শ্যালিকা
প্রিশিতা পরী
গোপীনাথ মাহাতো জঙ্গল মহলের এক মেধাবী ও কৃতী ছাত্র ।বাংলা,ইংরেজি,গণিত,বিজ্ঞান , খেলাধুলা সবেতেই ব্যুৎপত্তি ছিল চোখে পড়ার মতো ।
বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির দ্বারা নির্বাচিত হন গোকূলপুর হাই স্কুলে। গণিত ও ভৌতবিজ্ঞান এই দুটি বিষয়ে শিক্ষাদান শুরু করেন দক্ষতার সহিত।মাত্র একুশ বছর বয়সে শিক্ষক হন।
উনার ক্লাস ছিল খুবই আকর্ষণীয় ও মনোগ্রাহী।
অমনোযোগী ছাত্রও মন দিয়ে শুনতো তাঁর প্রতিটি কথা। প্রত্যেক কথার মাঝে গল্প জুড়ে দিতেন। যার বেশিরভাগই বাস্তব ও জীবনমুখী। রোমাঞ্চ ছড়িয়ে থাকতো শব্দজালের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
মাঝে মাঝে মনে হত তিনি বাংলার শিক্ষক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প,কবিতার প্রতিটি লাইন ছিল নখদর্পণে । ঐতিহাসিক, পৌরাণিক, সামাজিক সমস্ত উপন্যাসের বিষয়বস্তু ও প্রধান চরিত্রগুলি তাৎপর্যের সাথে ব্যাখ্যা করতেন।
বিদ্যালয়ে একবার ভূগোল শিক্ষকের আকাল হয়।সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা। কিছুতেই শিক্ষক মিলে না। শেষমেশ গোপীনাথবাবুর ঘাড়ে দায়িত্ব এলো।কোন রকম নঞর্থক শব্দ শোনা গেল না তাঁর কাছ থেকে। সেবার চারজন চেকে ভূগোল লেটার মার্কস পায়।তখনকার দিনে লেটার মার্কস হাতে গোনা ছেলে মেয়েরা পেতো । সেরকম রেজাল্ট আর কোনো বছরই করতে পারেনি গোকুলপুরের ছাত্রেরা।
বি এড ডিগ্রি হতে না করেই চাকরি পান তিনি। NCTE নতুন করে নিয়মাবলীর সংস্করণ করে।শিক্ষকতার চাকরিতে বি এড বাধ্যতামূলক করা হয়।কর্মরত শিক্ষক শিক্ষিকাদের সরকারি উদ্যোগেই এক মাসের রেসিডেনসিয়াল ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়।
গোপীনাথবাবুকেও ভর্তি হতে হয়।বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা ট্রেনিং কলেজে অধ্যয়ন করতে থাকেন । হরিলাল দাস নামে এক প্রৌঢ় শিক্ষকও ছিলেন । গোপীনাথের সাথে হরিলালের বেশ ভাব জমে উঠলো । দু জনে একটা রুমে থাকেন।গোপীনাথ ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে যান হরিলাল।মনের কথা প্রকাশ করে ফেলেন নিঃসঙ্কোচে ।
"তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে করবে? তোমাকে আমার জামাই করার খুব ইচ্ছে ।"
হরিলালবাবুর কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলো গোপীনাথ।আপনার প্রস্তাব কখনোই বাস্তবে পরিণতি পাবে না।
কেন? আমায় মেয়ে ইংলিশে অনার্স।বর্তমানে সে প্রতিষ্ঠিত। মেদিনীপুরের এক বিখ্যাত স্কুলে চাকরিরতা। দেখতেও শুশ্রী। আশাকরি কেউ অপছন্দ করতে পারবে না ।মেয়ে আমার ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট।তোমার কিরকম মেয়ে চাই বাপু?
"আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে পারবো না।"
"তোমার ফোর হুইলার লাগবে?টাউনে জমি লাগবে? সব ব্যবস্থা করে দেব।চিন্তা করবে না।আমি আছি তো তোমার হবু শশুর।"
"ওসব কিছুই লাগবে না।বিয়ে আমি করবো না।" হাসতে হাসতে গোপীনাথ জবাব দেয়।
" ঠিক আছে তুমি আগে আমার মেয়েকে দেখো।তারপর সিদ্ধান্ত নেবে।"
পরদিন যথারীতি ক্লাস শুরু হল।হরিলালবাবু টিফিনের সময় ইশারা করে মেয়েকে দেখায় গোপীনাথকে। গোপীনাথ দেখে বেশ সুশ্রী চেহারা,লম্বা তন্বী, কেশধারী,চক্ষু টানাটানা।কিছুতেই গোপীনাথের চোখের পলক পড়ে না। বাপ ও মেয়ে বি এড ডিগ্রির জন্য একই কলেজে ভর্তি হয়েছে। হবু জামাই ও মেয়েকে সাক্ষাৎ করাতে পেরেছে।
হরিলালবাবু মনে মনে যারপরনাই খুশি হল।
এদিকে দুজন দুজনকে শ্বশুর জামাই বলে ডাকা শুরু করে দিয়েছে।কথাটি মেয়ে রুমানার কানে যায়।রমনা রেগে আগুন । বাবাকে উত্তম মধ্যম শুনিয়ে দেয়।
একদিন ক্লাস ছুটির সময় গোপীনাথ ও রুমনা মুখোমুখি হয়। সেইসময় হরিলাল একতলা থেকে নিচে নামলো।
"কি গো শ্বশুর? দেরি করছেন কেন? তাড়াতাড়ি আসুন।"
গোপীনাথের কথা শোনার পর যেন আগুনে ঘি পড়লো। তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল রুমনা।
"কে হে বাবু তুমি! তোমার তো সাধ কম নয়।আমাকে বিয়ে করার স্বপ্ন? পরের জন্মেও সম্ভব নয়।"
"আমি তোমাকে বিয়ে করব কে বলেছে ?" গোপীনাথ মুখের উপর জবাব দেয়।
রমনা -- "তাহলে আমার বাবাকে শ্বশুর বলছেন কেন?"
গোপীনাথ -- " আমি বিবাহিত ।আমার ছেলেও আছে ।তাই তোমার বাবাকে বলেছি এই বিবাহ হবে না "
রমনা - " বাবাকে শ্বশুর সম্বোধন করেন কেন?বাবা যদি শ্বশুর হয় আমি তাহলে তোমার কি হব?"
গোপীনাথ এক কথায় উত্তর দেয় --" তুমি আমার শ্যালিকা হও"।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন