মৃত্যু যন্ত্রণার প্রসব
যখন অনেকগুলো নুড়িপাথর পরপর সাজিয়ে সামনের দিকে এগোতে থাকি, পাশ দিয়ে চলতে-থাকা নিবিড় অরণ্যরাজির অসামান্য চিত্ররেখা তখন কোনোভাবেই চোখের পাতা ভেজাতে পারেনা। নুড়িপাথরগুলো সমস্যাদের নিয়ে এঁকেবেঁকে চলতে থাকে ঠিকই, তবে এভাবে দুকূল ভেজানো জলসীমান্ত সমুদ্রের কিনারা খুঁজে পায় না। আসলে এই খোঁজ করাটাই বড় আপেক্ষিক — এই খুঁজতে থাকাতে নতুন করে কোনো গুপ্তধন উদ্ধার কোথাও হয় না। যা রয়ে যায় পথের দুপাশ ভর করে, তার পুরোটাই কিন্তু রোজ একটু একটু করে জমতে থাকা অচৈতন্য শিশমহল… কপাট জুরে যেখানে আলমারির গায়ে আজও আঁটা রয়েছে প্রাচীন বিশাল আয়না!
বহুদিন হল, ওই কাঁচের দরজা হাট করে খুলে দিয়ে পুরোনো পড়ে থাকা বইগুলো নতুন করে রোদে ভেজানো হয়নি। সিঁড়ির তলার ঘর থেকে নিয়ে আসা কাঠের উঁচু টুলটায় পা ঝুলিয়ে বসে একটা একটা করে মলাটে হাত বোলাতে বোলাতে আনমনে প্রশ্নও করিনি, 'এই কাঠটাই কি মেহগনি?' অযথা এঁকেবেঁকে আসা উত্তর প্রত্ত্যুত্তরদের ভিড় যতই গোগ্রাসে গিলতে এসেছে অর্ধেকের উপরেরও বেশ কিছুটা সময় ও লুকোনো অতীত — তাদের প্রশ্রয় দিতেই বোধহয় নতুন করে একদান খেলব বলে স্যাঁৎসেতে সেটে যাওয়া পুরোনো তাসের প্যাকেটটা বইয়ের তাক থেকে সযত্নে নামিয়ে আনি।
নিজের জন্য একসময়, 'সময়'এর বড় প্রয়োজন মনে করেছিলাম। ভেবেছিলাম, এদিকটায় আগে সব গুছিয়ে নিই, তারপর সময়মতো সময় করে নিজের জন্য বার করব একান্ত খানিকটা সময়। পরপর তাতে লিখতে থাকব চিঠি - না, কোনো বিশেষ কাউকে উদ্দেশ্য করে নয়। কত কথাই তো জমা থাকে ভিতরে, জমতে জমতে বেলাশেষে জাঁকিয়ে ধরে তাদের কালরোগে। তাদের লিখে রাখলে অন্তত পরবর্তী প্রজন্মের গবেষণার কাজে লাগবে — উদ্ধার হবে কত তত্ত্ব; জানবে সবাই - মানুষ এমনও হয়!
যদিও নিজেই জানি, সব কথাদের রূপদান করতে নেই ভাষায়। তাতে সমস্যা বাড়ে নতুন কথা খুঁজতে যাওয়ায়! খেলার মাঝেই আড়চোখে দেখে নিই, হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে বইয়ের তাক আর গল্পগুলো, মাথা নাড়ি,বলি অল্প হেসে, 'উঁহু! নাহ্, এখনই নয়!'
জলের ধারেই ফেলে এসেছিলাম যেই নুড়িপাথরদের, আগে খুঁজতে হবে তাদের বিবর্তনের পরিচয়। দুপাশে ফেলে আসা জঙ্গল জুড়ে এখন নিশ্চয়ই নামছে আঁধার, মাথার উপরে ফুটে উঠেছে চাঁদের আবছা বলয়!
সমস্তকিছুই থাক বরং এখন পড়ে, অনাবৃত ভীতু মনন সব। মাঝগভীরে ডুব দিয়ে আসি এবেলা — ছুঁয়ে আসি মৃত্যু যন্ত্রণার প্রসব!
======================
পারিজাত ব্যানার্জী
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া