বাংলা সাহিত্যে প্রবন্ধের উৎপত্তি ও ব্যাপ্তি
শ্যামল হুদাতী
প্রত্যেক প্রবন্ধে কোন কিছু প্রতিপাদ্য বিষয় থাকে। প্রবন্ধ সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে দর্শন, ইতিহাস, জ্ঞান বিজ্ঞান, সমাজ রীতিনীতি, সাহিত্য শিল্পকলা প্রভৃতি বিষয় চিন্তা মূলক গদ্য প্রবন্ধে ফুটে ওঠে। বাংলা সাহিত্যে প্রবন্ধের অবদান অপরিসীম। সাহিত্য সৃষ্টিতে যুক্তির সাহায্যে কোন বক্তব্য প্রকাশ করে এবং সাহিত্য রসে সঞ্চার করে। এখানে লেখকের ব্যক্তিগত খেয়াল খুশির প্রকাশের কোন সুযোগ নেই। যথেষ্ট তথ্য প্রমাণের সমাবেশ, ভাবে, ভাষায় চিন্তায় প্রয়োগের সেই প্রতিপাদ্য বিষয়কে রূপদান করাই প্রবন্ধের লক্ষ্য।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে প্রবন্ধযুগ শুরু হয় নাথ ধর্ম এবং নাথ সাহিত্যের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এই ধর্মকে কেন্দ্র করে রাজা মানিকচন্দ্র, তাঁর স্ত্রী ময়নামতি ও পুত্র গোপিচাঁদ অনেক প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। তবে অধিকাংশ মৌখিক আকারে ছিল পরে লিখিত রূপে আমরা পাই। সেই সময়কার অনেক লেখা বিশ্বভারতী থেকে পঞ্চানন মন্ডল "গোরক্ষবিজয়" নামে প্রকাশ করেন। অধিকাংশই ৩০০ বছরের অধিক পুরানো নয়।
মুদ্রণের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল গদ্য প্রবন্ধ সাহিত্য সৃষ্টি। গদ্য সাহিত্যের রচনার পেছনে কেরী সাহেবের অনুপ্রেরণা ছিল যথেষ্ট। এই সময় রাজা রামমোহন তাঁর বেদান্ত ও উপনিষদের অনুবাদ ও সহমরণ-নিবর্তন সম্পর্কিত পুস্তকগুলি প্রবন্ধ আকারে রচনা করেছিলেন। তা ছাড়াও তিনি গৌড়ীয় ব্যাকরণ ও লিখেছেন। সেই সময় উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের 'রাজাবলি' ,হরপ্রসাদ রায়ের 'পুরুষ পরীক্ষা', উইলিয়াম কেরীর 'ইংল্যান্ড দেশের বিবরণ', মিল সাহেবের 'ভারতবর্ষীয় ইতিহাস' ,কালাচাঁদ বসুর 'সহমরণ' ,ভারতচন্দ্রের 'বিদ্যাসুন্দর' ও 'অন্নামঙ্গল' রামমোহন রায়ের অনেক গ্রন্থ।
১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে লং সাহেব তার সংগৃহীত প্রবন্ধ গ্রন্থাবলীর একটি তালিকা প্রকাশ করেছিলেন তাতে মোট ৯১৭ খানা প্রবন্ধ ছিল। সেই সময় মুদ্রিত পুস্তকই শিক্ষা বিস্তারে বড় সহায়ক হয়েছিল।
বাঙালি সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা, সাহিত্য ও প্রবন্ধের অগ্রগতিকাল আমরা উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগকেই ধরি। এই সময় মদনমোহন তর্কালঙ্কার ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অসামান্য অবদান চিরকাল মনে রাখবে সবাই। সমাজ সংস্কারক প্রবন্ধ লিখে রাম নারায়ন তর্করত্ন ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এক বৈপ্লবিক প্রভাব সৃষ্টি করেছিল। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে রামনারায়ণ তাঁর 'কুলীনকুলসর্বস্ব' প্রবন্ধ লিখে সনাতনী সমাজের ওপর এক প্রচন্ড আঘাত হলেন। এই লেখার দ্বারা তিনি প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করলেন যে জন্মের সঙ্গে কৌলিন্যের কোন সম্পর্ক নেই।
১৮৫৮ থেকে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে মধুসূদন, রঙ্গলাল, বঙ্কিমচন্দ্র, দীনবন্ধু, গিরিন্দ্র মোহিনী, বিহারীলাল, হেমচন্দ্র, কেশব চন্দ্র, শিবনাথ ও ভূদেবের লেখা অলংকৃত করেছিল।
১৮৮৫ থেকে ১৯০৪ পর্যন্ত সময়কালে নবীনচন্দ্র, গিরিশচন্দ্র, রাজকৃষ্ণ, কামিনী রায় লেখকদের প্রবন্ধ রচনার মধ্যে আমরা মুক্ত চিন্তাধারার প্রভাব লক্ষ্য করি। এই যুগে বাংলা চিন্তা ধারাকে নতুন দিগন্তের দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন- তাঁর মধ্যে ছিলেন বিবেকানন্দ, দীনেশচন্দ্র, রমেশচন্দ্র, অক্ষয়কুমার সরকার প্রমুখ প্রবন্ধকার। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হয়েছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ।
১৯০৫ থেকে ১৯১৯ পর্যন্ত সময়কালে আমরা বাংলা সাহিত্যের নায়ক হিসাবে দেখি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ক্ষীরোদপ্রসাদ, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, অনরূপা দেবী, বিপিনচন্দ্র পাল, রমেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, অরবিন্দ, প্রমথ চৌধুরী, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে। এই সময় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল উদ্বোধন পত্রিকা, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, সবুজপত্র, প্রভৃতি পত্রিকা সমূহ। এই যুগেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার।
১৯১৪ থেকে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে অধ্যাপক বিনয় কুমার সরকার তার পাঁচ হাজার পৃষ্ঠা ব্যাপী 'বর্তমান জগৎ' প্রবন্ধ লিখে বাঙালি পাঠককে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সমাজ সংস্কৃতি, শিক্ষা, ইতিহাস, শিল্প ও রাজনীতির সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন। এই যুগে শিশু সাহিত্য রচনা করেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার, যোগীন্দ্র সরকার, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও সুকুমার রায়। ১৯১৪ সালে প্রমথ চৌধুরী মহাশয় তার সবুজপত্র চলতি ভাষায় প্রবন্ধ রচনা করে নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করেন। এই সময় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নারীর মূল্য, পল্লীসমাজ,চরিত্রহীন ও শ্রীকান্ত প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯১৯ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শ্রীকান্তের দ্বিতীয়,তৃতীয় ও চতুর্থ পর্ব, বামুনের মেয়ে, পথের দাবী প্রভৃতি বিখ্যাত উপন্যাস প্রকাশিত হয়। এই সময় প্রবন্ধকারের মধ্যে উল্লেখনীয় নিরুপমা দেবী, রাজশেখর বসু, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম,কালিদাস রায়, রজনীকান্ত দাস, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সতীন্দ্রনাথ ভাদুরি, নরেন্দ্র দেব, মোহিতলাল মজুমদার, অন্নদাশঙ্কর রায় ,বুদ্ধদেব বসু, জসীমউদ্দীন, যোগেশ রায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, সৌমেন্দ্র নাথ ঠাকুর, যোগেশ চন্দ্র রায় প্রমুখ। এই যুগে পুরুষদের মধ্যে জনপ্রিয় লেখক ছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সৌরীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় এবং মহিলাদের মধ্যে প্রভাবতী দেবী সরস্বতী ও রাধারানী দেবী। এ যুগের শেষের দিকে আবির্ভূত হয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধ সান্যাল, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, সতীন্দ্রনাথ মজুমদার, প্রফুল্ল চন্দ্র সরকার, সুভাষচন্দ্র বসু, দিলীপ রায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অচিন্ত্য সেনগুপ্ত, সুনীতি চট্টরাজ, সুকুমার সেন প্রমুখ। এই যুগের লেখার বৈশিষ্ট্য ছিল বিদ্রোহী মনোভাবের প্রকাশ।
সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় সাহিত্য ক্ষেত্রে প্রতিফলন ঘটিয়েছেন 'বেদান্ত গ্রন্থ' 'গোস্বামীর সহিত বিচার', 'প্রবর্তক ও নিবর্তকের সংবাদ' প্রভৃতি গ্রন্থে চিন্তার বলিষ্ঠতা সুস্পষ্ট বিদ্যমান।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কারমূলক প্রবন্ধাবলী এবং বেনামীতে রচিত গ্রন্থসমূহ বিদ্যাসাগরের বিশিষ্ট ভাষারীতির পরিচায়ক। তাঁর প্রবন্ধে কোন কোনটিতে যেমন যুক্তি তর্ক বিচার বিশ্লেষণের পরিচয় আছে তেমনি কতগুলোতে হাস্যপরিহাসময় মনোভাবেরও বিকাশ ঘটেছে।
সুচিন্তিত প্রবন্ধকার হিসাবে ভূদেব মুখোপাধ্যার নাম উল্লেখযোগ্য। 'সফল স্বপ্ন' ও 'অঙ্গুরি ও বিনিময়' রচনা করে ঐতিহাসিক প্রবন্ধের স্রষ্টা হলেও তিনি পারিবারিক প্রবন্ধ, সামাজিক প্রবন্ধ, বিভিন্ন প্রবন্ধ রচনা করেছেন।
রাজনারায়ণ বসু সেই সময়কার একজন বিখ্যাত প্রবন্ধকার। সমাজ ধর্ম ও সাহিত্যের বিষয় অবলম্বনে তিনি বহু প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন যেমন 'মেকাল আর একাল' , 'ব্রহ্ম সাধন' ইত্যাদি। তাঁর আত্মচরিত্র এক বিখ্যাত গ্রন্থ।
কালীপ্রসন্ন ঘোষ চিন্তা মূলক প্রবন্ধ লিখে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিলেন তাকে পূর্ববঙ্গের বিদ্যাসাগর বলা হয়। তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থের মধ্যে 'নারী জাতি বিষয়ক প্রস্তাব' ও সমাজ শোধনী সমাজ সংস্কার সম্পর্কিত।
শিবনাথ শাস্ত্রী দেশের তৎকালীন সকল প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ জ্ঞানগর্ভ সমাজবিজ্ঞানমূলক মূল্যবান প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধে রামতনু লাহিড়ীর কাহিনী বর্ণনা সহযোগে তৎকালীন বাঙালি জীবনের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যের সমস্ত শাখায় সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রবন্ধ শাখায়ও যুগান্তর এনেছিলেন। তাঁর যাদু স্পর্শে বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যে আন্তর্জাতিক গৌরবময় স্তরে উন্নত করেছিলেন। তাঁর প্রবন্ধ অনুভূতি স্নিগ্ধ কবি মনের মধুর স্পর্শে রহস্য সমৃদ্ধ সাহিত্যকর্মে রূপায়িত হয়েছে। তিনি লিখেছেন সাহিত্যতত্ত্ব, সমালোচনা, ধর্ম, দর্শন, সমাজ, শিক্ষা, চরিতকথা, আত্মস্মৃতি, ভাষাতত্ত্ব, ভ্রমণ কাহিনী, চিঠিপত্র প্রভৃতি নানা বিষয় অবলম্বনে বিপুল আকার প্রবন্ধ সাহিত্যের বিকাশ ঘটিয়েছেন।
প্রমথ চৌধুরী ভাষারীতি অভিনব প্রয়োগে তিনি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। সবুজপত্র নামে বিখ্যাত সাহিত্য পত্র সম্পাদনের মাধ্যমে তার অবদান সাহিত্যের ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । 'তেল নুন লাকড়ি', বীরবলের হালখাতা, নানা চর্চা ইত্যাদি প্রবন্ধ গ্রন্থে তার যুক্তিনিষ্ঠ ও সংস্কার মুক্ত মনের পরিচয় পাই।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্গদর্শন নামে বিখ্যাত সাহিত্য পত্রে প্রবর্তনের মাধ্যমে তিনি বাংলার সমালোচনা সাহিত্যে অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি করেছেন। জাতীয় সংস্কৃতি ও সমাজ জীবন অবলম্বনে তিনি অজস্র প্রবন্ধ রচনা করেন। তার প্রবন্ধের বক্তব্য বিষয় পরিবেশনের গুণে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞান সাহিত্য সমাজতত্ত্ব দর্শন ইতিহাস প্রভৃতি সকল বিষয়ে রচনা স্থান পেয়েছে। তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থগুলি - রহস্য কমলাকান্তের দপ্তর ও মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত, বিজ্ঞান রহস্য, কৃষ্ণ চরিত্র ও ধর্মতত্ত্ব।
আধুনিক যুগের প্রবন্ধ মানব চিন্তাকে বড় ধর্ম রূপে উদ্দীপ্ত যুক্তিভিত্তিক মনোভঙ্গি গ্রহণ করে নতুন আঙ্গিকে আত্মপ্রকাশ করেছে। আধুনিকতার ধারণা স্বভাবতই গতিশীল ও ধাবমান। একটু যদি আমরা পিছিয়ে যাই, দেখতে পাই ফরাসি বিপ্লবের পরে "মানুষের অধিকার", "মানবতা বোধ" অনেক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিল। চন্ডীদাস অনেক আগেই বলেছিলেন, "সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই"।প্রবন্ধের বিষয়বস্তু আর দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, এখন আর্টের বিচারে, রসের বিচারে প্রবন্ধের মানদণ্ড অনেক কম - জীবন দর্শনে প্রতিফলিত ঘটেছে তার ব্যাপ্তি।
------------------------------
Shyamal Hudati
P.A.Shah Road,
Kolkata - 700068
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন