্রয়োজন কারো সে বোধহয় এইভাবেই খুঁজে চলে ...!
কিংবা শহর পোকা তে ...
"এত নেশা করলে সমবৃতা
তবু তোমার নেশা হতে পারলাম কই ? "
মন দেখে ভালো বাসেনি যারা তাদের নেশা হয়তো কেটে যায় এক সময় !
"আমরা একে অপরকে কিছু না কিছু দিয়ে যাবই
ভালোবাসা ,ঘৃনা , সেপিয়া জীবন
অথবা সম্পর্কের রাজনীতি."..
( পার্সোনা নন গ্রাটা মোশন পিকচার )
যা চাই তা ভুল করে চাই যা পাই তা চাইনা ..
যোনি থেকে যোনি
রাস্তা থেকে ধূ ধূ রাস্তায়
পুরুষের কবিতায় ভুল ট্রেনের ছায়া এসে পড়ে
সূর্যের ছায়ার মতন!
কিসের টানে পুরুষ এত ভুল ট্রেনে চাপে? স্মৃতি হারাতে চায় পুরুষ ? হয়তো !
ঘুম এক বিশ্বস্ত ডায়েরি ...
অচেতন ঘুমের মধ্যে ভিতরে কি লেখা কাটাকুটি চলে তা খুব বিশ্বস্ত।কেউ জানতে পারে না । ....
বন্ধ চোখে যা আপণ
খোলা চোখে তাই স্বপন...
চোখ বন্ধের ওপাড়ে ভয় নেই কেউ ছিনিয়ে নেবে না নিশ্চিতে নির্মাণ হয় কত কিছু নিজের ।
সুশীল জীবনে কবি লিখছেন ...
"অন্তত একবার তুমি সুখী হবার স্পর্ধা দেখিও
ভুলে যেও তোমার চোখের নিচে
অন্ধকার গোটা একটা যুদ্ধের কথা "।
সুখী হবার মিথ্যা দেখানো যায় কিন্তু স্পর্ধা দেখানোর জন্য কত হিম্মত জোটাতে হয় কত দিন লাগে কে জানে !
নাথিং অফিসিয়াল। পিরিয়ড এ...
" রক্তক্ষরণ হয় আমারও
আমিও না গ্রাম না শহর না দেশ, মহাদেশ ছেড়ে দিয়ে দূরে থাকি কোথাও মনে মনে ..
আমি রমলা নই
হতে পারবো ও না
আজও আকাশে তারা ফুটেছে
দূরে কোনো ছায়াপথে কোনো গাঁওকোর জন্মায় নি,
কাপড়ের ভাঁজে নারীত্ব ঢাকার চেষ্টা করেনি ওরা ।"
সত্যি যদি মনের রক্ত ক্ষরণ এ কোনো ছায়া পথে চলে যাওয়া যেত ! কিন্তু নিঃশব্দে সে রক্ত ক্ষরণ বয়ে চলে । হাসতে হয় উঠতে হয় কাজ করতে হয় ।
" পুরুষ মানুষের জীবন সম্পূর্ণ হতে অনেক কিছু লাগে
যেমন ঝাপসা তারিখ
বিষণ্ণ চুম্বন
রং চটা লেটার বক্সে অপঠিত চিঠি
বর্ষা দুপুরে শান্তি নিকেতনের নির্জন রাস্তায় বাগান বাড়ি
সাদা কালো জীবন ,সাদা কালো টিভি
গোলাপি অ্যালজোলামের সঙ্গে নিটোল আড্ডা
সেপিয়া রঙের দু তিনটে ছবি ,ফটোফ্রেম
কুয়াশা মাখা হল্ট স্টেশন
অমিতাভ ও মৌসুমীর বৃষ্টিতে ভিজে রিমঝিম গিরে শাওন গান
অলস আলোছায়া দিনের পাহাড় ! ( পুরোনো হাতের লেখা )
বেশ সুন্দর ছিমছাম চাওয়া গুলোর সুন্দর ছবিটি মানস পটে চিত্রিত।
"শরীর জুড়ে থাকে জেদি ইনসমনিয়া।ইনসমনিয়ার পাশে শান্ত হয়ে বসে থাকে তরুণ ক্ষত।
এখানে ভালোবাসা মৃত্যুর মতো সুন্দর।"
"চলমান গল্পের ভেতরের অবয়ব হীন দেহ
ইওর অনার স্মৃতি হীন হতে চাই !"
( আমাকে ঘেন্না করো)
ঘেন্না করো আমায় এতটা যে, যেনো আসতে না পারি আর ফিরে ..
মুছে যাক সব স্মৃতি যেমন করে ঢেউ এসে মুখে বালু কণায় লেখা নাম আঁকা মুখ ! স্মৃতি যতদিন থাকবে শুধু কষ্ট ই মিলবে ! তাই স্মৃতি হীন হোক মন ।
এমন ই কত কত চাওয়া পাওয়া দেওয়া নেওয়া হিংসা হতাশা ভালোবাসা মন্দবাসা অপমান অভিমান এর গল্প গুলোকে কথা দিয়ে সাজিয়ে এনেছেন কবি ।আমরা সেখানে নিজের নিজের জিনিস গুলো কেউ পাচ্ছি কেউ না পেলেও অনুভব করছি অন্যের টা!
কি বলবো সিনেমার কবিতা না কবিতার সিনেমা ?
জানতে হলে পড়ুন ।
উনি বহু দিকে প্রতিভাধর ।আমরা ইতিমধ্যেই পরিচয় পেয়েছি অনেক কিছুর। তাই সেগুলো নিয়ে এখন বলছিনা । কবিতা ভালবাসেন?.ভালো কবিতা পড়তে আগ্রহী ? কাঁদতে চান খুব গোপনে. ভাবতে চান যদি ..পড়ুন এই বইটি ।
ধূসর বিকালে যে পাখি ডেকে আনে বৃষ্টি হয়তো সে রকম বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে যাবে অনেক কিছু ..
ভিতরের রক্তের নদীটিতেও বৃষ্টি এসে পড়বে টুপ টাপ... ভালবাসা কে তখন মৃত্যুর মত অপূর্ব সুন্দর লাগবে ।
কিংবা গহীন নির্জন অরণ্যে নীরবতার পিয়ানো যেমন সুর তোলে তেমনি বই টি পড়ার পর সেই অচেনা পিয়ানোর সুরের মতো একটা রেশ থেকে যায় ! ফুরোয় না ...!
বর্তমান সময়ের আমার প্রিয় কবি ও আমার প্রিয় বন্ধু কে জানাই অযুত শুভেছা ও অজস্র শুভকামনা । আগের প্রকাশিত বই গুলোর মতোই এই বইটিও সাদরে গৃহীত হোক পাঠক দের কাছে।
==============
বই- 'ভালবাসা মৃত্যুর মতো সুন্দর'
কবি - রাজাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
ধানসিড়ি প্রকাশনী
মূল্য ১৬০ টাকা ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন