Featured Post

গল্পঃ শান্তা কর রায়

 

ফেরত



সবুজ মেঘ পুষেছিল বাবা
ভালবেসেছিলো
একদিন বৃষ্টি হয়ে ঝরতে শেখালাম
উড়ে গেলো
এরপর বছরে একবার যখন পায়রা
ওড়ানোর ইচ্ছে হয়
মেঘটাকে ডাকি-- ঘুড়ি হয়ে ওড়ে!!
একইভাবে ও রাগ করলে কষ্ট হয়!!

ফেরাতে পারিনি কোনদিন, একের পর এক মেহগনি মেঘ আসে যায়
আমি অবাক -বসে থাকি দোরগোড়ায়!!


বসন্তসখ আমাকে বৃষ্টি হতে দেয়নি
বরং বমি পেয়েছে গরমে
কঠিন হতে শিখিয়েছে নরমে!!!-


ভাবছেন কবিতা কেন? আসলে আমার গল্পের নায়িকা এমিলিয়া কবি । ওর জন্ম নিউ জার্সিতে । বড়োলোক আর একটু এলোমেলো । ও বাবা ভক্ত। উনি রক্ষণশীল, তাই রাত ন' টার মধ্যে ঘরে ফিরতে হতো । এমির প্রেমে পড়েনি এমন কেউ ওর ক্লাসে ছিলনা। ফলে প্রায় প্রত্যেকদিনই ওর দেরি হতো,আর জুটতো মায়ের বকুনি । আর বাবাকে শুনতে হতো,'তোমার আদরে এমি উচ্ছন্নে গেছে '। এমির কাউকে পুরোপুরিভাবে ভালো লাগতো না,কারোর চোখ তো কারোর ঠোঁট সুন্দর । এভাবে চলছিল, ইউনিভারসিটি বাসে প্রতিদিন ওকে পাশে বসানো নিয়ে স্মার্ট ছেলেদের মধ্যে রীতিমত প্রতিযোগিতা চলতো । এমি ব্যাপারটা এনজয় করতো । একজন গরীব পড়ুয়া এমিকে দূর থেকে দেখতো,কেউ জানতে পারেনি । 
তিনদিনের জ্বরেরধাক্কা সহ্য করতে না পেরে হঠাৎ এমির মা চলে গেলেন, ছোটো ভাইকে দেখার জন্য এমির বাবাকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে হয়। এরপরেই ওর খারাপ দিনের সুত্রপাত । 
এমি যখন লুকিয়ে কাঁদতো পিটার রুমাল এগিয়ে দিলো। ক্রমশ ওর ওঠাবসা সবকিছুর দখল নিলো । চাঁদ ওঠার মতোই নিঃস্ব মুহূর্তগুলো ভরিয়ে দিলো । সকাল হলেই দমবন্ধকরা পরিবেশ থেকে এমি সোজা পিটারের দোচালায় । ওর মায়ের হাতের বানে ( রুটি) নিজের মাকে ফিরে পেতে চাইতো, চোখের জল আনন্দে পূর্ণ হয়ে উঠলো । নিজের বিয়ের জন্য জমানো টাকায় পিটারের চাকরীর ফর্ম ভরতে শুরু করলো । অনেক ডালে বেরানো পাখি হঠাৎই পিটারকে নির্দ্বিধায় বিছানা দিলো, ভালবাসলো কখনো বর কখনো সন্তানের মতো । পিটারও সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ছাড়লো না,নিংড়ে ছিবড়ে করে এমিকে ছুড়ে ফেলে দিলো । ততোদিনে সুধীমহলে রটে গেছে এমির নাকি বিবাহ বিচ্ছেদ ইত্যাদি ঘটে গেছে। এতোটাই রটলো, যার সবটা এমিরও জানা ছিলনা । যাইহোক মুক্ত বিহঙ্গ এখন ডানাভাঙা পাখি । ওরদিকে কেউই এখন করুণা বা ঘৃণা ছাড়া কিছুই ছোড়েনা । 
আর যে ভ্রূণ ও বহন করেছিল, সর্বস্ব দিয়ে তাকে রক্ষা করতে পারলো না । নিরর্থক যাপনে এবার আছড়ে পড়ুক ঢেউ, এবার ও বুঝতে শিখুক নির্জন উপকূল সবার জন্য নয়। এবার ওর জানা হয়ে যাক অন্যের জন্মদিন পালনের জন্য নিজেকে নিঃস্ব করতে নেই । চামড়ায় অনেককিছু লেখা থাকে সেটা পড়তে শিখুক । পশুতুল্য অথবা পশুত্বর ওপর দাঁড়িয়ে থাকা জীব চিনতে শেখা, বা অতি আবেগ থেকে ধীরেসুস্থে সরে এলে আবেগ ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধবে । 
এমিলিয়া কাঁদতে ভুলে যায়, হাসতে ভুলে যায়, আর ভালবাসতে ভোলেনা । পিটার যার সংগে আছে সেও এমির ক্লাসমেট । ওকে উচ্চাভিলাষী করেছে এমি।সবথেকে বড়ো ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে । আর প্রতিদিন গডের কাছে প্রে করেছে । নিজের জন্য নয় অন্যের জন্য বরাবর ওর ন্যাকামো, দেখলে মনে হবে মেগাসিরিয়াল চলছে ।
একদিন সূর্য উঠতে দেরি করলেও ও কিন্তু খাবার নিয়ে প্রস্তুত । এইভাবে চললো দীর্ঘ দশ বছর । 
ঘরে ঢোকার মুহূর্তে পিটার দুহাতের বন্ধনে তুলে এমিকে ছুড়ে দিতো বিছানায়।
অপ্রস্তত এমি জানতো এমন ঘটনা অস্বাভাবিক কিছু নয়,তবু বরাবরের মতো কপট রাগ দেখাতো। 
ছাড়ো, মা রয়েছেন, ব্যাগ রাখতে দাও।
পিটারের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই,বরং ডাকাতের মতো স্বভাব, আদরে জড়িয়ে বলে,
আমার ভয় করছে এমি!
কিসের ভয়!
তোমাকে হারানোর ভয়,দুঃস্বপ্ন দেখেছি,
তাই! তাহলে তো ভালোই হয়,তোমার মতো ডাকাতের হাত থেকে মুক্তি পেতাম!
বলেই এমি ওর বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে উঠে বসে ।
চারদিকে বিষন্ন ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে আজকাল, কেন,কিসের জন্য পিটার ওকে নিঃস্ব করে চলে গেলো!!
বেশি ভাবলেই বুকের বাঁদিক ব্যথা করে,কেমন অসহায় মনে হয়। এমির বাবা যে ওকে সারা পৃথিবী হাতের মুঠোয় দেওয়ার কথা বলেছিল এতদিন সেও কেমন বদলে গেছে । এমি জানলা দিয়ে রামধনু দেখে, কিছুক্ষণ আগে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেলো । এখানে চাঁদ উঠতে দেরি করে,এইসব বিকেল একসময় উচ্ছলতায় কাটিয়েছে । এখন সব পানসে মনে হচ্ছে।
পিটারের দেওয়া লাল চুনির দুলটা এমি পরেছে। লাল গাউনে পরীর মতো লাগছে । পিটারের মা সারাদিন রান্নাঘর থেকে বেরুতে পারেনি, পাঁচরকমের কেক বানিয়ে ওদের জন্য অপেক্ষা করেছে পিটার ফেরেনি, এমিকে ফোন করে জানতে চেয়েছে,
তোদের কি হয়েছে,বলতো?
তোমার ছেলের কাছে জানতে চেয়েছো কখনো? কেন আমাকে ছেড়ে----
আর বলতে পারেনা । দুজনের স্তব্ধতা ভেদ করে একটা পাখি অবেলায় ডাকে কর্কশ স্বরে । 
একবছর আগে এইদিনটাই ছিল একসংগে কাটানো শেষ দিন। সারাদিন মলে ঘুরে মার্কেটিং করেছে, বাইরে খেয়েছে, সিনেমা দেখেছে । তারপর বাড়ি ফিরে পিটারের জন্য যখন রান্না করেছে, পিটারের আবদারের অন্ত নেই।
আজ থেকে শুধু তুমিই আমার জন্মদিনের কেক বানাবে,
সেকি মা তো করে রেখেছেন,আমি শুধু ডেকোরেশন করবো, আর ডিনার।
নানা তা হবে না আজ আমাদের এনগেজমেন্ট তাই-- বলেই ঐ অবস্থায় মায়ের সামনেই আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় ।
সারারাত এমিকে ঘুমাতে দেয়নি পিটার। পাশ ফিরতে দেয়নি ঘুমন্ত চাঁদ দেখার জন্য । সকালের দিকে এমির বমি হয়,সংগে সামান্য রক্ত পড়ে । বেসিন লাল দেখে প্রথমে আঁতকে ওঠে,পরে অবশ্য স্বাভাবিকভাবে কথা হয় ।
কি হয়েছে,ঠিক আছো তো?
হু,কদিন ধরেই বমি হচ্ছে মাঝেমধ্যে, মনে হয় তুমি বাবা হবে পিটার! 
শক খাওয়ার মতো ছিটকে যায় পিটার,ওকে এভাবে সরে যেতে দেখে অবাক হয় এমি,কাছে এসে জড়িয়ে ধরে,বলে
কি হয়েছে,আমরা খুব তাড়াতাড়ি অফিসিয়াল বিয়ে করে নেবো!
না,ও কে পৃথিবীকে আসতে হবে না,আমি তোমাকে বোঝাতে পারছি না,আমি বাবা হতে চাইনা ।
বিরক্ত এমি উঠে বসে,
তুমি চাওনা! আমি চাই,ও আমাদের ভালবাসা --
কিছুতেই না,ও কে জন্ম দিতে হলে তুমি আমাকে হারাবে ।
বেশ, আমি কোনো যে মূল্যেই ও কে পৃথিবীতে আনবো । 
না আনা হয়নি,সেটা ইচ্ছে হয়নি কাউকে জানাতে,কুমারী মা হওয়ার সাধ না মিটলেও যন্ত্রণা পাঁচ মাস ভুগতে হয়েছিল। সবকিছুর জন্য যে দায়ী সেই পিটারকে দেখা করে শেষ অস্ত্রটা নিক্ষেপ করার ইচ্ছে এমির বাড়ছিল । মাথার চুল খাড়া হয়ে যাচ্ছিল । যুদ্ধংদেহি রূপে এমিকে দেখে এসময় সবাই ভয় পেতো । শুকনো দিনেও তীব্র স্রোত উপলব্ধি করেছিল এমি। ওর জীবনের এই ছিদ্রের ভিতর দিয়ে যারা ওকে বিব্রত করলো তাদের ক্ষমা করার কথা বলেছিল পিটারের মা। এমি এতোটা মহৎ হতে পারেনি, বরং কিছুদিন সাহসে দরজা ঠেলে যাদের ঢোকা বন্ধ ছিল তাদের জন্য মজুত রেখেছিল ভালো স্ন্যাক্স আর কফি ।
কাঁধেচাপা চাপা পড়েছিল অজ্ঞাত কোনো মৃতদেহ । ও কেন মেপে ওজনে ভালবাসেনি,ভাবতে বসলো, আর খেই হারিয়ে ফেললো এইভেবে পিটারের ব্যবহারে কোনো ফাঁক দেখতে পেলো না। জড়িয়ে ছিল স্মৃতিতে অদ্ভুত সেই অভিজ্ঞান ।
আগুনের শিখার মতো জ্বলছিল এমি। পিটারের মা দরজায় কড়া নাড়ছে । এমি বাবা তাড়িয়ে দিচ্ছে দেখে এগিয়ে এলো,
বলুন! 
পিটারের চিঠি;
আমি কি করতে পারি, ওতো ভালো আছে খবর পেয়েছি । 
না,ভালো নেই ।
আমি জানতে চাইনা।
বেশ, এটা রাখো, না পড়তে চাইলে ফেলে দিও ।
উনি চলে যাওয়ার পর কতক্ষণ বসেছিল জানেনা, মেট এসে কফি দিয়ে গেলো । বুঝতে পারছেনা কি করা উচিৎ । হাতের মধ্যে দলা পাকিয়ে আছে মাকে লেখা পিটারের স্বীকারোক্তি ।
প্রথম সন্তান জন্ম না দিতে পারা বছর তেইশের এক মা অন্য মাকে লেখা চিঠির কোঁচকানো অংশ মেলে ধরল দিনের শেষ আলোয়,
মা,প্রণাম নিও। এতোদিন পরে টাকা পাঠাচ্ছি, জানি তুমি গ্রহণ করবেনা । এমি কেমন আছে মা! আর আমাদের সন্তান!
মা তোমাকে একটা কথা জানাতে চাই,তুমি আর বাবাওতো ভালবেসে বিয়ে করেছিলে, হয়তো আনন্দেই ছিলে,আমি তোমাদের জীবনে আসার পর তোমরা সবসময় ঝগড়া করতে। আমার কষ্ট হতো খুব । তোমরা থামতেনা,যখন থামলে বুঝলাম আলাদা হতে চাও। তখন আমি তোমার সংগে আমার শিকড়, খেলনাপুতুল, প্রিয়বন্ধু বাবাকে ছেড়ে চলে এলাম । তোমার আত্মসম্মানবোধ আমাকে ভালো মানুষ করে গড়ে তুলতে গিয়ে ভালো বাবা হতে দিলো না। আমার কষ্টের দিনগুজরানো সময় ছিল ভীষণ যন্ত্রণার, আমি এর পুনরাবৃত্তি চাইনা । আমার সন্তানকে এমি ভালো রাখবে জানি,ও যাতে আমায় ভুলে যায় সেদিকে লক্ষ্য রেখো, তোমরা ভালো থেকো ।
চিঠিটা হাতের ওপর উপুড় হয়ে এমির স্পর্শ চায়,এমি ভারসাম্যহীন চোখ আকাশের দিকে মেলে ধরে ।

==================





জনপ্রিয় লেখা

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৯তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮০তম সংখ্যা ।। কার্তিক ১৪৩১ অক্টোবর ২০২৪

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

মুদ্রিত নবপ্রভাত উৎসব ২০২৩ সংখ্যার ডাউনলোড লিঙ্ক

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী