''কর্তব্য"
তপন কুমার মাজি
'গেঁয়ো যোগী ভিখ্ পায় না'- এই প্রবাদটি যে কত
বাস্তব তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে
পেরেছে নিভারাণী এই কদিনে। এক হাতে অন্ধ স্বামী আর অন্য হাতে ভিক্ষার বাটি নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে কোথাও সে খুঁজে পায়
নি এক ফোঁটা দয়া। এমনই হৃদয়হীন এই পাষাণ সমাজ। গত তিন দিনে
ভিক্ষার পরিবর্তে তাদের কপালে জুটেছে শুধুই লাঞ্ছনা গঞ্জনা আর অপবাদ। দারিদ্র বাধ্য করেছে তাদের নিজের এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে।
সমাজের চোখে নিভারাণী ব্যভিচারিণী। যৌবনে সে নাকি নগ্নতাকে
পুঁজি করে শিক্ষিকার মুখোশে রোজগার করেছে দু'হাতে প্রচুর। এমন কি সামান্য টাকার লোভে নিজের শরীরের নগ্নতাকে নির্লজ্জভাবে চরম শিখরে পৌঁছে
দিতে বিন্দুমাত্রও অসম্মান বোধ করেনি কখনো।
কিন্তু দুঃখের বিষয় যাঁরা একটা সমগ্র জাতি তথা দেশের সৃষ্টি
ও কৃষ্টির ধারক ও বাহক সেই মহিমময়ী নারীদের
শুধু অবহেলিতই হতে হয় না, স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে তাদের বিতাড়িতও হতে হয় চিরতরে সমাজ থেকে---
হারিয়ে যেতে হয় দেশের ইতিহাস থেকে। সেই সমস্ত হতভাগিনী
নারীদের মধ্যে একজন হলেন নিভারাণী, যিনি জন্ম থেকেই ছিলেন শারীরিক প্রতিবন্ধী। একটু পরিশ্রমেই
হাঁপিয়ে পড়তেন, বোধহয় সেই কারণেই দয়া পরবশ হয়ে তারিণী
বাবু ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন একদিন তাঁকে। কিন্তু বিধাতা তাদের কপালে বেশিদিন সুখ লেখেনি বলে বিয়ের মাস ছয়েক পরেই তাদের জীবনে নেমে এসেছিল ভয়ঙ্কর
বিপদ। দৈব দুর্বিপাকে কোন এক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে চিরদিনের মতো তাঁর স্বামী তারিণীবাবুকে হারাতে হয়েছিল দুটি চোখ। জীবন জীবিকার প্রশ্নে
পরিস্থিতির চাপে পড়েই হয়তো নিভারাণীকে এমন একটা পথ বেছে নিতে হয়েছিল। তবে যে যা-ই বলুক না কেন মাসিক দু'হাজার টাকার বিনিময়ে 'দেবা-দেবী'র সংসারটাকে কনোওরকমে টিকিয়ে রাখার একটা সুযোগ যে পেয়েছিলেন নিভারাণী, সে কথা বলা যেতেই পারে, সে ক্ষেত্রে নিভারাণী বড়ই সৌভাগ্যবতী। অবশ্য শরীরের সম্পূর্ণ নগ্নতা প্রদর্শনের
খাতিরে কখনো কখনো জুটতো একটু বেশি অর্থ-- মাত্র পঞ্চাশ
টাকা। ছাত্রদের সামনে তাঁর শরীরের উলঙ্গতার দাম এমনই।
কিন্তু যে দেশ বা সমাজ শিল্পের বড়াই করে, শিল্পকে পুঁজি করে দেশে বিদেশে নিজেদের সম্মানকে তুলে ধরার জন্য
প্রতিযোগিতার আসরে নেমে পড়ে, কোটি কোটি টাকা জলাঞ্জলি দেয় নিজেদের শিল্পের
শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে সেই দেশ বা সমাজ কি একবারের জন্যও জানার চেষ্টা করে সেই শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাকগ্রাউণ্ডে যাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি তাদের
আত্মবিসর্জনের সঠিক মূল্য কত ? সেই ইতিহাস একবারের জন্যও জানার প্রয়োজন বোধ করে না
এই সভ্য সমাজ।
এক সময় যাঁরা
ছিলেন নিভারাণীর শিক্ষার্থী তাঁদের অনেকেই আজ দিকপাল। তাঁদেরই মধ্যে একজন শুভঙ্কর মহাশয়- নিভারাণীর একমাত্র
শুভানুধ্যায়ী ডঃ শুভঙ্কর চ্যাটার্জী যিনি দেশের বুকে সাম্প্রতিক
কালের একজন খ্যাতনামা পোর্ট্রেট শিল্পী।
তিনি যখন কলকাতা বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে আসছেন ঠিক সেই সময় ভাঙা ভাঙা স্বরে তাঁর পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল,
----বাবু, তিনদিন হোল কিছু খাই নি। দয়াকরে যদি আমায় কিছু সাহায্য
করেন--
শুভঙ্করবাবু পিছন
ফিরতেই ভিক্ষার বাটি হাতে ভিখারিণীকে চিনতে পেরে তাঁর উন্নত মস্তক লজ্জায় একেবারে হেঁট হয়ে গেল। তিনি ফেটে
পড়লেন ক্ষোভে ও দুঃখে। কেন তাঁকে দেখতে হোল তাঁর মডেল
শিক্ষিকার এমন দৈন্য দশা? শিক্ষিকার প্রতি সমাজ ও দেশের অকর্মণ্যতার কথা ভেবে নিজের অজান্তেই
শুভঙ্করবাবুর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল,
---"... কি বিচিত্র এই দেশ !"
দুঃখ হোল তাদের
প্রতি, যারা হাততালি দেয় শিল্পীর কীর্তিকে অথচ
লাথ মারে শিল্পজন্মার পেটে !
নিতান্ত কৃতজ্ঞতার খাতিরেই নিজের উপার্জিত টাকার বিনিময়ে
বয়সের ভারে জর্জরিত বৃদ্ধ দম্পতিকে একটা
বৃদ্ধাশ্রমের ব্যবস্থা করে দিলেন শুভঙ্করবাবু। অশ্রু ভারাক্রান্ত নয়নে শিক্ষিকার আদর্শ ছাত্রটি স্টাট দিলেন গাড়িতে এবং সাউণ্ড-সিস্টেমে
"ও আমার দেশের মাটি তোমার 'পরে ঠেকাই মাথা"
গানটি শুনতে শুনতে
রওনা দিলেন বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে। (সমাপ্ত)
-------------------------------------------------------------
Tapan Kumar
Maji, c/o A.K. Basu.(NIGAMALAYA),
Court more,
Hindusthan park, St.no -- 1, P.O- Chelidanga, Burdwan(w), Asansol-- 713304,
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন