বুদ্ধির মূলে জল
শম্পা পাত্র
প্রগতি ছাত্রাবাসটি কার্তিক মাইতির বাড়িতে অবস্থিত ।ভিন্ন ভিন্ন জেলা থেকে আগত ছাত্রেরা বিদ্যার্জনের জন্য প্রসিদ্ধ জগন্নাথ ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হয়েছে।লালগড়, বেলপাহাড়ী, হাওড়া, হুগলী, পাঁশকুড়া, গড়বেতা,ভিমগড়,চন্দ্রকোনা রোড,শালবনী,গোকুলপুর,সবং,পিঙ্গলা সহ ময়নার বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত ছেলেরা মিলে মিশে অধ্যয়নে রত।
প্রগতির কর্ণধার কার্তিক সামন্ত।মানুষটি সন্তান স্নেহে দ্বায়িত্ব সহকারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করেন।চন্দন রানা হলেন মেসের নৈশ প্রহরী। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তায় সমদৃষ্টিতে সবার লক্ষ্য রাখেন।
আষাঢ় মাস সবে শুরু ।গতকাল থেকে একনাগাড়ে বৃষ্টি হওয়ায় পুকুর ঝিল কানায় কানায় পূর্ণ।সাব-মারশেবিলটা বিকেলে চলছিল।ট্যাংকের জল শেষের পথে। ট্যাপকলে সেঁ সেঁ আওয়াজ হতেই সুবীরবাবু কৌমোদ্বীপ ওরফে বিজ্ঞানীকে হাঁক পড়েন ," বিজ্ঞানী পাম্পটা চালিয়ে দে তো"।
বিজ্ঞানী ছেলেটির পিতা গত হয়েছে।অভাবী মা অনেক কষ্টে ছেলেকে বলাইপন্ডা মেসে রেখে পড়ান। বুকে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে গ্রামের বাড়িতে দিন কাটান।মামা ঝাড়গ্রামে থাকে ।সরকারি হাসপাতালে কাজ করে সাথে টিউশনি পড়িয়ে সংসার চালায়।ভগ্নিপতি গত হওয়ার পর দিদির সংসারে প্রয়োজন মতো সহযোগিতার হাত বাড়ায়।
বিজ্ঞানী পাম্পের সুইচে প্রেস করে কোন কাজ হল না । সত্তর জন ছেলের স্নান,রান্না,টয়লেটের জল কোথা থেকে আসবে?ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছে না কেউ ।
কার্তিক সামন্ত - হ্যালো স্যার পাম্প খারাপ হয়েছে ।তাড়াতাড়ি বাড়ি আসুন।
কার্তিক মাইতির স্ত্রী - পরশুদিন যাবো।স্বামীকে ডাক্তার দেখাবো কাল।
সামন্ত বাবু ফোন কেটে দিয়ে রাগে গজগজ করতে থাকেন।
অগ্রিম সত্তর হাজার টাকা বছরের শুরুতে দিতে হয়েছে।
পাশের বাড়ির থেকে পাইপে করে জল নেওয়া হল। বালতি বালতি জল নিয়ে কোনমতে প্রাতকর্ম শেষ হল।
কাজের মাসি রান্নার জল চারটে বালতিতে রেখে দেন।
স্নানের জল কোথায় পাবে?
কার্তিক বাবু বিড়বিড় করে কি যেন বলতে লাগলেন।
নতুন ড্রাম কিনবে বলেও মনস্থির করেন।অনেক টাকা খরচ করতে হবে ।ভ্রু কুচকে ভাবতে লাগলেন তিনি ।
জল সংকটে প্রগতি ছাত্রাবাসে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠলো ।ময়না ঝিলের জন্য বিখ্যাত ।চারিদিকে ঝিল দ্বারা পরিবেষ্টিত মৎস উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ ।
লম্বা বেত ধরে সবাইকে নির্দেশ দেন -- " সবাই গামছা, তেল, সাবান নিয়ে বেরিয়ে আয় বাইরে।"
সবাই তো হতভম্ব।জল নেই এক চিলতে ।গামছা তেল নিয়ে কি করবে?
অত্যন্ত কড়া পরিচালক বলে পরিচিত । তাই ছেলেরা সাহস পেলো না প্রশ্ন করার।
তাঁর নির্দেশ মতো লম্বা লাইন দিয়ে বেরিয়ে পড়লো সবাই।৫০০ মিটার মতো হাঁটার পর ঝিলে পৌঁছে গেলো ।আষাঢ়ের প্রথম বর্ষায় জল টইটুম্বুর ।সাগ্রহে আল থেকে ঝাঁপ মেরে জলে ডুব দেয় সাগর, রণদ্বীপ সহ সকলেই।খুব আনন্দ করে মজা করলো সবাই।এমন স্নান কোনোদিন করেনি তারা।ঝিলের জলে নিজেদের শৈশব কৈশোরকে নতুন ভাবে চিনতে পারল সকলে।
স্নান হয়ে গেলো ।রাতের জল কোথা থেকে আসবে?
চন্দন বাবুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলছে ।বাজারে গিয়ে আঠারো ফুট বাই বারো ফুটের ত্রিপল কিনে আনেন।ত্রিপল নিয়ে কি হবে অনেকে মুখ টিপে হাসতে লাগলো ।স্নানের চাথালের পাশে বাঁশ মাটিতে পুঁতে দড়ি দিয়ে ত্রিপলটাকে বেঁধে দেন।বেশ চৌবাচ্চার মতো দেখতে লাগলো। পনেরোশো ষোলোশো লিটার জল ধরা কোনো ব্যাপারই নয়।সকালে পাশের বাড়ি থেকে শৃঙ্খল আকারে দাঁড় করিয়ে বালতি বালতি জল ওই ত্রিপল মোড়া চৌবাচ্চাটিতে ঢালতে থাকে।জলে ভরে উঠলো চারদিক। ঠেলায় না পড়লে বিড়াল গাছে ওঠে না।প্রতিকূল পরিস্থিতি বুদ্ধির গোড়ায় জল দেয়।চন্দন বাবু নিজের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটালেন এই চমকপ্রদ কাজের মাধ্যমে ।প্রগতির বুদ্ধির শেকড়ে জল পড়লো।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন