ও নদী রে
প্রিয়ব্রত দত্ত
সুন্দর একটা রিং- টোনে মোবাইলটা বেজে উঠতেই বিবেক হাতে নেয় ফোনটা| একটা অচেনা নম্বর |
—হ্যালো, কে বলছেন ?
— হ্যালো , বিবেক আমি তুহিনা বলছি |
সহসাই যেন স্মৃতির ঝরাপাতা উড়ে যেতে লাগলো বিবেকের চোখের সামনে থেকে |
এতগুলো বছর পর তুহিনা যোগাযোগ করতে পারে সেটা ভাবতেই পারছে না বিবেক | কলেজ জীবন থেকেই ওর সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক |
—আচ্ছা আমাকে সত্যি ভালোবাসো ?শরীর আর মনের গভীরতায় পৌছাতে পৌছাতে প্রশ্ন করেছে তুহিনা |
—হ্যা গো, সত্যি ভালোবাসি, ট্রু লভ্ সোনা, তুমি ?
— আমিও | ভালোলাগার আশ্লেষে আপ্লুত হতে থাকা তুহিনার সংক্ষিপ্ত উত্তর |
—সারাজীবন ভালোবাসবে তো ?
বিবেকের চোখে কী দেখতে পেলো কে জানে? বললো , কেন, তোমার বিশ্বাস হয় না ?
—হয় গো হয় | বিশ্বাসই তো সব |
—হুম্ | সব সময় বিশ্বাসটা রাখবে | আমার ওপরে মাঝে মাঝে অবিশ্বাস করো বলে মনে হয় ...
—তাই ? মুচকি হাসে বিবেক| কেন জানো?
—কেন ?
—কারন আমি তোমায় এত গভীরভাবে ভালোবাসি যে তোমাকে হারাবার ভয় পাই |
—আমি তোমারই থাকবো সারাজীবন | ভয় পেয়ো না |
— সত্যি ?
— সত্যি |
— আজ নীল শাড়ীতে দারুন লাগছে তোমায় |
—তাই ! ভ্রু নাচিয়ে বলে তুহিনা |
—হ্যা সোনা, বলতে বলতে তুহিনার নীল আকাশে ডুবে যেতে থাকে বিবেক |
গভীরে
যেতে যেতে হঠাৎ যেন চৈতন্য ফিরে আসে বিবেকের |কয়েকদিন ধরে যোগাযোগ করছে না
তুহিনা |ফোনে দু একবার সংযোগ হলেও অল্প সময়ের জন্য কথা হয় |
—এখন
বাড়ির পরিস্থিতি খুব খারাপ, বাইরে বেরুতে দিচ্ছে না| ফোনে কথা বলছি কি না
নজর রাখছে সবাই | তুমি ভালো থেকো| সময় হলে আমি ঠিক যোগাযোগ করবো |
ভিতরে ভিতরে ছট্ ফট্ করতে থাকে বিবেক |
তুহিনার
অনেক ছেলেবন্ধু আছে | ভালোরকম মেলামেশা আছে| তাদের ই কারোর সাথে প্রেম
নেই তো ? না কি সত্যিই অসুবিধার মধ্যে আছে ও ! বিবেক যতই চাকরি করুক,
তুহিনার বাড়ির লোক ওকে খুব একটা পছন্দ করেনা | তার জন্যেই কি ? কিন্তু
আজকালকার দিনে চাকরিজীবি ছেলে কটা পাওয়া যায় ? এইরকম একটা সুপাত্র হাতছাড়া
করবে ওর বাড়ির লোকেরা?
—তুমি কেন এমন করছো বলো না?এত কথা হতো , এত দেখা হতো আমাদের| তুমি কি চাও না আমার সাথে আগের মত করে থাকতে ?
—আমার কিছু করার নেই | তুমি একটু ধৈর্য্য ধরো, বিশ্বাস রাখো|
তুহিনারএই
উত্তরে ওর অসহায়তার ছবিটাই স্পষ্ট হয়ে উঠলো বিবেকের কাছে |সময় গড়িয়ে যেতে
থাকে, পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তনই দেখতে পায় না সে | আবার খারাপ চিন্তাগুলো
জড়ো হয়|সত্যি কি ভালোবাসে তুহিনা ওকে ? নাকি সবই ছলনা ছিল ? হয়তো অন্য
কারোর সাথে জড়িয়ে পড়ছে ও ....
অসহ্য মানসিক যন্ত্রনার
মধ্যে তলিয়ে যেতে থাকে বিবেক | সে তুহিনাকে প্রকৃত ভালোবাসে |তবু কেন মাঝে
মাঝে ঘৃণা আসে, রাগ আসে? কেন ক্ষোভে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করছে তার ? ওর মনে
হয় এক্ষুনি তুহিনার বাড়িতে গিয়ে ওকে সব জিজ্ঞাসা করে, কিন্তু তুহিনার
সতর্কবানী মনে পড়ে, আমি যতদিন না আমাদের বাড়িতে যেতে বলবো তুমি আসবে না |
আমি সব ব্যবস্থা করে তবে তোমাকে ডাকবো |না হলে আমার বাড়ির লোক তোমাকে মেনে
নেবে না | যখন সময় হবে আমি ঠিক তোমায় জানাবো | আর একটা কথা আমরা যখন দুজন
দুজনকে সত্যি ভালোবাসি, তাই মনে রাখবে যা হবে দুজনার ভালোর জন্যেই হবে|
প্রকৃত ভালোবাসা হলো যাকে ভালোবাসো সে যেন ভালো থাকে | নিজেকে বোঝায় বিবেক |তুহিনার যদি এতেই ভালো হয় তবে তাই হোক |
ও
আর যোগাযোগ করবে না | তুহিনাই জানাবে বলেছে ওকে| দিন মাস বছর পেরিয়ে গেলেও
যোগাযোগ করে নি বিবেক| সে যে আর পাঁচজনের মতো চাওয়া পাওয়ার ভালোবাসায়
বিশ্বাসী নয় |সে তার প্রকৃত ভালোবাসার অপেক্ষায় থাকবে |
তবে
বেশি নয় বছর দেড়েকের মধ্যেই বন্ধু মারফৎ একজন প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ারের
সাথে তুহিনার বিয়ের খবর পেতেই দেরি করেনি বিবেক | সেও বিয়ে করে তনিমাকে |
তুহিনার মতো তত সুন্দরী নাহলেও একটা অন্যরকম সৌন্দর্য্য আছে তনিমার | ভালো
লাগে বিবেকের|
এই কয়েক বছরে ভালোবাসা দিয়ে তুহিনার স্মৃতি ভুলিয়ে দিতে পেরেছে তনিমা |
কিন্তু আজ তুহিনার গলার চেনা স্বরে সব স্মৃতি ভেসে উঠছে আবার |
—কেমন আছো ? খুব শান্ত গলায় প্রশ্ন করে বিবেক |
— ভালোই| তুমি কেমন আছো ?
তুহিনার গলার স্বরে বিষন্নতার আভাষ পায় বিবেক |
—আমি বেশ ভালোই আছি | কথাটা শুনতে হয়তো তোমার খারাপ লাগছে ...
—না, তা কেন , তুমি ভালো থাকো ঈশ্বরের কাছে এটাই আমি চেয়েছি সারাজীবন...
—
তা চাইতে পারো, তবে সত্যি বলতে সব যন্ত্রনা ভুলতে অনেক সময় লেগেছে আমার
|তুমি এমন কেন করলে বলো না ? আমাকে দেওয়া সমস্ত কথা মিথ্যে প্রমান করে দিলে
কেন ?
— আমি কিছুই মিথ্যে প্রমান করি নি বিবেক |জানি
এতসব ঘটনার পরে তোমার অবিশ্বাস স্বাভাবিক|তুমি হয়তো বুঝবেনা এই
বিশ্বায়নের যুগেও ফ্যামিলির মানুষগুলোর মন রাখতে গিয়ে আমি আমার সুখ
স্বাচ্ছন্দ বিসর্জন দিতে পারি| তুমি হয়তো বুঝবে না , একজন সফল ইঞ্জিনিয়ারের
সাথে বিয়ে হলেও, সব পেয়েছির দেশে থেকেও আমার মনের গভীরের বিষাদের বীজ ধীরে
ধীরে মহীরূহে পরিনত হতে পারে |
আর সেখান থেকে ডিভোর্স পর্যন্ত হতে পারে তার কারন ও তুমি হয়তো বুঝবে না |
বিবেক কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে| তারপর বলে, আমি বোঝার চেষ্টা করছি তুমি বলো |
—তুমি
হয়তো ভাববে আমি এখন বিপদে পড়ে তোমার কাছে ফেরার চেষ্টা করছি |সেই রকম
ভাবনার কারন নেই | আমি আমার বাবা মায়ের, ফ্যামিলির আর সকলের কথা , আমার
সংসারের কথা ভেবে তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারি নি | এই সহজ সরল কথাটাও
তোমার দৃষ্টিভঙ্গিতে অন্যরকম মনে হতে পারে | কিন্তুএটাই সত্যি | আর এটা
তোমার জানা দরকার তাই জানালাম |
—এতদিন পর ?
—হ্যা
| এতদিন পর| কারন আমার কাছের মানুষজনদের মন রাখতে গিয়ে আমি এতদিন ধরে
অন্য খাতে নদীকে বইতে দেওয়ার চেষ্টা করে গেছি | কিন্তু এটাই বুঝেছি জোড়
করে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা যায় না | সে যাক, একটা কথা জিজ্ঞাসা করা হয়নি,
তুমি বিয়ে করেছো নিশ্চয় বিবেক ?
বিবেক মনের গভীরে কোথাও পাথরের বুক চিরে জলস্রোতের শব্দ শুনতে পায় | এই নদীর স্রোত তার খুব চেনা |
***********************
প্রিয়ব্রত দত্ত, বর্ধমান
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন