Featured Post

কাব্যনাট্য: শঙ্করী বিশ্বাস



নিয়তি—কেন বাধ্যতে

      

      মহাভারতের এক অন্যতম চরিত্র কর্ণ । মহর্ষি ব্যাস তাঁকে বহুযুগ  পূর্বে আমাদের  সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। কর্ণের  জীবনেতিহাস আমরা সবাই জানি। আমরা জানি আজন্ম  তাঁকে লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে শুধুমাত্র তাঁর জন্ম           ইতিহাসের কারণে । অথচ তিনি নিরপরাধ । জীবনে যা কিছুতে তাঁর ন্যায্য অধিকার ছিল তার কোনোটিই তিনি লাভ করেন নি। অন্যায় বঞ্চনা কেবল জুটেছে তাঁর প্রাপ্তির ভাড়ারে। তিনি কি সত্যিই কেবল বঞ্চনা  অবহেলা পাওয়ার যোগ্য?জন্মরহস্যের জন্য তো কর্ণ দায়ী নন। অথচ এই জন্মরহস্যের জন্যই জননী তাঁকে জন্মলগ্নে পরিত্যাগ করেছেন। এবং সেইহেতু তাঁর জীবনে নেমে এসেছে বারবার নিয়তির অমোঘ আঘাত বা প্রতিবন্ধকতা । বলা ভাল জন্মলগ্ন থেকেই কর্ণের জীবন নিয়তিতাড়িত। নিয়তির নিষ্ঠুরতার জন্য জীবনে নারীর কোমল স্নেহ-প্রেম লাভে ব্যর্থ । জননী ও জায়া তাঁর জীবনে কোনোদিন তাদের ছায়াপাত করেনি। একজন নারীকে তিনি জীবনে আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন প্রেয়সীরূপে,তার সহধর্মীনীরূপে। কিন্তু ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস!সেখানেও কর্ণ প্রত্যাখ্যাত হন কেবল জন্মবৃত্তান্তের জন্য। জন্মরহস্য কিভাবে একটা জীবনকে আমূল পরিবর্তিত করে দিতে পারে,কিভাবে শূন্যতার ভারে জীবনকে পরিপূর্ণ করে দিতে পারে তার অন্যতম নিদর্শন কর্ণের জীবন। কিন্ত যদি একজন নারী,যাকে কর্ণ তার হৃদয়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বলে মনে করতে পারেন তাঁর যৌবনে সে যদি কর্ণের পাশে এসে দাঁড়াতো,সহধর্মিনী ও সহমর্মিনী হত,তাহলে কর্ণের জীবনের বাঁক পরিবর্তিত হতে পারতো। কুরুসমরে তাঁর এমন মর্মন্তদ পরিণতি হত না। দ্রৌপদী যদি কর্ণের জীবনে আসতো তাঁর পত্নীরূপে তাহলে কর্ণের জীবন অন্যরূপ হতে পারতো।  দ্রৌপদী ও কর্ণের সাক্ষাৎ বা কর্ণের অন্তর্নিহিত ক্ষোভ বা আক্ষেপ বা বেদনাজাত বক্তব্য দ্রৌপদীর কাছে উপস্থাপন ———এসব মূল মহাভারতে নেই। কর্ণ ও দ্রৌপদীর এই সাক্ষাৎকার সম্পূর্ণ কাল্পনিক। আমার এই ব্যক্তিগত অনুভূতি ও মননজাত প্রয়াস যদি পাঠকের ভাল লাগে তবে এই প্রচেষ্টা সার্থক হবে। যাই হোক অনেকখানি ভূমিকার পর আসুন এবার মূল রচনায় প্রবেশ করি।




           সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আকাশের  রঙ সিঁদুরের মত লাল । পৃথিবী শেষবারের  মত শেষবেলার আলোটুকু মেখে নিয়েছে সারা গায়ে। আর কিছুক্ষণ পরেই সময় তার গা থেকে সমস্ত আলো শুষে নেবে। টেনে নিয়ে যাবে তাকে অন্ধকারের জঠরে। এমনই পরিস্থিতিতে কর্ণ তাঁর উদ্যানে নীরবে নির্জনে দাঁড়িয়ে  আছেন। অদূরে বয়ে চলেছে স্রোতোস্বিনীর শান্ত ধারা। ক্লান্ত  পাখিরা দ্রুত নীড়ে ফিরছে। কর্ণ ভাবনায় মগ্ন। রাত্রি শেষ হলেই শুরু হবে কুরুক্ষেত্রের মহাসমর। এই বিভীষিকাসম যুদ্ধের ভাবী ফলাফল কর্ণ অনবগত নন। তিনি প্রাজ্ঞ। তবুও তিনি      প্রতিজ্ঞায় অনড়। জীবন তাঁকে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির   সম্মুখীন করেছে। আজীবন তিনি নিয়তিতাড়িত,লাঞ্ছিত জীবনযোদ্ধা। আজ বেলাশেষে নিভৃতে আত্মচারণায় তিনি মগ্ন। এমন সময় তাঁর সম্মুখে আচম্বিতে উপস্থিত হলেন পঞ্চস্বামী গর্বিতা দ্রুপদনন্দিনী দ্রৌপদী। অকস্মাৎ পাঞ্চালীর আবির্ভাবে কর্ণ বিস্মিত, বাকরুদ্ধ,কৌতূহলী চিন্তিত । আগুনের লাল শিখার মত উজ্জ্বল বস্ত্রপরিহিতা,আলুলায়িতা,উৎকন্ঠিতা পাঞ্চালী কর্ণের মুখোমুখি  দাঁড়িয়ে  । কর্ণ প্রশান্তভাবে প্রথমে দ্রৌপদীকে অভিবাদন করলেন। তারপর আসন গ্রহণ করতে বললেন। শুর হল তাঁদের আলাপ ।

কর্ণঃএসো দ্রৌপদী(ডান হাত দেখিয়ে  )উপবেশন কর।

দ্রৌপদীঃতুমি এমন নিভৃতচারী জানতেম না।

কর্ণঃআমি চিরকালই নিঃসঙ্গ । নীরবতাই আমার একমাত্র সঙ্গী । যাক সে কথা। আমার জীবনেতিহাস তোমার কাছে নিষ্প্রয়োজন। তোমার আগমনের কারণ জানতে আমি উদ্গ্রীব ।

দ্রৌপদীঃআমার আগমনের হেতু অবশ্য আছে।অকারণ আলাপচারিতায় আমার কোনো উৎসাহ নেই।
কর্ণঃআমি জানি দ্রৌপদী। পঞ্চস্বামী গর্বিতা পাণ্ডব কূলবধূর কর্ণের কুটিরে আগমন অকস্মাৎ অপ্রত্যাশিত হলেও অহেতুক  নয় কখনোই। তবে কারণ প্রদর্শনের পূর্বে আসন গ্রহণ কর।
দ্রৌপদীঃ(তবুও দাঁড়িয়ে  আছেন)আমি আজ বিশেষ প্রয়োজনে এসেছি। তাই কালবিলম্ব না করে---
কর্ণঃ(দ্রৌপদীকে বক্তব্য সম্পূর্ণ  করার অবকাশ না দিয়ে)নিশ্চই। (বিদ্রূপের সঙ্গে) পাণ্ডবকূলবধূর অবসর না থাকাই স্বাভাবিক । তোমার সময়ের মূল্য আমি বুঝি। তবে সেকথা স্মৃতির বাইরে চলে গিয়েছিল। কিন্ত পঞ্চস্বামীর গর্বে গর্বান্বিতা যিনি,তিনি এমন পড়ন্তবেলায় অন্ত্যজ সমীপে কেন এসেছেন সেকথা বোধ হয় জানি।

দ্রৌপদীঃ(ঈষৎ রুষ্ট কন্ঠে)কর্ণ!বারবার পঞ্চস্বামী গর্বিতা বলে কেন বিদ্রূপ করছ আমাকে?

কর্ণঃ(বক্রহাসির রেখা ঠোঁটে)বিদ্রূপ ?সত্যকে তুমি বিদ্রুপ মনে কর?অর্জুন তোমার প্রিয়তম সেকথা সর্বাংশে সত্য। কিন্ত আরও চারজন স্বামী তোমার আছেন। একথা সত্য যে সেদিন অন্ত্যজবলে আমাকে নির্মমভাবে  তোমার স্বয়ংবরসভা থেকে বিতাড়িত  করেছিলেন। (কর্ণর কন্ঠস্বর জলভরা মেঘের মত)তাই তো অর্জুন তোমায় লাভ করতে সমর্থ হয়েছিল

দ্রৌপদীঃ(শান্ত কন্ঠে)অর্জুন আমার প্রিয়তম স্বামী একথা সত্যি। আরো চারজন পুরুষ আমার স্বামী এও সত্যি। এবং আমার জীবনের এই সত্যের মূলে আমার ভাগ্য,আমার নিয়তি  কর্ণ । (চোখ দুটো আর্দ্র হয়ে আসে,গলার স্বর কান্নাজড়ানো)কর্ণ আজ আমি তোমার কাছে প্রয়োজনে এসেছি। তুমি আমার ভাগ্যকে পরিহাস করছ?তোমার ন্যায় একজন বিচক্ষণ  পুরুষের কাছে এ আচরণ সম্পূর্ণ  অপ্রত্যাশিত । তোমার এহেন আচরণ আমার কল্পনার অতীত।

কর্ণঃতোমার ভাগ্যকে আমি পরিহাস করছি?কি বলছ দ্রৌপদী?একজন অন্ত্যজের পক্ষে তোমাকে পরিহাস করা তো অক্ষমনীয় ধৃষ্টতা।

দ্রৌপদীঃ(ক্রোধোন্মত্ত ,তবুও শান্ত কন্ঠে  )কর্ণ তুমি তোমার সীমা লঙ্ঘন  করছ।

কর্ণঃ(স্বগোতোক্তি     )আমি সীমা লঙ্ঘন  করছি দ্রৌপদী?(মুহূর্তকাল উভয়েই নীরব)

দ্রৌপদীঃকর্ণ?

কর্ণঃনা দ্রৌপদী আমি আমার সীমা লঙ্ঘন  করিনি। করতে পারিনি। যখনই এগিয়েছি দুষ্প্রাপ্যকে নিজের করে নিতে তখনইনিয়তির নিগড়ে আমি বন্দী হয়েছি নির্দিষ্ট সীমানায়। বাহুবলে,বুদ্ধিবলে বহুক্ষেত্রে জয়ী হয়েছি। কিন্ত সেসব মূল্যহীন । সেসব মিথ্যে হয়ে গেছে। আমি যা চেয়েছি তা চিরদিন অধরাই থেকে গেছে। আমার সমস্ত পৌরুষ  সেখানে ব্যর্থ । হৃদয়ের দাবী প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি আকাঙ্ক্ষিতের কাছে। আজন্মকাল শুধু লাঞ্ছনা আর বঞ্চনা  পেয়েছি। নিয়তি আজ আমার জীবনকে তীরে টেনে এনেছে। নিয়তি আমার জীবনকে পরিপূর্ণতা দেয়নি। কালস্রোত আমায় প্রিয়প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত  করেছে,ন্যায্য অধিকার কেড়ে নিয়েছে। বারবার আমি নিয়তির নিষ্ঠুর  চক্রান্তের শিকার হয়েছি। নিয়তিই আমাকে করেছে বন্ধনহীন নিঃসঙ্গ স্বাধীন ।

দ্রৌপদীঃসেই সঙ্গে নিষ্ঠুর (বক্রহাসির রেখা ঠোঁটে)যদিও সবাই তোমাকে দানবীর বলে জানে।

কর্ণঃহয়তো। তবে আমার জীবনের এক চরম সত্য তুমি জেনে রাখ। আমার নিষ্ঠুরতার জন্য দায়ী তুমিও।

দ্রৌপদীঃকর্ণ?

কর্ণঃসত্য বড় নির্মম দ্রৌপদী। আমার জীবনের সত্য তোমার কাছে একান্ত অপ্রিয় সেকথা স্বীকার করি।

দ্রৌপদীঃআমি আশ্চর্য হয়ে যাচিছ তোমার স্পর্ধা দেখে।

কর্ণঃকেন পঞ্চস্বামী গর্বিতা বলে?

দ্রৌপদীঃঅবান্তর প্রশ্ন।

কর্ণঃআমার অস্তিত্বই তো এক বিরাট  জিজ্ঞাসা (দীর্ঘশ্বাস )আমার অস্তিত্বের  কোনো প্রয়োজন তোমার নেই। তোমায় একটা প্রশ্ন করি আজ আমার জীবনের  কতটুকু জান তুমি?

দ্রৌপদীঃআর সকলে যতটুকু জানে।

কর্ণঃআমি শুধু তোমার  কথা জানতে চাই।

দ্রৌপদীঃ(নদীর বুকে আসন্ন অন্ধকারের দিকে মুখ ফেরালেন)সূর্য অস্তাচলে। আমাকে ফিরে যেতে  হবে।

কর্ণঃজানি তোমাকে চলে যেতে হবে। অর্জুনের কাছে। তোমায় আমি বাধা দিতে পারি না। সে অধিকার আমার নেই।

দ্রৌপদীঃঅধিকার?তোমার অধিকারের প্রসঙ্গ আসছে কোথা থেকে?

কর্ণঃ(ক্ষণকাল নীরব। নতমুখী। দ্রৌপদীর স্থির দৃষ্টি আবদ্ধ কর্ণের প্রতি। মৌনতা ভাঙলেন কর্ণ। ধীরে ধীরে মুখ তুললেন। শান্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন দ্রৌপদীর দিকে। )আমাদের বর্তমান জীবনের গতিপথ তো অন্যরকম হতে পারতো পাঞ্চালী। একজন আমাকে জীবনের সেই আদিলগ্নে বঞ্চনা  করেছে। জীবনের সমস্ত সুখানুভূতিকে সে বিনষ্ট করেছে। কিন্তু তুমি?

দ্রৌপদীঃবিধাতার বিধান নির্দিষ্ট কর্ণ। সত্যকে স্বীকার করে নেওয়াই বুদ্ধির প্রকাশ ও শ্রেয় । অসম্ভবের কল্পনায় কালযাপন বিচক্ষণতার লক্ষণ নয়। অবাস্তবকে মনে স্থান না দেওয়াই সমীচীন ।

কর্ণঃবিধাতার বিধান !তাই বটে!কিন্ত বিধাতা সত্যকে আড়াল করে ভাগ্য নির্ধারণ করেন কেন বলতে পার ?

দ্রৌপদীঃআবার সেই একই প্রসঙ্গ !

কর্ণঃএই একটি প্রসঙ্গ শেষ নিঃশ্বাস  পর্যন্ত আমার চেতনায়  জাগ্রত  থাকবে।

দ্রৌপদীঃঅসম্ভবকে মন থেকে মুছে ফেল। অলীক কল্পনাকে বিস্মৃতির অতলে নিয়ে যেতে সচেষ্ট হও।

কর্ণঃএই প্রাণ যেদিন চিতায় পুড়বে সেদিন আমার সমস্ত চেতনা অনুভূতি কালের অতল গর্ভে আশ্রয় নেবে চিরতরে।

দ্রৌপদীঃতুমি কল্পনাবিলাসী কর্ণ । সংযত হও। পেছন ফিরে দেখা বীরের ধর্ম নয়।

কর্ণঃআমি কল্পনাবিলাসী !সত্য বটে!কিন্তু  কল্পনাই তো বেঁচে  থাকার  রসদ যোগায় পাঞ্চালী। এই সত্যি তো তুমি অস্বীকার করতে পারবে না। আর ফেলে আসা জীবনকে না দেখলে জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকার  প্রেরণা কে দেবে আমায়?

দ্রৌপদীঃ প্রেরণা ?

কর্ণঃঅতীত আমাকে অনুপ্রাণিত করে। না পাওয়ার যন্ত্রণা আমাকে প্রতিনিয়ত দগ্ধ   করে। আজন্মকালের বঞ্চনা  লাঞ্ছনা প্রতিশোধস্পৃহায় উন্মত্ত করে তোলে। এত কিছুর মধ্যেও তোমার স্মৃতি আমার হৃদয়কে উত্তাল করে তোলে। আমি তোমাকে কি প্রচণ্ড ঘৃণা করি তুমি ভাবতে পারবে না। শুধুমাত্র বংশমর্যাদার মাপকাঠিতে যে নারী তার জীবনসঙ্গী নির্বাচন করে শুধুমাত্র  সেই নারী আমার যৌবনকে ব্যর্থ করেছে। একমাত্র সেই একজন নারীর জন্য আমি আমার যৌবন বিসর্জন দিয়েছি। শুধুমাত্র  ঐ নারীর জন্যঅন্য কোনো নারীকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিই নি।

দ্রৌপদীঃস্তব্ধ হও। স্তব্ধ হও কর্ণ । শান্ত হও। আমার জীবনে তোমার অনুভূতির ইচ্ছের বিন্দুমাত্র  মূল্য নেই। স্বামী -সন্তান -সংসার  নিয়ে আমি আজ এক পরিপূর্ণ নারী। তোমার জীবনের ব্যর্থতার কাহিনীতে আমার কোনো আগ্রহ নেই। সর্বোপরি এতদিন পর পুরনো  কবর খুঁঁড়ে কি লাভ বল?যা সমাধিস্থ হয়েছে তাকে জাগাতে নেই।

কর্ণঃজানি সেকথা। এও জানি যে আমাকে দেবার মতো তোমার কিছু নেই। পাঞ্চালী তুমি একজন সম্পূর্ণ নারও। আর আমি?আমি এক অস্ম্পূর্ণ পুরুষ । আমার ঘর নেই সংসার নেই স্বজন নেই। সারাজীবন ধরে শুধু জেনেছি যুদ্ধ জয়ের কৌশল। আজ আমি  বাহুবলে প্রতিষ্ঠিত  । কিন্ত একজন অসম্পূর্ণ পুরুষ এই আমার সত্য পরিচয়। এক জীবনে আমার কর্মপ্রবাহ কিছুতেই সম্পূর্ণ হতে পারবে না। কে নেবে আমার অসমাপ্ত কর্মের ভার?বলতে পার দ্রৌপদী?বলতে পার কাকে উত্তরাধিকারী  করে যেতে পারি।

দ্রৌপদীঃ(শান্ত সমব্যথী কন্ঠে)সংযত হও কর্ণ । আমি তোমার জওবন যন্ত্রণা অনুভব করতে পারি। কিন্তু তুমি তো বিচক্ষণ  তাপস।

কর্ণঃআমি জানি তুমি কেন এসেছ?

দ্রৌপদীঃজান যদি তবে যে পথে অগ্রসর হয়েছ  পার না সে পথ পরিত্যাগ করতে?

কর্ণঃহারানোর বেদনা আমি জানি।

দ্রৌপদীঃতবে কেন এ যুদ্ধের  আয়োজন?

কর্ণঃবৃথা প্রশ্ন ।

দ্রৌপদীঃযুদ্ধের ফলাফল কি তুমি কল্পনা করতে পারছ না?কত নারী স্বামীহারা সন্থানহারা হবে একবার ভেবে দেখ কর্ণ । সেইসব হৃতসর্বস্ব নারীকন্ঠের মর্মান্তিক আর্তনাদ তুমি সইতে পারবে তো?


কর্ণঃএ যুদ্ধে আমার কোনো ভূমিকা নেই। আর তুমি যে হৃদয়বিদারক আর্তনাদের কথা বলছ সে কি শুধু নারীর? যে সব পুরুষেরা যুদ্ধে মিলিত  হতে চলেছে তারা কি তাদের জীবনের প্রিয় সুখানুভূতি বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে না?তারা কি তাদের নিশ্চিন্ত নিরাপদ সুখাশ্রয় থেকে বিদায় নিচ্ছে না?যুদ্ধগামী পুরুষের আত্মা মৃত্যুর পূর্বেই বিদায় নেয় দ্রৌপদী। তাদের জন্য কি তোমার কোনো সহানুভূতি নেই?তুমি নারী বলে শুধু নারীর সমব্যথী ?তোমার কাছ থেকে পুরুষের জন্য সহানুভূতি প্রত্যাশা করা ভুল।

দ্রৌপদীঃপ্রগলভতা তোমার জন্য নয় কর্ণ। তোমার জীবনে যা কিছু ঘটেছে তা নিয়তিনির্দিষ্ট। সেসব দুর্ঘটনা । তার জন্য দুঃখ করো না।

কর্ণঃ উঃ। আবার সেই নিয়তি। আমি জানি না নিয়তি ,মানি না নিয়তির শৃঙ্খল ।

দ্রৌপদীঃঅতিক্রম করতে পেরেছ কী?

কর্ণঃকেন?কেন ?কেন আমি এমন অসহায় ?কেন এ নিষ্ঠুর বঞ্চনা ?অসহ্য। অসহ্য এই জীবনের ভার।

দ্রৌপদীঃকিন্ত কর্ণ তুমি যে পথে মুক্তি চাইছ সেই পথে আরও অনেকে অনেক কিছু হারাবে। তুমি তাদের কথা ভাববে না?

কর্ণঃভেবেছি। কিন্তু আমি নিরুপায় । প্রতিজ্ঞাপাশে বদ্ধ  ।

দ্রৌপদীঃপ্রাণের চেয়েও প্রতিজ্ঞা তোমার কাছে বড়?

কর্ণঃ না দুই সমান ।

দ্রৌপদীঃসিথির সিঁদুর আমার বড় প্রিয় ।

কর্ণঃশুধু তোমার নয়। প্রতিটি প্রণয়িনী স্ত্রীরই প্রিয়। যে গভীর প্রেমের সঙ্গে তুমি তোমার অর্জুনকে আবদ্ধ করেছ সেই পবিত্র প্রেমই পুরুষের রক্ষাকবচ,প্রেরণা ,প্রশান্তির কোমল শয্যা।
(দ্রৌপদী অশ্রুপূর্ণ  নেত্রে কর্ণের দিকে তাকালেন। নীরব রইলেন ক্ষণকাল  )

কর্ণঃবর্ণময় জীবনের বিচিত্র বর্ণ প্রশান্তভাবে গ্রহণ করো দ্রৌপদী। বিচলিত  হয়ো না। আজীবন পুরুষকে রক্ষা করেছে একজন নারী। নারীশক্তিতেই পুরুষের  বিকাশ -বৃদ্ধি।

দ্রৌপদীঃআমায় ক্ষমা করো কর্ণ । তোমাকে অনেক কটুকথা বলেছি।

কর্ণঃক্ষমা?!তোমার প্রতিটি বক্তব্য তোমার গভীর বিশ্বাস সঞ্জাত। তোমার যুক্তির সমর্থনে তোমার মন্তব্য  । তার জন্য লজ্জা বা অনুতাপ নিষ্প্রয়োজন ।

দ্রৌপদীঃআমি আসি কর্ণ। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।

কর্ণঃযাও। প্রেমের  যে প্রদীপ তোমার মনের গহন প্রদেশে প্রজ্বলিত তাকে চিরকাল জ্বেলে রেখো। তুমি সুখী হও।

দ্রৌপদীঃবিদায়কালে যাও বলতে নেই। বলো এসো।

কর্ণঃএ জন্মে তোমার আমার এই সাক্ষাৎ যেন শেষ সাক্ষাৎ হয়,এই প্রার্থনা করি। বিদায় দ্রৌপদী। আজকের সন্ধ্যার এই অন্ধকার হয়তো আমার এই জীবনের শেষ অন্ধকার । কালকের সূর্যোদয় হয়তো নতুন  জীবনের ঠিকানা বলে দেবে। আমার অপেক্ষা এখন নতুন আলোর জন্য। বিদায় দ্রৌপদী,বিদায় ।
                                        সমাপ্ত।


Sankari Biswas, Clo-Upendranath Dey, Netaji Road, Beside Jyanadadebi Girls High School, P.O- Dinhata,  Dt- Coochbehar,  PIN- 736135,   Mobile- 8159914968.



জনপ্রিয় লেখা

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৯তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮০তম সংখ্যা ।। কার্তিক ১৪৩১ অক্টোবর ২০২৪

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

মুদ্রিত নবপ্রভাত উৎসব ২০২৩ সংখ্যার ডাউনলোড লিঙ্ক

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী