Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

পবিত্র চক্রবর্তীর গল্প

ঢাকী




কান্ড দেখেছ!
দুগগা পুজোতে ঢাক ভালোই বাজিয়েছে কীর্তন কামার। ছোট্ট থেকেই বাপ ঠাকুরদার
হাত ধরে শহুরে হাওয়ার মাঝে ট্যাং ট্যাং করে কাঁসি পিটাতে পিটাতে কখন যে
বাপ থেকে নিজেই ঠাকুরদা হল, মনে করা দায়।
বছরের কিছু সময় তার ছক বাঁধা কাজ। তাছাড়া বার মাসের তের পাব্বন, উৎসব
লেগেই আছে, তবে তা থেকে ঘরে তোলার মত তেমন কিছু থাকে না। উঠোনের দাওয়ায়
চমরাটাকে টান করতে করতে কত কথাই না মনে পরে যায়। এই তো সেবার রায় দালানের
খড়ি ওঠা ঠাকুর মন্দিরের সামনে ঠাকুরদা পাল্লা দিয়েছিলেন অন্য ঢাকিদের
সাথে। কীর্তনের তখন উঠতি বয়স, কচি কচি গোঁফ, হাল্কা দাড়ি এদিক উদিক দিয়ে
উঁকি মারছে। কাঁসির বদলে ঢাকের বোলে হাত ঝালাচ্ছে সবে। পিঠ টন টন করলেই
দাদুর চোখ পাকানো দেখেই আবার শুরু করছে বাদ্যি।
রাত যত ঘন হচ্ছে, মা মা রব চারিদিকে। ধোঁয়া- ধুনোর গন্ধ। বৃদ্ধ রায়
মশায়ের ঘড়ি ধরা কাজ, তার সাথে নরহরি বামুনের নিয়মের মাঝে কীর্তনের বাপ
টপাটপ করে বিশাল রাম দা হাতে একটা একটা করে পাঁঠার মুন্ড মাটিতে
নামাচ্ছে। ফিনকি দিয়ে লাল রক্ত ছিটকে ছিটকে লাগছে মুখে-গায়ে। উফ ভাবা যায়
এসব পুণ্যির কাজ।
-"বলি দাদু, ঢাকের সাথে সাথে তুর চামরাও এব্বার শুকাবে, তুর ছেইলে যে
ডেইকে ডেইকে সারা" -পালুর কথায় বুড়ো তাকিয়ে দেখে বংশের একমাত্র পিদিম
দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে। দাদুর সাথে রঙ্গ করার সময় পেলেই হাত ধুয়ে লেগে পরে।
পালুর একটাই নাম। ইস্কুলের খাতাতেও ওই নাম তোলা আছে। কচি শাল গাছের মত
চেহারা। পালুর বাপ বলে এক নম্বরের খচ্চর। কান ধরে কত বার ঢাক বাজানোর
চেষ্টা করেছে। শেষে কীর্তনের কথায় পালু নাক বেঁকিয়ে ঢাক ধরে। এটা বোঝে
না, কত পুন্ন্যি করলে ঢাকি হয়ে জন্ম নিতে হয়। সময় পেলেই নাতির গায়ে হাত
বোলাতে বোলাতে বুঝিয়েছে, "দ্যাক, পেলো, তুর এই হাতেইর বাইদ্যি শুনেই
দেবতারা সগগ থেইকে মাটিতে লামেন, খুশি হন"।
পালুর হয়েছে জ্বালা , এই বুড়োর কথা খুব একটা ফেলতে পারে না। মাঝে মধ্যে
অবশ্য ঘাড়ের রোঁয়া ফুলিয়ে বলে, "হ, তুর দেবতারা খুশি হন, আমার বন্ধুরাও
দাঁত বাইর কইরে হাসে। বলে, ওই পেলো ঢাকি আইসছে"।

পালুর বন্ধু মহলটাও কম ছোট না। গাঁয়ের শেষ প্রান্তে সন্ধ্যে হলেই মা-বাপ
খেদানো ছেলে পিলেদের সাথে নানা ভাষার সম্মেলন আর কিঞ্চিৎ কটু ধোঁয়ার
মৌতাতে জমে ওঠে আসর। টিম টিমে বাল্বের আলোয় চলে নানা রঙিন পরিকল্পনা।
পালু এখানকার মাতব্বর। ভগবানের কৃপায় সুঠাম চেহারা আর মারকুটে স্বভাবের
জন্য ওর মুখের ওপর খুব একটা কথা বলার সাহস রাখে না।
-"না! এভাবে চলে না, একটা ঘড় দরকার। লক্ষী'দা অনেকদিন ধরেই বলছে পাশের
গ্রামের সঙ্গে জলে ঝাঁপাতে হবে"।
-"হ রে তোর লক্ষী'দা বলেই খালাস, তারপর, টাকাটা কে দেবে তোর বাপ!"
উত্তেজিত হয়ে মনা বলে ওঠে।
উদাস ভাবে কিচ্ছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর প্যান্ট ঝেরে উঠে পরে পালু। সারা
রাস্তায় নানা স্বপ্নের জালগুলো কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘিরে ধরে পালুর শরীরকে।
আপন বলে ওঠে "নিদেন হাজার দুই তো লাগবেই।" ঠোঁটটা কামড়িয়ে হাঁটতে থাকে
পালু। পড়ে থাকে পিছনে পড়ে থাকা শিশিরে ভেজা ধুলো পথ।
ঘড়ের টিমটিমে আলোয় পা টিপে টিপে ঢুকতেই বাবা বলে উঠলেন, "লবাব পুত্তুর
এয়েছেন, রাত –বিরেত লাই, গান্ডে পিন্ডে গিলে লাও"।
নিঃশব্দে পালু রান্নাঘড়ে ঢুকে থালা টেনে খেয়ে শুতে চলে গেল। মনে হল না
বাপের কথায় কোন ছাপ পরেছে। এ যেন এক চিরস্থায়ী। বাপ বলে যাবে আর পালু
সমান্তরাল কান দিয়ে বার করে দেবে।
ছোট্ট ঘর। কিছুটা পারিপাট্যের ছাপ আছে। যদিও বাড়াবাড়ি রকমের কিছু করার
ক্ষমতা নেই। কীর্তন কামার থেকে শুরু করে পালুর মা স্কুলের গণ্ডী পার
করাটাকে বাহুল্য মনে করেছিল এক জমানায়। তবে পালুর ক্ষেত্রে তাদের মতের
পরিবর্তন অবশ্যই হয়েছে। যদিও মাঝে মধ্যে ছেলের বেয়াদপি দেখে নিজের
পরিবর্তিত সেই চিন্তার গালে চড় মেরে বসে।
কামার সম্প্রদায়ের হলেও , কীর্তন তার ছেলের নাম নিজের সাথে মিলিয়ে
রেখেছিল গৌর। মাঝে মধ্যে সন্ধ্যেবেলায় গৌর গ্রামের বুড়ো বটের দাঁত বার
করা রোয়াকে বসে বিড়িতে জব্বর টান মেরে ভাগ্যকে এন্তারসে গাল পেরে বলে,
"কি আর হবে, এত্ত কাল ধইরে ঢাক বাজাচ্চি, আর আমার পুত্তুর ইস্কুলে গিয়ে
পূবপুরুষদের বিদ্যে লদীতে ফেলচে।"
এইভাবেই কাটে কীর্তন কামারদের প্রতি সন্ধ্যা। সামনেই পৌষ মাস। অমাবস্যার
কালী পুজো। বায়নার জন্য ডাক পরে হরিপুর থেকে। সংসারে অসময়ে দেবতারা মাঝে
মধ্যে আসেন বলে কিছুটা ক্ষরা কাটে। মা লক্ষ্মী সদয় হন। সেদিন রাতে কীর্তন
পালুর দরজাটা ঠেলে ঘুমন্ত পালুর কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে পরে। ঘোলাটে চোখে
বোঝার চেষ্টা করে নাতির মতিটাকে। ঘড়ের বাল্বের হাল্কা আলোয় নিজের কৈশোরকে
অনুভব করে। পরম মমতায় পীঠে হাত বোলাতেই জেগে পালু। বিস্ময়ে ফ্যাল ফ্যাল
করে তাকিয়ে থাকে। নাতির ঘুম ভেঙে যাওয়াতে বুড়ো এক মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে
মলাম স্বরে বলে, "পেলো, সামনেই পৌষে কালী, কর্তা বাড়ীর বায়না এয়েচে।
বাপের সঙ্গে যা তু। "
-"বুড়োর মাতাটা সত্যিই গেচে, সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা।"
-"তো কি হয়েচে বাপ! দেবতাদের চটাতে লাই রে, এবার তু বাজাবি আর আমি না হয়
কাঁসিটা বাজাবো, কেমন!"
কোনও ক্রমে ঠেকের ভাষাকে সামলিয়ে পেলো ঝাঁঝিয়ে ওঠে, "ভাগ তো, মাঝ রাতে
কেলো কইরতে এয়েচে", বলেই পাশ ফিরে জোর করে চোখ বন্ধ করে।

রাতটা বেশ গভীর। ঢাকটা জোড়েই বাজচ্ছে। বরং বেশী জোড়েই। উদ্যাম ভাবে বোল
উঠছে একের পর এক। আদিম আর্তনাদের মতো প্রাচীন উলুর সাথে জুবু থুবু থাকা
সারবদ্ধ পাঁঠার ভয়ার্ত স্বর মিলে মিশে একাকার। ভিজে উঠছে জমি, সারা হাত,
কাপড় গাঢ় কালচে থকথকে জমাট রক্তে অমাবস্যাকে করে তুলছে যোগ্য পৌষে কালীর
রাত। ফাঁক বুঝে পটু হাতে গলা সমেত কাটা মাথা তুলে নিচ্ছে কর্তা বাড়ীর
নির্বাচিত লোক।
না, পালু পৌষে কালী পুজোর ঢাক বাজাই নি। ওইদিন রাতের পর সকালে কীর্তন
কামারের সাথে গৌরও মলাম সুরের খেই ধরে। কাজ উদ্ধার হয়নি, গৌরের চিল
চিৎকার কিছুটা কানে ঢুকেছিল পালুর।
বয়েসের ভারে ন্যুব্জ কীর্তন কামার তার বাপ-ঠাকুরদার টান করা ঢাকে কাঠি
দিয়েছিল, বোলগুলো যেন বাধ্য শিশুর মত বুড়োর তালে কথা বলতে শুরু করে। এবার
আর এই কামারদের কাছে বলির দায়িত্ব দেওয়া হয় নি। গৌরের মনটা খারাপ। এহেন
ভাগ্যের কাজ পরেছে অন্য গ্রামের কামারদের। কানাঘুষায় শোনা যাচ্ছে
ব্যাটারা টাকা কম নিচ্ছে। তবে বলির মাংস বেশ ক্ষানিকটা করে পাবে।
-"ওহ! ভারী তো কম লেবে! কাটারিটাই ভালো কইরে ধইরতে লারচে", বাপের কানের
কাছে ফিস ফিস করে বলে গৌর।
_ "লিক গে, ছাড়ান দে, যা পেইচি তাতেই চালা রে", একটু গম্ভীর ভাবে বলে কীর্তন।
এবছর, ধান কাটার তাড়া নেই। জমি কোথায়! সারা বছর ফাঁক পেলে যে ভাগ চাষির
কাজ করতো, তাও গেছে। আগের বছরে তাও কীর্তনের সাথে হাত মিলিয়েছিল ছেলে আর
নাতি। নাতি হল নবাব, কীর্তনও পা হড়কে বেশ কিছু মাস বিছানার সাথে ভাব
করেছিল। গৌর একা আর কত পারবে! নাতি যত তাল গাছের মত বাড়ছে, এসব কাজকে কেন
জানি না অস্পৃশ্য অচ্ছুতের মত দেখছে। ভাগ চাষির ভাগ্য খানিকটা বুড়ো বলদের
মত।
হঠাৎ সোরগোলে সম্বিৎ ফিরে পায় কীর্তন। কোমরটাকে একটু সোজা করে ঘারটা তুলে
ধরে। লয়টা গেছে কেটে। পাশে গৌর নেই। গলাটা ঝেড়ে, শুকনো ঠোঁটের কষটা মুছে
কয়েকবার নাতি আর ছেলের নাম ধরে ডাক দেয়।

জমাট ধুনোর গন্ধ ম ম করছে, ভিজে ফুলের গন্ধের সাথে বাতাসকে ভারী করে
তুলেছে নানা ফল-দুধ-রক্তের নোনতা গন্ধ। এসব আর নাড়া দেয় না কীর্তনদের।
আচমকা শরীরটা কেঁপে উঠল পালুর অশ্লীল গলার শব্দে। নিজের কানকে বিশ্বাস
করানোটা কঠিন। তবে যতই এগিয়ে যাচ্ছে কীর্তন ততই ছেলের রগরগে গলাটাও শুনতে
পেল। চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে একটা জায়গায় বেশ কিছু লোকের মাথা গোল হয়ে
দাঁড়িয়ে আছে, সঙ্গে চলছে হাত-পা নাড়িয়ে কথাবার্তা।
ফাঁকা জায়গায় সন্তর্পণে ছাল ওঠা ঢাকটা রেখে বাঁকা দেহটাকে সেদিকে নিয়ে
যেতেই কীর্তনের চক্ষু চড়কগাছ। একি! পেলোকে পেরে মারছে কেন?
বেশ কিছু শক্তি ফিরে পায় বুড়ো। কোঁচকানো শিরা ওঠা হাতে ভিড় করে থাকা
ভক্তদের সরিয়ে এগিয়ে যায় কীর্তন। ঘাড় গোঁজা পেলোর পাশেই ফুঁসতে থাকা
ষাঁড়ের মত গৌর মাজায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
-"ও গৌর, বাবা কি হইচে বল রে, পেলোকে কি কললি!", শত বছরের প্রাচীন
অশ্বত্থের পাতায় হাওয়া লেগে যে ভয়ার্ত আওয়াজ ওঠে, কীর্তনের স্বরে যেন
তারই অনুকম্পন জেগে উঠছে।
-"লাও লাও আর মাতা খেয়ো নি, তুর লবাব কি কইরেচে, হারামজাদা" ফুঁসতে
ফুঁসতে জবাব দেয় গৌর।
হাজার কথার মধ্যে সব কথা যেন হারিয়ে যায়। বেদীর কালী মূর্তির নিথর পাঁঠার
নীলাভ চোখের মত কীর্তনের চোখ বোঝার চেষ্টা করে। রাশি রাশি ঝাঁঝালো কটু
নগ্ন কথার সারমর্ম যখন আশি বছরের বুড়োর কালচে খড়ি ওঠা ধুলোটে হৃদয়ে ঢুকল,
বুঝল কি আহামক্কের মত কাজটা সে করেছে। ঢাকের বায়না তো দূর অস্ত, মুখও
দেখবে না কেও গ্রামের। হয়ত, বাবুদের কৃপাতে একঘড়ে হয়ে পরবে।
-"পেলো এইটা কইরতে পাইরলি! এত্ত বচরে এইমনটা কেও কইরে নি বাপ" নিঃস্পন্দ
গলায় কেটে কেটে ধীর ভাবে বলে কীর্তন। না, চোখ দিয়ে জল পরছে না। তারা
কামার। শত লোহার বল বুকের প্রতিটা পাঁজরে। অনেক ঘটনা জীবনের ইতিহাসকে
ওলট-পালট করেছে। বুকের ভীষণ এক গভীরে নাড়া খেলেও, চোখের জলে মণি কখন ভাসে
নি।
_ "বেশ কইরেচি, আবার কইরব দইরকার হলে", কথাটা বলে পালু মার খাওয়া ফুলো
ফুলো চোখে টলতে টলতে হাঁটা লাগাল।
কর্তা মশাইয়ের মন। ধন্যি লোক। ঘাড় ধরে বার করে দিলেও, লোকের হাত দিয়ে
হাজার তিনেক টাকা কীর্তনের হাতে দিয়েছে। অবশ্য, গৌর বা কীর্তন ধুলোয় বসে
বার কয়েক নিষ্ফল ব্যর্থ আবেদন করতে পিছিয়ে যায় নি। কর্তা পাথর চোখে
তাকাতেই, কিছু মাতব্বর গৌরের পিছনে লাথ মেরে পায়ের সুখটা জমিয়ে করেছে।
অতি উৎসাহীরা ঢাকের চামড়ায় বেশ কিছু আঁকিবুঁকি কেটে বাদ-প্রতিবাদও
জানিয়েছে।

জীবনের গতিপথ কুয়াশা ঢাকা এক সরল রেখা। সরল যে অনেক সময় আক্ষরিক অর্থে
জটিলতার রূপান্তর। হয়ত সেই আলেখ্য বুঝতেই জীবনের অনেকটা সময় শেষবারের
জন্য জ্বলে ওঠার অবলম্বন খোঁজে। তার তাগিদে এক অনামী সন্ধ্যায় বিছানার
পাশে শুয়ে কীর্তন হাতরে বেড়ায় ফেলে আসা রুক্ষ পথ। এখন তার চোখ দিয়ে যে জল
বেরোয়, তার নাম কান্না কিনা বোজা মুশকিল। তবে তীব্র দহন যে তার হাড় বার
করা বুকের খাঁচার বাইরের না, সেটা বোঝে একমাত্র নিজেই। কিছু দড়ি ছেঁড়া
খাটিয়ার একচেটে জীবন আজ তার সর্বক্ষনের সঙ্গী। মাঝে মধ্যে গৌর এসে উঁকি
মারে। ঘোর কাটলে কীর্তন ক্ষয়াটে জীর্ন ভুরূর ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করে।
দুর্বোধ্য ভাষায় চলমান জীবনের অভিযোগ জানাতে ছাড়ে না। আদৌ অভিযোগ না
অনুনয় তা গৌর কেন কেওই বোঝে না!
-"শুইয়ে থাক, চিল্লাতে হবেক লা, পেটের ভাইত তো আইনতে হবেক", নিত্যদিনের
রোজনামচার মত বলে বেরিয়ে যায় গৌর। এইভাবেই শুরু হয় দিন আর শেষও হয় অনুরুপ
ভাবে। ঢাকের বোলের ছন্দ কীর্তন কামারের গত হয়েছে মাস ক্ষানেক হল।
সামান্যের মাঝে অসামান্য নানা রূপে আসে। সেই আকস্মিক পরিবর্তনের লয় ধরতে
পারলে জীবন তোমার, না ধরতে পারলেও জীবন সেই তোমারই থাকে। শুধু পটভূমি যায়
পরিবর্তিত হয়ে। কর্তা বাড়ির ঘটনাটা পালুর কাছে ছিল তীব্র প্রতিবাদ। উঠতি
বয়েসের এক চেতনার মিশ্রণ। তবে তা তথাকথিত শাস্ত্রের পরিপন্থী কিনা তা
ভাবার সময় তার ছিল না। নিরীহ জীবহত্যা লীলার বিরুদ্ধে এক কিশোরের চরম
থাপ্পর।
সেদিন থাকতে পারে নি পালু। চোখের সামনে ছটফট করতে করতে নিথর হয়ে যাওয়া
নির্বাক পশুগুলোর ভাষা যেন তার কানের পর্দাকে ছিঁড়ে দিচ্ছিল। পালু যে আগে
এসব দেখে নি তা নয়। কিন্তু কৈশোরের প্রাবল্য তার মনের অতলে জাগায় প্রশ্ন,
অনুভূতি। কাঁসিটা টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে কাটারি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা কামারের
গালে সপাটে থাপ্পর মারতে সে বেশী চিন্তা করে নি। চিন্তা করে নি নামাবলী
কোমরে জড়িয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুতের অস্তিত্বকে। গলাটা টিপে ধরে
থামিয়ে দিয়েছিল অর্থ না বুঝে মন্ত্রের কচকচানি
প্রাচিত্তির সহ শুদ্ধ ভাবে হোম করে আবার শুরু হয়েছিলো পৌষে কালীকে তুস্টি
করার পালা ।শুধু পালা পরিবর্তন হয়েছিলো কীর্তন-গৌরদের গতিপথে। তবে,
সেদিনের এই দুঃসাহস ভোলা কি যায় !ক'জনের মনের মধ্যেই বা জেগে ওঠে আদিম
রূপের মধ্যেও আদিমতা।

কামার জীবনে এহেন ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে যায় প্রাচীন কীর্তন। বিরোধ বাধে নিজের
সাথে নিজেরই। গৌর যখন তার 'লবাব'কে বাঁখারি দিয়ে পিটাচ্ছিল থামাই নি সে।
এটাই পালুর প্রাপ্য শাস্তি। মার খেতে খেতে কঁকিয়ে বলেছিল, "শালা, বেশ
কইরেচি, কোন ধম্মে লিকেচে কালী মাংস খাবে, আর তোরা নাকি শিল্পী, লাচ
ভাইলো কইরে..." কথাটা শেষ করার আগেই রাগের মাথা খেয়ে বলিষ্ঠ গৌর পালুর
মুখে দেয় সজোরে গুঁতো। রক্তে ভেসেছিল গৌরের হাত। লুটিয়ে থাকা ছেলেটার
পাশে পিচ করে থুতু ফেলে চালার মধ্যে ঢোকে। কীর্তন ভালো ভাবে বোঝার আগেই
গৌর হিড় হিড় করে টেনে তাকে নিয়ে যেতে যেতে বলে, "শালো থাকুক পইড়ে।"
' তোরা নাকি শিল্পী, লাচ ভাইলো কইরে',- এ কথার মানে যে কতটা নিষ্ঠুর
হাসির মত তা এতদিনে বোঝে নি কামার শ্রেণীর এই প্রাচীন প্রতিনিধি। বার বার
করে ঘুরে ফিরে আসে কীর্তনের মাথায় পালুর মার খাওয়া জড়ানো গলার ব্যঙ্গ।
ধর্ম বা শাস্ত্রের তলোয়ার তাকে যতটা না কাটাকুটি করেছে, তার থেকেও বেশী
বার এই ভোঁতা অথচ ছ'টি শব্দের চাবুক তার পঁচাত্তরটা বছরের ধারাপ্রবাহকে
আকস্মিক ভাবে মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছিল বারবার। ঝর্না থেকে নদী চলতে চলতে
অন্তিম লগ্নে এসেও অনেক সময় পথের ক্লান্তিতেই যে ভাবে হারিয়ে ফেলে মাটির
সাথে সখ্যতা, সেই নিয়মটা কীর্তনের শিল্পী সত্ত্বাকে এক কঠিন কথার অনুরণনে
করে তুলেছিল শুষ্ক।
পরদিন সকালে গৌরের কড়া নিষেধ অমান্য করে ' লবাব'-এর কাছে ছুটে যেতে গিয়েই
ধাক্কা খায়।
-" পেলো, ও পেলো ওঠ রে, গৌর দ্যাকে যা লাতি উঠছেক লাই", মাটিতে বসে পরে
নাতির ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া মাথাটাকে কোলের উপর তুলে ডাকাডাকি জুড়ে দেয়
কীর্তন। কাক ভোরে ক্ষোয়াটে গলার চিৎকারে পথ চলতি লোক, কামার পাড়ার
হাঁপরের দড়ি ছেড়ে হুমড়ে পরে কিছু মানুষ। গৌর ছেলেকে পাঁজাকোলা করে ঘড়ের
মধ্যে ঢোকে। কীর্তন পাথরের মত পা ভাঁজ করে উবু হয়ে বসে থাকে উঠোনের সজনে
গাছের ছড়ি ছিটিয়ে থাকা পাতা-ফুলের মাঝে। অদূরেই শিশিরে ভিজে থাকা খয়েরি
রক্তের উপর জমতে শুরু করেছে ধুলোর আস্তরণ। গুন গুন করে শুরু হয় কামার
পাড়ার গুঞ্জন। সূর্যের আলোয় ভর করে বগল ছেঁড়া সোয়েটার, র্যা পার জড়িয়ে
আসে কীর্তনের মত কিছু রোঁয়া ওঠা প্রাচীনের দল।
-"ওঠ রে কেত্তন। চুপ কইরে থাকিস না রে। বিশে ডাগতার লিয়ে আইসলেই দেইখবি
লাতি ছুইটবে।"
-"হ গো কেত্তন'দা ডবকা লাতি তুমার, বইসে বইসে না ভেইবে উইঠে পর।"
-"বড্ড ভালো গো তুর লাতি, উটতি বয়েসে কাইলকের মত কাইন্ড কইরে থাকে, তা
বলে গৌর বাড়াবাড়ি কইরবে কেনে?"
বাক্যবাণে জর্জরিত কীর্তন বোঝাতে পারে না বা হয়ত বোঝানোর চেষ্টাও করে না।
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে মাটির দিকে। অস্ফুট গলায় বলার চেষ্টা করে, "
শিইল্প, আমি কি ঢাকি..."
বোধের বাইরে কথাগুলো চলে যাওয়াতে কামার পাড়ার কিছু চ্যাঙরা ছেলের দল
ধরাধরি করে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে আসে। আশ্চর্য মানুষ আর তাদের জীবন! কালকের
ঘটনায় প্রায় একঘরে করে দেওয়ার নিদানের পক্ষে একজোট হয়ে গলা চড়িয়েছিল, আর
আজ এক রাতের প্রবাহে নতুন এক উৎসাহে কীর্তন, পালুকে সমবেদনা জানাতে
একবারের জন্য কার্পন্য করতে ভোলে নি। ভুলে যায় নি না দেখা নিশুত রাতের
ঘটে যাওয়া ঘটনায় নানা রঙের পরত চাপাতে।

কিছুদিন ধরেই আকাশটা ঘোলাটে হয়ে থাকতো। আজ সকাল থেকে তামাটে মেঘ কালো করে
শুরু হল অঝোরে বৃষ্টি। শিং নামিয়ে গরুগুলো ডাক ছেড়েছে। কামার পাড়ায় আগুণ
নিভু নিভু। বৈশাখীর মা কোমরে শাড়ির খুঁট খুঁজে ধানিকে মাঠ থেকে আনতে
ছুটেছে। হাওয়ার দাপটে রতন কামারের দাওয়ার প্লাস্টিকের ত্রিপল পাল্লা দিয়ে
কোন মতে টিকে আছে। গৌর কোনমতে ছাতাটা চেপে ধরে বাড়ির কাছে আসতেই ঠুন ঠুন
করে শব্দ। ভ্রূ জোরা কুঁচকে দোরের দিকে কান পাততেই বুঝলো, আওয়াজটা একটু
জোড়াল একঘেয়ে তালে বেজে চলেছে। এ যে ঢাকের বোল!
অনেক দিনের চেনা লয়। ছাতাটা দাওয়ার এক কোনে কোন মতে ফেলে কাদা পা নিয়ে
দরজাটা খুলতেই দেখে ঘড় অন্ধকার, জানলা দিয়ে জোলো হাওয়ার সাথে বৃষ্টির
ছাঁট ঢুকছে। চোখ বুলিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো শব্দের উৎস।
-" বাবা, জেইগে আছ নাকি," কিছুটা অজানা আতঙ্ক মিশ্রিত গলায় ডেকে ওঠে গৌর।
জানলাটা বন্ধ না করে বাপের কাছে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। খাটিয়ার একপাশে
রাখা ছাল ওঠা ঢাকটার উপর টপ টপ করে বিন্দু বিন্দু জল চুঁইয়ে পড়ছে। শব্দটা
ওখান থেকেই উঠে আসছে। ঠিক যেন প্রাচীন সভ্যতার ইতিকথার ধোঁয়াটে নিশীথের
কথা বলে চলেছে। দিচ্ছে অস্তিত্বের প্রমান। শেষ হয়েও না শেষ হওয়া
সংগ্রামের বীরত্বকে। গৌর থমকে থাকে। দেওয়ালের স্যাঁতস্যেঁতে কোনায় বসে
পরে। রুক্ষ চামড়ায় আজ জলীয় বাষ্পের কণা লেগে আছে। ফাটা চামড়ায় আজ শীত
আঁকিবুঁকি কাটছে স্বল্প । তবুও এক সহনশীল খোঁচায় সচকিত হয়ে গৌর তাকায়
কীর্তনের দিকে। কিছু বলতে গিয়ে অজানা কান্নায় কামার জীবনের চোখটা সজল হয়ে
ওঠে। অস্ফুট শব্দে বিড়বির করতে থাকে।
- "বাবা তুর হাইতটা লইরছে রে আবার, পারবিক তু।" শুকনো মাটিতে বৃষ্টির
প্রথম জলকণা প্রথম যে ছন্দের মদিরতা তোলে, তারই যেন অমোঘ ছোঁয়া লেগেছে
কীর্তনের দেহে । সমূল উৎপাটিত বৃক্ষেরও কোন না কোন অংশ লেগে থাকে মাটির
গহ্বরে। দীর্ঘ টানাপড়েনের ইতিহাস লেগে থাকে মানব জীবনে, তার সত্তার কোন
এক প্রহেলিকাময় পটভূমিতে ।
নাতির 'তোরা নাকি শিল্পী, লাচ ভাইলো কইরে' কথাটা যে কতখানি তার শিল্পী
সত্ত্বায় আঘাত হেনেছিল, তা এক উঠতি কিশরের মনে নাও দাগ কাটতে পারে।
কিন্তু, কিছু আপাত বালখিল্য কথা পরিবর্তন করে দেয় মানব জীবনের আলেখ্য।
দোষ পালুকে সত্যি কি দেওয়া উচিত! প্রশ্নটা আপেক্ষিকতার প্রসঙ্গ টানতে
পারে। এটা ঠিক আপেক্ষতার বিচার করতে বসলে অনেক কিছুই জীবনে পাওয়াও যেমন
হয় তেমন, হারাতেও হয় তার বেশী। বেশ ক'টা মাস বিছানায় থেকে কীর্তনের
অবচেতন মনে যে কথা ঘুরপাক খায়, তা এক অজানা রহস্যে আবৃত। সেই সত্য
উদ্ঘাটন করার সামর্থ্য হয়তো কারোরই নেই। তবু বোধ যখন সজাগ হয় তখন সময়
অনেকটা চলে গেলও ফেলে যায় কিছু দাগ। সেই দাগের ভরসায় শুরু হয় বাকী পথ
চলা।
থরথরে করে ঠোঁটটা কেঁপে ওঠে প্রাচীন কামারের শুষ্ক মুখের প্রতিটি বলি
রেখায়। কয়েকবার ঢোঁক গিলে যেন কীর্তন বলতে চায় তার ঘুমন্ত দেশের অনুভুতির
কথা। শীতের কোল ছেড়ে এক ক্ষুদার্ত অজগর যেমন অতি ধীর লয়ে এগিয়ে চলে
খাদ্যের সন্ধানে। কীর্তনের দৃষ্টিও সেই সর্পিল আকারে ঘুড়ে ফিরে দেখতে চায়
কিছু একটা।
_ "পে-লো ক-ই , বা-ই-দ্যি-টা ল-ই-য়ে আ-য় ", শ্যাওলা ধরা বটের কোটরের কোন
এক অতল অন্ধকার থেকে বেরল কীর্তনের ভাঙা ভাঙা স্বর।
প্রথমে বুঝতে অসুবিধা হলেও , ক্ষানিক পরে গৌর বুঝে যায় কথাটা। ক্ষানিক
চুপ করে থেকে শান্ত গলায় বলে, "তু একটু সুইস্থ হইয়ে ওঠ, সব হবেক।"
অকাল বৃষ্টির ছাঁট ঘড়ের এক কোণকে ভিজিয়ে তুলেছে। সব দেখেও ধীর ভাবে
এগিয়ে যায় জানলার কপাটের কাছে। সুক্ষ গুঁড়োর মত জল কণা ভিজিয়ে তুলছে
গৌরের রঙ ওঠা জামাটাকে। আজ খারাপ লাগছে না, বরং বেশী করে আসুক জল ধারা,
ভরিয়ে তুলুক ফুটি ফাটা বক্ষ পিঞ্জরকে। সজীব করে তুলুক খয়েরী হৃদয়ের
প্রতিটি স্পন্দনকে। ভাবের ঘোরটা তা কাটলো একটু পরেই। আকস্মিক ভাবে রঙ ওঠা
আধ খাওয়া দরজার ঠন ঠন করে কড়া নাড়ার শব্দে। একবার নয় –দু'বার নয় বেশ
কয়েকবার, জোড়েই। এবার জানলাটা দ্রুত বন্ধ করে, দরজার দিকে পা চালায় গৌর।
পাল্লাটা খুলতেই আরও এক বিস্ময় তার চোখে মুখে আছড়ে পড়ল। একটাই শব্দ অতি
কষ্টে বেরোল, "তু...!!"
- "এইখানেই দাঁইড়ে রাইখবি নাকি!" প্রশ্নটা ছুঁড়েই ভিতরে ঢুকে জামার বোতাম
খুলতে থাকে পালু।
জটিল তত্ত্বে ভরা মানব জীবন। তার থেকেও নানা আবরণে ভরা ব্যবহারিক
বৈচিত্র্য। গৌর দরজার দোরেই নিঃস্পন্দের মত দাঁড়িয়ে থাকে। দুটো চোখ
লেপ্টে থাকে পালুর দিকে। বোঝা মুশকিল তার চোখের দৃষ্টি কী আদৌ কোন অর্থ
খুঁজছে! বেশ কিছু মাস ধরেই এই হাল। বয়েসের আগেই আর এক বয়েস যেন তাকে গিলে
ফেলছে ক্রমশ। সেদিনের ঘটনার পর পালুকে নিয়ে নানা চর্চা বেশ কিছুদিন এক
পল্লী জীবনে চায়ের আড্ডা, কামাড়শালা এমনকি রায় বাড়িতে জমে উঠেছিলো। একটু
দুরের গ্রামীন হাসপাতালে কটাদিন পরে থাকতে হয়েছিল পালুকে। অসময়ের যদি কোন
ফুল ফোটে তাহলে তাকে ঘিরে যেমন কথাও হয় ঠিক তেমনি নানা মানুষের অতি
সক্রিয়তাও দেখা যায়।
পালুর ঞ্জান ফিরতেই যে মানুষগুলো বৃদ্ধ কীর্তনকে, গৌরকে নানা ভাবে
সাত্বনা দিয়েছিল তারাই আবার উস্কানির আগুনটা জ্বালাতে কম সাহায্য করে নি।
স্রোতহীন পুকুরে একটা ঢিল যে তরঙ্গ ক্ষনিকের জন্য ওঠে, অনুরূপ ভাবে এক
নতুন উৎসাহে জেগে উঠেছিল কীর্তনের অসম্যের প্রতেবেশীকুল। তবে এটাই
আশ্চর্যের পালুকে পুলিশের কথা যতবারই বলা হয়েছে ততবারই ক্ষীণ স্বরে বাখান
দিয়ে উঠেছিলো।
- "তুরা লিজের ঘড়টাকে সামলা শালো রা..."
স্তম্ভিত হয়ে যায় পালুর এই ব্যবহারিক পরিবর্তনে। বাখান থেকে মা বাপ তুলে
কাঁচা খিস্তিটা নতুন নয়, বরং ডাগর ছেলের মুখে বড় মানানসই। কিন্তু
প্রতিশোধের আগুন এত তাড়াতাড়ি নিভে যাবে এটাই অবাক করার মত!
অবাক হয়েছিল আরও ঠিক দু-একদিন পর, হয়ত আলোচনার রসদ আর মর্ম বানীর শোনানোর
দুই রাস্তা প্রস্তুত করে পালু ঘড়ে আর পা বাড়ায় নি। কীর্তনের চোখ দিয়ে
একটা শুষ্ক জলের রেখা কী যে বলতে চেয়েছিল নিজে কে তা বোঝাই দুঃসাধ্য ।
গৌর পুরপুরি পাথর না হলেও ছেলের দোষের গুণাগুণ হয়ত কিছুটা বিচার করার মত
ক্ষমতাটা অর্জন করেছিল। সাধারণত জীবনে অনেক বড় কিছু হওয়ার পর মানুষের
বোধেরও পরিবর্তন হয়! গৌর কেন তার ব্যতিক্রম হবে?
শাস্ত্র ঞ্জানহীন হতে পারে কীর্তন বা গৌর, তবে, এটা হয়তো বুঝেছিল, পালু
খুব একটা ভুল নয়। সত্যিই, টাকার জন্য তাদের ঢাক বাজাতে হয়। পেটের তাগিদ
বড় তাগিদ! রক্তে ভেসে যাওয়া মন্দির প্রাঙ্গনের সাথে তাদের শিল্পের কোন
যোগই নেই। পাশের পাড়ার জগু, মধো বলেছিল, "দ্যাক গৌর ছেইলটা তোর বইড্ড
পাকা। আরে বাবা ফেইল কড়ি মাকো তেল।"
হরেন খুড়ো মুখ ঝামটা দিয়ে মরা মাছের মত কীর্তনকে বলতেও ছাড়েনি, "সহাগের
লাতি! তা বইলে শিইল্প শিইল্প করে ... পেটে টান পড়লেই সব পাছা দিয়ে বেইড়ে
পইড়ত!"
পালুর আকস্মিক কোথায় চলে যাওয়ার পর খুব একটা খোঁজ নেয় নি কেউই। বেয়াড়া
ছেলের থাকা থেকে না থাকাই ভালো, এই ভাবতে টকটকে লাল লোহার পর বলিষ্ঠ
হাতুড়ির ঘা দিতে দিতে বহুবার ভেবেছে। আর যত ভেবেছে, ততই সেই অবয়বহীন লোহা
কোন ফাঁকে যে কাটারীতে পরিণত হয়েছে খেয়ালই সে করে নি!
খেয়াল যখন এলো তখন দেখে যতটা পাতলা হওয়ার দরকার তার থেকে বেশী পাতলা হয়ে
গেছে। আর কয়েক ঘা দিলে ওটা আর কাটারীই থাকত না। সাঁড়াশি দিয়ে ধরে জলে
ফেলতেই ছ্যান করে গরম ধাতু এক শান্তির নিঃশ্বাস যেন কোন অতল থেকে ছাড়ে।
যেন বলতে চায়, সৃষ্টির মধ্যেও থাকে শৃঙ্খলা, অনুশাসন, তার বাইরে বেরোলেই
সৃষ্টির অবমাননা।
পেটের জন্য সৃষ্টি,না, সৃষ্টির জন্য পেট! আপাত সংসারী মানুষ কীভাবে দেখেন
সেটা তাদের রুচির বিষয়, বাঁচার ও বাঁচানোর তাগিদের বিষয়। পালু হয়ত,
পরোক্ষ স্বার্থ যুক্ত শিল্পী, যার উন্মাদনা সৃষ্টির মধ্যেই সীমিত, আবেগ
বাধাহীন। হাজারো পরস্পর পক্ষ ও বিরোধী কথায় চঞ্চল হয়ে পড়েছিল সেই পুজো
এবং তার পরবর্তী ঘটনা ক্রম। যতই চঞ্চলতা বেড়েছে স্তিমিত হয়েছে তার পিতৃ
মন।

- "হাঁ কইরে কি দেইকছ, দরজাটা দাও কেনে!" পালুর কথায় সম্বিত ফিরে পায় গৌর।
দরজার পাল্লাটা বন্ধ করে গৌর বলে ওঠে, "কুথা থেইকে আসছিস?"
- "ও বড্ড জব্বর বিষয়, কাইল দেইখতে পাবেক, শালো এই 'ফাঁপি'র চোটে লস্ট না
হইয়ে যায়।" সত্যিই এই অকাল পউষে বাদলায় আর 'ফাঁপি'র তান্ডবে জীবন কিছুটা
বিপর্যস্ত। তবে বহুকাল পর এমন হওয়ায় একটু অন্য মেজাজে আছে প্রকৃতি।
প্রকৃতিও তো মানুষের মত। পালুর কথায় সন্দেহটা কেন জানি না আরও দীর্ঘতর
হতে থাকে বাপের মন।
পালু উদ্বেগহীন ভাবে দাদুর কাছে গিয়ে বুড়োর কঠিন কর্কশ গালের চামড়ায় টান
মেরে আদরের সুরে বলে ওঠে, "বুড়ার বইড্ড গোসা, অনেক শুইয়ে লিয়েছিস, কাল
সকালে তুকে লাচাব দেইকে লিছ।"
দাদু আর নাতির বহু পুরনো এক দৃষ্টি বিনিময় হয়। বহুদিনের বীজ যেমন তার
ছোট্ট মাথাটি দিয়ে শক্ত মাটির গালে স্নেহের চুম্বন দিয়ে বলে ওঠে, এবার
আমাকে আলো দেখাও, জেগে ওঠে নতুন অঙ্কুর। কীর্তনের চোখে দেখা দিল সেই নব
কিশলয়ের স্নিগ্ধতা।
ঘড় থেকে পালানোর উদ্দেশ্য ঠিক উদ্দেশ্যমূলক ছিল না। অদ্ভুত একটা বিষণ্ণতা
পালুর মনে দাগ কেটেছিল। হয়ত ওই ঘটনাটা হয়েই পালুর জীবনে কিছুটা হলেও
পরিবর্তন এনেছিল। সে তার রায় বাড়ীর ঘটনার উপর কোন কারনেই অনুতপ্ত নয়। মনে
মনে সে আজও তা স্বীকার করে। নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা ধর্মের নামে! ঠিকই করেছে।
কিন্তু অন্তরে দাগ কেটেছে তার দাদুকে কথাটা বলার পর। যদিও সে কতটা বুঝে
বলেছে তা সে নিজেও জানে না।
যতবার পালু নিজের সাথে নিজে কথা বলেছে ততবার অনুভব করতে পেরেছে সেই
কথাটার তাৎপর্য। এটা বুঝেছে, অশতিপর ওই বুড়ো তাকে, তার পরিবারকে নিরন্তর
ভাবে বাঁচিয়ে রেখেছিলো ঢাকের জোরেই । আজ ওই বাদ্দ্যিটা যদি না জানত তার
অশিক্ষিত দাদু তাহলে কেমন জীবনযাত্রা হত! সেটা অন্য প্রসঙ্গ।
শিল্পের জন্য সাধনা, না বাঁচবার জন্য শেখা! এই জটিল তত্ত্ব বোধ করি কেউই
ভাবে না, কীর্তনও ভাবে নি। বাপের ধারাকে বজায় রেখে তার আগামী প্রজন্মকে
এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, এই সরল অঙ্কে হয়ত ছিল তার জগত। তবে কীর্তন ভালবেসেছিল।
শহরে কিছুকাল কুলিগিরি করে বুঝেছে, জীবনে বাস্তবের দৈর্ঘ্যটা বড্ড রকম
বেশী। তাও কামারের কাঠিন্য পালু ভোলে কী করে, এ যে তার অস্তিত্ব! কিছু
টাকা কোনমতে রোজগার করে সে ফিরে এসেছে তার গ্রামে। কী ভাবে কোন পথে
রোজগার করল, সেটা না হয় নাই জানলাম।

পরের দিন সকালে বাদলা কমে গেছে। ফাটা ঠোঁটের মত জমি সমস্ত নির্যাস সংগ্রহ
করে কিছুটা প্রশান্ত। পালু ভোর থেকেই কোদাল হাতে গ্রামের পাঁচটা ছেলের
সাথে ভিজে আগাছা গুলো পরিস্কার করে যেন বলতে চাইছে, সকল মলিনতা ভুলে আবার
তৈরী হোক নতুন জমি।
- "কে পালু নাকি? কবে এলি বাপ", মুরুব্বি গোছের এক বুড়ো পালুকে জিজ্ঞাসা করে উঠল।
- " ও দাদু, এয়েচি কাল গো। আজ এস বাদ্দ্যি শোনাব," পালু হাঁসতে হাঁসতে জবাব দিল।
বেলা যত গড়ায়। ভগ্ন শীতের সকাল একটু তার পরিধিও বিস্তার করে। বেলা একটু
বেড়েছে। তবে, আজ গ্রামে যেন অকাল উৎসব লেগেছে। গ্রাম্য জীবনে খুশীর
প্রলেপ। সাঁঝ বেলায় শাঁখের ফুঁ দেওয়ার পর বারয়ারি তলায় আসর জমানোর জন্য
বাউল গানের আসর বসবে।
পালু গ্রামে ফেরার পথে কিছু টাকা দিয়ে এসব কান্ড করে আসে।
সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালানোর পর, যে যার মত বেড়িয়ে এসে জমতে থাকে অনুষ্ঠানের
জায়গায়। শীতের প্রাবল্য না কমায় মা তার বাচ্চাকে বেশ খানিকটা পুরনো উলের
সোয়েটার চাপিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ এই অত্যাচারের আতিশয্যে শিশু প্রবল চীৎকারে
প্রতিবাদ জানিয়ে উঠলেও আসর ছাড়া যাবে না। এমন সুজোগ সীমিত কামার ও
গ্রাম্য কুলে কমই পাওয়া যায়।
- "চল বুড়া আইজ দেইখবি তোর পেলো কেমন লাচায়," পাজাকলা করে পালু কীর্তনকে
তুলে আনে। মঞ্চের পাশে খাটিয়ায় শুইয়ে দেয়।
ক্রমে রাতের সাথে সাথে বাড়ছে লোক, বাড়ছে হ্যজাকের আলোর তীব্রতা। বাউল
গানের পর পালু তার বন্ধু জছোনের বাড়ী থেকে নিয়ে এলো লাল শালুতে মোড়ানো
ঢাক।
চমকে ওঠে গৌর। ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকায় কীর্তন। মাথায় তার জমে থাকা
ধোঁয়ার মত কুন্ডলীকৃত চিন্তা যেন বেড়িয়ে আসতে চায়। ঢাকটা পালু কাছে নিয়ে
যেতেই প্রাচীন বদ্ধ দরজার মত ঠোঁট দুটি কেঁপে ওঠে তির তির করে।
- "দ্যাক, এিটা কে বইলে চাদর, কেমন শইব্দ হয় দ্যাক কেনে," বলেই
প্লাস্টিকের শক্ত কাঠি নিয়ে নতুন পাতলা ফাইবারে মোড়ানো ঢাকে কাঠি দিয়ে
বাজাতে থাকে পালু।
গম গম করে ওঠে চারি দিক। চামড়ার ঢাকের বদলে নতুন সাজে ঢাক। দিব্ব্যি সুরও
তোলে। বাজিয়ে চলেছে পালু। এক উন্মাদনা যেন তার আজ প্রতিটি রন্ধ্রে
আবর্তিত হতে থাকে। কার তাগিদ, কীসের জন্য তার এই প্রচেষ্ট!
বেশ খানিকক্ষণ বাজানোর পর থামে পালু। শীতের রাতেও দরদরিয়ে ঘাম ছুটে
চলেছে। ঝাঁকড়া চুল মুখের সামনে থেকে তুলে বুড়োর কাছে মুখটা নামিয়ে বলে, "
বইল্লি না তো কেমন হল!"
মানব জীবনে প্রত্যাবর্তন নানা ভাবে আসতে পারে। এটা নয় যে জীবন কাওকে
সুজোগ দেয় না। এটা নয় মৃত্যু দোরগোড়াতে দাঁড়িয়ে আছে বলে আরও একবার আশা
দেখবে না।
কীর্তনও পেয়েছিল। দীর্ঘ খরা কাটানোর পর সেই প্রথম বৃষ্টির মত। নিশ্চুপ সে
বহুকাল ধরেই। আজ যেন সে আরও নিশ্তব্ধ। তবুও বৃদ্ধের জীর্ণ হাত আস্তে
আস্তে উঠলো। মুখে একটা আবেদন। পালু এগিয়ে দিল নতুন ঢাকের নতুন কাঠি।
- "বাজা বুড়া, এইবার বাজা," একটু ঝুঁকে জড়ালো ভাবে দাবী জানিয়ে পালু বলে উঠলো।
কামার পাড়া অবাক। অবাক গৌরও। কামারের কঠোর চোখে আজ যেন জমাট জল। ছেলের
কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখল, কীর্তনের হাতে কাঠিটি ধরা। পালু ঢাক এগিয়ে দিল।
ক্ষীণ শব্দ উঠলো অশতিপর বৃদ্ধের হাত দিয়ে , ধিন ধিন ধিন...।


মাঝ সমুদ্রে যে জাহাজটা চলছিল। নাবিক দূরবীনটা চোখে দেয়।
যাত্রীরা নামার জন্য ব্যস্ত। এখন শুধু স্থির হাতে হুইল ধরে রেখে ধীরে
লাগাতে হবে জাহাজ বন্দরে।।

………………xxxxxxxxxxxxxx…………………



লেখক – পবিত্র চক্রবর্তী
সেক্টার ২এ, বিধান নগর
দুর্গাপুর- -৭১৩২১২
জেলাঃ—পশ্চিম বর্ধমান

মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩