“অ-নারীবাদী”
পারিজাত
১)আর এই মোড়টা ঘুরলেই বড়রাস্তা। সেটা পেরোলেই রাস্তার ডান হাতে পড়বে শ্রবণার বাড়ি।
একটু তাড়াহুড়ো করেই হাঁটতে শুরু করলাম। ইশ, বড্ড দেরী হয়ে গেছে। ঠিক দশটার সময় শ্রবণা পৌছে যেতে বলেছিল ওর ওখানে। ওর যা সময়ের বাতিক, আমি নিশ্চিত, এতক্ষণে তৈরী হয়ে ও ঘরবার করতে শুরু করেছে। অবশ্য, আমারই বা তেমন উপায় কোথায় ছিল? মলি-টা সকাল থেকে এমন বমি শুরু করল - সবদিক সামলিয়ে তবে তো বেরোনো!
ও হো, যাঃ, আমার তো প্রেসক্রিপশনটা আনাই হয়নি! ভাবলাম যে ফেরার পথে ওষুধ কটা কিনে ফিরব! এমা! এত ভূলোমন হচ্ছে না আমার বয়স বাড়ার সাথে সাথে! ধুৎ! ভাল্লাগে না একদম!
দেখেছেন! আলাপটাও ঠিকমত সাড়া হয়নি, আর আমি বসে গেলাম আমার হাঁড়ির খবর বলতে আপনাদের সামনে! আমি মল্লিকা। শুধু মল্লিকা ডাকলেই চলবে — ওই পদবীতে তেমন কিছু এসে যায়না আমার। আর তাছাড়াও, তেমন করে আমাকে চেনার আর সুযোগ পাবেন কখন? তার আগেই তো মোড়ের মাথায় পৌছে যাব আমি! দেখছেন না, কত জোরে হাঁটছি! আপাতত ওইটুকু পরিচয় দিয়েই কাজ চালিয়ে নেবেন, কেমন?
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। কুড়ি মিনিটের হাঁটা পথ। একটা ট্যাক্সি তো নেওয়াই যেত। নিলাম না, মূলত দুটি কারণে — এক, সকাল সকাল ওই ট্যাক্সিওয়ালাদের ভনিতা করে ‘যাব না’ বা ‘কিছু বেশী দিয়ে দেবেন” গোছের কথাবার্তা পোষাবে না। অার দুই এবং অবশ্যই প্রধান কারণ, মলির জন্য এখন এমনিতেই অনেক খরচ আমার। এসময়ে অত বিলাসিতা ঠিক মেনে নিতে পারবনা কিছুতেই।
গত একমাস যাবত ভুগছে মেয়েটা। পেটে একটা ছোট্ট টিউমার পেয়েছে ডাক্তাররা। খুব তাড়াতাড়ি অস্ত্রপচার প্রয়োজন। কিন্তু কোনোভাবেই সেরকম করে টাকার যোগান হচ্ছে না। তাই-ই এতদিন পর শ্রবণার ওখানে যাচ্ছি। দেখি, ও যদি কিছু ব্যবস্থা করতে পারে! ওর তো একটা এন জি ও রয়েছে। মেয়েদের জন্য করে টরে। আর শ্রবণা মেয়েটাও তো ভালো। আমি জানি, পারলে ওই পারবে।
খুব কম দিন তো হোলোনা শ্রবণাকে চিনি আমি। অমন ধারালো চকচকে মুখ আমি আগে কখনও দেখিনি। ওর প্রতিটি কথায় মেয়েদের জয়গান। ওর স্পষ্টবাদিতার জোরেই আজ ও একজন স্বনামধন্য নারীবাদী।
সেই কোন স্কুলে পড়ার সময়ে থেকেই তো দেখেছি।পাশে থেকেছি ওর! কোনো মেয়ের কিছু হলেই ওর কেমন যেন অস্বস্তি হতে থাকে ভিতর ভিতর। ধর্ষণ থেকে বধুহত্যা থেকে যাবতীয় নিপীড়ন— সবকিছুতে এগিয়ে গিয়ে শুধু প্রতিবাদ করাই নয়, একেবারে আন্দোলন গড়ে তোলে এই অগ্নিপ্রভা।
প্রতিবছর ৮ই মার্চ ধুমধাম করে উদযাপন করে নারীদিবস। সকালে প্রভাতফেরি, তারপর বেশ কিছু বক্তৃতা, সভা, বিকেলের দিকে কোনো অনাথাশ্রম বা পতিতালয়ে উপহার সামগ্রী নিয়ে যাওয়া— আরও যে কত কি আয়োজন করে মেয়েটা একা হাতে, বিশ্বাসই হয় না সবসময়। এমন একজন মহীয়সী নারী যে আমার বান্ধবী — এই ভাবনাটাই বড় আনন্দ দেয় আমায়। ওর সাথে কত ঘুরেছি, এদিক ওদিক দৌড়েছি এককালে - এখন ভাবতে বসলে মনে হয়, কত জন্ম আগের কথা! তেমনই এক জমায়েতের সময়ই তো — যাগগে, থাক বরং আজ ওসব কথা। কথায় কথা বাড়বে। দশটা কুড়ি এমনিতেই বাজে।আর দেরী করব না। ওই তো ওর লাল রঙের বারান্দাটা দেখা যাচ্ছে। এগোলাম আমি, কেমন?
২)
“আরে মল্লিকা যে! এসো এসো। বাড়িতে ভালো তো সবাই?”
মল্লিকা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে অঞ্জলি মাসিমাকে। “হ্যাঁ মাসিমা। সব ভালোই তো। ওই, শুধু মেয়েটার জন্য আজ ছুটে এসেছি এতদূর। শ্রবণা বাড়ি আছে তো?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। যাও না ওপরে। ও নিজের ঘরেই আছে। তবে তৈরি হচ্ছে। দশ পনেরো মিনিটেই বেড়িয়ে যাবে বোধহয়। কি বলল, কোন রিফিউজিদের একটা দল আসছিল বেড়া টপকে, তাদের মধ্যে বেশ কিছু মেয়ে আর বাচ্চাও ছিল। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে গিয়ে নাকি অকথ্য অত্যাচার করেছে। ওই নিয়েই এক সমাবেশ আছে আজ ধর্মতলায়।”
মল্লিকা ঠোঁট কামড়ায়। “ইশ! কি সব হচ্ছে আজকাল! সত্যিই! ভাগ্যিস শ্রবণার মতো মেয়েরা তবু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে মেয়েগুলোর পাশে— নয়তো —”
অঞ্জলি মাসিমা হাসেন। “সেই! সে হিসেবে আমি তো তাহলে রত্নগর্ভা! তবু কি জানোতো মল্লিকা, সব রত্নের কি আর ওভাবে বাইরেটা দেখে বিচার করা যায় সবসময়? যাগ্গে, উপরে যাও। আমি বরং চা পাঠানোর ব্যবস্থা করি একটু।”
মল্লিকা দোতলায় উঠে আসে। এবাড়ির প্রতিটি ঘর, কোণ ওর ভীষন রকম চেনা। কত রঙিন বিকেল যে একসাথে কেটেছে ওদের এইখানে, সত্যিই, হাতে গুনে তা শেষ করা যাবে না! কোনো বড় কাজের আগে এখানেই বসত তাদের আলোচনা, কত রাত পার হয়ে যেত - তবু কাজ ফোরাতো না। জনসেবার কাজের কি আর শেষ হয় কখনো?
ঘরের পাল্লাটা সামান্য ভেজানো ছিল। মল্লিকা হাট করে খুলে দিল তা পুরোনো দিনের চেনা ছন্দে। শ্রবণা পিছন ফিরে দেখে নেয় তাকে। “ওহ, তুই! আমি ভাবলাম, মা! আসলে দরজায় সাড়া না নিয়ে ঢুকে এলি তো, তাই!” শেষ কাঁটাটা খোঁপায় গুঁজে নেয় শ্রবণা।
সামান্য থমকায় মল্লিকা।তারপর অপ্রস্তুত হাসি হাসে কোনোমতে - “আমারই ভূল রে। আসলে মাসিমা বললেন তুই বেড়িয়ে যাচ্ছিস, তাই তাড়াতাড়িতে আর অতো সব খেয়াল করিনি।”
পুরোনো সেকেলে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকায় শ্রবণা। “সাড়ে দশটা বাজছে মল্লিকা। তোর কখন আসার কথা ছিল বলতো! আমায় আর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই কিন্তু বেরোতে হবে। আমি আজকের সমাবেশের প্রধান অতিথি। দেরী করতে পারব না। ”
মল্লিকা মাথা নাড়ে। “হ্যাঁ হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। শুনলাম মাসিমার কাছে সব। উফ্, আমার যে কি গর্ব হচ্ছে না তোকে নিয়ে! আমি তো মলিকে প্রায়ই বলি, বড় হয়ে ও-ও যেন তোর মতো অন্য সব মেয়েদের পাশে দাঁড়ায়। প্রকৃত অর্থেই হয়ে ওঠে নারীবাদী।”
শ্রবণা হালকা গোলাপি লিপস্টিকটা মনোযোগ দিয়ে লাগাতে থাকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। “আর কিন্তু ঠিক দু মিনিট আছে।কি দরকার বল! নয়তো, সময় ফসকে যাবে তোর হাত থেকে মল্লিকা!”
মল্লিকা হাসে। মাথা নিচু করে দাঁড়ায় ক্ষাণিক। “শ্রবণা, মলির পেটে একটা টিউমার ধরা পড়েছে। ডাক্তার খুব তাড়াতাড়ি অপারেশনটা করে নিতে চাইছে। বলছে, ফেলে রাখা ঠিক হবে না। তোর তো এতো চেনাজানা, দেখবি একটু কোনোভাবে কোনো সাহায্যের ব্যবস্থা —”
শ্রবণা ঘুরে দাঁড়ায়। চোখে চোখ রাখে মল্লিকার। “ আমি বুঝতে পারছি মল্লিকা। কিন্তু তোকেও তো কিছু বুঝতে হবে, তাই না! ভালো করে ভেবে দেখ, এখন মলির ব্যাপারটা তেমন আর ফুটেজ খাবে না। তখন সময়টা অন্য ছিল। সবে সবে ধর্ষণের ঘটনাটা ঘটেছে। তার উপর একা সন্তান জন্ম নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিস তুই— তখন যেভাবে তোকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদ বা সভা সমাবেশ গড়া যেত, এতদিন পর আর তা সম্ভব না, তাই না!এতদিন পর মিডিয়া আর এসব ব্যাপারে মাথা ঘামাতে চাইবে না। তার উপর এটা ঠিক নারীবাদী কোনো এন জি ও র কাজের আওতায় তো পড়ে না। তুই বরং মলিকে নিয়ে কোনো সরকারি হাসপাতালে চলে যা। ওখানে অনেক কম খরচে অস্ত্রোপচার করে দেবে ওরা। ভাবিস না। যাগ্গে, বুঝলি, আমি বেরোই বরং এবার।”
অঞ্জলি হাতে চায়ের কাপ আর এক প্লেট মিষ্টি নিয়ে ঢোকেন। “ওমা, এখনই বেরোবি কি? এই তো মেয়েটা এলো সবে! একটু চা টা খেতে দে আগে ওকে!”
বিছানার উপর থেকে ব্যাগটা তুলে নেয় শ্রবণা। “হ্যাঁ হ্যাঁ। মল্লিকা থাকুক না আরও কিছুক্ষণ। আমার তো বসার সময় নেই মা। আমি চললাম। চলি রে মল্লিকা! চিন্তা করিস না। মলি ঠিক ভালো হয়ে যাবে।”
মল্লিকা হাসে। “সে তো বটেই! তবে আমি কি চাই জানিস, অপারেশনের পর ওর পুনর্জন্ম হোক। কেবল মেয়ে হিসেবে না, বেঁচে উঠুক ও মানুষ হিসেবে। দেখিস, ঠিক ওভাবেই ওকে গড়ে তুলব এবার আমি!”
শ্রবণা চমকায় সামান্য। তারপর কোনো উত্তর না দিয়ে সোজা বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে দ্রুতগতিতে।
অঞ্জলি ট্রে টা টেবিলে নামিয়ে রাখেন। মল্লিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন সামান্য। “আমি কিছুই ভুলিনিরে মা। কিভাবে ওই পতিতালয়ে আমার মেয়েটাকে বাঁচাতে গিয়ে তুই শয়তানগুলোর লালসার শিকার হয়েছিলি— কিভাবে মাথা উঁচু করে তাও একা মা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে জন্ম দিয়েছিলি মলির, সব মনে আছে রে আমার। বিশ্বাস কর, আমার চোখে তুই-ই কিন্তু আজও সত্যিকারের নারীবাদী!”
মল্লিকা মাথা নাড়ায়। “না মাসিমা!আজ বুঝলাম, নারী নয়, আমি সারাজীবন শুধু মানুষ হতেই চেয়েছি। মেয়ে বলে বা মেয়েদের জন্য আলাদা কোনো সহানুভূতি বা পক্ষপাত চাইনি, মানুষ হিসেবেই যোগ্য সম্মান কুড়োনোর চেষ্টা করেছি খালি।আমায় বরং তুমি ‘অ-নারীবাদী’ বলে ডেকো, কেমন — তাতেই আমি খুশি।”
৩)
আরে আপনারা এখনও দাঁড়িয়ে এখানে? যাক, ভালোই হল। এতটা পথ, দিব্যি অন্তত গল্প করতে করতে চলে যাওয়া যাবে।
আজকে জানেন তো, অনেকদিন পর মনে হচ্ছে নিশ্বাস নিতে পারছি।নিজের পূর্ণবয়স্ক মননে আবার নতুন করে জেগে উঠছে চেতনা। আজ একটা শব্দবন্ধও তৈরী করে ফেলেছি ঠিকঠাক সময়ে, জানেন?‘অ-নারীবাদী’। ভালোনা? ভেবে দেখলাম, ভূলই হতো যদি মেয়েটার অস্ত্রোপচারের জন্য শ্রবণা সাহায্য করত আমায়। পরে ওই মেয়েই তো বলতো, “কেন মা? শুধুমাত্র মেয়ে বলে আমি সুযোগ নিলাম কেন? যেটুকু সুযোগসুবিধা মানুষ পায়, সেটুকু পেলেই তো আমিও খুশি হতাম!তাই না!”
না না, মলির ওই কটুকথা শোনার থেকে এই ভালো হল, খুব জোর বাঁচিয়ে দিল শ্রবণা।
ও বরং থাকুক ওর জোর করে রাঙানো মেয়েলি দুনিয়ায় — আমি সেসময় গড়ে তুলব মলিকে আমার একান্ত নিজস্ব মানুষ তৈরীর কারখানায়!
ওহো, বাস এসে গেছে দেখছি।মেয়েটা একা। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে তো। চলি তাহলে, কেমন?
__________________________________
@পারিজাত
Currently residing at Sydney, Australia
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন