দিনুদির ভূত অভিজ্ঞতা
গল্পটা! ভূতের। দিনুমনিদির জীবনে ফেলে আসা, সেই অতিতের ঘটে যাওয়া একটা সত্য ঘটনা। আমি আর কি! তার ছেলেমেয়েদের টিউশন পড়াই, দিদিই একদিন ডেকে বলেছিল, এই সুমিত ইউনিভার্সিটিতে পড়ছিস তাই না, আমি বললাম, হুম দি! দিদি বলল, ফাকা সময় এদিক সেদিক না ঘুরে আমার ছেলেমেয়ে দুটোকে পড়ালেই তো পারিস?, তাতে তোর হাত খরচাটাও হবে, বাপমা 'র কাছে আর কত চেয়ে বসবি বল? তাই আর কি! দিনুদির কথায় সায় দিলাম, ভাবলাম ঠিকই তো বাপমা'য়ের ঘারে বসে আর কত চাইবো?
একদিন বিকেলবেলা টিউশন পড়াচ্ছি, বাতাস নেই, খালি খালি আঙিনায় একটা আম গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ল হুরমুড়িয়ে। আমি বললাম, এ আবার কি হল? হাওয়া বাতাস কিছুই তো নাই?আর অমনি অমনি তরতাজা ডালটা পড়ল? সন্দেহ লাগছে আমারও। দিদি তখন আমার জন্য চা তৈরী করছিল, কিচেনে থেকেও দিদির কানে ডাল পড়ার শব্দটা গেল, কিচেন থেকে বেরিয়ে এসে দেখেই দিদি বলল, ওমা,মগডালটাই ভেঙ্গেছে। বাপরে বাপরে কোন বেটা মহারাজা ভূত এলো আমার বাড়িতে? নইলে শুধু শুধু ডালটা ভেঙ্গে পড়লো কি করে বলত ভাই? এই বলে দিদি চায়ের কাপটা একটা প্লেটে করে কয়েকটা বিস্কুট সমেত দিয়ে গেল, আমায় বলল, অবাক হচ্ছিস নাকি ভাই? তবে দাঁড়া আমি আমার চায়ের কাপটা নিয়ে আসি, তারপর বলছি আমার জীবনে ভূতের একটা কান্ড।
চায়ের কাপে চুমু দিতে দিতেই দিদি বলল, আচ্ছা ভাই তুই ভূতে বিশ্বাস করিস? তুই হ্যাঁ বললে বলছি, না বললে আর বলছি না।
আমি বললাম, হ্যাঁ দিদি, বিশ্বাস করি আর কি! ওই ওঝা আর তান্ত্রিকদের কাছেই যতটা শুনেছি, তবে চোখ কোনো দিন দেখিনি! সে যাইহোক, ভাবছি আসলেই আমি ভূতে তেমন বিশ্বাস করিই না! শুধু দিদির কথা শুনব বলেই হ্যাঁ বলে দিলাম। আর কি অন্যকোনো লোক হলে হয়তো অন্য গল্পে মোড় ঘুড়িয়ে দিতাম কখনই! দিদি বলছে তাই, শুনি, তাছাড়া আমার তো দিদি নেই, দিনুদিকে দিদি বলে সাদ মেটাই! মানেও একদম আপন ভাইয়ের মতো, কার্তিকে ভাই ফোটাও দেয়, রাখি পড়ায়। সে বলত আমারও একটা ভাই ছিল কিন্তু ছোটোবেলায় পুকুরে পড়ে মৃত্যু হয়েছে, এখন তো নেই, তোমরাই আমার ভাই।
কি বলব! শুনবি তো? আমি বললাম, হুম দি একদম। দিদি বলা শুরু করল, আজ থেকে সাতআট বছর আগের ঘটনা ভাই, তোর ভাগনা ভাগ্নি দুটোর বয়স তখন পাঁচ আর সাত'বছর চলছে! জৈষ্ঠ মাস,গরমকাল!ভরখর আমাবস্যা চলছে তখন, আমি ঠিক জানিই না যে সেদিন আমাবস্যা চলছে, পরে সব কারও শুনেছি। যাইহোক তুই জানিসই তো সেময় আম কাঠাল পাঁকার দিন। সেদিন খাওয়া দাওয়া হল রাত ন'টার মধ্যে। ছেলে তখন খুব বিরক্ত করছে, তাই ভাবলাম থালা বাসন গুলো একটু পরে মেজেনিই, আগে ছেলেটাকে ঘুম পাড়াই, ছেলে ঘুমিয়ে গেল মেয়েও ঘুমিয়ে গেল তোর জামাই বাবু ও। ওর শরীরটা তেমন ভালো ছিল না সেদিন, আসলে সারাদিন খাটাখাটুনি । আমি তখন কুপির আলোয় থালাবাসন নিয়ে গেলাম কুয়োর পাড়ে, তখনও আমাদের গ্রামে তো ইলেক্ট্রিক আসেনি! এখন না সব হয়েছে! তাই তখন কুপির ব্যাবহার।
আমি থালাবাসন গুলো মাজতে মাজতে কুপির আলোয় দেখলাম আমার ছেলের সমান উচু একজন দাড়িয়ে আছে, আমি ভাবছি আমার ছেলেই ঘুম থেকে উঠে দাড়িয়ে আছে, আমি বকা শুরু করলাম, তোরা এত বিরক্ত করতে পারিস, এখুনিই তো ঘুমিয়ে দিয়ে এলাম, যা বিছানায় যা! ঘুমা গা। কিছুই বলছে না। আসলে আমিও লক্ষ্যই করিনি ছেলে না কে? একটা প্রতিচ্ছবি দেখছি! তবুও বকেই যাচ্ছি আর থালাবাসন মেজেই গেলাম। মাজা অবশ্য হল, রান্না ঘরে থালাবাসন রাখতে গেলাম সেও আমার আগে হেটে যাচ্ছে সেটা লক্ষ্য করছি।
যখন সব কাজ সেরে ঘরে যাচ্ছি, দেখলাম ছেলেটা ঘুমাচ্ছে আপন মনে, মেয়েটাও ঘুমাচ্ছে। গা শিহরিত হয়ে উঠল তখন। ভাবলাম, তাহলে আমি কি দেখলাম? ভয়ে ভয়ে তোর জামাইবাবুকে ডাকলাম! বললাম সব কথা খুলে, মানুষটা বিশ্বাসই করল না!প্রথমে একটু হাসল, হে - হে - হে করে । উল্টে আমায় বলল, ও তোর মনের ভুল। যাজ্ঞে ঘুমাও গে, মেলা রাইত হইছে। আমার শরীর তখন কাঁপছে থরথর করে, তবুও ভয়ে ভয়ে আবার কুপি নিয়ে কুয়োর পাড় অবধি যাচ্ছি, দেখা যাচ্ছে ঘরের দরজা থেকে একদম কুয়োর পাড় পর্যন্ত, আমার জুতো পায়ের ছাপের ঠিক পেছনে পেছনে গুটি গুটি ভেজা পায়ের ছাপ। এমনকি যে জায়গাটায় দাড়িয়েছিল সেখানে ভেজা আর ঠান্ডার আজ তখনও। তখন আর বেশি দেরি করলাম না, সোজাসুজি ঘরে এলাম।ভয়ে ভয়ে কাটল রাতটা। আমি একটু ঠাকুর বিষহরি মেনে চলি ভাই, পরের ভয় কাটানোর জন্য সব লেপা মোছা করে পুজো দিলাম, কেটে গেল কয়েক দিন! পনেরটা দিন বাদে পূর্ণিমা। সেই হল একটা কাল।
তারপর কিছু হয়েছে নাকি দিভাই? তারপর আর কি হবে রে ভাই? একদিন আরও সেই এরকমই ঘটনা! তবে সেটা ছিল একটু ফারাক।
আর সেই রাতেই ঘটল অঘটন। সেদিন দেখলাম একটা দাড়িওয়ালা মানুষ,বোঝা যাচ্ছে একটা পাঞ্জাবি পড়া! আকৃতি আর প্রতিচ্ছবি ঠিক আগের মতোই,আমি শুধু ওর ছায়া শরীর দেখলাম, একটু পর সব মিলিয়ে গেল, মনে মনে রাম নাম জপ করলাম, রাম রাম জয় রাম। কিছুক্ষন পর তখন নিশার রাত্রি, সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন,চারদিকে সারা শব্দ নেই সব যেন নিশ্চুপ। রাতের আধারে একটা ঘুঘু ডাক দিচ্ছে! ঘুঘু ঘুঘ কিসের দুঃখ, ঘুঘু ঘুঘ ব্যাঙের দুঃখ। মনে মনে ভাবছি এত রাতে ঘুঘু ডাকছে বিষয়টা ভালো ঠেকছে না, কিছু একটা হতে চলেছে। তবে হলই।
তার পর কি হতে চলল দিভাই! আমার কিন্তু গা শিহরে উঠছে। লোম থরথরে দাড়াচ্ছে!
----ভয় হচ্ছে না তো ভাই।
-----না না দিভাই, তুমি বলো, শুনিই পুরোটা।
তারপর সবাই ঘুমিয়েছি! সকাল হল। তোর জামাইবাবুকে দেখছি ঘরে নেই! খুজতে খুজতে পেলাম বাড়ির দক্ষিণ পাশে ঝোপটার কাছে শুয়ে আছে! আদুল গা য়ে, ঘাসের উপর। ডাকদিলাম কি গো ঘর ছেড়ে এখানে কোথায় ঘুমিয়েছো? তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি? তবুও সারা পেলাম না! হইচইয়ে অনেক লোকজন জরো হলো, সবাই ডাকছে তবুও সারা নেই। তখন দত্তবাড়ি বড় ছেলে, সে অবশ্য বেশ ডাকাবুকো চেহারার, বেজায় সাহস তার! সে একটা টলানি দিতেই উঠে পড়ল তোর জামাইবাবু, চোখ ঘষরাতে ঘষাঘষি করতে করতে বলল, এত লোক জন কিসের জন্য? তোমরা হইচই করছ কেন? যাও যাও বাড়ি যাও! এদিকে তার যে এরকম অবস্থা সেটা তার হুস হচ্ছে না। আমি তখন বললাম, তোমার জন্য সকলে এখানে আর তুমি বলছ এত লোকজন! হইচই করছ কেন?
------আরে দিনু কি হয়েছে ভালো করে বলত, শুনি।
------আঃ মরন! তুমি তো সারা রাত এখানে ঘুমিয়েছো,তাই তো এত সব!
------- কি বলছ? এটাই তো বাড়িটা। কি সুন্দর ঘুমালাম।
-------মাথা পুরো গেছে। চারদিক তাকিয়ে দেখ! বাড়ি না কি?
------- তখন চারদিক তাকাতেই, মাথাঘুরে উঠল তোর জামাইবাবু, পরে গেল মাটিতে।
-------ধরাধরি করে কয়েকজন ছেলে বাড়ির ভিতর দিয়ে গেল, জল দিলাম মাথায়। কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরতেই হুস এল! বলতে শুরু করল ইয়া বড় টাকার সিন্ধুকটা, আমার কই গেল! আর ছটফট করতে লাগল সিন্ধুকের জন্য।। আমি বললাম, কই? সিন্ধুক আমাদের নেই। ও, বলতে শুরু করল, আরে কালকে রাতেই তো টাকা ভর্তি সিন্ধুকটা নারলাম। অনেক টাকা, অনেক। সোনার টাকা। হে-- হে-- হে আমি কোটি পতি! আমি কোটিপতি বলে চিৎকার শুরু করল। কি জানিস ভাই, আরও বলল, ওরা কই, ওরা? আমি বললাম, ওরা আবার কারা? তোর জামাইববাবু বলল, সাদা ধবধবে দুটো মানুষ, যে আমাকে বন্ধু করেছে, আরে ওরাই তো সিন্ধুকটা আমার কাছে এনেছে, আমাকে দেবে বলে আমাকে কথা দিল। আর সেই টাকা টাকা করেই তো লোকটা অসুখেই পড়ল!
শেষে চারপাশা গ্রামের সিদ্ধ সাধু ও তান্ত্রিক বাবাকে ডেকেপাঠিয়েছি,বাবা এসে বলল বাড়ির দক্ষিন কোনটা নাকি খুব খারাপ। সেখানে নাকি একটা।কবর রয়েছে! আর সেই কবরে রয়েছে একটা অতৃপ্ত আত্মা! সে ঘুরে বেড়ায় শনিবার ঠিক মধান্ন্য রাত দুপুরে, তোমরা বুজবে সেই সময়টা একটা নাই বাতাসের বাতাস বয়, ঠিক শীতল বাতাস। অবশ্য আমাবস্যা আর পূর্ণিমার সময়ও এই অতৃপ্ত আত্মা দৃষ্টান করে, যার পেছনে লাগে তার কিছু একটা তো হয়ই! আর এই অতৃপ্ত আত্মাটা যক্ষ হয়ে আছে! যে কাউ টাকা দেখিয়ে মারাতে চায়, আর যে নতুন আত্মা আসবে তাকে সেখানে রেখে সে মুক্তি হতে চায়।
তখন বাবা বলল, ভয় নেই মা। তোমরা বাস্তুভিটে পরিবর্তন কর,। বাস্তুটারও ওই দোষের ছায়া আছে। তারপর এইখানে জমি কিনে তারপর বাড়ি বানালাম। ওই তাতেই আমি ভূতে বিশ্বাস করি ভাই!না হলে আমি তোর মতো ভূতে তেমন বিশ্বাস করতাম না। এখন দেখছিস ভগবানের কৃপায় ভালো আছি।
এখন তোর জামাইবাবুকে বললে, সেই ভয়ংকর ঘটনাটা বলে ভালো করে। সেদিন পূর্ণিমার রাতে দুজন পালকি নিয়ে এসে ডাকল, এই রাজেশ, রাজেশ বাড়ি আছিস! সে দরজা খুলে বেরিয়ে আসেই দেখে দুজন ভদ্র লোক, পালকি আর দিন দিন লাগছে।ওরা গম্ভীর গলায় বলল, চল আমাদের সঙ্গে কাজ আছে! তোর আর অভাব থাকবে না। পালকিতে করে নিয়ে গেল। ঝোপটার কাছে, সেখানেও বলে রাজেশ দেখতে শুধু বিশাল প্রাসাদ! ওরা প্রাসাদের ভিতর নিয়ে গিয়ে বসতে দিল চেয়ারে। তারপর একটা বিশাল লোহার সিন্ধুক নিয়ে এল,। বলল, এই বেটা রাজেশ কি দেখছিস? এই সোনার মোহর এগুলো সব তোর, আমরা আগে পাহারা দিতাম, এখন তোর হাতে ছেড়ে দিতে চাই! রাজেশের, লোভজমে গিয়েছে সিন্ধুকটার প্রতি, সে ভাবছে, এটা আমার হলে, আমি রাজার হালে যুগ পরাম্পরায় দিন কাটাতে পারব। আর জানতাম না ওরা ভূত। বিশাল প্রাসাদে থাকে ওরা। একটু পর দুজনের আসল চেহারা, মুখ যেন নেই, দাতের সারি আর কঙ্কাল স্বরূপ মাথা, দাত দুলো বেরিয়ে আসছে, হাতগুলো আমার দিকে বিশাল লম্বায় গলার কাছে আসছে, রক্ত মাংসহীন মাথায় চোখ দুটো আগুনের গোলার মতো জ্বলছে।আর গম্ভীর স্বরে বলছে, রাজেশ, আমরা আজকে যাচ্ছি হি হি হি, আমরা মুক্তি হি হি হি, তুই এখন এই সিন্ধুকটা নিবি, আয় আয়, ভালো করে দেখ। আমার শরীর জল জল হল, কাঁপছে থরথর করে কখন যে অজ্ঞাত হয়ে গেলাম বুজতেই পারলাম না। সকালবেলা হল, দেখলাম লোকজনের ভির আমি শুয়ে আছি আমার বাড়ির ঝোপের একদম সন্নিকটে । তারপর যা হওয়ার তাই। সেদিন বউটা ঠিকই দেখেছিল, আমি ওকে বিশ্বাস করিনি! এগুলোই তোমার জামাইবাবু সেদিনের স্মৃতি চারনায় বলে। আরও বলে যে আমার টাকার প্রয়োজন নাই ওরকম, পরিশ্রম করলে যা পাব সেই আমার ভালো।