।।অণুগল্প।।
ভূলুণ্ঠিত পিলসুজ
চারদিকে একটা থমথমে পরিবেশ। কতকগুলো ডুকরে ডুকরে ওঠা কান্নার আওয়াজ যেন পরিবেশটাকে আরও ভারী করে তুলেছে। কী হয়েছে আজ মাহারা পাড়ায়? একসাথে অনেক আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলছে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে-কিন্তু কেন??!! অনেক মানুষ জড়ো হয়ে দেখছে সে দৃশ্য! কাছে গিয়ে দেখি সবার মুখ গুলো বিষন্নতা মাখা অশ্রুসজল চোখগুলো তাদের! তাদের চোখে মুখে শুধু একটাই অস্ফূট নিরুত্তর জিজ্ঞাসা -এর নাম সভ্যতা??
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম ঘটনা স্থলের দিকে দুরু দুরু বুকে মনে অনেক জিজ্ঞাসা নিয়ে। পরিস্থিতিটা অনুধাবন করার চেষ্টা করলাম। ইতস্তত ঘোরাফেরা করে একটা হদিস অবশ্য পাওয়া গেল। কে বা কারা যেন এই ভোরবেলা মা-হারা পাড়ায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। ওটা শ্রমিক পাড়া। ওদের প্রত্যেকে ছেলে বুড়ো সকলেই কিছু না কিছু কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। কেউ কেউ কারখানায় কাজ করে, কেউ কেউ আবার অন্যের জমিতে মাঠে চাষ আবাদ করে, মেয়েরাও অন্যের বাড়িতে ঠিকে ঝি এর কাজ করে। কিন্তু রান্নার কাজ করে না।ছেলেরা রিক্সা চালায়, মুটে বয়, পাকা ঘরের জোগাড়ের কাজ ও করে। ওদের পূর্ব পুরুষেরা নাকি জমিদার বাড়িতে যারা সমাজের গন্য মান্য ব্যক্তি তাদের পাল্কীতে করে বয়ে নিয়ে যেতো। তবুও ওরা ছুঁলে নাকি জাত চলে যায়!ওরা বাবুদের বাড়িতে গেলে বা কোথাও বসলে সে জায়গাটা গোবর জলে বা গঙ্গা জলে নিকানো হ'ত। ওদের থালায় খেতে দিত না। অবশ্য বর্তমানে একটু রূপ বদলে কেউ কেউ আবার পড়াশোনা করছে। তবুও জাতের দুর্গন্ধ টাকে ওদের গায়ে ছিটিয়ে দিতে ভোলে না আজকের মেকি সভ্য সমাজের মানুষ।
একটা ঘটনা বেশ কিছু দিন ধরে ঘনীভূত হচ্ছে,চারপাশের পরিবেশটাকে দূষিত করছে। জমিদার বিনয় চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে রমলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে সদ্য একটি বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকার পদে নিযুক্ত হয়েছে।সে ভালবাসে মাহারা পাড়ার ছেলে বিকাশ মাহারাকে।বিকাশ ও শিক্ষিত বেকার যুবক। বিকাশ ভদ্র ও অসম্ভব সহানুভূতিশীল ছেলে। রমলা একদিন স্বেচ্ছায় বিকাশ মাহারার ঘরনী হয়ে ওদের বাড়িতে চলে যায়।তাতেই যত বিপত্তি ঘটে।বিনয় চৌধুরী নিজেকে সমাজে সভ্যতার আলোক বর্তিকা বলে গর্ব অনুভব করে। গায়ে সভ্য মানুষের খোলস পরে সভা সমিতিতে শ্রমিক মানুষদের সভ্যতার পিলসুজ বলে আখ্যায়িত করে বক্তৃতা দিয়ে বাহবা কুড়িয়েছেন বহুবার।তাঁর ই মেয়ে রমলা সভ্য সমাজের রুচিশীল মহিলা,তাই পিতার কথাকে মান্যতা দিতে বিকাশ মাহারাকে বিয়ে করে। কিন্তু বিনয় বাবু তা মেনে নিতে পারেনি মন থেকে।তাই কার্যোপলক্ষে রমলা বাইরে গেছে কয়েকদিন এসব খবর রেখেছেন বিনয় বাবু। বিকাশ তখন ঘরে ছিল। সুযোগ বুঝে, সবাই যখন ঘুমের ঘোরে ঠিক সেই সময় এই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে সুপারি কিলারের সাহায্যে। এটা তার বহুদিনের প্ল্যান। মা-হারা পাড়া শেষ হয়ে গেছে। তাই আজ জ্বলছে চিতা। বাহ্ সভ্যতা! তোমার আলোক বর্তিকা জ্বালাবার জন্য এখন কোথায় পাওয়া যাবে পিতলের সেই ধাতব পিলসুজ? সব নিরুত্তর। ধিক ধিক সভ্য সমাজ!ধিক সভ্যসমাজের মানুষ! তোমাদের মুখোশ টাকে টেনে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে।
ইচ্ছে করে মেকি সভ্যতার আলোক বর্তিকাকে চিরতরে নিভিয়ে দিয়ে মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবো তুলসী তলায়। সেখানে হরির নাম গান হবে সাঁঝ সকালে। পরিবেশ দূষণ মুক্ত হবে।
======(স মা প্ত)=======
জনাদাঁড়ি, গোপীনাথপুর, পঃ মেদনিপুর
======(স মা প্ত)=======
।।মুক্তভাবনা।।
সভ্যতার পিলসুজ
সভ্যতা বলতে বুঝি -যা সুন্দর, যা মনোহরন, যা
শ্রুতিমধুর,যা দৃষ্টি নন্দন। এক কথায় যা মহিমাময় অপরূপ তাই-ই সভ্যতা। এই
সভ্যতার তৈলপূর্ণ দীপটি যার উপরে বসে থাকে তাই হ'ল পিলসুজ। কথায় কথায়
আমরা নিজেদের নিয়ে গর্ব করি -আমরা সভ্য দেশের নাগরিক। দিকে দিকে সভ্যতার
আলো জ্বলছে-আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হ'চ্ছে। এই কারণে আমরা
ভারতীয়রাও সভ্য বলে আখ্যায়িত হচ্ছি। কিন্তু, বলি কী প্রদীপের তলায় যে
আঁধারটা থাকে সেদিকে আমরা তাকিয়েও দেখি না। শুধু দেখছি প্রদীপটি ভালোই
জ্বলছে। তার মানে আমি বলতে চাইছি প্রদীপটা পিলসুজের উপর বসে আছে বলেই না
এতটা আলোকিত হয়েছে চারপাশটা। কিন্তু আমরা একবারও কি ভেবে দেখেছি পিলসুজের
যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে এতো আলো পাওয়াই যাবে না।
আমাদের দেশ জাতি ধর্ম কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ধারক বাহক হ'ল মেহনতি মানুষ। সেই মেহনতি মানুষকে কতটা মর্যাদা দিই তাদের কথা আমরা কতটুকু ই বা ভাবি? এই যে বিশাল মণিহর্মে বাস করি এর পিছনে তো কত মেহনতি মানুষের শ্রম আছে। শুধু মাত্র পারিশ্রমিক দিয়ে কী তাদের শ্রমের মূল্য নির্ধারণ করা যায়?
আমাদের দেশ জাতি ধর্ম কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ধারক বাহক হ'ল মেহনতি মানুষ। সেই মেহনতি মানুষকে কতটা মর্যাদা দিই তাদের কথা আমরা কতটুকু ই বা ভাবি? এই যে বিশাল মণিহর্মে বাস করি এর পিছনে তো কত মেহনতি মানুষের শ্রম আছে। শুধু মাত্র পারিশ্রমিক দিয়ে কী তাদের শ্রমের মূল্য নির্ধারণ করা যায়?
যেমন তাজমহল ভারতের সুমহান ঐতিহ্যবাহী ঐতিহাসিক দর্শনীয়
স্থান বলে তুলে ধরা হয়েছে দেশ বিদেশের কাছে,এ প্রশংশা তো শুধু ভারতের
কিন্তু কতজন শ্রমিকের কঠোর পরিশ্রমের মূল্যে এটি নির্মিত হয়েছিল তার কথা
তো কেউ বলে না। ওই যে মাঠে দিন রাত ঘাম ঝরিয়ে কায়িক পরিশ্রম করে চাষ করল
চাষী আর তার মুনাফা লুটলো অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ। পুঁজিবাদী উৎপাদনের
উপকরণ হল পণ্য আর গতর। তার মানে শ্রমশক্তি ও সেখানে পণ্য বলে পরিগণিত
হচ্ছে। প্রতিনিয়ত উৎপাদনের খরচ বাড়ছে আর ফসলের দাম কমছে। এখানেই কৃষকের
তথা শ্রমিকের আয় লুঠ হয়ে যাচ্ছে যা আমরা আমাদের চামড়ার চোখে দেখতে
পাচ্ছি না। যে কোনো ধরনের কাজে পুঁজির লুটের শিকার হল শ্রমিক। মুনাফার
পাহাড়ে বসে পুঁজিবাদীরা ভোগ বিলাসে থেকে স্বর্গ সুখ লাভ করে। হাড়ভাঙ্গা
খাটুনি খেটে যা মূল্য পায় তাতে ব্যাঙ্কে তো কিছু জমে না বরং বাজারে চড়া
দামে সব কিছু কিনতে হয়। ফলে শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অথচ
ওদের গতরে গড়ে উঠেছে গতিশীল সভ্যতা, চোখ ধাঁধানো অত্যাধুনিক পৃথিবী,
মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের অফুরন্ত সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও ঐশ্বর্য।আর শ্রমিকেরা
বেশি খেটে, কম খেয়ে পরে নিরাশ্রয় হয়ে বিনা চিকিৎসায় মরে। অথচ এদের
শ্রমের নগর শহর বন্দর গড়ে উঠেছে। শ্রমিকের শ্রমের সভ্যতা ধাপে ধাপে
এগিয়ে চলেছে। যেখানে যা কিছু সুন্দর সেখানে শ্রমজীবী মানুষের শ্রম আছে।
তাদের সত্যিকারের শ্রমের মূল্য দেওয়ার পরিবর্তে অসভ্য মানুষ বলে আমরা উপর
তলার মানুষেরা ঘৃণার চোখে দেখি। তাদের উপর অকথ্য অত্যাচার করতেও
ভুলিনা।যার উপরে সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে তার ভালো মন্দের বিষয়টার সম্পর্কে
কেউ ভেবে দেখি না।এইসব মেহনতি মানুষ আছে বলেই না আমরা সুন্দর ও সভ্য বলে
গর্ব করি। সত্যি যদি আমরা নিজেদের বিবেকের কাছে দাঁড়াই তাহলে বিবেকই বলে
দেবে একমাত্র শ্রমজীবী মানুষরাই সভ্যতার পিলসুজ। একমাত্র তারাই ধরে রেখেছে
আমাদের সভ্যতার প্রদীপটিকে। তাইতো রবি কবি বলেছেন-
"ওরা চিরকাল টানে দাঁড়
ধরে থাকে হাল
ওরা মাঠে মাঠে বীজ বোনে
পাকা ধান কাটে
ওরা কাজ করে নগরে প্রান্তরে।"
একমাত্র শ্রমিকের ঘামেই এগিয়ে চলে বিশ্বের সভ্যতা। সবশেষে, শ্রমিক মানুষদের অসংখ্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন