শ্রমিক
ওইখানে কারখানা হবে-
সবুজের বুকে মিটিমিটি সন্ধ্যাতারা।
শ্রমিকের ঘরে ভিনদেশী চাঁদ নেমে আসে,
মিথ্যের অজগর চোখ টিপে হাসে।
খড়ের ছাউনিতে স্বপ্ন পিছলে যায়,
এক বিন্দু শিশির চোখের কোনে।
একুশের মেয়েটা লাল চেলি খোঁজে,
মায়ের কপালের টিপ সূর্যর মত জ্বলে।
ঠান্ডা ঘরে অঙ্ক কষে কোট-প্যান্ট-টাই
পোশাকের আড়ালে খাদ্যলোভী।
পান্তাভাতে লঙ্কা ঘষে শ্রমিকের ছোট মেয়ে,
তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে অবসরে ক্লান্ত
উৎসবে অবসন্ন শ্রমিক বিপ্লবী।
স্লোগানের ফোয়ারায় ভিজতে ভিজতে
লাল ফিতে কাটে প্রশিক্ষিত হাত।
শ্রমিকের হাতে ফোস্কা পড়ে
ছিটেবেড়ায় নতুন করে মাটি,
বছরের ফেরে বোনাস মেলে
বন্ধ কারখানার তালা-চাবি।
শ্রমিকের প্রতিশব্দ তখন বিপন্নতা।
নুন আনতে পান্তা ফুরোয় না,
খিদেটাই মরে যায়।
পাততারি গোটানো অজগর
শ্রমিকের বিক্ষোভে গলা মেলায়,
আড়ালে ডাবা পেট হজমের বড়ি খায়।
গান্ধীর দেশ,বুদ্ধের দেশ,
এ দেশ নির্বোধের ও।
সভ্যতার স্তরে স্তরে ঘূনপোকার বাসা,
মরচে পড়া প্রতিবাদ,সংবিধান শব দেহ।
রঙ বদলায় নীতি বদলায়,
অপুষ্ট হাত পতাকা তুলে নেয়।
মিছিলের শেষে ক্লান্ত পায়ে
সাদা থান শাড়িতে শ্রমিকের বউ,
অনেকটা পথ হাঁটলে তবে না
দৈনিক মজুরীটুকু মেলে,
কিংবা অস্তিত্ব খুঁজে পায় কেউ।
========================================
চোখের আলোয় (গল্প)
------------------পরপর তিনখানা বাস চলে গেল।মায়া তো নামলনা।আজ এত দেরি করছে কেন।প্রতি হপ্তাতেই তো যায়।এত দেরি হয়না।দূর!সমীর আর একটা বিড়ি ধরায়। আজ মায়াকে রাজি করাতেই হবে।পাঁচ বছর আগে যখন পরিমল কর্মকার ওকে গঙ্গার ঘাট থেকে উদ্ধার করে আনল সেই সেদিন থেকে ওকে ভালোবাসে।শুনেছিল ওর স্বামী নাকি ওকে বিক্রি করে দিয়ে পালিয়েছে।সম্মান বাঁচাতে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছিল।পরিমল জেঠু সেদিন ওকে দেখতে না পেলে..এমনকি যখন জানতে পারল ও চারমাসের পোয়াতি তখনো মন সরাতে পারেনি।এতদিন ধরে অনুনয় করেও ওর সেই এক কথা!ও কাউকে চায়না। না বললেই হল!এক্সিডেন্টে একখানা পা না খোয়ালে ওর আর কিসের অভাব।দেশে তো সবই রয়েছে।শুধু দু'দুটো বোনের বিয়ের দায় তাই ছোট থেকে কলকাতায় কাজে আসা।আর একটা বাস আসছে।দেখা যাক।
--------------------শোন্,একটিবার আমার কথা শোন্!বাস থেকে নামতেই মায়ার পিছনে দৌড়ে আসে সমীর।মায়া ওকে দেখেই জোরে পা চালায়।সামনেই রিক্সা স্ট্যান্ড।একবার রিক্সায় উঠে পড়লে ছাড়ান পাওয়া যাবে।ওহ্,একেবারে জোঁকের মত আটকে আছে!এই রিক্সা,কুমোরটুলি।মায়া উঠে বসে পিছনে তাকায়।সমীর তখনো ল্যাঙচাতে ল্যাঙচাতে আসছে।চেঁচিয়ে বলে ওঠে,শোন্!আমি তোকে খুব ভালোবাসি!মায়া মুখ ঘুরিয়ে নেয়।লজ্জা শরম কিচ্ছু নেই।খোলা রাস্তায় এভাবে কেউ ছি!ছি!
------------------"গলি দিয়ে ঢুকে ওই লাল বাড়িটার উল্টোদিকে দাঁড়াও।"
রিক্সা থেকে নেমেই দেখে টুম্পা কালুকে খাওয়াচ্ছে।ইশ,বড্ড বেলা হল আজ।খুব খিদে পেয়েছে ছেলেমেয়েগুলোর।ওকে খাইয়ে ভিতরে আয়।আমি ভাত বাড়ছি।ঘরে ঢুকে দেখে সোনাই ঘুমিয়ে পড়েছে।এই ক'দিনেই বড্ড মায়া পড়ে গেছে মেয়েটার ওপর।মানুষ এত নিষ্ঠুরও হয়!ওইটুকু দুধের শিশুটাকে ডাস্টবিনে ফেলে চলে যায় কী করে!ভাগ্যিস সেদিন মায়া অত রাতে ওর কান্নাটা শুনেছিল।টুম্পা ঘরে ঢুকে মা'কে জড়িয়ে ধরে।মা জানো কালু খুব ভালো খেয়েছে আজ।ওই বড় বাড়ি থেকে বাড়তি মাংস আর হাড়গুলো খুব খেল।তোমার এত দেরি হল কেন মা?মায়া ভাত বাড়তে বাড়তে বলে,আর বলিস না।বড়বাজারে এত জ্যাম।তার ওপর এত জিনিস কেনা।টুম্পা হাসিমুখে বলে,মা জানো রঘুদাদু বলছিল তোমার হাতের কাজ নাকি আরো ভালো হয়েছে।মায়া হেসে ফেলে।কি জানি।চল,এখন তাড়াতাড়ি খা দেখি।ঠাকুরের শাড়িগুলো সব গুছিয়ে রাখবি।হাতে আর ক'টা দিন সময় আছে মাত্র।ঠাকুর নিতে সব খদ্দেররা চলে আসবে।সব রেডি রাখতে হবে তো।আমি সব করে দেব মমা।টুম্পা হাসিমুখে বলে।
---------------------দুপুরবেলা আকাশের মুখ বেশ ভার দেখে মায়া চটপট সব ত্রিপল গুলো দেখে নেয়।কয়েকটা ঠাকুর এই সবে রঙ করা শেষ হয়েছে।এখনো খানিক শুকোতে হবে।তারপর শাড়ি গয়না আরো সব সাজ পরানো।কে জানে আকাশ আবার কি বলে।আচমকা বৃষ্টি এলেই সব যাবে।কত বড় বড় সব শিল্পী এখানে।নাম করা।ওর তো আর তেমন নয়।গেলে সব যাবে।পরিমল কর্মকার ছিল নাম করা শিল্পী।ওকে মেয়ে বলে ঠাঁই না দিলে আর হাতে ধরে কাজটা না শেখালে যে কী হত।ছোটোবেলায় আঁকার হাত বেশ ছিল ওর মনে পড়ে।তাই হয়ত পেরেছে।বায়না বেশ ভালোই আসে।ক'দিন নাওয়া খাওয়া ভুলে ঠাকুর তৈরি।দুগ্গা পুজোতেই যা আয়।বাকি সময় তেমন চাহিদা আর কই।মায়া একখানা মায়ের মুখ তুলে নেয়।শুধু মাটির আদলটুকু হয়েছে।চোখ তৈরি হয়নি।প্রতিবার মায়ের চোখ আঁকে আর অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়।নতুন করে নিজের জীবনটা দেখতে ইচ্ছা হয়।কিন্তু অতীতকে ভোলা কি এতই সহজ!অন্ধকার অতীত যে আরো ভয়ংকর!সমীরও যদি রঞ্জনের মত ওকে ঠকায়।তার চেয়ে এই ভালো আছে।টুম্পাকে মানুষ করতে হবে।আর ওই যে ছোট্ট সোনাই। হোকনা হাজার কুড়িয়ে পাওয়া ওকেও তো বড় করতে হবে।তার ওপর পুষ্যি দুটো আছে।নাহ্!সমীর এবার এলে ওকে দূর করতেই হবে।মিথ্যে আশা যে বড় ভয়ানক!
--------------------টুম্পাকে স্কুলে দিয়ে ফেরার সময় মায়া পানের দোকানের দিকে আড়চোখে তাকায়।দু চারজন রোজকার মতই দাঁড়িয়ে। কিন্তু সমীর নেই।মায়া অবাক হয়।রোজই তো এই সময় থাকে।ওকে দেখেই দৌড়ে আসে। আজ আবার কি হল!যাক গে,আপদটা বিদেয় হলেই ভালো।মায়া হাঁটা দেয়।হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে হাজির হয় সমীর।হাতে একটা প্যাকেট।এই নে,তোর জন্য এনেছি।পুজোয় পড়িস।মায়া বুঝতে পারে ওতে শাড়ি আছে।এত বলেও শোধরান গেলনা।ঠিক এটা ওটা নিয়েই আসবে।ওই তো কটা টাকা রোজগার ভ্যান চালিয়ে।দেশে শুনেছে মা বোন আছে।টাকা পাঠাতে হয়।তাতে আবার পিরীত!মুখে কিছু না বলে মায়া আবার হাঁটা দেয়।সমীর বলে ওঠে,বিশ্বাস কর!আমি তোকে কোনোদিন ছাড়বনা।তুই একবার সুযোগ দে!মায়া পিছন ফিরে তাকায়না।রোজ একই কথা।সবাই এমনই বলে।রঞ্জনও বলেছিল।কিন্তু বাড়ি থেকে পালিয়ে যখন ওর হাত ধরে কোলকাতা এল তখন বোঝা গেল আসলে ও কি চায়।বাড়ি ফেরার রাস্তা ছিল বন্ধ।মামার সংসারে ওকে কেউ মানতনা।সেদিন গঙ্গার ঘাট থেকে বাবা ওকে না বাঁচালে এতদিনে কোনো বেশ্যাপল্লীতে..নাহ্,আর কাউকে এ জীবনে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়।মায়া গতি বাড়ায়।
-------------------মহাষষ্ঠীর দিন সকালে মায়া চান সেরে ঠাকুর পুজো করে ওর ঠাকুর তৈরির চালায় আসে।বড় শূন্য লাগে এই সময়টা।নিজে হাতে গড়া সব মূর্তি একে একে চলে যায় অন্যের ঘরে।তাকিয়ে দেখে চালার এদিক ওদিক শুধু মাটির তাল,রঙ আর খড়ের ছাঁচ পড়ে রয়েছে।ভাঙা হাটের মত।মনটা খারাপ লাগে।দূরে একটা মূর্তি দাঁড় করানো।বায়না হতে শুধু ওই একখানাই বাকি ছিল।তাই রঙহীন হয়ে রয়েছে।মায়া হঠাৎই হাতে তুলে নেয় ঠাকুরের চোখ আঁকার তুলি।আঁকতে থাকে দেবীর চোখ।বড় আশ্চর্য লাগে ওর।সব মুখের আদল এক শুধু চোখ টুকু আলাদা।ওতেই কখনো দুর্গা কখনো কালী কখনো সরস্বতী।নইলে অতি সাধারন নারী।একই অঙ্গে বহু রূপ।আজ মায়া চোখ আঁকবে কিন্তু কোনো দেবীর চোখ নয়।সেই সাধারন এক নারীর চোখ যে চোখের আড়ালে ঘুমিয়ে থাকে হাজার স্বপ্ন।সমীর,রঞ্জন,কোনো পুরুষ সে চোখ দেখেনি।কোনোদিন দেখেনা।বরং বারবার সে চোখে পর্দা ঘিরতে চেয়েছে।শুধু বাইরেটা দেখার অভ্যাস থেকে নিজেকে দেখতে ভুলে যায় তারা।ভুলে যায় নিজের মন নিজের সত্তা।আজ সেই চোখে দৃষ্টিদান করবে মায়া।ধীরে ধীরে চোখ আঁকা হয়।টালির চালের ফাঁক দিয়ে তখন একফালি রোদ্দুর মায়ার মুখে।বড় তৃপ্ত বড় উজ্জ্বল দেখায় তাকে।
============================================
সোমা ভারতী
তারকেশ্বর, হুগলী।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন